শোনো বসে চুপচাপ , শোনো এক গল্পো । ধন‍্যি মেয়ের দস‍্যিপনা। প্রথম পুরী ভ্রমন। ১৯৭৯।ছোটো বেলা থেকেই ঘুরতে বেড়াতে ভালবাসতাম‌। আমাদের পরিবারের বেশিরভাগ জেঠা কাকারা রেল এ চাকরী করার দরুন পাশ পেতেন। এক পিসেমসাই ব‍্যাংক এ ছিলেন।ওনারা প্রতি বছর ই কোথাও না কোথাও বেড়াতে যেতেন। আমার বাবা র ব‍্যবসা ছিল‌ ‌ সুতরাং বেড়ানোর জন্যে খরচ করাটা আপত্তিকর ছিল। এই ভাবেই বড় হয়ে গেলাম। খুব ইচ্ছে ছিলো এমন একজন জীবন সংগী চাই ,যে শুধুই বেড়াতে নিয়ে যাবে। কিন্তু হায়, কপালে জুটলো সরকারি বিদ‍্যুৎ উৎপাদন করার কারখানা য় ভেপু বাজলে ,তিন শিফট এ ডিউটি করা লোক।ছুটি র দিন গুলো বাড়িতে বসে ভালোমন্দ খেয়ে ঢেকুর তুলতেই বেশী সছন্দ ছিল।বেড়ানোর নাম শুনলেই দশ পা দূরে হাটা দেয়।অবশ‍্য ভাত - কাপড় দেওয়ার বদলে "থাকবো না কো বদ্ধ ঘরে, দেখবো এবার জগৎ টা কে""" এই অঙ্গীকার আদায় করে ছিলাম। তাই যথারীতি কোথাও বেড়াতে হলে আমাকেই কোমর বেধেঁ লাগতে হতো। তখন না ছিল কমপিউটারাইজড টিকিট কাটার সুযোগ, না ছিল অনলাইনে হোটেল বুক করার সুবিধা।বড় বড় স্টেশন এ লাইন দিয়ে হাতে
লিখে দেওয়া টিকিট।কাটতে হোতো। তো পুরী যাওয়ার খুব ইচ্ছা। অঙ্গীকার এর কথা মনে করে দিলে উত্তর মিলতো ,নিজে সব আয়োজন করতে পারলে যেতে পারি। অগত‍্যা মাঠে নামতেই হোতো তখন তো মনে হয় পু্রী যাওয়ার জন্যে এতগুলো ট্রেন ছিল না।পু্রী একপ্রেস।এর টিকিট কাটলাম হাওড়া স্টেশন এ গিয়ে।থাকার ব‍্যবস্থা গিয়ে দেখা যাবে।বাক্স -প‍্যাটরা নিয়ে ,তিন ছেলে মেয়ে আর শাশুড়ি মাকে তীর্থস্থানে নিয়ে যাওয়ার আশ্বাস দিয়ে ( ওনাকে নিলে তো ওনার ছেলের উৎসাহ বাড়বে)ওনাকে বগলদাবা করে বেড়িয়ে পড়লাম জগন্নাথ দর্শন করতে।ট্রেনে ই একটি পরিবারের সাথে আলাপ হলো,ওনারা যাচ্ছেন হাওয়া বদলাতে।পুরীতে নিজস্ব বাড়ি আছে। ""চলছে রেলের গাড়ী ,অনেক দূরের পাড়ি,..."""এরকম আনন্দ হচ্ছে।পূরী স্টেশন এ নামতেই পান্ডারা ঘিরে ধোরেছে।বলতে ভুলে গেছি, গিয়েছিলাম রথযাত্রার সময়।লোকে লোকারণ্য।কোথায় গিয়ে উঠবো এই ভাবনায় ব‍্যাকুল হয়ে জগন্নাথ দেব কে স্মরণ করছি এমন সময়ে ঐপরিবারের বয়োজেস্ঠো মাসীমা বললেন ঘর না পেলে আমাদের বাড়িতে থাকতে পারো।আমি যেন হাতে চাদ পেলাম। তাড়াতাড়ি মালপত্র নিয়ে ওদের সাথে চললাম।বাড়ীটা ছিল শ্মশানের কাছেই। যতদূর মনে হয় এখন যেখানে বিদেশঘর নামে হোটেল হয়েছে।সেখানে।তবে দোতলার জানলা খুলেই সমূদ্র দেখা যায়।মনটা যেন বলে উঠল # ও,সাগর ! যখনই তোমায় দেখি.... তোমার অন্ত খুজে না ......পাই।। দূচোখে রং মেখে নিয়ে আমিও হারি.... য়ে যেতে চাই।# সেই সময়ে মেরিন ড্রাইভ রোড ছিল না।ভারত সেবাশ্রমের পাশের রাস্তা দিয়ে মন্দিরে যেতে হয়। পরের দিন গেলাম জগন্নাথ দর্শন করতে।আর দুদিন বাকী।রথযাত্রার ।তার ই প্রস্তুতি চলছে। মন্দির বন্ধ। জগন্নাথ এর জ্বর হয়েছে। বাইরে থেকে প্রণাম করে ফিরে এসে রান্না খাওয়া করে বিকেলে গেলাম সীবীচ।এ।স্বর্গদ্বার এর যে সিড়ি গুলো এখন দোকান হয়েছে, কিছুই ছিলনা।সোজা সিড়ি দিয়ে নেমে বালির মধ‍্যে।পাশ দিয়ে "গরম সিঙারা,মদনোমোহনো ধাই কিরি কিরি" বাকে করে বিক্রি করছে। ভোরের সূর্যোদয় ঘর থেকেই দেখতাম। এখন কত বেশি টাকা দিয়ে সীফেসিং ঘর বুকিং করতে হয়।সেই সময় ঐ সীফেসিং ঘরভাড়া ছিল রোজ ১০০ টাকা।সমূদ্রে স্নান করতে গিয়ে তো নাকানি চোবানি। ঢেউয়ের ধাক্কায় উল্টে পাল্টে যাচ্ছি।প্রথম দিকে ভয় পেলেও বাচ্চারাও লুটোপুটি খাচ্ছে। পরদিন গেলাম টূরের সাথেই বাসে করে কোণারক সহ সাইট সিন এ। বিকেলের দিকে সমূদ্রের পাড়ে বসে দূচোখ ভোরে ঢেউ গুনতাম।""ও সাগর ,কতো মূক্তো আছে.. তোমার বুকে ? অথবা সা...গর ডাকে আয়,আমার গানে জীবন আ..নে চলার ঈশারায়। চন্চল হৃদয়ের স্বপ্ন স্রোতে চিন্হ রেখে যাই প্রেম সৈকতে।"" রথের দিন প্রভুর দর্শন পেতেই হবে।মরিয়া হয়ে গেলাম। এখন যেমন ভীড় ,ধাক্কাধাক্কি হয়, তখনো ছিল হয়তো, তবে অসভ‍্যতা ছিল না।প্রচণ্ড ভীড়।দাড়ানো যাচ্ছে না। হঠাৎ দেখলাম মন্দিরের ঠিক উল্টোদিকে একটা বাড়ীর পেছনের সিড়ি দিয়ে উপরে যেতে দিচ্ছে।ছূটে গিয়ে ঢুকে গেলাম।দোতলার ছাদ থেকে জগন্নাথ দর্শন করলাম।এরজন্য ওই বাড়ীর মালিক টাকা নিয়ে ছিলেন।একে একে শুভদ্রা,বলরাম, শেষে জগন্নাথ দেব কে নিজ নিজ রথে বসানো হল।পান্ডাশ্রেস্ঠো গন গলায় হাতে,সোনার গয়না পরে রথে উঠছেন।শুরু হল দড়িতে টান। রাজা এলেন গুন্ডিকা মার্জনা করতে।তারপর এগিয়ে চল্লেন প্রভু মাসীর বাড়ির উদ্দেশে।পুরী তো সকলেই দেখেছেন, রথযাত্রাও দেখেছেন।তাই বিস্তারিত লিখলাম না। সাত দিনে সাতশো টাকায় পুরী ঘুরে এসেছি।ভাবা যায় ,? খাওয়া দাওয়া র জন্যে বেশি খরচ হয় নি ,রান্না করে খেতাম। শাশুড়ি মার মনোষ্কামনা পুরন হয়েছে।খুব খুশী।বল্লেন "" ধন‍্যি মেয়ে তুমি ? যেভাবে জগন্নাথ দর্শন হলো ?অনেক দিন মনে থাকবে।"' তারপর বহুবার পুরী গিয়েছি ,সেই প্রথম দেখা ভুলতে পারিনি।তাই শেয়ার করলাম।আর একটা কথা, আমার যে ছেলে আজ ইউ,কে ইউ এস এ করে বেড়াচ্ছে ,সেই ছেলে র বয়স ছিল দেড়বছর।২০১২ তে দেশে এসে পুরীতে নিয়ে গিয়েছিলো সবাই কে। সেই ছবির ই কয়েকটা শেয়ার করলাম।প্রথম পুরী ভ্রমণের ছবি তুলেছিলাম আগফা ক‍্যামেরাতে।৩৫ সাদাকালো রিলে ।সেগুলো অস্পষ্ট হয়ে গেছে।তাই পুরোনো স্মৃতি তে নতুন ছবি দিয়ে মেলবন্ধন করলাম।আশা করি,ভুল ভাববেন না।