মন্দিরময় ওড়িশায় চারটি বৈশিষ্টপূর্ণ মন্দিরের কিছু তথ্য..................

পাহাড় থেকে নেমে পাদুটো একটু ক্লান্ত। শহুরে শীততাপ নিয়ন্ত্রিত যন্ত্রে লালিত পা দুটো কি আর পাথুরে এবরো খেবড়ো পথের চাপ নিতে পারে। খিদেও পেয়েছে, সেই সকাল ৯
টায় বেরিয়েছি। পথে শুধু ডাবের জল ,কেক,আর বিস্কুট। এতে আর কতক্ষণ থাকা যায়। চলেছি লিঙ্গরাজ দর্শনে।পথে আসতে আসতে ড্রাইভার বলে দিয়েছিলো লিঙ্গরাজ মন্দিরে পান্ডাদের উতপাতের কথা। জোরজুলুম আর প্রনামী চাওযার প্রবণতা ভীসন। গাড়িতে বেল্ট, জুতো,মানিবাগ সবকিছু রেখে খালি পায়ে চললাম মন্দির দর্শনে। gate এ মেটাল ডিটেক্টর এ সর্বাঙ্গ পরীক্ষা নিরীক্ষার পর মন্দির প্রাঙ্গনে প্রবেশ। এর মধ্য আমাদের পিছনে দাড়ানো একজন মহিলা তল্লাশির সময় ধরা পড়ল।কোমরে শায়ার মধ্য মোবাইল লুকিয়ে নিয়ে ঢুকছিলেন কিন্তু বিধি বাম তাই অগত্যা সমর্পণ।

বড়সর মন্দির Complex । প্রথমে সর্প দেবতার একটি ছোট মন্দির। এরপর ধীর পায়ে মূল মন্দিরের দিকে এগিয়ে যাওয়া। প্রসঙ্গত জানিয়ে রাখি লিঙ্গরাজ মন্দিরে ছবি তোলায় নিষেধাজ্ঞা আছে। তাই মন্দিরের সামনে থেকে কেনা একটি বই এর ছবি স্ক্যান করে তুলে দিলাম Reference হিসাবে। কথায় আছে হিন্দুদের ৩৩ কোটি দেবদেবী। এখানে আসলে তার কিছুটা আভাস আপনি পাবেন। ছোট বড় অসংখ্য মন্দির। এ বলে আমায় দেখ ও বলে আমায় দেখ। ঝিরঝিরে বৃষ্টি শুরু হওয়ায় একটি মন্দিরে ঢুকলাম আর সেই পুরনো অভিজ্ঞতা হলো অর্থাথ পায়ের নিচে ভিজে চিটচিটে ভাব , ফুল বেল পাতার গন্ধ আর ধুপের গন্ধ সবেমিলে এক রহস্যময়তার পরিবেশ। আলো আঁধারী পরিবেশ। বৃদ্ধ পুজারী দক্ষিনার আশায় মুখপানে চেয়ে। আশা পূরণ করে বাইরে এলাম।

ভালো করে সময় নিয়ে পুরো প্রাঙ্গনটা ঘুরলাম। মূল মন্দিরের নির্মানশৈলী অপূর্ব। যদিও সংস্কারের কাজ চলছে। এটি শিবের মন্দির। আমাদের যেমন কালীঘাট বা দক্ষিনেশ্বর অথবা তারকেশ্বর পুন্যধাম ঠিক তেমনি ভুবনেশ্বরবাসির কাছে এই মন্দির অতন্ত্য প্রিয় এবং ধর্মীয় স্থান।মহাদেব এখানে নিত্য পূজিত হয়। ভুবনেশ্বর এর প্রাচীনতম এবং বৃহতম মন্দির হিসাবে লিঙ্গরাজ ক্ষাত। লিঙ্গরাজ অর্থাৎ লিঙ্গদের রাজা। যেখানে লিঙ্গ মানে ভগবান শিব কে বোঝানো হয়েছে। 11th century তে সোম বংশীয় রাজা জজতি কেশরী দ্বারা নির্মিত এই মন্দির ওড়িশা তথা ভারতের এক উল্লেখযোগ্য ঐতিহাসিক নিদর্শন।হাজার বছরের বেশি প্রাচীন এই মন্দিরের উল্লেখ হিন্দু ধর্মশাস্ত্র ব্রহ্মপুরানেও আছে। কলিঙ্গ শিল্পকলার সাক্ষ্য বহন করে চলেছে এই মন্দির। সমসাময়িক শিল্পকলা ও তত্কালীন জীবনযাত্রার নিদর্শন খোদিত মন্দিরগাত্রে।

৫৫ মিটার উচ্চতা বিশিষ্ট এই মন্দির নিকষ কালো sandstone দ্বারা নির্মিত। ভুবনেশ্বর শহরের এক অন্যতম দ্রষ্টব্য এই মন্দির কাছে টেনে আনে দেশ বিদেশ হতে আগত বহু দর্শনার্থীকে। হিন্দুরা ছাড়া অন্য ধর্মের মানুষ এই মন্দিরে প্রবেশ করতে পারে না। সমগ্র প্রাঙ্গনে ছোট বড়ো মিলিয়ে ৫০ টি মন্দিরের সমাহার। সমগ্র মন্দিরটি চারটি ভাগে বিভক্ত।গর্ভ গৃহ ,যজ্ঞশালা, ভোগ মন্ডপ আর নাট্য শালা এই চার ভাগ। জল, দুধ আর ভাং এর মিশ্রণে স্নান করানো হয় লিঙ্গরাজকে প্রতিদিন। অতীতের দেবদাসী প্রথার সাক্ষ্য বহন করে চলেছে নাট মন্দির। ঐতিহ্য ,সংস্কার আর ভারতীয় শিল্পকলা ও সংস্কৃতির এক সমৃধ্য নিদর্শন এই মন্দির এক দর্শনে মন ভরে না বরং আসতে হয় বার বার ফিরে ফিরে।

লিঙ্গরাজ দর্শন শেষ এবার যাব মুক্তেস্বর । ড্রাইভার চালাকি করে বলল এখানেই নাকি আমার মুক্তেস্বর দর্শন হয়ে গেছে। হয়ত গাড়ির তেল বাচানোর ধান্দায় ছিলো কিন্তু আমিও নাছোরবান্দা। ভালো করে রিসার্চ করে এসেছি জানি ইটা মুক্তেস্বর নয়। তাই একরকম বাধ্য হয়ে চলল আমার ইশারায় মুক্তেস্বর উদ্দেশ্য। গঠনগত দিক থেকে কিছুটা আলাদা কিন্তু শান্ত স্নিগ্ধ মন্দির চত্বর মন ছুয়ে যাবে আপনার। পরিস্কার পরিছ্ন্য তাই খালি পায়ে হেটে বেড়াতে বেশ ভালো লাগে। ভাবলাম এই শান্ত নির্জন পরিবেশে দু দন্ড বসে থাকতে পারলে ভালো হয়। কিছু ফিসফিসানি শুনে মন্দির পিছনে দেখলাম এক যুগল প্রনয়ে ব্যস্ত। বিরক্তি না ঘটিয়ে মনের সাধ করে ছবি তুলে ফিরে এলাম। পাশেই আরেক মন্দির ব্রহ্মভেস্বর। গঠনগত মিল আছে। চিত্রকলা ও স্থাপত্য প্রায় একই রকম লাগলো। মিনিট পনের সময় নিয়ে ঘুরে এবার গাড়ির পথে ফেরা।

গাড়ী এবার থামলো একটা A /C রেস্টুরেন্ট এর সামনে। ঘন্টাখানেক ভুরিভোজ শেষে আবার শুরু পথচলা। এবার ফেরার পথে দেখে নেব জয়গোপাল আর সাখিগোপাল এই দুই মন্দিরকে। পিপলি হয়ে ফিরছি। বাইরে প্রবল বৃষ্টি আর ভিতরে আমরা চারজন। আমার পুঁচকে তা আছে সাথে। মাঝে মাঝে হাজার বায়নার আবদার। আমার অবস্থা প্রানান্তকর তার দুষ্টুমিতে। চলেছি মসৃন কালো পিচের রাস্তা ধরে হিমশীতল গাড়ির সওয়ারী হয়ে। এসে গেল জয় গোপাল মন্দির। প্রাচীন মন্দির সে বিষয় সন্দেহতীত। আড়ম্বরহীন এই মন্দির এবং শান্তস্নিগ্ধ পরিবেশ বিরাজমান। ছেলে ছিল সাথে, পুজারী তাকে চরণামৃত দিতে আনন্দে মুখে নিয়েছিল কিন্তু দর্শন শেষে দরজার বাইরে এসেই ওয়াক থু। খুব গাড় কর্পূর মিশ্রিত সে জল তার পক্ষে গিলে ফেলা সম্ভব হয়নি তাই এই পরিনতি।

পুরী জেলার সাখিগোপাল গ্রামে এই মন্দিরের অবস্থান। প্রচলিত বিশ্বাস অনুসারে সাক্ষীগোপাল দর্শন বিনা পুরী ভ্রমন সম্পূর্ণ হয় না। ওড়িশার একটি জনপ্রিয় এবং বিখ্যাত মন্দির এই সাখিগোপাল। এর অর্থ witness Gopal .বহু ঐতিহাসিক ঘটনার সাক্ষী এই মন্দির। নামকরণ এর পিছনে একটি ঐতিহাসিক ঘটনা আছে যা বেশ মজার। অনলা নবমী,দোলপূর্নিমা,চন্দন যাত্রা, কার্তিক পূর্নিমায় ঘটা করে এখানে ফেস্টিভাল হয় যা বেশ আনন্দায়ক এবং বহু দর্শনার্থীর সমাবেশ ঘটে। ভগবান শ্রী কৃষ্ণ ও রাধার মূর্তি নয়নাভিরাম যদিও বিকেল পাঁচটা বেজে যাওয়ায় আমার আর মূর্তি দর্শন এর সৌভাগ্য হয়নি। তবুও পুরী থেকে মাত্র বাইশ কিলোমিটার এর দুরত্বে এই মন্দির অবশ্য দ্রষ্টব্য। নারকেল গাছের বিভিন্ন শিল্পের জন্য এবং নারকোল জাত সামগ্রীর জন্য এই গ্রাম বিখ্যাত।

#পুরী #লিঙ্গরাজ #মুক্তেস্বর #সাক্ষীগোপাল #ওড়িশা #ভুবনেশ্বর # মন্দির
#puri #lingaraj #mukteswar #sakshigopal #Orissa #Odisha #Bhubaneswar #jaygopal #temple