সমুদ্র  ভ্রমন অভিজ্ঞতা
ছোট বেলায় সেই ভাবে কোনদিন ঘুরতে যাবার সুযোগ হয়ে ওঠেনি। তার কারন ছিলো…আমার বাবা অফিসের কাজে প্রায়ই পশ্চিমবঙ্গের বাইরে থাকতেন,যা এখনও থাকেন। তাই সপরিবারে ঘুরতে যাবার অভিজ্ঞতা আমার প্রায় নেই বললেই চলে। ছোট বেলায় মনে আছে মা বাবা, আমার দুই পিসি সবাই দীঘা গিয়েছিলো, কিন্তু আমার যাওয়া হয়নি।কারন বাড়ির একমাত্র অতি আদুরে হওয়ায় ঠাকুমা, দাদু তাদের নাতনিকে সমুদ্রে বেড়াতে যেতে দিতে ভয় পেয়েছিলো। এখন মনে এত আদুরে না হলে জীবনে বাবা মা একসাথে যাবার অভিজ্ঞতা পুরন হত। তবে যতটুকু বেড়িয়েছি, পাহাড়ের থেকে সমুদ্র আমায় কাছে টানে। ক্লাস ইলেভেনে পড়তে আমি প্রথম দীঘা যাই। তবে এখনও মনে স্মৃতি হয়ে আছে পুরী আর বাকুঁড়া, পুরুলিয়া ভ্রমন। একই বছর আমি দুই জায়গায় পরপর যাই।
বি.এস.সি সেকেন্ড ইয়ার…কলেজ থেকে ঠিক হল ভাইজাগ এক্সকারসানে যাওয়া হবে। কিন্তু টিকিট না পাওয়ায় পুরী যাওয়া ঠিক হল। মনে এক বিশাল আনন্দ। মনে আছে জানুয়ারি মাস, কলেজের ত্রিশ জন ছাত্রছাত্রী আর পাঁচজন প্রোফেসর,তিন জন নন টিচিং স্টাফ…. সবাই মিলে হাওড়া স্টেশনে হাওড়া স্টেশনে এসে পৌঁছালাম নিউ কমপ্লেক্সে। অনেকেরই মা বাবারা এসেছেন তাদের সি অফ করতে। সন্ধ্যে সাতটা জগন্নাথ এক্সপ্রেসে উঠলাম, কেন জানি না আমি কেঁদে ফেলেছিলাম। তার কারন মা বাবা কে ছেড়ে এত দূরে এই প্রথম বাড়ির বাইরে। মায়ের মুখটাও বেশ ছোট হয়ে এসেছিলো, কিন্তু প্রচুর চকলেট আর চিপসের প্যাকেট কিনে দেওয়া হল আমায়, তার সাথে প্রচুর মিষ্টি। বলা বাহুল্য আমার লাগেজের থেকে খাবার দাবারের পরিমাণ বেশি ছিল। অতি আদুরে, যদি রাস্তায় ক্ষিদে পায়, তাই মায়ের এত আয়োজন।
একটা সময় ট্রেন ছাড়লো, আস্তে আস্তে ট্রেন হাওড়া স্টেশনের সীমারেখার বাইরে চলে যেতে লাগলো, রাত বাড়তে লাগলো, আমরা খেয়ে দেয়ে শুয়ে পড়লাম। রাতে কিছুটা ঘুম, কিছুটা আড্ডা এই চলতে থাকে। তবে ঘুম না হবার একটা মস্ত কারন ছিলো জুলজির পি.কে. বি স্যারের ট্রেনের হর্নের থেকেও মারাত্মক নাক ডাকা। উফফফফ…. কি মারাত্মক সেই আওয়াজ, গোটা কমপার্টমেন্ট তার সাক্ষী বহন করে চলেছিল সারা রাত। ঠিক ভোর পাঁচটা আটচল্লিশ আমরা পুরী স্টেশনে নামলাম। সবার মধ্যেই তখন একটা খুশির রেশ চলছে। আমরা গাড়ি করে এসে পৌঁছালাম হোটেল ইন্টারন্যাশনালে। ভোরের অন্ধকারে সমুদ্রের ডাক একটা অন্যরকম অনুভূতি। হোটেলে এসে আমরা যে যার রুমে ঢুকলাম। আমি তো চেঞ্জ করে একটা ছোট ঘুম দিয়ে নিলাম। সকাল সাড়ে সাতটা ঘুম ভাঙলো, গরম গরম লুচি আর ছোলার ডাল খেয়ে আমরা বের হলাম বোটানির স্যার দের সাথে। দুপুর অব্দি প্রচুর গাছ সংগ্রহ করে আমরা আবার হোটেলে ফিরে এলাম। রাতে হোটেলের সামনে ব্যালকনিতে আমরা আর স্যারেরা সবাই মিলে আড্ডা শুরু হল। আস্তে আস্তে রাত বাড়তে লাগলো, আড্ডার লোকসংখ্যা কমতে লাগলো। আমি কিন্তু অনেক রাত অব্দি জেগে রাতের সমুদ্রের ঢেউয়ের গর্জন, আর সেই শীতলউষ্ম বাতাসকে অনুভব করার চেষ্টা করছিলাম। আজ এটা লিখতে মনে হচ্ছে সত্যি যদি আমার লেখক আর কবিসত্তা সেদিন আজকের মতন প্রকট হতো তাহলে আমার কবিতা আর গল্প, উপন্যাসের ঝুলি ভরিয়ে তুলতে পারতাম প্রতি মুহুর্তে। আজ ভ্রমণকাহিনী লিখতে গিয়ে মনটা যেন সেই রাতের সমুদ্রের ডাক শুনতে পাচ্ছে….মনে হচ্ছে সেদিন যদি লিখতে পারতাম…
হে সমুদের বিশালাকায় জলরাশি,
তোমার সুবিস্তৃত জলের মতন আমার মনেও প্রেম জেগে ওঠছে,
রাতের নীরবতায় ঢাকা এই পৃথিবীতে তোমার এই চঞ্চল মন,
আমার হৃদয়কে বারবার তোমার কথা মনে করিয়ে দিচ্ছে,
শুধু মন বলছে… একবার আমার কাছে এসে আমায় স্পর্শ করে
বলো…জীবনের প্রতিটা ক্ষনে আমি শুধু তোমার জন্য প্রতিক্ষায়
অবকাশ গুনছো….
রাত বাড়তে থাকে, আমি ঢেউয়ের আসা যাওয়া দেখতে দেখতে কখন রাত দেড়টা বেজে যাই। আড্ডা বিরতি নেয় পরের দিনের অপেক্ষায়। ঘুমতে যাই, ঠিক ভোর সাড়ে পাঁচটা পি.কে. বি স্যারের ডাক,ওটাকে ডাক না বলে হুঙ্কার বললেও ক্ষতি কিছু নেই। ঘুমের চোখে, এত সুন্দর সমুদ্রের শীতলউষ্ম আবহাওয়ায় এই হুঙ্কার শুনে ঘুম থেকে ওঠা, ঠিক মনে হচ্ছিলো কেউ যেন কানের পাশে শব্দবাজি ফাটিয়ে দিয়ে গেলো। ভোর বেলা ফ্রেশ হয়ে আমরা বেড়িয়ে পড়ি ভোরের সমুদ্র দেখতে। কিছু মাছ ধরার নৌকা এসে দাঁড়িয়েছে বালির চরে। শুরু হল জুলজির কাজকর্ম। তখন মনে হচ্ছিলো আচ্ছা, এই সুন্দর আকাশ, সবে ওঠার অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে লাল সূর্য, ঢেউয়ের শান্ত পরশ, আরে এখন কি পড়াশুনায় মন বসে স্যার। সবার মনেই একটা অন্যরকম অনুভূতি জাগছে, তা স্যারদের দোষটাই বা কোথায়, কিছু পড়াকু স্টুন্ডেন্ট চিরকালই এই অনুভূতি গুলো থেকে দূরের ঠিকানায় বসবাস করে। আলো ক্রমে ফুটতে থাকে, আমরা জলে নেমে পা ভিজিয়ে এগিয়ে চলি, একটা করে ঢেউ আসছে আর পায়ের গোড়ালিটা ভিজিয়ে দিয়ে যাচ্ছে। শান্ত ঢেউ ধীরে ধীরে চঞ্চল হতে শুরু করে। ভেজা গোড়ালি যেন বলছে আমি শুধু তোমার জন্যই যে অপেক্ষায় আছি, আমার সাথে একটু স্পর্শের সংযোগের খেলায় মাততে। জেলে সবে মাত্র সারা রাতের পরিশ্রম শেষ করেছে। নোনতা জলে হাত ডুবিয়ে বলে আসি….” আবার কাল আসবো,কথা দিলাম”। পরপর দুদিন এই ভাবেই কাটে।
তৃতীয় দিনে আমরা সকাল সকাল বেড়িয়ে পড়ি অন্য গন্তব্যে। এসে পৌঁছাই নন্দনকানন। বাঘ, সিংহের ছবি তোলার চেষ্টায় সবাই মগ্ন। তখন ডিজিটাল ক্যামেরা আমাদের দেশে সেইভাবে ব্যবহৃত হয়নি, আমার একটা কোড্যাক ক্রোমা ছিলো, তাই দিয়েই শুরু হয় ছবি তোলা। বাঘ বাবাজীবন তো খুব সাথ দিয়েছিলো,উনি একদম সামনে এসে দাঁড়িয়ে আমাদের খাঁচার ভিতর থেকে অভিবাদন জানিয়েছিল। সেখান থেকে লিঙ্গরাজ মন্দির হয়ে ঘুরে আমরা হোটেলে ফিরি। রাতের খাবার সেরে আমরা বসে পরি রোজের আড্ডায়,গানে, নাচে জমে ওঠে রাতের প্রহর। আর মাত্র দু দিন, আমাদের বাড়ি ফেরার সময় এগিয়ে আসছে। শেষ দুদিন আমরা পুরীতেই রইলাম। কাতাতুয়ার খাজা, প্রায় কেজি খানেক কেনা হল বাড়ির জন্য। যেদিন আমরা ফিরবো সেদিন নিজে থেকেই ভোরের আলো ফোটার আগেই ঘুম ভেঙ্গে গেল। রুমের ব্যালকনিতে এসে দাঁড়ালাম, মনে হল সমুদ্রের ঢেউ আমায় ডাকছে, বলছে এসো তোমার নরম গোড়ালিটা একটু ভিজিয়ে দিই,আমার থেকে অনেক দূরে চলে যাবে, জানিনা তোমার সাথে আমার আর কোনদিন দেখা হবে কিনা,কিন্তু তোমার ভিজে পায়ের ছাপ রইবে আমার বালির চরে চিরকাল। বেলা বাড়তে জগন্নাথ দেবের মন্দিরে গিয়ে পুজো দিলাম, স্বর্গদ্বারের কাছে এসে দাঁড়ালাম, মনে হলো এই কদিনে এই জায়গাটা কত আপন হয়ে গেছে। দুপুরে লাঞ্চ সেরে প্যাকিং শুরু। সন্ধ্যেবেলা আমরা বেড়িয়ে পড়লাম পুরীর স্টেশনের উদ্দেশ্যে। হোটেল ছেড়ে বেরোবার সময় আমাদের সবার চোখে জল। এই সাত দিনে সবাই খুব আপন হয়ে গেছি সবাই। রাত দশটা, পুরী এক্সপ্রেস ছাড়লো তার দেশ, আমরা এবার আপন দেশে ফেরার যাত্রী।
এটা লিখতে গিয়ে খুব মনে পড়ছে সেই আড্ডা,সেই ভিজে গোড়ালির আস্বাদন, ইচ্ছে জাগছে তোমার আমার সমস্ত প্রতিবন্ধকতাকে সরিয়ে, আবার নোনতা জলে তোমার হাত ধরে ভোরের শান্ত সমুদ্রে গোড়ালি ভিজিয়ে নতুন সূর্য দেখি।

#পুরী #কলেজ #ভ্রমন #ছাত্র #ছাত্রী #সমুদ্র #স্নান #কাহিনী
#puri #college #tour #student #chhatra #chatri #story #ocean #bath #hotel