চাঁদিপুর - পঞ্চলিঙ্গেস্বর - কুলডিহা ।

আজ তিন বছর আগের একটি ভ্রমণকথা আপনাদের সাথে Share করতে চলেছি। সাল ২০১৫। কোলকাতার ভ্যাবসা গরমে প্রাণ ওষ্টাগত। মাঝে মধ্যে রাতে বাড়ি ফিরে, দিনগত পাপক্ষয়ের উপান্তে, খোলা ছাদে খাটিয়া পেতে বিশ্রাম করতাম। সারাদিনের ক্লান্ত শরীরে যখন মৃদুমন্দ দক্ষিণা বাতাসের ছোঁয়া লাগত, শরীর মন সহজেই তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে পড়ত। সেই অবসরেই বরফঘেরা হিমালয় স্বপ্নে বারবার উঁকি দিত। এরপর প্রতিটা নির্জন দুপুরে পাহাড় যাওয়ার হাজারো ছক কষেছি। বন্ধুদের সাথেও আলোচনা চলেছে বিস্তর। প্রত্যেকেই হিমালয়ের কোলে হারিয়ে যেতে উদগ্রীব। কিন্তু বাঁধ সাধল 'ছুটি'। কমপক্ষে ৫-৭ দিনের কর্মবিরতি না নিলে তো হিমালয়ের সাথে Dating সম্ভব নয়। বন্ধু অনুপম জানালো মেরেকেটে ২ দিন ছুটি মঞ্জুর হতে পারে। ঠিক করলাম এই স্বল্প অবসরকে পুঁজি করেই কাছেপিঠে কোথাও ঘুরতে যাব। Google ঘেঁটে ছোট্ট Home Work এর পর গন্তব্য ঠিক হলঃ পঞ্চলিঙ্গেশ্বর- চাঁদিপুর- কুলডিহা। সেপ্টেম্বরের এক শুক্রবার রাত ১২:০৫ এর হাওড়া - পুরী প্যাসেঞ্জারে সওয়ার হলাম। আমার সহযাত্রীঃ বন্ধু অনুপম, অরিন্দম ও তন্ময়। পরদিন ভোর ৬টা নাগাদ ওড়িষার বালাসোর (বালেশ্বর) স্টেশনে নামলাম। Next Plan: একটি হোটেল বুক করে, সকালের প্রাতঃক্রিয়া ও স্নান সেড়ে ঘুরতে বেড়িয়ে পরা। এর মধ্যে অনুপমের হোটেল পর্যন্ত পৌঁছানোর ত্বর সইল না। অগত্যা স্টেশন সংলগ্ন সুলভ শৌচালয়ের শরণাপন্ন হতে হল। কিছুক্ষণ পর সে ফিরে এসে জানালো,- "শৌচালয়টি বেশ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন। স্নানেরও সুবন্দোবস্ত রয়েছে। যেখানে মাত্র ১০-১৫ টাকা খরচ করলেই আমাদের উদ্দেশ্য সম্পাদন সম্ভব, সেখানে শুধু শুধু ১০০০ টাকা খরচ করে হোটেল নেবার কী দরকার? জাগো গ্রাহক জাগো!" দেখলাম, এই দুর্মূল্যের বাজারে ওর পরামর্শ সকলের মনেই রেখাপাত করল। ততক্ষণে বন্ধুর এহেন বিচক্ষণতায় তন্ময় কিছুটা আবেগতাড়িত হয়ে অনুপমকে 'ভাই' বলে বুকে জড়িয়ে ধরেছে। বালাসোর স্টেশন থেকে বেরলেই অটোস্ট্যান্ড। সারাদিনে আশেপাশের কোন কোন যায়গা ঘুরে দেখা যেতে পারে তার একটা ছক কষে, অটোচালক রঘুজী'র সাথে ৭০০ টাকায় রফা করে ভ্রমণের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন ঘটল। পথের ধারে হাল্কা প্রাতঃরাশ সেড়ে প্রথম গন্তব্যঃ ক্ষীরচোরা গোপীনাথ। শ্রীকৃষ্ণের আর এক নাম গোপীনাথ। রঘুজী জানালো, কথিত আছে গোপীনাথ ক্ষীর চুরি করে বাড়িতে বকা খাওয়ার ভয়ে আত্মগোপন করেছিলেন। সেই কাহিনীর আদলেই এই মন্দির। মন্দির প্রাঙ্গণে কিছুটা সময় কাটিয়ে পারি দিলাম পরবর্তী গন্তব্য নীলগিরি পাহাড়ের উদ্দেশ্যে।

অটোর চাকা আবার ঘুরতে আরম্ভ করল। এখান থেকে নীলগিরি পাহাড়ের দূরত্ব ২১ কিলোমিটার। এই ২১ কিমি যেতে অটোর চাকাকে মোট কতবার পাক খেতে হবে জানি না। তবে বালাসোর স্টেশন চত্বর পেরোতেই সহজ সরল স্নিগ্ধ গ্রাম্যজীবন, চোখে এক অন্যরকম শান্তির প্রলেপ দিল। যদিও পথ খুব একটা আরামদায়ক নয়। কিছুটা জায়গার পথ এতটাই উঁচু-নীচু যে মনে হল আমরা রঘুজীর রোলার কোস্টারে চেপেছি। ক্ষাণিক পরে NH6 এ উঠে কিছুটা স্বস্তি পেলাম। মসৃণ ফাঁকা রাস্তা পেয়ে রঘুজীও খট খট করে দুটো গিয়ার ফেলে Accelerator এ একটু জোরে মোচর দিল। নীলগিরি পাহাড় পৌছাতে সময় লাগল ২৫-৩০ মিনিট। পাহাড়ে ওঠার মুখেই দেখলাম একটা বিশাল ফটক। দাড়ে দন্ডায়মান একজোড়া সিংহমূর্তি। পাশের একটা সাইনবোর্ড পড়ে বুঝলাম এটি একটি রাজবাড়ি। ভিতরে প্রবেশ করতেই খালি গায়ে দোহারা চেহারার এক পৈতে পরা ভদ্রলোক আমাদের দিকে এগিয়ে এলেন। জানলাম বর্তমানে এনি এই সুবিশাল রাজবাড়ির পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার কাজে নিযুক্ত। কোনো টুরিস্ট এলে তিনিই আবার গাইডের ভূমিকায় অবতীর্ণ হন। তাঁর মুখে সেই রাজ্যপাটের সংক্ষিপ্ত ইতিবৃত্ত শুনলাম। ভদ্রলোকের ঠাকুরদা ও বাবা এখানকার পুজারী ছিলেন। রাজত্ব পাটে ওঠার পর মন্দিরও জৌলুস হারিয়েছে। এখন শুধুমাত্র নিত্য সন্ধ্যাপূজাটুকু দেওয়া হয়। এই কাজটাও তিনিই সম্পাদন করেন। একথা শুনে বন্ধু অরিন্দম দেখলাম ঝটপট পকেট থেকে মোবাইল বের করে তাঁর সাথে একটা সেলফি তুলে নিল। এই রাজবংশের এক উত্তরসূরি আছেন এখনও। তবে তিনি সপরিবারে ভুবনেশ্বরে থাকেন। শুধুমাত্র দূর্গাপুজোর সময় এই বাড়িতে আসেন। রাজবাড়িতে আজও মহা ধুমধাম করেই দেবী দূর্গার আরাধনা আয়োজিত হয়। এককালে এখানে প্রচুর বলি হত। তবে এখন আর তা হয় না। বর্তমানে এই রাজবাড়িতে সকালে একটি প্রাথমিক স্কুল পরিচালিত হয়।

এরপর আমরা পাহাড়ে ওঠার মনস্থির করলাম। ভদ্রলোক গায়ে একটা গামছা জড়িয়ে আবার আমাদের সামনে হাজির হলেন। বললেন, পাহাড়ে ওঠার ক্ষেত্রেও তিনি গাইডের কাজ করে থাকেন। যদিও নীলগিরি পাহাড় দর্শনের জন্য গাইডের কোনোরূপ প্রয়োজন নেই, তথাপি আমরা তার Multi-tasking কে Tribute জানাতে তাকে সঙ্গী করে নিলাম। তিনি বলে চললেন - এককালে এই ঘনজঙ্গলবেষ্টিত পাহাড়ে প্রচুর হাতি ও চিতাবাঘের উপদ্রব ছিল। আর ছিল হরিণের পাল। চিতাবাঘের তাড়া খেয়ে হরিণের দল মাঝে মধ্যেই জনপদে নেমে আসত। চোরা শিকারিরা নির্বিচারে জঙ্গলের গাছ কেটে সাফ করেছে। জন্তু জানোয়ারের আধিক্য এদিকে আর তেমন নেই। তবে এখনও মাঝে মধ্যে ভাল্লুক আর শেয়ালের দেখা মেলে। কিন্তু বর্তমানে এই অঞ্চলের সব থেকে বড় ত্রাস "চন্দ্রবোরা সাপ"। কথাটা শোনার পর থেকেই চন্দ্রবোরা সাপের লেজের ঝনঝনির শব্দ তন্ময়ের কানে অবিরত অনুরণিত হতে থাকল। এত জন্তু জানোয়ারের কথা শুনে আপনাদের হয়ত Animal Planet এর কথা মনে হতে পারে। কিন্তু বিশ্বাস করুন আমাদের কাছে এটা শুধুই History Channel হিসেবে প্রতিভাত হল। খালি ভূতপূর্বের গল্প শুনেই সময় কাটালাম, কোনো কিছুই চাক্ষুস করা হল না। এরকম ভাবতে ভাবতেই গাছের আড়ালে আবিষ্কার করলাম এক অদ্ভুত জীবকে। এক গাছ থেকে অন্য গাছে লাফাতেই কিছুটা রং পরিবর্তন ঘটল। বুঝলাম এটা গিরগিটি। কিন্তু গিরগিটি এত বড়? একটু কাছে গিয়ে দেখলাম বেশ শিহরণ জাগানো রূপ। এবার গাইডবাবু মুখ খুললেন - "এর নাম ক্যামেলিয়ান"। এটি এখন বিলুপ্তপ্রায় প্রাণী। তিনি নিজেও প্রায় ৫-৬ বছর পরে এখানে ক্যামেলিয়ান দেখলেন। গাইডবাবুর সঙ্গ একেবারেই অপ্রয়োজনীয় বা অপয়া প্রতিপন্ন না হওয়ায় আমরা সবাই মনে মনে বেশ খুশি হলাম। তখন আমার DSLR ছিল না। স্মৃতিবন্দীর উপাদান বলতে একটি ছোটো Compact Digital Camera। তার সৌজন্যেই ক্যামেলিয়ানের বেশ কয়েকটা Snap নিয়ে নিলাম।

আমাদের পরবর্তী গন্তব্য পঞ্চলিঙ্গেশ্বর। রঘুজী পকেট থেকে তার ফোনটা বের করে সময় দেখে নিয়ে সশব্দে রথ ছোটালেন। ঘড়ির কাঁটা ১১টা ছুঁই ছুঁই। নীলগিরি থেকে পঞ্চলিঙ্গেশ্বর যেতে সময় লাগল ২০-২৫ মিনিট। এখানে পাহাড়ের ওপর একসাথে পাঁচটি শিবলিঙ্গ আছে। তবে মজার ব্যাপার হল এই শিবলিঙ্গ চোখে দেখা যায় না। কারণ পাহাড়ের এক প্রকান্ড প্রস্তরখণ্ডের একটু অবনমিত খাঁজে রয়েছে প্রাকৃতিক ভাবে সৃষ্ট পাঁচটি শিবলিঙ্গ। আর তার ওপর দিয়ে বয়ে চলেছে এক অবিরাম বারিধারার ঝরণা। পাথরের খাঁজে অত্যন্ত সন্তর্পণে দাঁড়িয়ে ঝরণার স্রোতের নীচে হাত ঢুকিয়ে শিবলিঙ্গ স্পর্শ করতে হয়। এভাবেই পঞ্চলিঙ্গেশ্বরের দেবদর্শন হয়ে আসছে যুগ যুগান্তর ধরে। তবে প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন করতে একটু অসাবধানী হলেই ঝরণার স্রোতের সাথে প্রায় ২৫ ফুট নীচের গিরিখাতে পড়ে গিয়ে ঈশ্বরপ্রাপ্তি ঘটতে পারে। আমরা বেশ উৎসাহের সাথেই এই রোমাঞ্চকর দেবদর্শন সমাধা করলাম। এহেন অদ্ভুত দেবদর্শনের রীতিই এই অনামী পাহাড়কে বিখ্যাত করে তুলেছে। পাহাড়ের চারিদিকে ইতস্তত বিক্ষিপ্তভাবে ছোটো ছোটো ঝরনা নিরন্তর বয়ে চলেছে। পঞ্চলিঙ্গেশ্বর স্পর্শ করার সময় জামাকাপড় আগেই ভিজেছে। নামার সময় অপেক্ষাকৃত কম বিপদসংকুল একটি ঝর্ণাধারা দেখতে পেয়ে সেখানে কিছুক্ষণ জলকেলীতে মেতে উঠলাম।

পাহাড় থেকে একটি রাস্তা এক আদিবাসী গ্রামের দিকে নেমে গেছে। সেই পথ ধরে কিছুটা এগোতেই একাধিক মাটির বাড়ি ও একটি বেশ বড় ও পরিপাটি বেড়ার স্কুলবাড়ি নজরে এল। সেই মূহুর্তে আমরা সকলেই কমবেশি তৃষ্ণার্ত। এক ভদ্রলোক তার বাড়ির উঠানে বসে বাঁশ কেটে জমি বেড়া দেওয়ার উপকরণ তৈরী করছিলেন। দুর্গম এই অঞ্চলের আদিবাসীদের ভাষা কী হতে পারে সে সমন্ধে চটজলদি কোনো সাম্যক ধারণা মস্তিষ্কে উঁকি দিল না। আমি হিন্দিতেই তার কাছে একটু খাবার জল চাইলাম। ভদ্রলোক কোনো কর্ণপাত করলেন না। আমরা প্রত্যেকে নিজেদের মধ্যে হতাশার চাহনি বিনিময় করলাম। তন্ময় হঠাৎ এক পা এগিয়ে (হাত-পা-গর্দান) ভাঙা ওড়িয়া ভাষায় জল চেয়ে বসল। ভদ্রলোক কাঁচা বাঁশে সজোরে দা এর এক কোপ মেরে আমাদের দিকে তাকালেন। ঘটনার আকষ্মিকতায় আমরা সবাই পাথরের শিবলিঙ্গের মত নিশ্চল। আর কপাল বেয়ে পাহাড়ের ঝরণাধারার মত ঘামের স্রোত নীচে নামতে থাকল। হঠাৎ ভদ্রলোক মৃদু হাসলেন, একটু জড়ানো বাংলায় বললেন - "আপনারা জল খাবেন? ওটা থেকে খেয়ে নিন।"একটু দূরে রাখা একটা মাটির জ্বালার দিকে দিক্-নির্দেশ করলেন। জল খেয়ে তাড়াতাড়ি অটো অভিমুখে এগিয়ে গেলাম।

এবার ভূগোল বই বন্ধ করে একটু ইতিহাসে ঢুকে পড়ার পালা। পরবর্তী গন্তব্য ঐতিহাসিক বুড়িবালাম। এই নদীর তীরেই বিপ্লবী যতিন দাসের সঙ্গে ইংরেজদের ভয়াবহ সংঘর্ষ হয়েছিল। আমরা আগেই ঠিক করেছিলাম চাঁদিপুরে রাত কাটাবো। বুড়িবালাম দেখে আমরা চাঁদিপুর পৌছাঁবো। হঠাৎ রঘুজী প্রস্তাব দিলেন, যদি আমাদের সম্মতি থাকে তাহলে গতানুগতিক যে বুড়িবালামের প্রান্তর টুরিস্টরা দেখেন, তার বদলে এক অন্য বুড়িবালামকে তিনি দেখাতে পারেন। এ এক বিশেষ স্থান, যেখানে বুড়িবালাম বঙ্গোপসাগরের বুকে আত্মসমর্পণ করেছে। আমরা এক কথায় ইতিহাস বই বন্ধ করে আবার ভূগোল বই খুলে নিলাম। অধুনা গন্তব্যঃ বুড়িবালামের মোহনা। এর ফাঁকে পথের ধারে একটি ধাবায় মধ্যাহ্নভোজন সেড়ে নিয়েছি। ফাঁকা রাস্তায় রঘুজীর অটো পক্ষীরাজের মত ছুটছে। বেশ কিছুক্ষণ চলার পর চাঁদিপুর অতিক্রম করে অটো এগিয়ে চলল পূর্ব অভিমূখে। পথের দু'পাশে মাছ শুকিয়ে শুটকী প্রক্রিয়াকরণ শিল্প। সহজেই আন্দাজ করতে পারছেন এই স্থানের গন্ধটা কেমন হতে পারে। অনতিবিলম্বে এক খোলা প্রান্তরে এসে আমাদের অটো থামল। না, এখানে আর শুটকী মাছের কোনো গন্ধ নেই। খোলামেলা সামুদ্রিক বাতাস শরীর স্পর্শ করছে। আর বঙ্গপোসাগরের ধূসর জলরাশি, ধূসর মেঘবর্ণিত আকাশের সাথে মিলেমিশে এক Grayscale Canvas সৃষ্টি করেছে। হঠাৎ রঘুজীর ডাকে সম্বিত ফিরল।- "বাবু ইধার দেখো"। আমরা তার হাতের দিকনির্দেশ মত তাকালাম। বুড়িবালাম এক বিশাল চওড়া নদীখাত সৃষ্টি করে বঙ্গোপসাগরে পড়েছে। যেদিকে দুচোখ যাচ্ছে শুধু অথৈ জল। মন চাইল সেই মোহনার দিকে ছুটে চলে যাই। সাথে সাথে রঘুজী বাধা দিয়ে জানালো, ওদিকে বালির চর নেই, নরম কাদামাটি। কমপক্ষে এক হাঁটু কাদা তো হবেই। আমাদের ডানদিকে কিছুটা এগোলে অবশ্য সমুদ্রতীরের বালির চড় চোখে পড়ছে। আমরা সেদিকে এগোতে থাকলাম। রঘুজী জানালো এই বীচ ধরে সোজা হাঁটলেই চাঁদিপুর। কথাটা শুনে আমাদের সকলের চোখ উত্তেজনায় চিক্ চিক্ করে উঠল। আমরা প্রত্যেকে প্রত্যেকের মনের ইচ্ছেটা বুঝে গেছি। আমি জিজ্ঞাসা করলাম এখান থেকে চাঁদিপুর মোটামুটি কতটা রাস্তা হবে? রঘুজী ততক্ষণে থমকে দাঁড়িয়েছে। আমি প্রশ্নটা দ্বিতীয়বার করলাম। কিন্তু রঘুজী এই প্রশ্নের যা উত্তর দিল, তাতে পশ্চিমবঙ্গ মধ্যশিক্ষা পর্ষদের যে কোনো শিক্ষক পাঁচ এ গোল্লা দিতে বাধ্য। তিনি বললেন, এদিকে ডানপাশের ঘন জঙ্গলে শেয়ালের উপদ্রব আছে। এই বালিয়াড়ি ধরে হাঁটা মোটেই নিরাপদ নয়। আমি তৃতীয়বার একই প্রশ্ন করলাম। এবার রঘুজী জানান দিল, কমবেশি ৪ কিলোমিটার। অতঃপর আমরা চারজনে অজস্র বাক্যব্যয়ে রঘুজীকে আস্বস্ত করে তাকে অসীম কৃতজ্ঞতার সহিত বিদায় জানালাম। যাওয়ার পূর্বে রঘুজী উপদেশ দিয়ে গেলেন- অদূরে পড়ে থাকা একটি শুকনো গাছের ডাল ভেঙে সবাইকে হাতে একটা করে 'লকড়ী' নিয়ে নিতে। আমরা রঘুজীর কথা অমান্য করিনি। প্রত্যেকে গাছের ডাল ভেঙে একটা করে লাঠী হাতে নিয়ে চাঁদিপুর অভিমুখে এগিয়ে চললাম। কয়েকপা এগোতেই একটি কুকুরের আধখাওয়া দেহাবশেষ নজরে এলো। বুঝলাম রঘুজীর দুশ্চিন্তা অমূলক নয়। ঝাউবনের ধার ছেড়ে আমরা সমুদ্রের দিকে কিছুটা এগিয়ে আবার চাঁদিপুর অভিমুখী হলাম। কিছুটা এগোতেই বালির ওপর পড়ে থাকা একটা জিনিষের ওপর আমার চোখ আটকে গেল। একটা প্রাকৃতিক শঙ্খ। আকার খুব একটা ছোট নয়। হাতে তুলে নিয়ে দেখলাম এর খোল অত্যন্ত পাতলা এবং ওজনেও হালকা। আমি সেটি হাতে নিয়েই হাঁটতে থাকলাম। বাকীরা দেখলাম একটু ঈর্শার দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকালো। কয়েকপা এগোতেই তন্ময় বেশ উত্তেজিত হয়ে বলে উঠল- "ঐ দেখ আর একটা শঙ্খ।" বলেই সে দ্রুতবেগে সেদিকে গিয়ে শঙ্খটি হাতে তুলে নিল এবং আমার দিকে তাকিয়ে একটা ক্রুর হাসি হাসল। বাকী দুজনের মুখ তখনও ম্লান। আর একটু এগোতেই আর একটা শঙ্খ আমার নজরে এলো। সেকথা বাকীদের বলতে যাব তার আগেই অনুপম চিৎকার করে উঠল- "এই শঙ্খটা আমার।" তবে আমি যেটা দেখেছি ওটা সেটা নয়। অর্থাৎ, তাহলে অরিন্দমের বরাদ্দও মিলে গেছে! আমি আমার দেখা শঙ্খটা তুলে নিয়ে অরিন্দমের হাতে তুলে দিতে যাব, এমন সময় দেখি ও নিজেই একটা প্রকান্ড শঙ্খ হাতে তুলে নিয়েছে। সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে আমরা সবাই থমকে দাঁড়িয়েছি। শুধু একটা দুটো নয়, অজস্র শঙ্খ এখানকার বালিভূমিতে পরে আছে। যে শঙ্খটা দেখতে ভালো লাগছে সেটা হাতে তুলে নিচ্ছি। আবার যেই তার থেকে বড় একটা চোখে পড়ছে, তৎক্ষণাত সেটা ফেলে বড়টা তুলে নিচ্ছি। সেই মূহুর্তে আমাদের সাথে একটা ৩-৪ বছরের শিশুমনের কোনো ফারাক নেই। যে অপার মুগ্ধতায় আমরা আচ্ছন্ন হয়েছিলাম, তা সত্যিই ভাষায় প্রকাশ করার সাধ্য আমার নেই। এভাবে হাঁটতে হাঁটতে আমরা চাঁদিপুর পৌছে গেলাম। এরপর প্রথমেই হোটেল বুক করা হল। হোটেল আশা নিবাস (০৮৩২৮৯৩৬১৮০)। চারজন থাকার মত একটি রুমের ভারা ধার্য্য হল ৭৫০ টাকা। ঘরে ঢুকে জামাকাপড় বদলে আমি আর অরিন্দম সী বীচ এ যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। বাকী দুজন হোটেলেই বিশ্রামে অবতীর্ণ হল।

বুড়িবালাম থেকে আসার পথেই দেখেছি বীচ থেকে সমুদ্রের জল বহুদূরে। জল প্রায় দৃষ্টিগোচর হয় না বললেই চলে। একমাত্র জোয়ারের সময় এদিকে জল আসে। তবে এই বিস্তীর্ণ বীচের বালি কিন্তু শুকনো নয়। বালির নীচে ফল্গুধারার মত অবস্থান করছে সমুদ্র। আমরা খালি পায়ে জলের অভিমূখে এগিয়ে চললাম। ততক্ষণে সূর্য পশ্চিমে ঢলে পড়েছে। বেলাশেষের নরম আলো সেই বালুকাতটের ওপরে পড়ে এক মায়াবী প্রতিচ্ছবি রচনা করেছে। দুর্ভাগ্যবশত ক্যামেরা হোটেলের ব্যাগেই রেখে এসেছি। এহেন অবর্ণনীয় সৌন্দর্যকে ক্যামেরাবন্দী করতে না পারার আফসোস আজও আমার মনকে তিক্ত করে তোলে। বীচে কয়েকটা জেলিফিস আমাদের চোখে পড়ল। এদিকে হাঁটতে হাঁটতে হয়ত আমরা আরও ২ কিলোমিটার চলে এসেছি। অতঃপর সমুদ্রের মৃদু ঢেউ আমাদের দৃষ্টিগোচর হল। ১০-১৫ মিনিট সেখানে থাকার পর আবার আমরা পারের দিকে রওনা দিলাম। কারণ সন্ধ্যে নামার আগেই আমাদের হোটেলে ফিরতে হবে। হোটেলে ফিরে হালকা টিফিন করে আমরা চারজনই ক্লান্তিতে ঘুমিয়ে পড়লাম। ঘুম ভাঙল রাত আটটা নাগাদ। পরদিন এখানে সূর্যদয় দেখে আমরা পাড়ি দেব কুলডিহা ফরেস্টের দিকে। তাই গাড়ি ঠিক করতে আমরা বাইরে বেরলাম। গাড়ি বুকিং করতে গিয়ে শুনি কুলডিহা ফরেস্ট এখন বন্ধ আছে। নভেম্বরের শুরুতে ফরেস্ট টুরিস্টদের জন্য খোলা হবে। তখন আমরা সকলেই ভ্রমণে অনভিজ্ঞ। তাই জঙ্গল সম্পর্কে এই ফান্ডামেন্টাল তথ্য সম্পর্কে আমরা কেউই অবগত ছিলাম না। মন ভেঙে গেল। এমতাবস্থায় জানি না কোন কুক্ষণে অনুপম বলে উঠল- "আমি জানতাম বর্ষাকাল পড়লেই সব জঙ্গলই টুরিস্টদের জন্য বন্ধ করে দেওয়া হয়। কারণ এখন পশুপাখীদের Breading Time. কথাটা শেষ না হতেই আমাদের তিনজোড়া রক্তবর্ণ চক্ষু অনুপমের নাতিদীর্ঘ দেহের প্রতি অগ্নিবাণ নিক্ষেপে উদ্যত হয়ে উঠল। সকালে ওর প্রতি তৈরী হওয়া সবটুকু সমীহ মাত্র ১৪ ঘন্টার ব্যবধানে তাসের ঘরের মত ভেঙে পড়ল। আমি আর অরিন্দম নির্বাক। তন্ময় একটু ভারী গলায় বলল- "কোলকাতায় চল তোর জন্য Bleeding Time অপেক্ষা করছে।" হোটেলে ফিরে রিসেপশনের সামনে একটি সোফায় নিরাশ মুখে চারজন বসে আছি। হোটেলের মালিক সস্নেহে জিজ্ঞাসা করলেন আমাদের এরূপ বিষণ্ণতার হেতু। হুরহুর করে সমস্ত দুঃখ তার কাছে উগরে দিলাম। ঘটনা শুনে তার নিটোল মুখ ঈষৎ কুঞ্চিত হওয়ায় বুঝলাম তিনি যথাযথই আমাদের সমব্যাথী হয়ে উঠতে পেরেছেন। অতঃপর দুধের স্বাদ ঘোলে মেটাবার মত একটা 'মোটামুটি মুশকিল আসান' তিনি বের করলেন। "কাল চারমূর্তি মিলে দেবকুন্ড ঘুরে এসো। হালকা জঙ্গলের ফ্লেভার পাবে। এছাড়াও একটা অপরূপ ঝরণা আর অম্বিকামাতার মন্দির আছে।" অন্য কোনো উপায়ান্তর না পেয়ে আমরা হোটেল মালিকের প্রস্তাবেই সিলমোহর দিলাম। উনি একটি ইন্ডিকা বুক করে দিলেন, ভাড়া ধার্য্য হল ১৮০০ টাকা।

পরদিন ভোরে আকাশ মেঘাচ্ছন্ন থাকায় চাঁদিপুরের সূর্যদয় আর চাক্ষুস করা হল না। ঠিক সকাল আটটায় কেয়ারটেকার এসে জানালো আমাদের গাড়ি এসে গেছে। আমরা কালবিলম্ব না করে হোটেলের বিল চুকিয়ে দেবকুন্ড অভিমুখে রওনা দিলাম। চাঁদিপুর থেকে দেবকুন্ডের দূরত্ব প্রায় ৮০ কিলোমিটার। যেতে যেতে ড্রাইভারজী জানালেন দেবকুন্ডের শেষ ৭ কিলোমিটার রাস্তা জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে যেতে হয়। বহু আগে এখানে প্রায়শই হরিণ, হাতি, ভাল্লুকের দেখা মিলত। এখন শুধু কিছু সংখ্যক হাতি কুলডিহা-সিমলিপাল থেকে এদিকে আসে। প্রায় দু'ঘন্টা পর আমাদের গাড়ী দেবকুন্ডে এসে পৌঁছাল। গাড়ী থেকে নেমে আমরা হাঁটতে শুরু করলাম। সবুজ জঙ্গলের ভিতর দিয়ে লাল মাটির রাস্তা। কিছুটা এগোতেই ড্রাইভারজী হাঁকলেন- "এদিকে আসুন।" পিছনে ফিরে দেখলাম ওনার চোখ স্থির হয়ে একদিকে আটকে রয়েছে। কিন্তু আমরা সেদিকে দৃষ্টিনিক্ষেপ করেও উল্লেখযোগ্য কিছু দেখতে পেলাম না। অতঃপর তিনি পরে থাকা এক ধরনের কালো পদার্থ দেখিয়ে বললেন, 'হরিণের বিষ্ঠা'। দেখে মনে হচ্ছে আজ ভোরের দিকেই এখানে হরিণের আগমন ঘটেছিল। মূহুর্তে মনের অচীনপুরে বিদ্যূৎ খেলে গেল। তবে কি হরিণের দেখা মিলবে? উত্তেজনায় চার জনের শিঁড়দাড়া সোজা হয়ে গেল। কিছুদূর এগোতেই ড্রাইভারজী দেখালেন হাতির বিষ্ঠা। তবে সেটা কমপক্ষে ১৫ দিনের পুরোনো তো হবেই। আর একটু এগোতেই একটা কংক্রিটের ব্রীজ। নীচ দিয়ে বয়ে চলেছে স্ফটিকস্বচ্ছ ঝরণার জল। ড্রাইভারজী বললেন এই বারিধারার জলপ্রপাতটিই আপনারা ওপরে দেখতে যাচ্ছেন। এই জলধারাই সমতলে পতিত হয়ে 'স্বর্ণ' নদী নামে বয়ে চলেছে। আসার পথে গাড়ী থেকে নেমে অপরূপ স্বর্ণ নদীর একটি ছবি আমি তুলেছি। আমরা চারজন পাহাড়ী ঢালু পথ ধরে ওপরে উঠতে লাগলাম। ড্রাইভারজী সেখানেই রয়ে গেলেন। বেশ কিছুটা ওঠার পর শুরু হল কংক্রিটের সিঁড়ি। কমপক্ষে ৬০০ সিঁড়ি ভেঙে ওঠার পর আমরা অম্বিকা মাতার মন্দির দর্শন করলাম। আর দেখলাম মোহময়ী সেই জলপ্রপাতের গিরিখাতে ঝাঁপিয়ে পড়ার আগের খরস্রোতা রূপ। প্রায় ৮০ ফুট উচ্চতাবিশিষ্ট এই জলপ্রপাতের জল এতটাই স্বচ্ছ যে অতলের পাথরখন্ডগুলি পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। এইরকম জলাধারে স্নান করার লোভ সামলাতে পারলাম না। চারজন বেশ সানন্দে স্নান করে আবার নীচে নামতে আরম্ভ করলাম। এদিকে ক্ষিদেয় পেটে ছুঁচো ডন দিচ্ছে। ড্রাইভারজী জানালেন বালাসোর ছাড়া কোনো ভাল ভাতের হোটেল পাবেন না। অগত্যা আমাদের বালাসোর ফিরেই মধ্যাহ্নভোজন সারতে হবে।

ফেরার সময় গাড়ির দোলুনিতে ব্যাকসিটে আমার তিন বন্ধুই তখন ক্লান্তিতে তন্দ্রাচ্ছন্ন। এবার বাড়ি ফেরার পালা মনে হতেই আমিও একটু ভারী হৃদয় নিয়ে চোখ বন্ধ করে রইলাম। মনে মনে ভাবলাম, ওদিকে আর এক বাঙালীর ছেলে শঙ্কর, আফ্রিকায় গিয়ে বুনিপের সাথে লড়াই করে এসেছে। আর আমরা কিনা দুটো জন্তুর বিষ্ঠা দেখে ঘরে ফিরছি! বাঙালী জাতি আমাদের কোনোদিন ক্ষমা করবে না। ঘুম আসছেনা বলে জানলার বাইরে চোখ রাখলাম। মনে মনে ভাবলাম, নাই বা হলাম শঙ্কর, নাই বা পেলাম অ্যালভারেজের দেখা, কিন্তু নীলগিরির সেই গাইডবাবুই বা কম কিসে! সামনে এক লোকের তাড়িয়ে নিয়ে যাওয়া ছাগলের পালকে সাইড কাটাতে ড্রাইভারজী জোরে হর্ণ বাজানোয় সম্বিত ফিরল। আকাশকুসুম কল্পনা বাদ দিয়ে ঘুমোনোর চেষ্টা করলাম। প্রায় বিকেল বিকেল নাগাদ বালাসোর পৌছে মধ্যাহ্নভোজন সমাধা করে স্টেশন চত্বরেই একটু হেঁটে বেড়ালাম। তারপর সন্ধ্যার সেকেন্দ্রাবাদ-গুয়াহাটী সুপার ফাস্ট এক্সপ্রেস ধরে হাওড়া ফিরলাম।

পুনশ্চঃ কোলকাতায় ফিরে তন্ময় এবং অনুপমের মধ্যে কোনোরূপ সংঘর্ষ বা রক্তপাতের ঘটনা ঘটেনি।