রাচেলা পিক।। দার্জিলিং ।। কালিংপং ।। Rachela Peak Darjeeling Kalimpong
+++++++++++++++++++++++++++++++
পশ্চিমবঙ্গের চতুর্থ উচ্চতম স্থান হল এই রাচেলা পিক। সান্দাকফু, ফালুট, সবরগ্রামের পরেই এর স্থান। টাইগার হিল এর অবস্থানও এর নীচে। লাভার খুব কাছে, দুরত্ব মাত্র 8 (Eight) কিলোমিটার।
কলকাতায় ট্রাভেল এজেন্সির সঙ্গে যখন সম্ভাব্য
ভ্রমণ সূচী নিয়ে আলোচনা হচ্ছিল, তখন ট্রাভেল এজেন্সিরই একজন পরামর্শ দিলেন যে, আপনারা যখন লাভায় দুটো রাত কাটাবেন তখন রাচেলা পিকটা দেখে নেবেন।
লাভা,রিশপ, সিলারিগাঁও, ইচ্ছেগাঁও শুনেছি কিন্তু ওদিকে রাচেলা পিক নামে কোনো পিক আছে এমনতো কোনোদিন শুনিনি। তখন সেই ভদ্রলোক আমাদের পুরো ব্যাপারটা বুঝিয়ে বললেন। শুনে আমরা তো ভেতরে ভেতরে খুবই উত্তেজিত। বেশ একটা নতুন নতুন গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে। আগামী অজানা অ্যাডভেঞ্চারের নেশায় আমরা তিন সহকর্মী বন্ধু তখন টগবগ করে ফুটছি। মনে হচ্ছে হিমালয়ের কোনো অজানা শৃঙ্গ জয় করতে যাচ্ছি। আসলে ভদ্রলোক যখন বললেন যে, লাভার উচ্চতা যেখানে ৭২০০ ফুট সেখানে রাচেলা পিকের উচ্চতা ১০৫০০ ফুটেরও বেশী। ভদ্রলোক এও বললেন, আগে রাচেলা পিকের উচ্চতা বলা হত ১১৫০০ ফুট। পরে তা সংশোধন করা হয়। পরে লাভা ঘুরতে গিয়ে আমরা লাভা মোটর স্ট্যান্ডে একটা বোর্ড দেখেছিলাম, যেখানে রাচেলা পিক সম্পর্কে কিছু তথ্য দেওয়া ছিল।উচ্চতাও লেখা ছিল, লেখাটা বোধহয় ১১৫০০ ফুট ছিল। যদিও তার ওপর কালো রঙের একটা পোচ দেওয়া ছিল। রাচেলা পিক সম্পর্কে দু- একটি কথা না বললে লেখাটা অসমাপ্ত থেকে যাবে। এটি রাচেলা ডান্ডা নামে বেশী পরিচিত। নেওড়া ভ্যালী জাতীয় উদ্যানের সর্বোচ্চ স্থান। এটি ভুটান এবং সিকিম সীমান্তবর্তী এলাকা। এর পুরো এলাকাটি নানা জাতের ঔষধি গাছ ছাড়াও রডোডেনড্রন, পাইন আর বাঁশ গাছে পরিপূর্ণ। এখানে নানারকম পাখি দেখা যায়। আর নানা জন্তু জানোয়ার ছাড়াও এখানে দেখা যায় রেডপান্ডা। এই জঙ্গলে অনেকে ট্রেক করেন।
যাই হোক যেদিন রিশপ থেকে লাভা পৌঁছালাম সেদিন খাওয়া দাওয়ার পর গেলাম লোলেগাঁওয়ের কাছে নেওড়া ভ্যালী জঙ্গলে ক্যানোপি ওয়াকের মজা এবং হেরিটেজ জঙ্গলের রোমাঞ্চ অনুভব করতে। সন্ধ্যায় হোটেলে ফিরে হোটেলের ম্যানেজারের সাথে কথা বলে ঠিক হল আমরা আগামীকাল সকালেই রাচেলা পিক যাব।
ঠিক হল সকাল ৫টায় গাড়ী আমাদের পিকে নিয়ে যাবে। পরদিন আমরা সবাই ৫টায় রেডি হয়ে গেলাম। কিন্তু গাড়ী এল একটু দেরী করে। সময়টা এখন আর মনে নেই। গাড়ী এগিয়ে চলল ধীর গতিতে। ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহ। প্রচন্ড ঠান্ডা। এই মুহূর্তে তাপমাত্রা কত কে জানে! রাস্তায় সামান্য আলো ছিল। এখানকার সমস্ত মানুষ এখন যে যার মত এই প্রচন্ড ঠান্ডায় লব্ধ উষ্ণতায় নিজেকে আবৃত করে ঘুমের দেশে বিরাজমান। টাইগার হিলে যাবার সময় পথে অনেক গাড়ী চোখে পড়ে। কিন্তু এখানে সেরকম কিছু চোখে না পড়ার কারনটা গাড়ীর চালককে জিজ্ঞাসা করায় সে বলল, এখানে
লোকে খুব একটা আসেনা। শুনেই কেমন যেন একটা হালকা ভয় বুকের মধ্যে গুড়গুড় করে উঠল। একে নিকষ কালো অন্ধকার, তারপর প্রবল ঠান্ডা তৃতীয় কারণ হল রাস্তায় কোনো গাড়ির দেখা না পাওয়া, তিনে মিলে যেন ত্র্যহস্পর্শ। তার প্রমাণ পেলাম, গাড়ীতে ওঠার পর টুকটাক কথাবার্তা চলছিল, কিন্তু এখন সবাই চুপচাপ। গাড়ির চলা দেখেই বুঝতে পারছি রাস্তার অবস্থা খুব একটা ভালো নয়। রাতের অন্ধকারে হেডলাইটের আলোয় পাহাড়ি সরু পাকদণ্ডী চড়াই পথ অতিক্রম করা বেশ কষ্টসাধ্য ব্যাপার শুধু নয় বেশ ঝুঁকিপূর্ণও বটে। গাড়ী খুব ধীরে অসমান রাস্তায় টাল খেতে খেতে এগিয়ে চলেছে। যাইহোক গাড়ী গোঁ গোঁ করতে করতে অবশেষে একটা জায়গায় দাঁড়িয়ে পড়ল। চালক বললেন গাড়ী আর যাবেনা। গাড়ীর হেডলাইটের আলোয় দেখলাম আমাদের আগে আর একটা গাড়ী দাঁড়িয়ে আছে। যাক বাবা এতক্ষণে ধড়ে প্রাণ এল, আমরা শুধু একা নই আমাদের সাথে আরো কেউ আছে। গাড়ীটা দেখার পর বুঝতে পারলাম এতক্ষণ আমরা কেউই আমাদের মধ্যে ছিলামনা। হাতপা বোধহয় আড়ষ্ট হয়ে গিয়েছিল। জাদুকাঠির ছোঁওয়ায় হঠাৎই যেন সবাই সচল হয়ে উঠল। সবাই একটা দুটো কথা বলতে শুরু করল। গাড়ীর হেডলাইটের আলো চারিদিকের কুচকুচে কালো অন্ধকারকে খুব সামান্যই দূর করতে পেরেছে। গাড়ীর ভেতরে ঠান্ডা তো লাগছিলই, গাড়ী থেকে নামতে গিয়ে বুঝতে পারলাম, কাকে বলে ঠান্ডা। মুখটুকু ছাড়া সারা শরীর গরম কাপড়ে ঢাকা। তবুও মনে হচ্ছে আরো কিছু চাপালে হত। আক্ষরিক অর্থে তখন আমরা ঠকঠক করে কাঁপছি। হাতদুটো জ্যাকেটের পকেট থেকে বার করতে ইচ্ছে করছেনা। যাইহোক কোনোরকমে ডান হাতের সাহায্যে মোবাইলের টর্চটা জ্বেলে আর চালকের সাবধান বানী মাথায় রেখে, কারণ রাস্তা এখানে খুবই সংকীর্ণ, অন্ধকারে একটা পদক্ষেপের ভুলে যেকোনো মুহূর্তে দুর্ঘটনা ঘটে যেতে পারে। খুব সাবধানে একেক করে আমরা গাড়ী থেকে বেড়িয়ে চালকের পেছন পেছন এগোতে থাকলাম। গাড়ীর চালকই বর্তমানে এখন আমাদের গাইড। কয়েক পা এগোতেই প্রথম দলটির দেখা পেলাম। সংখ্যায় তারা জনাপাঁচেক। কোনো কথা হলনা। ঠান্ডাতে বোধহয় সবারই কথা বলার ইচ্ছেটা কমে গেছে। এরপর বড় রাস্তা ছেড়ে চালকের নির্দেশে সরু পায়েচলা আঁকাবাঁকা চড়াই পথ বেয়ে মাথার ওপর সম্মিলিত তারাদের আলো আর আমাদের হাতে ধরা মোবাইলের আলোর ভরসায় অতি সন্তর্পণে একজায়গায় এসে থামলাম। দেখলাম সেখানে গাছের কয়েকটা সরু ডালের সাহায্যে রেলিঙের মত করা রয়েছে। বুঝলাম আমাদের প্রার্থিত জায়গায় পৌঁছে গেছি। প্রথম দলটিও এসে আমাদের পাশে দাঁড়াল। অত্যন্ত সরু জায়গা, পায়ে চলা পথ যেমন হয় আরকি! আমাদের চারপাশে যে ছোটবড় নানান আকারের ঝোপজঙ্গল রয়েছে তা স্বল্প আলোয় বোঝা যাচ্ছে। জায়গার সংকীর্ণতার কারণে আমরা পাশাপাশি দাঁড়লাম। অনেকটা মানবশৃঙখল তৈরী হল। সামনে দূরে আকাশের গায় তখন শুরু হয়ে গেছে রঙের খেলা। নীচে জমাট কালো রঙের ওপর ভোরের মৃদু আলোকিত আকাশের গায় তখন লম্বাটে গাড় সরু লাল দাগ ডানদিক থেকে বাঁদিক চলে গেছে। কয়েক মুহূর্ত পর রঙের দাগটা বিস্তার লাভ করল। দেখা দিল উজ্জ্বল কমলা রঙ। তারপর গাড় হলুদ। তারপর একটু একটু করে উজ্জ্বল কমলা রঙের গোলাকৃতি সূর্যদেব কালো অন্ধকার ভেদ করে আস্তে আস্তে উপরে উঠে এলেন। আকাশে রঙের খেলা দেখে মুগ্ধ হয়ে যাচ্ছি। মনে হচ্ছে বিশাল আকৃতির এক প্রাকৃতিক পর্দায় যেন প্রকৃতির তৈরী এক ছায়াছবি প্রত্যক্ষ করছি। আমরা টাইগার হিলের সূর্যোদয়ের দৃশ্য প্রত্যক্ষ করেছি। আমি কোনো তুলনায় যাচ্ছিনা। যে যার মত সৌন্দর্য নিয়ে হাজির হয় আমাদের কাছে। আমরা মুগ্ধ, বিস্মিত এবং নির্বাক হয়ে গেছি। এক অদ্ভুত ভালোলাগার আবেশে আচ্ছন্ন আমরা। চমক ভাঙল চালকের কথায়। দাদা, আপনারা এবার ঘুরে পাহাড়ের পেছন দিকটায় চলে যান। ততক্ষণে ভোরের আলো ফুটে গেছে। যদিও কুয়াশার চাদরে ঢাকা ছিল রাচেলা পিক সহ পুরো শৈলশহর লাভা। সেই আলোয় সরু খানিকটা চক্রাকার চড়াই পথ হেঁটে পৌঁছে গেলাম পাহাড়ের পেছনে। পৌঁছে বুঝতে পারলাম এটা হল পাহাড়ের শীর্ষ দেশ। খানিকটা চ্যাটালো ছোট্ট ঘাসে ঢাকা উঠোনের মত। চোখ গেল আকাশের পর্দায় সেখানে তখন স্বর্ন মুকুট মাথায় নিয়ে হাজির কাঞ্চনজঙ্ঘা। কি অপরূপ সে দৃশ্য! আমরা মুগ্ধ, আমরা অভিভূত। কাঞ্চনজঙ্ঘা এত কাছে! মনে হচ্ছে যেন হাত বাড়ালেই ছোঁয়া যাবে। রিশপে থাকার সময় টিফিনদাঁড়া ভিউ পয়েন্ট থেকে আমরা সূর্যোদয় দেখিনি। যেটা অনেকেই দেখে থাকেন। কারণ সেটা আমাদের ভ্রমণসূচিতে ছিলনা। সেইজন্য মনের মধ্যে একটু খচখচানি, একটু আক্ষেপ ছিলই। ভেবেছিলাম আমরা বোধহয় ঠকে গেলাম। কিন্তু এখন সমস্ত আক্ষেপ ধুয়েমুছে সাফ। একরাশ অনাবিল আনন্দ, মুগ্ধতায় আমরা তখন ভাসছি। প্রত্যেকের চোখেমুখে খুশীর ছাপ। পিক-এর মাথায় দাঁড়িয়ে নীচে কুয়াশাবৃত ঘুমন্ত নিঝুম লাভাকে দেখলাম। সূর্য ওঠার পর দিনের আলো একটু বেড়েছে। সেই আলোয় পিকটা আরো ভালো করে দেখলাম। ছোট্ট গোলাকার মত জায়গা।
পাহাড়ের গায়ে ঝোপ জঙ্গল থাকলেও পিক-এ কোনো গাছপালা নেই। পায়ের নীচে ঘাসের চাদর।
একপাশে পর্যটকদের বসবার জন্য গাছের ডাল দিয়ে তৈরী বেঞ্চ রয়েছে। মাথার ওপর দোচালা শেডও রয়েছে। দেখে ভালোই লাগল। এই নির্জন জঙ্গলাকীর্ণ পাহাড়ের মাথায় এটুকুই বা কম কি! আমাদের গাড়ির চালকভাইটি বলছিলেন, আকাশ পরিষ্কার থাকলে ঝকঝকে দিনের আলোতে এখান থেকে নাথুলা পাস এবং তিস্তা নদী দেখা যায়। কিন্তু এই কুয়াশাচ্ছন্ন
ভোরবেলায় দূর থেকে সামনে পেছনে ডাইনে বাঁয়ে শুধু পাহাড়শ্রেণীই দেখতে পেলাম । কি আর করা যাবে মানুষের সব আশাতো একবারে পূরণ হয়না। দিনের বেলা এলে হয়ত দেখা যেতে পারত। কিন্তু তা আর সম্ভব নয়। ট্রাভেল এজেন্টের সাথে চুক্তিমত এখানে দ্বিতীয় বার আসা যাবেনা। তাছাড়া আরো অনেক কিছু দেখার বাকী আছে। তবে যা দেখলাম, যা পেলাম তাইতো অনেক। আমাদের প্রাপ্তির ঝুলি যে পূর্ণ। শুধু তাইনয় আরো এক সাফল্যে আমরা রোমাঞ্চিত। আমাদের বাংলার চতুর্থ উচ্চতম শৈলশিখরে তখন আমরা সশরীরে দন্ডায়মান। এটা যে কতখানি অদ্ভুত এক অনুভূতি তা বলে বোঝানো যাবেনা। আমরা হয়ত কোনোদিন সান্দাকফু, ফালুট কিংবা এই দুইয়ের মাঝামাঝি সবরগ্রামেও যেতে পারবনা। তাই প্রচন্ড ঠান্ডাতেও এই জয়ের আনন্দ আমাদেরকে এক উষ্ণতা এনে দিয়েছে। আনন্দে লাফিয়ে উঠতে ইচ্ছে করছে। পারিপার্শ্বিকতারর কথা ভেবে নিজেকে সংযত করলাম। তাপমাত্রা কত ছিল তা বুঝতে গেলে আমাদের পায়ের তলার ঘাসের দিকে তাকালেই বোঝা যাবে। রাতের শিশির ঘাসের ডগায় পড়ে জমে সাদা বরফ হয়ে গেছে। সকালের সেই ঠান্ডায় আমরা সবাই জবুথুবু হয়ে গেছি। জ্যাকেটের পকেট থেকে হাত বার করতে ভয় পাচ্ছি। তার মধ্যে কোনোরকমে কয়েকটা ছবি তুললাম। আমাদের যা পাতি ক্যামেরা তাতে কতটা কি আসবে জানিনা, তায় আবার ক্যামেরাটা আমাদের সাথে মাঝেমধ্যেই ছলনা করছে। যাইহোক দেখার পালা সাঙ্গ হল, এবার ঘরে থুড়ি হোটেলে ফেরার পালা। গাড়ি চালকভাইটির কথায় হুঁশ ফিরল। টা টা রাচেলা পিক। আবার আসব যদি তুমি ডাকো।
#rachela #peak #Darjeeling #lava #lolegaon #rishap #kalimpong
#hill #station #heaven #sunrise
#রাচেলা #দার্জিলিং #পর্বত #চূড়া #লাভা #ললেগাঁও #রিশপ #কালিম্পঙ #সূর্যোদয়
+++++++++++++++++++++++++++++++
পশ্চিমবঙ্গের চতুর্থ উচ্চতম স্থান হল এই রাচেলা পিক। সান্দাকফু, ফালুট, সবরগ্রামের পরেই এর স্থান। টাইগার হিল এর অবস্থানও এর নীচে। লাভার খুব কাছে, দুরত্ব মাত্র 8 (Eight) কিলোমিটার।
কলকাতায় ট্রাভেল এজেন্সির সঙ্গে যখন সম্ভাব্য
ভ্রমণ সূচী নিয়ে আলোচনা হচ্ছিল, তখন ট্রাভেল এজেন্সিরই একজন পরামর্শ দিলেন যে, আপনারা যখন লাভায় দুটো রাত কাটাবেন তখন রাচেলা পিকটা দেখে নেবেন।
লাভা,রিশপ, সিলারিগাঁও, ইচ্ছেগাঁও শুনেছি কিন্তু ওদিকে রাচেলা পিক নামে কোনো পিক আছে এমনতো কোনোদিন শুনিনি। তখন সেই ভদ্রলোক আমাদের পুরো ব্যাপারটা বুঝিয়ে বললেন। শুনে আমরা তো ভেতরে ভেতরে খুবই উত্তেজিত। বেশ একটা নতুন নতুন গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে। আগামী অজানা অ্যাডভেঞ্চারের নেশায় আমরা তিন সহকর্মী বন্ধু তখন টগবগ করে ফুটছি। মনে হচ্ছে হিমালয়ের কোনো অজানা শৃঙ্গ জয় করতে যাচ্ছি। আসলে ভদ্রলোক যখন বললেন যে, লাভার উচ্চতা যেখানে ৭২০০ ফুট সেখানে রাচেলা পিকের উচ্চতা ১০৫০০ ফুটেরও বেশী। ভদ্রলোক এও বললেন, আগে রাচেলা পিকের উচ্চতা বলা হত ১১৫০০ ফুট। পরে তা সংশোধন করা হয়। পরে লাভা ঘুরতে গিয়ে আমরা লাভা মোটর স্ট্যান্ডে একটা বোর্ড দেখেছিলাম, যেখানে রাচেলা পিক সম্পর্কে কিছু তথ্য দেওয়া ছিল।উচ্চতাও লেখা ছিল, লেখাটা বোধহয় ১১৫০০ ফুট ছিল। যদিও তার ওপর কালো রঙের একটা পোচ দেওয়া ছিল। রাচেলা পিক সম্পর্কে দু- একটি কথা না বললে লেখাটা অসমাপ্ত থেকে যাবে। এটি রাচেলা ডান্ডা নামে বেশী পরিচিত। নেওড়া ভ্যালী জাতীয় উদ্যানের সর্বোচ্চ স্থান। এটি ভুটান এবং সিকিম সীমান্তবর্তী এলাকা। এর পুরো এলাকাটি নানা জাতের ঔষধি গাছ ছাড়াও রডোডেনড্রন, পাইন আর বাঁশ গাছে পরিপূর্ণ। এখানে নানারকম পাখি দেখা যায়। আর নানা জন্তু জানোয়ার ছাড়াও এখানে দেখা যায় রেডপান্ডা। এই জঙ্গলে অনেকে ট্রেক করেন।
যাই হোক যেদিন রিশপ থেকে লাভা পৌঁছালাম সেদিন খাওয়া দাওয়ার পর গেলাম লোলেগাঁওয়ের কাছে নেওড়া ভ্যালী জঙ্গলে ক্যানোপি ওয়াকের মজা এবং হেরিটেজ জঙ্গলের রোমাঞ্চ অনুভব করতে। সন্ধ্যায় হোটেলে ফিরে হোটেলের ম্যানেজারের সাথে কথা বলে ঠিক হল আমরা আগামীকাল সকালেই রাচেলা পিক যাব।
ঠিক হল সকাল ৫টায় গাড়ী আমাদের পিকে নিয়ে যাবে। পরদিন আমরা সবাই ৫টায় রেডি হয়ে গেলাম। কিন্তু গাড়ী এল একটু দেরী করে। সময়টা এখন আর মনে নেই। গাড়ী এগিয়ে চলল ধীর গতিতে। ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহ। প্রচন্ড ঠান্ডা। এই মুহূর্তে তাপমাত্রা কত কে জানে! রাস্তায় সামান্য আলো ছিল। এখানকার সমস্ত মানুষ এখন যে যার মত এই প্রচন্ড ঠান্ডায় লব্ধ উষ্ণতায় নিজেকে আবৃত করে ঘুমের দেশে বিরাজমান। টাইগার হিলে যাবার সময় পথে অনেক গাড়ী চোখে পড়ে। কিন্তু এখানে সেরকম কিছু চোখে না পড়ার কারনটা গাড়ীর চালককে জিজ্ঞাসা করায় সে বলল, এখানে
লোকে খুব একটা আসেনা। শুনেই কেমন যেন একটা হালকা ভয় বুকের মধ্যে গুড়গুড় করে উঠল। একে নিকষ কালো অন্ধকার, তারপর প্রবল ঠান্ডা তৃতীয় কারণ হল রাস্তায় কোনো গাড়ির দেখা না পাওয়া, তিনে মিলে যেন ত্র্যহস্পর্শ। তার প্রমাণ পেলাম, গাড়ীতে ওঠার পর টুকটাক কথাবার্তা চলছিল, কিন্তু এখন সবাই চুপচাপ। গাড়ির চলা দেখেই বুঝতে পারছি রাস্তার অবস্থা খুব একটা ভালো নয়। রাতের অন্ধকারে হেডলাইটের আলোয় পাহাড়ি সরু পাকদণ্ডী চড়াই পথ অতিক্রম করা বেশ কষ্টসাধ্য ব্যাপার শুধু নয় বেশ ঝুঁকিপূর্ণও বটে। গাড়ী খুব ধীরে অসমান রাস্তায় টাল খেতে খেতে এগিয়ে চলেছে। যাইহোক গাড়ী গোঁ গোঁ করতে করতে অবশেষে একটা জায়গায় দাঁড়িয়ে পড়ল। চালক বললেন গাড়ী আর যাবেনা। গাড়ীর হেডলাইটের আলোয় দেখলাম আমাদের আগে আর একটা গাড়ী দাঁড়িয়ে আছে। যাক বাবা এতক্ষণে ধড়ে প্রাণ এল, আমরা শুধু একা নই আমাদের সাথে আরো কেউ আছে। গাড়ীটা দেখার পর বুঝতে পারলাম এতক্ষণ আমরা কেউই আমাদের মধ্যে ছিলামনা। হাতপা বোধহয় আড়ষ্ট হয়ে গিয়েছিল। জাদুকাঠির ছোঁওয়ায় হঠাৎই যেন সবাই সচল হয়ে উঠল। সবাই একটা দুটো কথা বলতে শুরু করল। গাড়ীর হেডলাইটের আলো চারিদিকের কুচকুচে কালো অন্ধকারকে খুব সামান্যই দূর করতে পেরেছে। গাড়ীর ভেতরে ঠান্ডা তো লাগছিলই, গাড়ী থেকে নামতে গিয়ে বুঝতে পারলাম, কাকে বলে ঠান্ডা। মুখটুকু ছাড়া সারা শরীর গরম কাপড়ে ঢাকা। তবুও মনে হচ্ছে আরো কিছু চাপালে হত। আক্ষরিক অর্থে তখন আমরা ঠকঠক করে কাঁপছি। হাতদুটো জ্যাকেটের পকেট থেকে বার করতে ইচ্ছে করছেনা। যাইহোক কোনোরকমে ডান হাতের সাহায্যে মোবাইলের টর্চটা জ্বেলে আর চালকের সাবধান বানী মাথায় রেখে, কারণ রাস্তা এখানে খুবই সংকীর্ণ, অন্ধকারে একটা পদক্ষেপের ভুলে যেকোনো মুহূর্তে দুর্ঘটনা ঘটে যেতে পারে। খুব সাবধানে একেক করে আমরা গাড়ী থেকে বেড়িয়ে চালকের পেছন পেছন এগোতে থাকলাম। গাড়ীর চালকই বর্তমানে এখন আমাদের গাইড। কয়েক পা এগোতেই প্রথম দলটির দেখা পেলাম। সংখ্যায় তারা জনাপাঁচেক। কোনো কথা হলনা। ঠান্ডাতে বোধহয় সবারই কথা বলার ইচ্ছেটা কমে গেছে। এরপর বড় রাস্তা ছেড়ে চালকের নির্দেশে সরু পায়েচলা আঁকাবাঁকা চড়াই পথ বেয়ে মাথার ওপর সম্মিলিত তারাদের আলো আর আমাদের হাতে ধরা মোবাইলের আলোর ভরসায় অতি সন্তর্পণে একজায়গায় এসে থামলাম। দেখলাম সেখানে গাছের কয়েকটা সরু ডালের সাহায্যে রেলিঙের মত করা রয়েছে। বুঝলাম আমাদের প্রার্থিত জায়গায় পৌঁছে গেছি। প্রথম দলটিও এসে আমাদের পাশে দাঁড়াল। অত্যন্ত সরু জায়গা, পায়ে চলা পথ যেমন হয় আরকি! আমাদের চারপাশে যে ছোটবড় নানান আকারের ঝোপজঙ্গল রয়েছে তা স্বল্প আলোয় বোঝা যাচ্ছে। জায়গার সংকীর্ণতার কারণে আমরা পাশাপাশি দাঁড়লাম। অনেকটা মানবশৃঙখল তৈরী হল। সামনে দূরে আকাশের গায় তখন শুরু হয়ে গেছে রঙের খেলা। নীচে জমাট কালো রঙের ওপর ভোরের মৃদু আলোকিত আকাশের গায় তখন লম্বাটে গাড় সরু লাল দাগ ডানদিক থেকে বাঁদিক চলে গেছে। কয়েক মুহূর্ত পর রঙের দাগটা বিস্তার লাভ করল। দেখা দিল উজ্জ্বল কমলা রঙ। তারপর গাড় হলুদ। তারপর একটু একটু করে উজ্জ্বল কমলা রঙের গোলাকৃতি সূর্যদেব কালো অন্ধকার ভেদ করে আস্তে আস্তে উপরে উঠে এলেন। আকাশে রঙের খেলা দেখে মুগ্ধ হয়ে যাচ্ছি। মনে হচ্ছে বিশাল আকৃতির এক প্রাকৃতিক পর্দায় যেন প্রকৃতির তৈরী এক ছায়াছবি প্রত্যক্ষ করছি। আমরা টাইগার হিলের সূর্যোদয়ের দৃশ্য প্রত্যক্ষ করেছি। আমি কোনো তুলনায় যাচ্ছিনা। যে যার মত সৌন্দর্য নিয়ে হাজির হয় আমাদের কাছে। আমরা মুগ্ধ, বিস্মিত এবং নির্বাক হয়ে গেছি। এক অদ্ভুত ভালোলাগার আবেশে আচ্ছন্ন আমরা। চমক ভাঙল চালকের কথায়। দাদা, আপনারা এবার ঘুরে পাহাড়ের পেছন দিকটায় চলে যান। ততক্ষণে ভোরের আলো ফুটে গেছে। যদিও কুয়াশার চাদরে ঢাকা ছিল রাচেলা পিক সহ পুরো শৈলশহর লাভা। সেই আলোয় সরু খানিকটা চক্রাকার চড়াই পথ হেঁটে পৌঁছে গেলাম পাহাড়ের পেছনে। পৌঁছে বুঝতে পারলাম এটা হল পাহাড়ের শীর্ষ দেশ। খানিকটা চ্যাটালো ছোট্ট ঘাসে ঢাকা উঠোনের মত। চোখ গেল আকাশের পর্দায় সেখানে তখন স্বর্ন মুকুট মাথায় নিয়ে হাজির কাঞ্চনজঙ্ঘা। কি অপরূপ সে দৃশ্য! আমরা মুগ্ধ, আমরা অভিভূত। কাঞ্চনজঙ্ঘা এত কাছে! মনে হচ্ছে যেন হাত বাড়ালেই ছোঁয়া যাবে। রিশপে থাকার সময় টিফিনদাঁড়া ভিউ পয়েন্ট থেকে আমরা সূর্যোদয় দেখিনি। যেটা অনেকেই দেখে থাকেন। কারণ সেটা আমাদের ভ্রমণসূচিতে ছিলনা। সেইজন্য মনের মধ্যে একটু খচখচানি, একটু আক্ষেপ ছিলই। ভেবেছিলাম আমরা বোধহয় ঠকে গেলাম। কিন্তু এখন সমস্ত আক্ষেপ ধুয়েমুছে সাফ। একরাশ অনাবিল আনন্দ, মুগ্ধতায় আমরা তখন ভাসছি। প্রত্যেকের চোখেমুখে খুশীর ছাপ। পিক-এর মাথায় দাঁড়িয়ে নীচে কুয়াশাবৃত ঘুমন্ত নিঝুম লাভাকে দেখলাম। সূর্য ওঠার পর দিনের আলো একটু বেড়েছে। সেই আলোয় পিকটা আরো ভালো করে দেখলাম। ছোট্ট গোলাকার মত জায়গা।
পাহাড়ের গায়ে ঝোপ জঙ্গল থাকলেও পিক-এ কোনো গাছপালা নেই। পায়ের নীচে ঘাসের চাদর।
একপাশে পর্যটকদের বসবার জন্য গাছের ডাল দিয়ে তৈরী বেঞ্চ রয়েছে। মাথার ওপর দোচালা শেডও রয়েছে। দেখে ভালোই লাগল। এই নির্জন জঙ্গলাকীর্ণ পাহাড়ের মাথায় এটুকুই বা কম কি! আমাদের গাড়ির চালকভাইটি বলছিলেন, আকাশ পরিষ্কার থাকলে ঝকঝকে দিনের আলোতে এখান থেকে নাথুলা পাস এবং তিস্তা নদী দেখা যায়। কিন্তু এই কুয়াশাচ্ছন্ন
ভোরবেলায় দূর থেকে সামনে পেছনে ডাইনে বাঁয়ে শুধু পাহাড়শ্রেণীই দেখতে পেলাম । কি আর করা যাবে মানুষের সব আশাতো একবারে পূরণ হয়না। দিনের বেলা এলে হয়ত দেখা যেতে পারত। কিন্তু তা আর সম্ভব নয়। ট্রাভেল এজেন্টের সাথে চুক্তিমত এখানে দ্বিতীয় বার আসা যাবেনা। তাছাড়া আরো অনেক কিছু দেখার বাকী আছে। তবে যা দেখলাম, যা পেলাম তাইতো অনেক। আমাদের প্রাপ্তির ঝুলি যে পূর্ণ। শুধু তাইনয় আরো এক সাফল্যে আমরা রোমাঞ্চিত। আমাদের বাংলার চতুর্থ উচ্চতম শৈলশিখরে তখন আমরা সশরীরে দন্ডায়মান। এটা যে কতখানি অদ্ভুত এক অনুভূতি তা বলে বোঝানো যাবেনা। আমরা হয়ত কোনোদিন সান্দাকফু, ফালুট কিংবা এই দুইয়ের মাঝামাঝি সবরগ্রামেও যেতে পারবনা। তাই প্রচন্ড ঠান্ডাতেও এই জয়ের আনন্দ আমাদেরকে এক উষ্ণতা এনে দিয়েছে। আনন্দে লাফিয়ে উঠতে ইচ্ছে করছে। পারিপার্শ্বিকতারর কথা ভেবে নিজেকে সংযত করলাম। তাপমাত্রা কত ছিল তা বুঝতে গেলে আমাদের পায়ের তলার ঘাসের দিকে তাকালেই বোঝা যাবে। রাতের শিশির ঘাসের ডগায় পড়ে জমে সাদা বরফ হয়ে গেছে। সকালের সেই ঠান্ডায় আমরা সবাই জবুথুবু হয়ে গেছি। জ্যাকেটের পকেট থেকে হাত বার করতে ভয় পাচ্ছি। তার মধ্যে কোনোরকমে কয়েকটা ছবি তুললাম। আমাদের যা পাতি ক্যামেরা তাতে কতটা কি আসবে জানিনা, তায় আবার ক্যামেরাটা আমাদের সাথে মাঝেমধ্যেই ছলনা করছে। যাইহোক দেখার পালা সাঙ্গ হল, এবার ঘরে থুড়ি হোটেলে ফেরার পালা। গাড়ি চালকভাইটির কথায় হুঁশ ফিরল। টা টা রাচেলা পিক। আবার আসব যদি তুমি ডাকো।
#rachela #peak #Darjeeling #lava #lolegaon #rishap #kalimpong
#hill #station #heaven #sunrise
#রাচেলা #দার্জিলিং #পর্বত #চূড়া #লাভা #ললেগাঁও #রিশপ #কালিম্পঙ #সূর্যোদয়