তিরুপতি-তিরুমালা
( প্রথম পর্ব )
অফিসের প্রচণ্ড কাজের চাপের মধ্যেও দুদিনের ছুটি বের করা গেল। অনেকদিন ধরে ইচ্ছে ছিল তিরুপতি যাওয়ার। বিশেষ করে ন্যাশনাল জিওগ্রাফি চ্যানেল এ তিরুপতি সংক্রান্ত ডকুমেন্টরি দেখার পর। কাজের সূত্রে হায়দরাবাদ আসাটাও ইচ্ছেকে আরো কাছে এনে দিলো। হায়দরাবাদ থেকে তিরুপতি নানাভাবে যাওয়া যায়। ট্রেন , বাস তো আছেই, পারলে সস্তার ফ্লাইট ও (১৫০০ টাকার মধ্যে ) বুক করে নিতে পারেন। আমরা redbus বুকিং এপ্লিকেশন থেকে অরেঞ্জ ট্যুরস এন্ড ট্রাভেলস এর বাস বুক করে ছিলাম। এসি বাস পরিষেবাও খুব ভালো। প্রত্যেক জন পিছু ৭৫০ টাকা লেগেছিলো। ( সূত্র- [You must be registered and logged in to see this link.]
রাত মোটামোটি ৯.৩০টার সময় বাস হায়দরাবাদ থেকে তিরুপতির উদ্দেশে রওনা দিয়েছিলো। বলে রাখা ভালো রাতের ডিনার আগে ভাগে সেরে রাখা ভালো বা নিয়ে ওঠা ভালো। কারণ রাস্তায় রাতে বাস দাঁড়িয়েছিল বলে আমার তো মনে নেই। সারাদিন অফিসের ধকল এর পর আমি তো দিব্বি টেনে ঘুম দিয়েছিলাম। সকাল ৮.৩০ নাগাদ বাস আমাদের নিরাপদে পৌঁছে দিয়েছিলো তিরুপতি। বাস আমাদের যেখানে নামিয়েছিল তার কাছেই ছিল তিরুপতি রেল স্টেশন। সামনে বিশাল বড়ো বড়ো পাহাড়, যেখানে রয়েছে শ্রী ভেঙ্কেটেশ মন্দির বা বিষ্ণুধাম। এককথায় পাহাড়ের ওপরে তিরুমালা আর নিচে তিরুপতি। তিরুপতি তে নামার পর পরই ভক্তের সমাগম চোখে পড়েছিল, নানা রকমের খাওয়ার দোকান তো আছেই, সঙ্গে বিভিন্ন ট্রাভেল এজেন্টদের রমরমা ও চোখে পড়েছিল। এককথায় জমজমাটি এক শহর। যেন বিভিন্ন প্রান্ত থেকে বিভিন্ন সংস্কৃতির মানুষ এক উদ্দেশে এই স্থানে জড়ো হয়েছে। ভিড় সেদিন ভালোই বোধ হচ্ছিলো, কারণ দিনটি ছিল গনেশ চতুরদর্শী। আমার মন পড়েছিল ওই ধোঁয়াটে, সবুজ , উঁচু উঁচু পাহাড় এর ওপর, যার গা বেয়ে এঁকে বেকেঁ এক সর্পিল পথ কোথাও যেন চলে গিয়েছে।
তিরুপতি-তিরুমালা
( দ্বিতীয় পর্ব )
এক দৃষ্টিতে পাহাড় গুলোর দিকে তাকিয়েছিলাম, কখন যে তিরুপতি পৌঁছে গিয়েছিলাম বুঝতে পারিনি। টনক নড়লো বন্ধুদের ডাকাডাকি তে। আমাদের আগে থেকে কোনো হোটেল বুকিং ছিল না, তাই বাস থেকে নেমে প্রথম কাজ ছিল হোটেল বুকিং করা। তিরুপতি স্টেশন এর পাশে একটা জুতসই হোটেল পাওয়া গেলো। আমরা চারজন গিয়েছিলাম, তাই একটা বড়ো ডরমেটরি তেই কাজ হয়ে গিয়েছিলো। ভাড়াও খুব বেশী নয় ,আমরা একদিনের জন্য রুম নিয়েছিলাম, জন প্রতি ৪৫০ টাকা লেগেছিলো। বলে রাখা ভালো, যদি তিরুমালা তে মন্দির এর কাছে থাকতে হয়, তবে অনেকআগে থেকে বুকিং করতে হবে। এতে যাতায়াত এর খরচও বাঁচবে সঙ্গে থাকারও। (ttdsevaonline.com ) এর মাধ্যমে আগে থেকে রুম বুকিং করে রাখতে পারেন। এছাড়াও অনেক ওয়েবসাইট এর মধ্যে গিয়েও আপনি বুকিং আগে ভাগে করে রাখতে পারেন, বা আমাদের মতো তিরুপতি তে পৌঁছে স্পট বুকিংও করতে পারেন। হোটেল এ গিয়ে ফ্রেশ হয়ে ঠিক করা হলো,আজ তিরুমালা তে গিয়ে সব কিছু জেনে আসা হবে, পরের দিন ভোর ভোর পৌঁছে পুজো দিয়ে, তিরুপতি থেকে বিকেলের ট্রেন ধরা হবে।আমি বলবো যারা তিরুপতি যাবেন, চেষ্টা করুন যেদিন পৌঁছবেন,সেদিন বা পরের দিনই পুজো টা সেরে ফেলতে। কেন এমন বললাম সেটা পরে বলছি। যাইহোক তিরুপতি বাস টার্মিনাল থেকে বাস পেয়ে গেলাম। প্রচুর বাস তিরুপতি আর তিরুমালার মধ্যে ওঠা নামা করে , তাই বাস পেতে বেশী দেরি হলো না। তিরুপতি থেকে তিরুমালা সাকুল্যে ৪৫ মিনিট লাগে বাসে করে (কম -বেশী হতে পারে ) . আমি বলবো জানলার ধারে বসেই যান ,যদি পরের বাসে তা পান তবে তাই করুন।
কারণ এই ৪৫ মিনিট আপনার জীবনের অন্যতম স্মরণীয় ৪৫ মিনিট হতে চলেছে। পাহাড়ের বুক দিয়ে যখন বাস ওপরের দিকে উঠে চলবে, যখন খুব উপর থেকে নিচের তিরুমালা শহর দেখতে পাবেন , যখন দূরে উইন্ডমিল গুলো আপনাকে উঁকি মারবে, আর বাসের মধ্যে গোবিন্দা গোবিন্দা রব আপনাকে কোলাহল পূর্ণ জীবন থেকে অন্য এক মায়াবী জগৎ এ নিয়ে যাবে।
বাস থেকে নামতে মন চাইছিলো না। তিরুমালা তে পৌঁছে আরো ভালো লাগলো কারণ, পাহাড়ের ওপরের পরিবেশ সবসময় ই ভালো লাগে। চারিদিকে ভক্তের সমাবেশ, দোকান ঘরে কেনা বেচার রব , দূরে পাহাড়ের ওপরে ভাসমান মেঘ সত্যিই মনে করাচ্ছিল আমরা কোনো এক স্বপ্নপুরী তে প্রবেশ করে ফেলেছি। যাইহোক তিরুমালা তে নেমে জানতে পারলাম, পুজো আজ দেয়াটাই ভালো, কারণ কাল নাকি এ রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী আসবেন মন্দিরে পুজো দিতে। এখন বলে রাখি যে কেন আমি বলেছিলাম পুজো যত তাড়াতাড়ি সম্ভব দিতে, কারণ আর কিছুই নয়, পুজো দিতে ৮ঘন্টাও লাগতে পারে আবার ৪ ঘন্টাও। যদি আপনার স্পেশাল দর্শন এর ব্যবস্থা থাকে তবে আলাদা ব্যাপার। তিন ধরণের দর্শন হয়ে থাকে -
১) সর্বদর্শন - এটি ফ্রি , টোকন নিয়ে আপনি লাইনএ দাঁড়াতে পারেন, কতক্ষন লাগবে বলা মুস্কিল।
২) দিব্য দর্শন - যারা পায়ে হেটে তিরুপতি থেকে মন্দির আসে তাদের জন্য, এটি তে সর্বদর্শন এর থেকে একটু তাড়াতাড়ি হয়।
৩) স্পেশাল এন্ট্রি দর্শন - এটি র জন্য ওপরের ওয়েবসাইট থেকে টিকিট কেটে রাখতে হয়। ৩০০ টাকা করে জন প্রতি লাগে। এতে সময় অনেক কম লাগে। এছাড়াও ইনফ্যান্ট দর্শন,স্পেশাল এন্ট্রি ফর ফিজিক্যাল ডিসেবিলিটি পার্সনস , vip ব্রেক দর্শন আছে। তরুণদের বলবো তারা যেন দিব্য দর্শনে যায়।
পাহাড়ের সৌন্দর্য দেখতে দেখতে মন্দির দর্শন এর মজাটাই আলাদা। আমরাও তাই প্ল্যান করেছিলাম , কিন্তু সময় এর অভাবে হয়ে ওঠেনি। টুরিস্ট এর জন্য একটা ইনফরমেশন শেয়ার করে রাখি , তিরুমালা তে বাস থেকে নেমেই দেখতে পাবেন ,অনেক আসবে এটা বলতে যে তারা খুব জলদি দর্শন করিয়ে দেবে। ভুলেও ফাঁদে পা দেবেন না , এরা আপনাকে একটি দোকানে নিয়ে গিয়ে বলবে ছবি তুলতে হবে, তারপর নিয়ে যাবে, কিন্তু ছবি তোলার টাকা দেয়ার পর বলবে লাইন এ দাঁড়িয়ে যান। নিজে গিয়েই লাইন এ দাঁড়াবেন। ভুল তখন হয়, যখন আমরা নতুন জায়গায় গিয়ে একটু ভয়ে ভয়ে থাকি। বহু মানুষ সোলো ট্রাভেল করেন, একটু খোঁজ খবর থাকলে কোনো অসুবিধে নেই।
তিরুপতি-তিরুমালা
(তৃতীয় পর্ব)
যাইহোক যেহেতু আমরা সর্ব দর্শন এর টিকিট নিয়ে লাইনে দাঁড়িয়েছিলাম, তাই মনে একটু খটকা লাগছিলো যে, আজ ভগবান এর দর্শন হবে তো? আমরা লাইনে দাঁড়িয়েছিলাম বিকেল সাড়ে তিনটে নাগাদ। এর দুই ঘন্টা আগে আমরা হন্যে হয়ে মস্তক মুন্ডন এর জন্য ছোটাছোটি করছিলাম, খুঁজছিলাম হারিয়ে যাওয়া একে অপরকে। ব্যাপারটা তবে খোলসা করে বলি , এতো বড়ো জায়গা , সঙ্গে এতো লোকের সমাগম আমাদের বারে বারে উদ্ভ্রান্ত করছিলো কোন দিকে গেলে কি পাবো বা কোন ঘরে গেলে আমাদের কাজটা হবে। নানা মুনির নানা মত। বলা ভালো কথিত আছে যে,তিরুপতি গিয়ে চুল দান করা পুণ্যের কাজ, কারণ আপনি বা আমি চুল দেওয়ার সাথে সাথে আমার ইগো টাকেও বিসর্জন দিচ্ছি। যাইহোক আমি এই পুণ্যের ভাগিদার হতে চেয়েছিলাম। মুন্ডন হওয়ার সময় যারা মুন্ডন করে তারা কিছু বকশিশ দাবি করতে পারে, তবে দেয়া বা না দেয়া আপনার ওপর। সাউন্ড বক্সগুলো তে কিন্তু সবসময় প্রচার হচ্ছে যে, কোনো রকম পয়সাকড়ি না দেওয়ার জন্য। এরপর অন্য কোনো এক কক্ষে স্নানাদি পর্ব সমাপন করে, হারিয়ে যাওয়া একে অপরকে উদ্ধার করে লাইনে গিয়ে দাঁড়ানো।
লাইনে গিয়ে দাঁড়াবার আগেই টিকিট কেটে নিয়েছিলাম। হেঁটেই চলেছি , কখনো সিঁড়ি বা আবার কোথাও সমতল হয়ে , কখনো এক ঘরের বারান্দা দিয়ে তো পরক্ষনে দুধ নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা ভলেন্টিয়ারদের পাস দিয়ে। বলতে ভুলেই গিয়েছিলাম যে কুপন নেয়ার সাথেই আপনাকে সেই বিখ্যাত তিরুপতির লাডডুর জন্যও টাকা দিয়ে কুপন নিয়ে নিতে হবে। তবে তা লাগবে এই সুদীর্ঘ প্রতীক্ষার অবসান হওয়ার পর মানে ভগবান দর্শন হওয়ার পর। তাই কুপন টি গুছিয়ে রাখতে হবে। আমরা যে স্পীডে যাচ্ছিলাম ভাবলাম তবে ভগবান জলদি দর্শন হয়ে যাবে, তবে টনক নড়লো যখন আমাদের প্রচুর লোক ভর্তি একটি ঘরে বসিয়ে দেওয়া হলো, আরো দু একজন ঢোকার পর গেটে তালা ঝুলিয়ে দেওয়া হলো। বুঝলাম এই ঘরের প্রত্যেকের সেই এক উদেশ্য, মানে ভগবান দর্শন। এরকম বহু ঘর আছে যেখানে মানুষজন বসে আছেন প্রতীক্ষায়, তাই আমরা মূল মন্দির থেকে কতগুলো ঘর দূরে আছি তা বোঝা যাচ্ছিলো না। অবশ্য ঘরগুলিতে ফ্যান লাগানো আছে অনেকগুলি, বিনোদনের জন্য ভক্তিমূলক নানান প্রোগ্রাম টিভিতে চলছে। ভলেন্টিয়ার বা মহিলা সেবকবৃন্দ মাঝে মাঝেই প্রসাদ বিতরণ করছে , সঙ্গে অবশ্য গরম দুধও পাওয়া যাচ্ছে। আমি বহুবার গরম দুধ সেবন করে ঘোরতর নিদ্রা কাটানোর চেষ্টা করছিলাম,অবশ্য অনেক মানুষ ইতিমধ্যেই নিজের মতো জায়গা করে স্বপ্ন রাজ্যে বিরাজ করছেন। বাথরুমের ব্যবস্থাও দেখলাম করা আছে। মাথার ওপর ছাদ, সঙ্গে খাওয়ার , বিনোদনের ব্যবস্থা সব কিছুই ছিলো , আর ছিল ক্ষনে ক্ষনে গোবিন্দা গোবিন্দা রব আর অফুরন্ত সময়।
তিরুপতি-তিরুমালা
(চতুর্থ পর্ব )
অনেকক্ষন বসে থাকার পর, সামনের ঘরগুলি থেকে মানুষজনের চেঁচামেচিতে বুঝতে পারলাম যে,আস্তে আস্তে গেট খুলে দেয়া হচ্ছে ভগবান দর্শন এর জন্য। আওয়াজ যত বাড়ছে, মনের মধ্যে উদ্দীপনা তত বেড়ে চলেছে। আনুমানিক ৪ঘন্টা বসে থাকার পর, প্রতীক্ষার অবসান হলো। গেট খুলে দেয়া হলো আমাদের ঘরের। লোকজন চটজলদি লাইনে দাঁড়ানোর জন্য হুড়োহুড়ি করতে লাগলো। আমরা কচ্ছপের ন্যায় মন্থর গতিতে এগোতে লাগলাম। এরপর রেলিং দিয়ে ঘেরা ঘরগুলির সামনের রাস্তা দিয়ে মন্দিরের উদ্যেশে এগোতে লাগলাম। কিন্তু তখনও মন্দির অনেক দূরে, এদিকে সূর্যি মামা পশ্চিম কোনে ঢোলে পড়েছে , পাহাড়ের গা ঘেঁষে সূর্য যখন ডুব মারছে সেই দৃশ্য যেন আমাকে হয়তো সবাইকে মোহিত করে তুলেছিল। তবে সব দৃশ্যই মনের চিত্রপটে অঙ্কিত হয়ে রয়ে গেছে ,কারণ ক্যামেরা বা মোবাইল কোনো কিছুই আমরা সঙ্গে নিতে পারিনি, মানে নিতে পারবেন না। ধীরে ধীরে এগিয়ে চলা ,আবার মাঝে মাঝে থমকে দাঁড়িয়ে যাওয়া- এই করতে করতে আমরা সিকিউরিটি চেক পয়েন্ট এর কাছে এসে দাঁড়ালাম। সিকিউরিটি চেক পয়েন্টে যা হয় আরকি, তা হয়ে যাওয়ার পর আমরা মন্দিরের চূড়া দেখতে পেলাম। শুনতে পাচ্ছিলাম ঘন্টাধনি, রাতের অন্ধকারে মন্দিরটিকে খুব সুন্দর ভাবে লাইট দিয়ে সাজানো হয়েছিল। যেন গোটা তিরুমালা শহরকে এই মন্দির আলোকিত করে রখেছে।
সবচেয়ে ভালো লাগছিলো মানুষজনের মধ্যে এতটুকু ক্লান্তিবোধ নেই, মাঝে মাঝে গোবিন্দা গোবিন্দা রব সেই উৎসাহ ব্যাক্ত করছিলো। এরপর সুযোগ এলো মন্দিরে ঢোকার, হুড়োহুড়ি এখনো থামেনি,বরং আরো বেড়ে গেলো মন্দিরে ঢোকার পর। মূল মন্দির পুরোটাই সোনা দিয়ে তৈরী করা হয়েছে। মূল মন্দিরের সঙ্গে আরো কিছু ঘর রয়েছে, সেখানেও ঠাকুর রয়েছে। যে ভগবান মানে বিষ্ণুকে দেখার জন্য আপনি এতক্ষন লাইন দিয়ে দাঁড়াবেন, তাকে দেখার জন্য আপনি ১ মিনিটেরও কম সময় পাবেন। মন্দিরের চারিদিকে সশস্ত্র পুলিশ দন্ডায়মান সঙ্গে ভলান্টিয়ার বাহিনীতো আছেই। আসলে এই বিপুল ভিড় সামাল দেওয়ার জন্য তা করতেই হবে। সবচেয়ে ভালো লাগছিলো,যে মন্দির দেখার জন্য মানুষজন বহু দূর দূরান্ত থেকে এসেছে সেই মন্দির অবশেষে দেখে ফেললাম এবং ভগবান এর দর্শনও হয়ে গেলো। এখানে বলে রাখি আমরা যে বিষ্ণুর অবয়ব দেখেছি বা যারা গিয়ে দেখবেন সেটি একটি রেপ্লিকা মাত্র,মূল অবয়ব গর্ভগৃহে রাখা থাকে। সেখানে সবার যাওয়ার অনুমতি নেই। এইখানে যে বিষ্ণুর অবয়ব আপনি দেখতে পাবেন সেটি কালো রঙের। এখানে বিষ্ণুকে ভেঙ্কটেশ্বরা বলে ডাকা হয়। সংস্কৃত শাস্ত্র অনুযায়ী ভেঙ্কটেশ্বরা নামের অর্থ পাপের বিনাশকারী মানে বিষ্ণু নিজে স্বয়ং। আরো কৌতহল থাকলে গুগল করে দেখতে পারেন এর ইতিহাস জানার জন্য বা পারলে ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক চ্যানেল এর তিরুপতি নিয়ে তৈরী ডকুমেন্টরিটা দেখে নিতে পারেন।
মূল মন্দিরের আশেপাশে বিভিন্ন ঠাকুরগুলি দেখে কিছুক্ষন বিরতি নেওয়ার জন্য বসে পড়েছিলাম। দক্ষিণা দেওয়ার জন্য একটি ঝোলা গোছের কিছু ঝোলানো ছিলো, সেখানে দক্ষিণাদি দিয়ে ঘি দিয়ে তৈরী করা খিচুড়ি খেয়ে এবার মন্দির থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পালা, শেষবারের মতো প্রণাম সেরে মন্দির থেকে বেরিয়ে গেলাম। এইবার লাড্ডু নেওয়ার পালা, কুপনের মধ্যে থাকা গেটের কাছে গিয়ে লাইন দিয়ে লাড্ডু পেয়ে গেলাম। সঙ্গে সঙ্গে একটা লাড্ডু খেয়েও নিলাম। সত্যি বলছি এমন স্বাদ আর পৃথিবীর কোনো লাড্ডুতে পাওয়া যাবে না। লাড্ডু খেয়ে মন জুড়িয়ে যাওয়ার পর মোবাইল ফোনগুলি নিতে গেলাম, তারপর জুতো নিতে গিয়ে দেখি আমার জুতোজোড়া কেউ নিয়ে গেছে, হয়তো কারো ভালো লেগে গেছিলো কিন্তু সে কভু আমার মনের অবস্থাটুকু বুঝিল না। যাইহোক আপনারা দামি জুতো নিয়ে পুন্য করতে যাবেন না,জুতো চুরি হওয়ার প্রভূত সম্ভবনা।সবচেয়ে বেশি যেটা খারাপ লাগলো জুতোর ঘরে কোনো সিকিউরিটি নেই। যাইহোক খালি পায়ে ঘুরে ঘুরে একটি দোকানে ধোসা ও চা সেবন করে নিচে মানে তিরুপাতিতে যেখানে আমাদের হোটেল রয়েছে সেখানে যাওয়ার প্রস্তুতি নিতে লাগলাম।কেনার জন্য বহু দোকান পেয়ে যাবেন, নানারকমের দ্রব্য সেখানে রয়েছে। আমি কেবল একখানি টুপি কিনেছিলাম। মন্দিরের সামনের বড়ো বড়ো বারান্দাগুলোতে দেখলাম বহু পুণ্যার্থী শুয়ে পড়েছে ,হয়তো তারা সেখানেই শুয়ে থাকবে সারারাত, হয়তো থাকার মতো জায়গা তারা জোগাড় করতে পারেনি কিন্তু তাদের ললাটে বিষ্ণুকে দর্শন করার প্রশান্তি ফুটে উঠেছে, ফুলে উঠেছে বুক আনন্দে। আর তাই মন প্রসন্ন হয়ে ঘুমের ঘোরেও বলে উঠছে গোবিন্দা গোবিন্দা।
তিরুপতি-তিরুমালা
(পঞ্চম পর্ব )
ঘড়ির কাটা বলছে সকাল ৭টা বেজে ৩০ মিনিট, গতকাল হোটেলে ফিরতে ফিরতে রাত ১২.৩০টা মতন হয়ে গেছিলো। সারাদিনের ধকলের পর তাই আর খুব সকালে কারোরই ঘুম ভাঙেনি। আমাদের সকাল ১০টার মধ্যে হোটেল ছেড়ে দিতে হতো , কারণ আজকেই বিকেল পাঁচটার ট্রেন ধরে আমাদের সেকান্দ্রাবাদ ফেরার কথা। অফিস থেকে সবারই দুদিনের ছুটি বরাদ্দ ছিল। তাই চোখ খোলার পর রুমে যেন দক্ষযজ্ঞ লেগে গেলো, কারণ গতকাল খালি পুজোটাই দিতে পেরেছি আমরা, আশেপাশের জায়গা গুলো ঘুরে দেখা হয়নি কারোরই। আমার নির্দেশ ছিলো কেউ যেন বড়ো ব্যাগ না নিয়ে আসে যাতে ঘুরতে অসুবিধে হয়, দেখলাম সবাই বাধ্য ছেলের মতো তাই করেছিলো।
তাই ফ্রেশ হয়ে চটজলদি ব্যাগ নিয়ে বেরোতে কারোরই লেট হয়নি। আজকের দিনের স্রোতে বয়ে যাওয়ার আগে বলে রাখি যে, গতকাল আমরা রাত ১১টা নাগাদ বাস পেয়ে গেছিলাম এবং সেই বাস আমাদের নিরাপদে তিরুপতি বাস টার্মিনালে পৌঁছে দিয়েছিলো। খালি এটা বলার জন্য আমি ফ্ল্যাশব্যাকে যাইনি , বলতে চাইছি যদি বাসে না বসে কোনো মোটর-সাইকেলের পেছনে বসে যদি নামতে পারতাম তবে বোধ হয় জীবন সার্থক হতো। রাতের পাহাড়ী হাওয়া, সঙ্গে নাম না জানা ফুলের পাগল করা গন্ধ, প্রত্যেক মোড়ের পাশে জানান দেওয়া মাইলস্টোন আর উপর থেকে দেখা গোটা আলোয় আলোকিতময় তিরুপতি শহর তা জানান দিছিলো, বস জীবন তো এটাই, জীবন তো ওই প্রত্যেক বাঁক নেওয়া অজানা পাহাড়ী মোড়। হায় গোবিন্দা ভালো লাগার মুহূর্তগুলো কত জলদি শেষ হয়ে যায়। তাই বাসে বসে নামার সময় না জানা কোনো এক কারণে চোখে জল চলে এসেছিলো।
সকাল সাড়ে ৯টার আগেই টিফিন নিঃশেষ করে সামনে সেই সেভেন হিলসকে সাক্ষী রেখে আবার বাসে করে তিরুমালার উদ্যেশে রওনা দেওয়া। এবার যাচ্ছি তিরুমালা তে মন্দিরের আশেপাশে খুব দূরে নয় এমন জায়গা ঘুরে দেখার জন্য। আসলে একবার গিয়ে সব জায়গা পুঙ্খানুপুঙ্খ ভাবে ঘুরে দেখা সম্ভব নয়। তাই মনের মধ্যে চিরকাল সব ভ্ৰমণ পিপাসুদের সেই এক কথা মনে আসে " শেষ হয়েও হইলো না শেষ"। যথারীতি তিরুমালাতে বাস থেকে নেমে আমাদের প্রথম কাজ ছিলো, যে জায়গাগুলি আমরা সিলেক্ট করেছিলাম সেই জায়গাগুলিতে কিভাবে পৌঁছানো যেতে পারে তা খোঁজা।
আপনি যদি গুগল করেন দেখবেন প্রায় ৪০খানি জায়গা উঠে আসবে মন্দিরের আশেপাশে ঘোরার জন্য। সবচেয়ে বিভ্রান্ত হইলাম এইভাবে যে, আমরা যে জায়গাগুলো সিলেক্ট করেছিলাম তা একদিকে কোনটাই নেই, সবই ছড়িয়ে ছিটিয়ে। তাই অগত্যা গাড়ি ভাড়া করা ছাড়া কোনো গতি নেই। আমাদের লিষ্টি শুনে বিভিন্ন এজেন্ট নানান রকমের মূল্যের রকমফের শোনালেন, আমরা খালি হা করে শুনেই গেলাম কিছু বলা বা ভাবার অবকাশ পেলাম না। অবশেষে একটি ড্রাইভার আমাদের সুরাহা করে দিলেন, বললেন বিকেল পাঁচটার ট্রেন যদি ধরতে হয় তবে এই এই জায়গাগুলি দেখতে পারেন ,সময়ের আগেই স্টেশনে পৌঁছে যাবেন। আমরাও সম্মতি জানালাম। শেষমেশ ৬০০ টাকাতে রফা হলো এবং স্থির হলো ৬টি জায়গা উনি ঘুরে দেখাবেন এবং আবার এই স্থানেই আমাদের ছেড়ে দেবেন।
আপনারা যারা তিরুপতি আসবেন তারা আগেভাগে ঠিক করে রাখবেন কি কি জায়গা ঘুরবেন এবং একটু দরদাম করে গাড়ি ভাড়া করবেন, আর অবশ্যই সময় বেশি নিয়ে আসবেন। কি কি জায়গা ঘুরবেন তা গুগল করলেই তার বিবরণসহ পেয়ে যাবেন এই একবিংশ শতাব্দীতে, তাই সেগুলি বলে বৃথা লেখা বড়ো করবো না । জয় গোবিন্দা বলে গাড়িতে উঠতেই আকাশের মুখ ভার হয়ে উঠলো এবং কিছুক্ষনের মধ্যেই অসংখ্য বারিধারা এই সুবিশাল পৃথিবীর বেড়াজাল ভেঙে নিচে নেমে আস্তে লাগলো।উফফ কি মুষুলধারে বৃষ্টি সঙ্গে মাঝে মাঝে ভগবানের দুএকটি করে ব্রহ্মাস্ত্র নিক্ষেপ।সেই ভিজে স্যাঁতসেঁতে গাড়ির সিটে কোনোরকমে মাথা গুঁজে আমাদের গাড়ি গড়গড়িয়ে এগিয়ে চলল সামনের দিকে।
পাহাড়ের বৃষ্টি দেখার ইচ্ছে ছিলো অনেকদিন থেকেই, ভগবান বোধহয় সেটাও পূরণ করে দিলেন। ঘন বৃষ্টির চাদর ঠেলে যখন আমাদের গাড়ি এগিয়ে চলছিলো, যখন বৃষ্টির আনন্দে মাতোয়ারা পাখিদের পাগলামি চোখে পড়ছিলো ,যখন পাহাড়ি রাস্তার কোনো এক কোণে গরম চায়ের হাওয়া উড়িয়ে চাওয়ালা হঠাৎ আমন্ত্রণ জানাচ্ছিল তা কোনো অংশে স্বর্গপুরী থেকে কম নয়। লোভ সামলাতে না পেরে আমরা সেই চাওয়ালার আমন্ত্রণ সাদরে স্বীকার করেছিলাম। বৃষ্টির ফোটা চায়ের কাপে পড়ে চায়ের ওপর যে কম্পন সৃষ্টি করছিলো , সেই কম্পন তখন সবার মনে এক গভীর ক্ষত তৈরী করে দিয়েছিলো, সেই ক্ষত ভালোলাগার, প্রকৃতিকে এতো কাছ থেকে দেখে ভালোবাসার। প্রথম যে স্পটটিতে আমরা দাঁড়ালাম সেখানে একটি কালিমাতার মন্দির রয়েছে, মন্দিরের স্থাপত্য বিশেষ কিছু না, সবাই দেখলাম পুজো দিচ্ছে,সামনে একটি হনুমানের মূর্তিও রয়েছে সেখানেও লোকজন লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কপালে তিলক লাগাচ্ছে দেখলাম। এরপর আমাদের নিয়ে যাওয়া হলো দুধসাগর দেখাবে বলে।দুধসাগরের যে বর্ণনা আমি শুনেছিলাম বা পড়েছিলাম ওখানে পৌঁছে একটু হতাশ ই হয়েছিলাম। পাহাড়ের গাত্র থেকে যে অজস্র বারিধারা নেমে আসার কথা ছিলো তা যে কেন আজ এলো না তা বুঝতে পারলাম না। আসলে এই জায়গাটাতে একটা ঝর্ণা থাকার কথা,কিন্তু গিয়ে দেখি ঝর্ণা তো দূরে থাক ফিনফিনে জলের স্রোত নেমে আসছে।
তবে অবিরাম বৃষ্টি পাহাড়ের পরিবেশটাকে মোহময়ী করে রাখার জন্য ঝর্না না দেখতে পাওয়ার যন্ত্রনা ভুলে গিয়েছিলাম। অবশ্য এই ঝর্ণা দেখার জন্য সিঁড়ি দিয়ে অনেকটা নিচে নামতে হবে। দেখলাম এক ফটোগ্রাফার ভাই বসে আপনার বা যারাই যাচ্ছে তাদের ফটো তোলার জন্য অনুরোধ করছে।আমরা বিশেষ আগ্রহ না দেখাতে অন্য দলের কাছে ক্যামেরা নিয়ে চলে গেলো। এক জায়গায় গিয়ে সিঁড়ির ধাপ শেষ হয়ে গেলো, খানিক এগিয়ে গিয়ে রেলিং ঘেরা একটা জায়গায় দাঁড়িয়ে পাহাড়ের মনোরম বৃষ্টিস্নাত পরিবেশ উপভোগ করতে লাগলাম। ছাতা নিতে বলেছিলাম সকলকে, তা যে এভাবে কাজে লেগে যাবে তা ভাবিনি। যাইহোক যা হয় ভালোর জন্যই হয়। যেখানে দাঁড়িয়েছিলাম সেখানে একটা মন্দির ছিলো, সবাই দেখলাম প্রণাম করছে, দেখাদেখি আমরাও প্রণাম সেরে নিলাম।
তিরুপতি -তিরুমালা
(অন্তিম পর্ব )
বৃষ্টি তখনও পড়েই চলেছে, কোনোরকমে দৌড়ঝাঁপ করে গাড়িতে উঠে বসলাম। ছাতা থাকা সত্ত্বেও দেখলাম গায়ের অনেকখানি অংশ ভিজে গেছে। আসলে এই ধরণের প্রবল পাহাড়ি বৃষ্টির জন্য আমরা কোনোভাবেই প্রস্তুত ছিলাম না। যাইহোক জ্বর হলে হবে কিন্তু এই বৃষ্টির আনন্দে মাতোয়ারা আমরা এই মুহূর্তকে কোনোদিনও ভুলতে পারব না। এরপর আমাদের গাড়ি উঁচু নীচু পাহাড়ি রাস্তার মধ্যে দিয়ে এগিয়ে যেতে লাগলো। রাস্তা জনমানব শূন্য, খালি প্রবল বৃষ্টির আওয়াজ আর গাড়ির গররর গররর আওয়াজ ছাড়া কিছুই চোখে বা কানে আসছিলো না। সামনে রাস্তাটি বিশাল এক বাঁক নেওয়ার পর এই জনমানব শূন্য রাস্তার মধ্যে দেখতে পেলাম একটি ছাতার তলায় গুটিসুটি মেরে, একে ওপরের হাত জড়িয়ে দুই মানব -মানবী আপন খেয়ালে হেঁটে চলেছে সামনের দিকে। যেন তারা চায় এই রাস্তা কখনো শেষ না হোক,যেন বৃষ্টি কখনো না বন্ধ হোক, আর স্মৃতি হয়ে থেকে যাক এই ক্ষণ,এই দিন আর এই মুহূর্তখানি।
একটা পাহাড়ি চেকপোস্ট পেরিয়ে যাওয়ার কিছুক্ষনের মধ্যেই আমরা আমাদের পরবর্তী গন্তব্যে পোঁছে গেলাম। এই জায়গাটিতে সুবিশাল এক বাঁধ বা যাকে বলে জলাধার চোখে পড়লো। চারিদিকে পাহাড়শ্রেণী জায়গাটিকে বেষ্টন করে রেখেছে, তবে সব কিছুই বড়ো আবছা বোধ হলো এই প্রবল বৃষ্টির জন্য। বাঁধের ওপর প্রান্তে কি আছে তা দেখার অনুমতি পেলাম না বাঁধ মেরামতির কাজ চালু থাকার জন্য।খুব হতাশ হয়ে পড়লাম, ইচ্ছে ছিলো বাঁধের ওপর দিয়ে নিচে নিকষ কালো জলের দিকে তাকিয়ে থাকতে, না জানি এর অতল গভীরে কোন অজানা রহস্য বিরাজ করছে। যাইহোক বাঁধের পাশে একটি মন্দির দেখতে পেলাম, আমরা প্রায় ভিজেই গেছি বলা যায়, দেখলাম মন্দিরে গুটিসুটি মেরে দুই ব্রাম্ভন পুরোহিত বসে রয়েছে, আমাদের দেখে যেন তাদের মধ্যে প্রাণের সঞ্চার হলো। ভিতরে ঢুকতেই তারা আমাদের নাম উচ্চারণ করে কি জানি কি মন্ত্র ঠাকুরের উদেশ্যে বলে হাতে প্রসাদ ধরিয়ে দিলেন। যাইহোক প্রসাদ আর ওপর থেকে পড়া বৃষ্টির জল খেতে মন্দ লাগছিলো না।
এবার আবার গাড়ির উদ্দেশ্যে ফেরার পালা, এখনো যে তিনটে স্পট ঘোরা বাকি। দেখলাম এখানে একটি প্রকৃতি উদ্যানের মতো কিছু একটা করা রয়েছে ,বৃষ্টির জন্য সেটাও বন্ধ। হাঁটছি বৃষ্টির মধ্যে আমরা খালি তিনজন, আশেপাশে থাকা ছোট ছোট দোকানগুলোতে দেখি সবাই আমাদের দিকে হাঁ করে তাকিয়ে রয়েছে। এরপর আমরা আর ছাতাতে আশ্রয় নিলাম না ,ছাতাকে বন্ধ করে বৃষ্টিতে ভিজতে শুরু করে দিলাম, সবাই খুব জোরে চিৎকার করছে ,বুঝলাম একেই বলে বাঁধনহারা আনন্দ। যেন আমাদের আর কিছু চাওয়ার নেই, সব যেন আমরা পেয়ে গিয়েছি। সত্যি টাকা পয়সা, গাড়ি- বাড়ি সব কিছুর কাছে এই আনন্দ খুব তুচ্ছ, আর সেটা একার মধ্যে দিয়ে নয় সবার সাথে ভাগ করে নেওয়ার মধ্যে দিয়ে আরো বেশি বোধ হয়। এই পাহাড়, নদী ,মন্দির , দূরে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষজন, ওই গাড়ির মধ্যে অপেক্ষারত মানুষটি,দূরের উইন্ডমিলগুলো আজ বড্ড আপন হয়ে গেছিলো, মন চাইছিলো না ছেড়ে যেতে বা ফিরে যেতে ওই কংক্রিটের চার দেয়ালে। হঠাৎ স্টেজের আলো নিভে গেলো।
না বলবার আর কিছুই তেমন ছিলো না। সত্যি বলছি প্রবল বৃষ্টির জন্য রাস্তা বন্ধ হয়ে যাওয়ায়, বাকি তিনটে স্পট আমরা দেখতে পাইনি। ফিরে এসে মন্দিরের কাছে এক জায়গায় বসে দূরের উইন্ডমিল গুলোর অবিরাম ঘুরে যাওয়া দেখছিলাম খালি। বৃষ্টি বন্ধ হয়ে খানিক রোদও বেরিয়ে গেছিলো। মন্দিরের কাছে এক গ্লাস দুধও শেষ বারের মতো খেয়েছিলাম। আর শেষে বাস ধরে সোজা তিরুপতি স্টেশনে নেমে গিয়েছিলাম।
কোথায় থাকবেন ?
১) মন্দিরের কাছে থাকতে হলে তিন চার মাস আগে থেকে বুকিং করে রাখতে হবে ttdsevaonline.com এর মধ্যে গিয়ে। এই ওয়েবসাইটে ঢুকে নিজের প্রোফাইল তৈরী করে বুক করে নিতে পারেন। তিরুপতি এবং তিরুমালা দুই জায়গাতেই রুম পেয়ে যাবেন।
২) oyo rooms, make my trips, এর মতো অনেক ওয়েবসাইট আছে যেখান থেকে আপনি আগে ভাগে বুকিং সেরে রাখতে পারেন।
৩) আমাদের মতো স্পটে পৌঁছেও হোটেল বুকিং করতে পারেন
কি দেখবেন ?
১) প্রথম এবং প্রধান মন্দিরের ভগবান দর্শন তাই সেটা আগেভাগে সেরে ফেলুন। প্রচুর ভিড় এড়াতে বা অনেক্ষন যদি অপেক্ষা করতে না চান তবে ttdsevaonline.com এর মধ্যে গিয়ে স্পেশাল দর্শন টিকিট কেটে রাখুন। এটাও তিন-চার মাস আগে কেটে ফেলুন।
২) সাইট সিইং এর অনেক বন্দোবস্ত রয়েছে। প্যাকেজ টুরও হয়। আপনারা সময় ও সাধ্য মতো প্যাকেজ পছন্দ করতে পারেন। গুগল করলে নাম ও তার ছবি সহ বহু আশে পাশে ঘোরার মতো জায়গার বিবরণ পেয়ে যাবেন। তিরুপতিতেও আসে পাশে ঘোরার মতো জায়গা পেয়ে যাবেন। শুনেছিলাম একটি ইসকন মন্দির নাকি রয়েছে দেখার মতো তিরুপতিতে।
৩) কোথাও যদি না যেতে চান তবে ভগবান নামের সাথে সাথে এক পেয়ালা চা নিয়ে উইন্ডমিলগুলো দেখতে মন্দ লাগবে না।
কি করে যাবেন ?
১) হাওড়া থেকে ট্রেন---
12863---HOWRAH YESVANTPUR EXPRESS---Daily
12867---HWH PDY WEEKLY EXPRESS----Sun
22855---SRC TPTY WEEEKY SF EXP---Sun
আরোও ট্রেন রয়েছে। ইন্ডিয়ান রেলওয়ের সাইট থেকে দেখে নিতে পারেন।
২) হায়দরাবাদ থেকে প্রচুর বাস তিরুপতি যায় সেটা আমি জানি। কলকাতা থেকে যাই কিনা সেটা একবার redbus.in থেকে দেখে নিতে হবে।
৩) কলকাতা থেকে তিরুপতি ফ্লাইট ডাইরেক্ট আছে বলে মনে হয় না। যদি না থাকে তবে ট্রেনে যাওয়াই বেস্ট অপশন। হয়দেরবাদ থেকে প্রচুর ফ্লাইট তিরুপতি যায় সেটা আমি জানি এবং সেটা ডাইরেক্টও।
খেয়াল রাখুন ---
১) অন্য কারোর সাহায্য নিয়ে মন্দির দর্শন করবেন না ,এতে আপনাকে ঠকতে হবে।
২) অযথা সব জায়গায় টাকা দিতে যাবেন না। অনেকেই আছে যারা টাকা চাইতে পারে,তবে জেনে রাখুন, যে সার্ভিস নিচ্ছেন তা ফ্রি সার্ভিস কিনা। যেমন নেড়া হতে কোনো টাকা লাগে না, তবে যারা চুল কাটে তারা টাকা চায়।
৩) জুতো,মোবাইল খুব সাবধানে রাখুন, পারলে হোটেলে লকার এ রেখে যান।
৪) সাইট সিইং করার সময় দরদাম করে গাড়ি বুক করুন আর জেনে নিন কোন কোন জায়গা ঘোরাবে।
৫) ঔষুধপত্র নিয়ে যাবেন সঙ্গে এবং টুপি,ছাতা বা রেনকোর্ট মাস্ট।
৬) কোনো কুরুচিকর মন্তব্য করবেন না , একে অপরকে সাহায্য করে চলুন।
৭) আশেপাশের পুলিশ স্টেশনের নম্বর গুগল থেকে দেখে নোট করে রাখুন।
৮) মন্দিরে ঢোকার সময় অযথা হুড়োহুড়ি করবেন না। মন্দিরের নিয়ম কানুন মেনে চলুন।
নোট - সব মোবাইল নেটওয়ার্ক পেয়ে যাবেন আশা করি এখানে।
"ইতি গজ "
( প্রথম পর্ব )
অফিসের প্রচণ্ড কাজের চাপের মধ্যেও দুদিনের ছুটি বের করা গেল। অনেকদিন ধরে ইচ্ছে ছিল তিরুপতি যাওয়ার। বিশেষ করে ন্যাশনাল জিওগ্রাফি চ্যানেল এ তিরুপতি সংক্রান্ত ডকুমেন্টরি দেখার পর। কাজের সূত্রে হায়দরাবাদ আসাটাও ইচ্ছেকে আরো কাছে এনে দিলো। হায়দরাবাদ থেকে তিরুপতি নানাভাবে যাওয়া যায়। ট্রেন , বাস তো আছেই, পারলে সস্তার ফ্লাইট ও (১৫০০ টাকার মধ্যে ) বুক করে নিতে পারেন। আমরা redbus বুকিং এপ্লিকেশন থেকে অরেঞ্জ ট্যুরস এন্ড ট্রাভেলস এর বাস বুক করে ছিলাম। এসি বাস পরিষেবাও খুব ভালো। প্রত্যেক জন পিছু ৭৫০ টাকা লেগেছিলো। ( সূত্র- [You must be registered and logged in to see this link.]
রাত মোটামোটি ৯.৩০টার সময় বাস হায়দরাবাদ থেকে তিরুপতির উদ্দেশে রওনা দিয়েছিলো। বলে রাখা ভালো রাতের ডিনার আগে ভাগে সেরে রাখা ভালো বা নিয়ে ওঠা ভালো। কারণ রাস্তায় রাতে বাস দাঁড়িয়েছিল বলে আমার তো মনে নেই। সারাদিন অফিসের ধকল এর পর আমি তো দিব্বি টেনে ঘুম দিয়েছিলাম। সকাল ৮.৩০ নাগাদ বাস আমাদের নিরাপদে পৌঁছে দিয়েছিলো তিরুপতি। বাস আমাদের যেখানে নামিয়েছিল তার কাছেই ছিল তিরুপতি রেল স্টেশন। সামনে বিশাল বড়ো বড়ো পাহাড়, যেখানে রয়েছে শ্রী ভেঙ্কেটেশ মন্দির বা বিষ্ণুধাম। এককথায় পাহাড়ের ওপরে তিরুমালা আর নিচে তিরুপতি। তিরুপতি তে নামার পর পরই ভক্তের সমাগম চোখে পড়েছিল, নানা রকমের খাওয়ার দোকান তো আছেই, সঙ্গে বিভিন্ন ট্রাভেল এজেন্টদের রমরমা ও চোখে পড়েছিল। এককথায় জমজমাটি এক শহর। যেন বিভিন্ন প্রান্ত থেকে বিভিন্ন সংস্কৃতির মানুষ এক উদ্দেশে এই স্থানে জড়ো হয়েছে। ভিড় সেদিন ভালোই বোধ হচ্ছিলো, কারণ দিনটি ছিল গনেশ চতুরদর্শী। আমার মন পড়েছিল ওই ধোঁয়াটে, সবুজ , উঁচু উঁচু পাহাড় এর ওপর, যার গা বেয়ে এঁকে বেকেঁ এক সর্পিল পথ কোথাও যেন চলে গিয়েছে।
তিরুপতি-তিরুমালা
( দ্বিতীয় পর্ব )
এক দৃষ্টিতে পাহাড় গুলোর দিকে তাকিয়েছিলাম, কখন যে তিরুপতি পৌঁছে গিয়েছিলাম বুঝতে পারিনি। টনক নড়লো বন্ধুদের ডাকাডাকি তে। আমাদের আগে থেকে কোনো হোটেল বুকিং ছিল না, তাই বাস থেকে নেমে প্রথম কাজ ছিল হোটেল বুকিং করা। তিরুপতি স্টেশন এর পাশে একটা জুতসই হোটেল পাওয়া গেলো। আমরা চারজন গিয়েছিলাম, তাই একটা বড়ো ডরমেটরি তেই কাজ হয়ে গিয়েছিলো। ভাড়াও খুব বেশী নয় ,আমরা একদিনের জন্য রুম নিয়েছিলাম, জন প্রতি ৪৫০ টাকা লেগেছিলো। বলে রাখা ভালো, যদি তিরুমালা তে মন্দির এর কাছে থাকতে হয়, তবে অনেকআগে থেকে বুকিং করতে হবে। এতে যাতায়াত এর খরচও বাঁচবে সঙ্গে থাকারও। (ttdsevaonline.com ) এর মাধ্যমে আগে থেকে রুম বুকিং করে রাখতে পারেন। এছাড়াও অনেক ওয়েবসাইট এর মধ্যে গিয়েও আপনি বুকিং আগে ভাগে করে রাখতে পারেন, বা আমাদের মতো তিরুপতি তে পৌঁছে স্পট বুকিংও করতে পারেন। হোটেল এ গিয়ে ফ্রেশ হয়ে ঠিক করা হলো,আজ তিরুমালা তে গিয়ে সব কিছু জেনে আসা হবে, পরের দিন ভোর ভোর পৌঁছে পুজো দিয়ে, তিরুপতি থেকে বিকেলের ট্রেন ধরা হবে।আমি বলবো যারা তিরুপতি যাবেন, চেষ্টা করুন যেদিন পৌঁছবেন,সেদিন বা পরের দিনই পুজো টা সেরে ফেলতে। কেন এমন বললাম সেটা পরে বলছি। যাইহোক তিরুপতি বাস টার্মিনাল থেকে বাস পেয়ে গেলাম। প্রচুর বাস তিরুপতি আর তিরুমালার মধ্যে ওঠা নামা করে , তাই বাস পেতে বেশী দেরি হলো না। তিরুপতি থেকে তিরুমালা সাকুল্যে ৪৫ মিনিট লাগে বাসে করে (কম -বেশী হতে পারে ) . আমি বলবো জানলার ধারে বসেই যান ,যদি পরের বাসে তা পান তবে তাই করুন।
কারণ এই ৪৫ মিনিট আপনার জীবনের অন্যতম স্মরণীয় ৪৫ মিনিট হতে চলেছে। পাহাড়ের বুক দিয়ে যখন বাস ওপরের দিকে উঠে চলবে, যখন খুব উপর থেকে নিচের তিরুমালা শহর দেখতে পাবেন , যখন দূরে উইন্ডমিল গুলো আপনাকে উঁকি মারবে, আর বাসের মধ্যে গোবিন্দা গোবিন্দা রব আপনাকে কোলাহল পূর্ণ জীবন থেকে অন্য এক মায়াবী জগৎ এ নিয়ে যাবে।
বাস থেকে নামতে মন চাইছিলো না। তিরুমালা তে পৌঁছে আরো ভালো লাগলো কারণ, পাহাড়ের ওপরের পরিবেশ সবসময় ই ভালো লাগে। চারিদিকে ভক্তের সমাবেশ, দোকান ঘরে কেনা বেচার রব , দূরে পাহাড়ের ওপরে ভাসমান মেঘ সত্যিই মনে করাচ্ছিল আমরা কোনো এক স্বপ্নপুরী তে প্রবেশ করে ফেলেছি। যাইহোক তিরুমালা তে নেমে জানতে পারলাম, পুজো আজ দেয়াটাই ভালো, কারণ কাল নাকি এ রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী আসবেন মন্দিরে পুজো দিতে। এখন বলে রাখি যে কেন আমি বলেছিলাম পুজো যত তাড়াতাড়ি সম্ভব দিতে, কারণ আর কিছুই নয়, পুজো দিতে ৮ঘন্টাও লাগতে পারে আবার ৪ ঘন্টাও। যদি আপনার স্পেশাল দর্শন এর ব্যবস্থা থাকে তবে আলাদা ব্যাপার। তিন ধরণের দর্শন হয়ে থাকে -
১) সর্বদর্শন - এটি ফ্রি , টোকন নিয়ে আপনি লাইনএ দাঁড়াতে পারেন, কতক্ষন লাগবে বলা মুস্কিল।
২) দিব্য দর্শন - যারা পায়ে হেটে তিরুপতি থেকে মন্দির আসে তাদের জন্য, এটি তে সর্বদর্শন এর থেকে একটু তাড়াতাড়ি হয়।
৩) স্পেশাল এন্ট্রি দর্শন - এটি র জন্য ওপরের ওয়েবসাইট থেকে টিকিট কেটে রাখতে হয়। ৩০০ টাকা করে জন প্রতি লাগে। এতে সময় অনেক কম লাগে। এছাড়াও ইনফ্যান্ট দর্শন,স্পেশাল এন্ট্রি ফর ফিজিক্যাল ডিসেবিলিটি পার্সনস , vip ব্রেক দর্শন আছে। তরুণদের বলবো তারা যেন দিব্য দর্শনে যায়।
পাহাড়ের সৌন্দর্য দেখতে দেখতে মন্দির দর্শন এর মজাটাই আলাদা। আমরাও তাই প্ল্যান করেছিলাম , কিন্তু সময় এর অভাবে হয়ে ওঠেনি। টুরিস্ট এর জন্য একটা ইনফরমেশন শেয়ার করে রাখি , তিরুমালা তে বাস থেকে নেমেই দেখতে পাবেন ,অনেক আসবে এটা বলতে যে তারা খুব জলদি দর্শন করিয়ে দেবে। ভুলেও ফাঁদে পা দেবেন না , এরা আপনাকে একটি দোকানে নিয়ে গিয়ে বলবে ছবি তুলতে হবে, তারপর নিয়ে যাবে, কিন্তু ছবি তোলার টাকা দেয়ার পর বলবে লাইন এ দাঁড়িয়ে যান। নিজে গিয়েই লাইন এ দাঁড়াবেন। ভুল তখন হয়, যখন আমরা নতুন জায়গায় গিয়ে একটু ভয়ে ভয়ে থাকি। বহু মানুষ সোলো ট্রাভেল করেন, একটু খোঁজ খবর থাকলে কোনো অসুবিধে নেই।
তিরুপতি-তিরুমালা
(তৃতীয় পর্ব)
যাইহোক যেহেতু আমরা সর্ব দর্শন এর টিকিট নিয়ে লাইনে দাঁড়িয়েছিলাম, তাই মনে একটু খটকা লাগছিলো যে, আজ ভগবান এর দর্শন হবে তো? আমরা লাইনে দাঁড়িয়েছিলাম বিকেল সাড়ে তিনটে নাগাদ। এর দুই ঘন্টা আগে আমরা হন্যে হয়ে মস্তক মুন্ডন এর জন্য ছোটাছোটি করছিলাম, খুঁজছিলাম হারিয়ে যাওয়া একে অপরকে। ব্যাপারটা তবে খোলসা করে বলি , এতো বড়ো জায়গা , সঙ্গে এতো লোকের সমাগম আমাদের বারে বারে উদ্ভ্রান্ত করছিলো কোন দিকে গেলে কি পাবো বা কোন ঘরে গেলে আমাদের কাজটা হবে। নানা মুনির নানা মত। বলা ভালো কথিত আছে যে,তিরুপতি গিয়ে চুল দান করা পুণ্যের কাজ, কারণ আপনি বা আমি চুল দেওয়ার সাথে সাথে আমার ইগো টাকেও বিসর্জন দিচ্ছি। যাইহোক আমি এই পুণ্যের ভাগিদার হতে চেয়েছিলাম। মুন্ডন হওয়ার সময় যারা মুন্ডন করে তারা কিছু বকশিশ দাবি করতে পারে, তবে দেয়া বা না দেয়া আপনার ওপর। সাউন্ড বক্সগুলো তে কিন্তু সবসময় প্রচার হচ্ছে যে, কোনো রকম পয়সাকড়ি না দেওয়ার জন্য। এরপর অন্য কোনো এক কক্ষে স্নানাদি পর্ব সমাপন করে, হারিয়ে যাওয়া একে অপরকে উদ্ধার করে লাইনে গিয়ে দাঁড়ানো।
লাইনে গিয়ে দাঁড়াবার আগেই টিকিট কেটে নিয়েছিলাম। হেঁটেই চলেছি , কখনো সিঁড়ি বা আবার কোথাও সমতল হয়ে , কখনো এক ঘরের বারান্দা দিয়ে তো পরক্ষনে দুধ নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা ভলেন্টিয়ারদের পাস দিয়ে। বলতে ভুলেই গিয়েছিলাম যে কুপন নেয়ার সাথেই আপনাকে সেই বিখ্যাত তিরুপতির লাডডুর জন্যও টাকা দিয়ে কুপন নিয়ে নিতে হবে। তবে তা লাগবে এই সুদীর্ঘ প্রতীক্ষার অবসান হওয়ার পর মানে ভগবান দর্শন হওয়ার পর। তাই কুপন টি গুছিয়ে রাখতে হবে। আমরা যে স্পীডে যাচ্ছিলাম ভাবলাম তবে ভগবান জলদি দর্শন হয়ে যাবে, তবে টনক নড়লো যখন আমাদের প্রচুর লোক ভর্তি একটি ঘরে বসিয়ে দেওয়া হলো, আরো দু একজন ঢোকার পর গেটে তালা ঝুলিয়ে দেওয়া হলো। বুঝলাম এই ঘরের প্রত্যেকের সেই এক উদেশ্য, মানে ভগবান দর্শন। এরকম বহু ঘর আছে যেখানে মানুষজন বসে আছেন প্রতীক্ষায়, তাই আমরা মূল মন্দির থেকে কতগুলো ঘর দূরে আছি তা বোঝা যাচ্ছিলো না। অবশ্য ঘরগুলিতে ফ্যান লাগানো আছে অনেকগুলি, বিনোদনের জন্য ভক্তিমূলক নানান প্রোগ্রাম টিভিতে চলছে। ভলেন্টিয়ার বা মহিলা সেবকবৃন্দ মাঝে মাঝেই প্রসাদ বিতরণ করছে , সঙ্গে অবশ্য গরম দুধও পাওয়া যাচ্ছে। আমি বহুবার গরম দুধ সেবন করে ঘোরতর নিদ্রা কাটানোর চেষ্টা করছিলাম,অবশ্য অনেক মানুষ ইতিমধ্যেই নিজের মতো জায়গা করে স্বপ্ন রাজ্যে বিরাজ করছেন। বাথরুমের ব্যবস্থাও দেখলাম করা আছে। মাথার ওপর ছাদ, সঙ্গে খাওয়ার , বিনোদনের ব্যবস্থা সব কিছুই ছিলো , আর ছিল ক্ষনে ক্ষনে গোবিন্দা গোবিন্দা রব আর অফুরন্ত সময়।
তিরুপতি-তিরুমালা
(চতুর্থ পর্ব )
অনেকক্ষন বসে থাকার পর, সামনের ঘরগুলি থেকে মানুষজনের চেঁচামেচিতে বুঝতে পারলাম যে,আস্তে আস্তে গেট খুলে দেয়া হচ্ছে ভগবান দর্শন এর জন্য। আওয়াজ যত বাড়ছে, মনের মধ্যে উদ্দীপনা তত বেড়ে চলেছে। আনুমানিক ৪ঘন্টা বসে থাকার পর, প্রতীক্ষার অবসান হলো। গেট খুলে দেয়া হলো আমাদের ঘরের। লোকজন চটজলদি লাইনে দাঁড়ানোর জন্য হুড়োহুড়ি করতে লাগলো। আমরা কচ্ছপের ন্যায় মন্থর গতিতে এগোতে লাগলাম। এরপর রেলিং দিয়ে ঘেরা ঘরগুলির সামনের রাস্তা দিয়ে মন্দিরের উদ্যেশে এগোতে লাগলাম। কিন্তু তখনও মন্দির অনেক দূরে, এদিকে সূর্যি মামা পশ্চিম কোনে ঢোলে পড়েছে , পাহাড়ের গা ঘেঁষে সূর্য যখন ডুব মারছে সেই দৃশ্য যেন আমাকে হয়তো সবাইকে মোহিত করে তুলেছিল। তবে সব দৃশ্যই মনের চিত্রপটে অঙ্কিত হয়ে রয়ে গেছে ,কারণ ক্যামেরা বা মোবাইল কোনো কিছুই আমরা সঙ্গে নিতে পারিনি, মানে নিতে পারবেন না। ধীরে ধীরে এগিয়ে চলা ,আবার মাঝে মাঝে থমকে দাঁড়িয়ে যাওয়া- এই করতে করতে আমরা সিকিউরিটি চেক পয়েন্ট এর কাছে এসে দাঁড়ালাম। সিকিউরিটি চেক পয়েন্টে যা হয় আরকি, তা হয়ে যাওয়ার পর আমরা মন্দিরের চূড়া দেখতে পেলাম। শুনতে পাচ্ছিলাম ঘন্টাধনি, রাতের অন্ধকারে মন্দিরটিকে খুব সুন্দর ভাবে লাইট দিয়ে সাজানো হয়েছিল। যেন গোটা তিরুমালা শহরকে এই মন্দির আলোকিত করে রখেছে।
সবচেয়ে ভালো লাগছিলো মানুষজনের মধ্যে এতটুকু ক্লান্তিবোধ নেই, মাঝে মাঝে গোবিন্দা গোবিন্দা রব সেই উৎসাহ ব্যাক্ত করছিলো। এরপর সুযোগ এলো মন্দিরে ঢোকার, হুড়োহুড়ি এখনো থামেনি,বরং আরো বেড়ে গেলো মন্দিরে ঢোকার পর। মূল মন্দির পুরোটাই সোনা দিয়ে তৈরী করা হয়েছে। মূল মন্দিরের সঙ্গে আরো কিছু ঘর রয়েছে, সেখানেও ঠাকুর রয়েছে। যে ভগবান মানে বিষ্ণুকে দেখার জন্য আপনি এতক্ষন লাইন দিয়ে দাঁড়াবেন, তাকে দেখার জন্য আপনি ১ মিনিটেরও কম সময় পাবেন। মন্দিরের চারিদিকে সশস্ত্র পুলিশ দন্ডায়মান সঙ্গে ভলান্টিয়ার বাহিনীতো আছেই। আসলে এই বিপুল ভিড় সামাল দেওয়ার জন্য তা করতেই হবে। সবচেয়ে ভালো লাগছিলো,যে মন্দির দেখার জন্য মানুষজন বহু দূর দূরান্ত থেকে এসেছে সেই মন্দির অবশেষে দেখে ফেললাম এবং ভগবান এর দর্শনও হয়ে গেলো। এখানে বলে রাখি আমরা যে বিষ্ণুর অবয়ব দেখেছি বা যারা গিয়ে দেখবেন সেটি একটি রেপ্লিকা মাত্র,মূল অবয়ব গর্ভগৃহে রাখা থাকে। সেখানে সবার যাওয়ার অনুমতি নেই। এইখানে যে বিষ্ণুর অবয়ব আপনি দেখতে পাবেন সেটি কালো রঙের। এখানে বিষ্ণুকে ভেঙ্কটেশ্বরা বলে ডাকা হয়। সংস্কৃত শাস্ত্র অনুযায়ী ভেঙ্কটেশ্বরা নামের অর্থ পাপের বিনাশকারী মানে বিষ্ণু নিজে স্বয়ং। আরো কৌতহল থাকলে গুগল করে দেখতে পারেন এর ইতিহাস জানার জন্য বা পারলে ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক চ্যানেল এর তিরুপতি নিয়ে তৈরী ডকুমেন্টরিটা দেখে নিতে পারেন।
মূল মন্দিরের আশেপাশে বিভিন্ন ঠাকুরগুলি দেখে কিছুক্ষন বিরতি নেওয়ার জন্য বসে পড়েছিলাম। দক্ষিণা দেওয়ার জন্য একটি ঝোলা গোছের কিছু ঝোলানো ছিলো, সেখানে দক্ষিণাদি দিয়ে ঘি দিয়ে তৈরী করা খিচুড়ি খেয়ে এবার মন্দির থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পালা, শেষবারের মতো প্রণাম সেরে মন্দির থেকে বেরিয়ে গেলাম। এইবার লাড্ডু নেওয়ার পালা, কুপনের মধ্যে থাকা গেটের কাছে গিয়ে লাইন দিয়ে লাড্ডু পেয়ে গেলাম। সঙ্গে সঙ্গে একটা লাড্ডু খেয়েও নিলাম। সত্যি বলছি এমন স্বাদ আর পৃথিবীর কোনো লাড্ডুতে পাওয়া যাবে না। লাড্ডু খেয়ে মন জুড়িয়ে যাওয়ার পর মোবাইল ফোনগুলি নিতে গেলাম, তারপর জুতো নিতে গিয়ে দেখি আমার জুতোজোড়া কেউ নিয়ে গেছে, হয়তো কারো ভালো লেগে গেছিলো কিন্তু সে কভু আমার মনের অবস্থাটুকু বুঝিল না। যাইহোক আপনারা দামি জুতো নিয়ে পুন্য করতে যাবেন না,জুতো চুরি হওয়ার প্রভূত সম্ভবনা।সবচেয়ে বেশি যেটা খারাপ লাগলো জুতোর ঘরে কোনো সিকিউরিটি নেই। যাইহোক খালি পায়ে ঘুরে ঘুরে একটি দোকানে ধোসা ও চা সেবন করে নিচে মানে তিরুপাতিতে যেখানে আমাদের হোটেল রয়েছে সেখানে যাওয়ার প্রস্তুতি নিতে লাগলাম।কেনার জন্য বহু দোকান পেয়ে যাবেন, নানারকমের দ্রব্য সেখানে রয়েছে। আমি কেবল একখানি টুপি কিনেছিলাম। মন্দিরের সামনের বড়ো বড়ো বারান্দাগুলোতে দেখলাম বহু পুণ্যার্থী শুয়ে পড়েছে ,হয়তো তারা সেখানেই শুয়ে থাকবে সারারাত, হয়তো থাকার মতো জায়গা তারা জোগাড় করতে পারেনি কিন্তু তাদের ললাটে বিষ্ণুকে দর্শন করার প্রশান্তি ফুটে উঠেছে, ফুলে উঠেছে বুক আনন্দে। আর তাই মন প্রসন্ন হয়ে ঘুমের ঘোরেও বলে উঠছে গোবিন্দা গোবিন্দা।
তিরুপতি-তিরুমালা
(পঞ্চম পর্ব )
ঘড়ির কাটা বলছে সকাল ৭টা বেজে ৩০ মিনিট, গতকাল হোটেলে ফিরতে ফিরতে রাত ১২.৩০টা মতন হয়ে গেছিলো। সারাদিনের ধকলের পর তাই আর খুব সকালে কারোরই ঘুম ভাঙেনি। আমাদের সকাল ১০টার মধ্যে হোটেল ছেড়ে দিতে হতো , কারণ আজকেই বিকেল পাঁচটার ট্রেন ধরে আমাদের সেকান্দ্রাবাদ ফেরার কথা। অফিস থেকে সবারই দুদিনের ছুটি বরাদ্দ ছিল। তাই চোখ খোলার পর রুমে যেন দক্ষযজ্ঞ লেগে গেলো, কারণ গতকাল খালি পুজোটাই দিতে পেরেছি আমরা, আশেপাশের জায়গা গুলো ঘুরে দেখা হয়নি কারোরই। আমার নির্দেশ ছিলো কেউ যেন বড়ো ব্যাগ না নিয়ে আসে যাতে ঘুরতে অসুবিধে হয়, দেখলাম সবাই বাধ্য ছেলের মতো তাই করেছিলো।
তাই ফ্রেশ হয়ে চটজলদি ব্যাগ নিয়ে বেরোতে কারোরই লেট হয়নি। আজকের দিনের স্রোতে বয়ে যাওয়ার আগে বলে রাখি যে, গতকাল আমরা রাত ১১টা নাগাদ বাস পেয়ে গেছিলাম এবং সেই বাস আমাদের নিরাপদে তিরুপতি বাস টার্মিনালে পৌঁছে দিয়েছিলো। খালি এটা বলার জন্য আমি ফ্ল্যাশব্যাকে যাইনি , বলতে চাইছি যদি বাসে না বসে কোনো মোটর-সাইকেলের পেছনে বসে যদি নামতে পারতাম তবে বোধ হয় জীবন সার্থক হতো। রাতের পাহাড়ী হাওয়া, সঙ্গে নাম না জানা ফুলের পাগল করা গন্ধ, প্রত্যেক মোড়ের পাশে জানান দেওয়া মাইলস্টোন আর উপর থেকে দেখা গোটা আলোয় আলোকিতময় তিরুপতি শহর তা জানান দিছিলো, বস জীবন তো এটাই, জীবন তো ওই প্রত্যেক বাঁক নেওয়া অজানা পাহাড়ী মোড়। হায় গোবিন্দা ভালো লাগার মুহূর্তগুলো কত জলদি শেষ হয়ে যায়। তাই বাসে বসে নামার সময় না জানা কোনো এক কারণে চোখে জল চলে এসেছিলো।
সকাল সাড়ে ৯টার আগেই টিফিন নিঃশেষ করে সামনে সেই সেভেন হিলসকে সাক্ষী রেখে আবার বাসে করে তিরুমালার উদ্যেশে রওনা দেওয়া। এবার যাচ্ছি তিরুমালা তে মন্দিরের আশেপাশে খুব দূরে নয় এমন জায়গা ঘুরে দেখার জন্য। আসলে একবার গিয়ে সব জায়গা পুঙ্খানুপুঙ্খ ভাবে ঘুরে দেখা সম্ভব নয়। তাই মনের মধ্যে চিরকাল সব ভ্ৰমণ পিপাসুদের সেই এক কথা মনে আসে " শেষ হয়েও হইলো না শেষ"। যথারীতি তিরুমালাতে বাস থেকে নেমে আমাদের প্রথম কাজ ছিলো, যে জায়গাগুলি আমরা সিলেক্ট করেছিলাম সেই জায়গাগুলিতে কিভাবে পৌঁছানো যেতে পারে তা খোঁজা।
আপনি যদি গুগল করেন দেখবেন প্রায় ৪০খানি জায়গা উঠে আসবে মন্দিরের আশেপাশে ঘোরার জন্য। সবচেয়ে বিভ্রান্ত হইলাম এইভাবে যে, আমরা যে জায়গাগুলো সিলেক্ট করেছিলাম তা একদিকে কোনটাই নেই, সবই ছড়িয়ে ছিটিয়ে। তাই অগত্যা গাড়ি ভাড়া করা ছাড়া কোনো গতি নেই। আমাদের লিষ্টি শুনে বিভিন্ন এজেন্ট নানান রকমের মূল্যের রকমফের শোনালেন, আমরা খালি হা করে শুনেই গেলাম কিছু বলা বা ভাবার অবকাশ পেলাম না। অবশেষে একটি ড্রাইভার আমাদের সুরাহা করে দিলেন, বললেন বিকেল পাঁচটার ট্রেন যদি ধরতে হয় তবে এই এই জায়গাগুলি দেখতে পারেন ,সময়ের আগেই স্টেশনে পৌঁছে যাবেন। আমরাও সম্মতি জানালাম। শেষমেশ ৬০০ টাকাতে রফা হলো এবং স্থির হলো ৬টি জায়গা উনি ঘুরে দেখাবেন এবং আবার এই স্থানেই আমাদের ছেড়ে দেবেন।
আপনারা যারা তিরুপতি আসবেন তারা আগেভাগে ঠিক করে রাখবেন কি কি জায়গা ঘুরবেন এবং একটু দরদাম করে গাড়ি ভাড়া করবেন, আর অবশ্যই সময় বেশি নিয়ে আসবেন। কি কি জায়গা ঘুরবেন তা গুগল করলেই তার বিবরণসহ পেয়ে যাবেন এই একবিংশ শতাব্দীতে, তাই সেগুলি বলে বৃথা লেখা বড়ো করবো না । জয় গোবিন্দা বলে গাড়িতে উঠতেই আকাশের মুখ ভার হয়ে উঠলো এবং কিছুক্ষনের মধ্যেই অসংখ্য বারিধারা এই সুবিশাল পৃথিবীর বেড়াজাল ভেঙে নিচে নেমে আস্তে লাগলো।উফফ কি মুষুলধারে বৃষ্টি সঙ্গে মাঝে মাঝে ভগবানের দুএকটি করে ব্রহ্মাস্ত্র নিক্ষেপ।সেই ভিজে স্যাঁতসেঁতে গাড়ির সিটে কোনোরকমে মাথা গুঁজে আমাদের গাড়ি গড়গড়িয়ে এগিয়ে চলল সামনের দিকে।
পাহাড়ের বৃষ্টি দেখার ইচ্ছে ছিলো অনেকদিন থেকেই, ভগবান বোধহয় সেটাও পূরণ করে দিলেন। ঘন বৃষ্টির চাদর ঠেলে যখন আমাদের গাড়ি এগিয়ে চলছিলো, যখন বৃষ্টির আনন্দে মাতোয়ারা পাখিদের পাগলামি চোখে পড়ছিলো ,যখন পাহাড়ি রাস্তার কোনো এক কোণে গরম চায়ের হাওয়া উড়িয়ে চাওয়ালা হঠাৎ আমন্ত্রণ জানাচ্ছিল তা কোনো অংশে স্বর্গপুরী থেকে কম নয়। লোভ সামলাতে না পেরে আমরা সেই চাওয়ালার আমন্ত্রণ সাদরে স্বীকার করেছিলাম। বৃষ্টির ফোটা চায়ের কাপে পড়ে চায়ের ওপর যে কম্পন সৃষ্টি করছিলো , সেই কম্পন তখন সবার মনে এক গভীর ক্ষত তৈরী করে দিয়েছিলো, সেই ক্ষত ভালোলাগার, প্রকৃতিকে এতো কাছ থেকে দেখে ভালোবাসার। প্রথম যে স্পটটিতে আমরা দাঁড়ালাম সেখানে একটি কালিমাতার মন্দির রয়েছে, মন্দিরের স্থাপত্য বিশেষ কিছু না, সবাই দেখলাম পুজো দিচ্ছে,সামনে একটি হনুমানের মূর্তিও রয়েছে সেখানেও লোকজন লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কপালে তিলক লাগাচ্ছে দেখলাম। এরপর আমাদের নিয়ে যাওয়া হলো দুধসাগর দেখাবে বলে।দুধসাগরের যে বর্ণনা আমি শুনেছিলাম বা পড়েছিলাম ওখানে পৌঁছে একটু হতাশ ই হয়েছিলাম। পাহাড়ের গাত্র থেকে যে অজস্র বারিধারা নেমে আসার কথা ছিলো তা যে কেন আজ এলো না তা বুঝতে পারলাম না। আসলে এই জায়গাটাতে একটা ঝর্ণা থাকার কথা,কিন্তু গিয়ে দেখি ঝর্ণা তো দূরে থাক ফিনফিনে জলের স্রোত নেমে আসছে।
তবে অবিরাম বৃষ্টি পাহাড়ের পরিবেশটাকে মোহময়ী করে রাখার জন্য ঝর্না না দেখতে পাওয়ার যন্ত্রনা ভুলে গিয়েছিলাম। অবশ্য এই ঝর্ণা দেখার জন্য সিঁড়ি দিয়ে অনেকটা নিচে নামতে হবে। দেখলাম এক ফটোগ্রাফার ভাই বসে আপনার বা যারাই যাচ্ছে তাদের ফটো তোলার জন্য অনুরোধ করছে।আমরা বিশেষ আগ্রহ না দেখাতে অন্য দলের কাছে ক্যামেরা নিয়ে চলে গেলো। এক জায়গায় গিয়ে সিঁড়ির ধাপ শেষ হয়ে গেলো, খানিক এগিয়ে গিয়ে রেলিং ঘেরা একটা জায়গায় দাঁড়িয়ে পাহাড়ের মনোরম বৃষ্টিস্নাত পরিবেশ উপভোগ করতে লাগলাম। ছাতা নিতে বলেছিলাম সকলকে, তা যে এভাবে কাজে লেগে যাবে তা ভাবিনি। যাইহোক যা হয় ভালোর জন্যই হয়। যেখানে দাঁড়িয়েছিলাম সেখানে একটা মন্দির ছিলো, সবাই দেখলাম প্রণাম করছে, দেখাদেখি আমরাও প্রণাম সেরে নিলাম।
তিরুপতি -তিরুমালা
(অন্তিম পর্ব )
বৃষ্টি তখনও পড়েই চলেছে, কোনোরকমে দৌড়ঝাঁপ করে গাড়িতে উঠে বসলাম। ছাতা থাকা সত্ত্বেও দেখলাম গায়ের অনেকখানি অংশ ভিজে গেছে। আসলে এই ধরণের প্রবল পাহাড়ি বৃষ্টির জন্য আমরা কোনোভাবেই প্রস্তুত ছিলাম না। যাইহোক জ্বর হলে হবে কিন্তু এই বৃষ্টির আনন্দে মাতোয়ারা আমরা এই মুহূর্তকে কোনোদিনও ভুলতে পারব না। এরপর আমাদের গাড়ি উঁচু নীচু পাহাড়ি রাস্তার মধ্যে দিয়ে এগিয়ে যেতে লাগলো। রাস্তা জনমানব শূন্য, খালি প্রবল বৃষ্টির আওয়াজ আর গাড়ির গররর গররর আওয়াজ ছাড়া কিছুই চোখে বা কানে আসছিলো না। সামনে রাস্তাটি বিশাল এক বাঁক নেওয়ার পর এই জনমানব শূন্য রাস্তার মধ্যে দেখতে পেলাম একটি ছাতার তলায় গুটিসুটি মেরে, একে ওপরের হাত জড়িয়ে দুই মানব -মানবী আপন খেয়ালে হেঁটে চলেছে সামনের দিকে। যেন তারা চায় এই রাস্তা কখনো শেষ না হোক,যেন বৃষ্টি কখনো না বন্ধ হোক, আর স্মৃতি হয়ে থেকে যাক এই ক্ষণ,এই দিন আর এই মুহূর্তখানি।
একটা পাহাড়ি চেকপোস্ট পেরিয়ে যাওয়ার কিছুক্ষনের মধ্যেই আমরা আমাদের পরবর্তী গন্তব্যে পোঁছে গেলাম। এই জায়গাটিতে সুবিশাল এক বাঁধ বা যাকে বলে জলাধার চোখে পড়লো। চারিদিকে পাহাড়শ্রেণী জায়গাটিকে বেষ্টন করে রেখেছে, তবে সব কিছুই বড়ো আবছা বোধ হলো এই প্রবল বৃষ্টির জন্য। বাঁধের ওপর প্রান্তে কি আছে তা দেখার অনুমতি পেলাম না বাঁধ মেরামতির কাজ চালু থাকার জন্য।খুব হতাশ হয়ে পড়লাম, ইচ্ছে ছিলো বাঁধের ওপর দিয়ে নিচে নিকষ কালো জলের দিকে তাকিয়ে থাকতে, না জানি এর অতল গভীরে কোন অজানা রহস্য বিরাজ করছে। যাইহোক বাঁধের পাশে একটি মন্দির দেখতে পেলাম, আমরা প্রায় ভিজেই গেছি বলা যায়, দেখলাম মন্দিরে গুটিসুটি মেরে দুই ব্রাম্ভন পুরোহিত বসে রয়েছে, আমাদের দেখে যেন তাদের মধ্যে প্রাণের সঞ্চার হলো। ভিতরে ঢুকতেই তারা আমাদের নাম উচ্চারণ করে কি জানি কি মন্ত্র ঠাকুরের উদেশ্যে বলে হাতে প্রসাদ ধরিয়ে দিলেন। যাইহোক প্রসাদ আর ওপর থেকে পড়া বৃষ্টির জল খেতে মন্দ লাগছিলো না।
এবার আবার গাড়ির উদ্দেশ্যে ফেরার পালা, এখনো যে তিনটে স্পট ঘোরা বাকি। দেখলাম এখানে একটি প্রকৃতি উদ্যানের মতো কিছু একটা করা রয়েছে ,বৃষ্টির জন্য সেটাও বন্ধ। হাঁটছি বৃষ্টির মধ্যে আমরা খালি তিনজন, আশেপাশে থাকা ছোট ছোট দোকানগুলোতে দেখি সবাই আমাদের দিকে হাঁ করে তাকিয়ে রয়েছে। এরপর আমরা আর ছাতাতে আশ্রয় নিলাম না ,ছাতাকে বন্ধ করে বৃষ্টিতে ভিজতে শুরু করে দিলাম, সবাই খুব জোরে চিৎকার করছে ,বুঝলাম একেই বলে বাঁধনহারা আনন্দ। যেন আমাদের আর কিছু চাওয়ার নেই, সব যেন আমরা পেয়ে গিয়েছি। সত্যি টাকা পয়সা, গাড়ি- বাড়ি সব কিছুর কাছে এই আনন্দ খুব তুচ্ছ, আর সেটা একার মধ্যে দিয়ে নয় সবার সাথে ভাগ করে নেওয়ার মধ্যে দিয়ে আরো বেশি বোধ হয়। এই পাহাড়, নদী ,মন্দির , দূরে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষজন, ওই গাড়ির মধ্যে অপেক্ষারত মানুষটি,দূরের উইন্ডমিলগুলো আজ বড্ড আপন হয়ে গেছিলো, মন চাইছিলো না ছেড়ে যেতে বা ফিরে যেতে ওই কংক্রিটের চার দেয়ালে। হঠাৎ স্টেজের আলো নিভে গেলো।
না বলবার আর কিছুই তেমন ছিলো না। সত্যি বলছি প্রবল বৃষ্টির জন্য রাস্তা বন্ধ হয়ে যাওয়ায়, বাকি তিনটে স্পট আমরা দেখতে পাইনি। ফিরে এসে মন্দিরের কাছে এক জায়গায় বসে দূরের উইন্ডমিল গুলোর অবিরাম ঘুরে যাওয়া দেখছিলাম খালি। বৃষ্টি বন্ধ হয়ে খানিক রোদও বেরিয়ে গেছিলো। মন্দিরের কাছে এক গ্লাস দুধও শেষ বারের মতো খেয়েছিলাম। আর শেষে বাস ধরে সোজা তিরুপতি স্টেশনে নেমে গিয়েছিলাম।
কোথায় থাকবেন ?
১) মন্দিরের কাছে থাকতে হলে তিন চার মাস আগে থেকে বুকিং করে রাখতে হবে ttdsevaonline.com এর মধ্যে গিয়ে। এই ওয়েবসাইটে ঢুকে নিজের প্রোফাইল তৈরী করে বুক করে নিতে পারেন। তিরুপতি এবং তিরুমালা দুই জায়গাতেই রুম পেয়ে যাবেন।
২) oyo rooms, make my trips, এর মতো অনেক ওয়েবসাইট আছে যেখান থেকে আপনি আগে ভাগে বুকিং সেরে রাখতে পারেন।
৩) আমাদের মতো স্পটে পৌঁছেও হোটেল বুকিং করতে পারেন
কি দেখবেন ?
১) প্রথম এবং প্রধান মন্দিরের ভগবান দর্শন তাই সেটা আগেভাগে সেরে ফেলুন। প্রচুর ভিড় এড়াতে বা অনেক্ষন যদি অপেক্ষা করতে না চান তবে ttdsevaonline.com এর মধ্যে গিয়ে স্পেশাল দর্শন টিকিট কেটে রাখুন। এটাও তিন-চার মাস আগে কেটে ফেলুন।
২) সাইট সিইং এর অনেক বন্দোবস্ত রয়েছে। প্যাকেজ টুরও হয়। আপনারা সময় ও সাধ্য মতো প্যাকেজ পছন্দ করতে পারেন। গুগল করলে নাম ও তার ছবি সহ বহু আশে পাশে ঘোরার মতো জায়গার বিবরণ পেয়ে যাবেন। তিরুপতিতেও আসে পাশে ঘোরার মতো জায়গা পেয়ে যাবেন। শুনেছিলাম একটি ইসকন মন্দির নাকি রয়েছে দেখার মতো তিরুপতিতে।
৩) কোথাও যদি না যেতে চান তবে ভগবান নামের সাথে সাথে এক পেয়ালা চা নিয়ে উইন্ডমিলগুলো দেখতে মন্দ লাগবে না।
কি করে যাবেন ?
১) হাওড়া থেকে ট্রেন---
12863---HOWRAH YESVANTPUR EXPRESS---Daily
12867---HWH PDY WEEKLY EXPRESS----Sun
22855---SRC TPTY WEEEKY SF EXP---Sun
আরোও ট্রেন রয়েছে। ইন্ডিয়ান রেলওয়ের সাইট থেকে দেখে নিতে পারেন।
২) হায়দরাবাদ থেকে প্রচুর বাস তিরুপতি যায় সেটা আমি জানি। কলকাতা থেকে যাই কিনা সেটা একবার redbus.in থেকে দেখে নিতে হবে।
৩) কলকাতা থেকে তিরুপতি ফ্লাইট ডাইরেক্ট আছে বলে মনে হয় না। যদি না থাকে তবে ট্রেনে যাওয়াই বেস্ট অপশন। হয়দেরবাদ থেকে প্রচুর ফ্লাইট তিরুপতি যায় সেটা আমি জানি এবং সেটা ডাইরেক্টও।
খেয়াল রাখুন ---
১) অন্য কারোর সাহায্য নিয়ে মন্দির দর্শন করবেন না ,এতে আপনাকে ঠকতে হবে।
২) অযথা সব জায়গায় টাকা দিতে যাবেন না। অনেকেই আছে যারা টাকা চাইতে পারে,তবে জেনে রাখুন, যে সার্ভিস নিচ্ছেন তা ফ্রি সার্ভিস কিনা। যেমন নেড়া হতে কোনো টাকা লাগে না, তবে যারা চুল কাটে তারা টাকা চায়।
৩) জুতো,মোবাইল খুব সাবধানে রাখুন, পারলে হোটেলে লকার এ রেখে যান।
৪) সাইট সিইং করার সময় দরদাম করে গাড়ি বুক করুন আর জেনে নিন কোন কোন জায়গা ঘোরাবে।
৫) ঔষুধপত্র নিয়ে যাবেন সঙ্গে এবং টুপি,ছাতা বা রেনকোর্ট মাস্ট।
৬) কোনো কুরুচিকর মন্তব্য করবেন না , একে অপরকে সাহায্য করে চলুন।
৭) আশেপাশের পুলিশ স্টেশনের নম্বর গুগল থেকে দেখে নোট করে রাখুন।
৮) মন্দিরে ঢোকার সময় অযথা হুড়োহুড়ি করবেন না। মন্দিরের নিয়ম কানুন মেনে চলুন।
নোট - সব মোবাইল নেটওয়ার্ক পেয়ে যাবেন আশা করি এখানে।
"ইতি গজ "