পুনাখায় পৌঁছাতে পৌঁছাতে প্রায় দুপুর হয়ে গেল ,তাই আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম আগে খাবার খেয়ে নিব ।গরম গরম ভাত। বড় মরিচের /মিষ্টি মরিচের একটা সব্জি ,ডাল আর ভাজি দিয়ে খাবার সারলাম ।এরপর গেলাম পুনাখা জং দেখতে ।নদীর উপর কাঠের ঝুলন্ত ব্রিজ পার হয়ে জং এ যেতে হয় ।
এমনিতেই ভুটানে চারপাশে গাছ আর ফুলের সমারোহ কিন্তু এখানে এসে মনে হল পুরাই ফুলের মেলা।
:পুনাখা জং এর সন্ন্যাসীরা :
সন্ন্যাসীরা যে যার মত নিরবে কাজ করে যাচ্ছে ।অনেকে আবার প্রেয়ার হুইল ঘুরিয়ে জপ করছে। এখানে বড় হুইল আছে যে গুলা ঘুরাতে ঘুরাতে কোন ইচ্ছা করলে তা পূরণ হয়। এই জিনিষ সব প্যাগোডা আর জং এ আছে ।
:পুনাখা জং:
জং টা অনেক বড়। আশেপাশে দেখা যায় পুনাখা ভ্যালির মোহনীয় রুপ। ভুটানের অধিকাংশ ধান এই ভ্যালীতেই উৎপন্ন হয়। নিচে দেখলাম অনেক গুলা ঘোড়া ঘাস খাচ্ছে। চারপাশে বাগান বিলাস ,গোলাপ আরও কত শত ফুল । পুরা জংকে ঘিরে আছে অনেক বড় বড় গাছ।
:পুনাখা জং এর কারুকার্য:
এক সন্ন্যাসী আমাদের জানালো এগুলা জারকান্ডা গাছ ।বসন্তে এই গাছের পাতাই দেখা যায় না ।পুরা গাছ আচ্ছাদিত থাকে বেগুনি রঙ এর ফুলে ।
ইশ! একথা শোনার পর মনে হল যদি বসন্তে আসতাম ।
ভাল করে পুরো জঙটা দেখে কিছুক্ষণ উপরে উঠে বসে থাকলাম দুরের প্রবাহিত নদী গুলো কলকল করে বয়ে যাচ্ছিল । এরপর জং থেকে বের হয়ে আমরা গেলাম মো আর ফো ছু এর সঙ্গম স্থলে।
দুইদিক থেকে দুই ছু মানে নদী এখানে এসে মিলিত হয়েছে। মো এর জল ফো এর চেয়ে অপেক্ষাকৃত সাদা ।ড্রাইভার আমাদের জানাল ওদের ফোকলোর অনুযায়ী মো হল মেয়ে আর ফো হল ছেলে ,এখানে এসে ওদের বিয়ে হয়েছে আর তাই একসাথে হাসতে হাসতে ওরা যাচ্ছে সাগর পানে।
: মো আর ফো ছু/নদী :
একথা শুনেই ড্রাইভার কে বললাম ,তাইলে তো আমরা মো ছু এর শ্বশুর বাড়ির লোক কারন পড়বে তো সেই বঙ্গোপ সাগরেই । এই দুই নদী পুনাখাতে একত্র হয়ে ভারত সীমান্ত পর্যন্ত প্রবাহিত হয়ে ব্রহ্মপুত্র নদে মিশেছে ।
আগেই বলেছি পুনাখাতে রাত কাটানোর ইচ্ছা নাই তাই বিকাল বিকাল ফেরার পথ ধরলাম।ফিরতে ফিরতে রাত হয়ে গেল।
:পুনাখা থেকে থিম্ফু ফেরার পথে :
এটাই থিম্ফু তে আমাদের শেষ রাত ।পরের দিন যাব পারো । লেতঠো এর সাথেও আর দেখা হবে না তাই রাতেই ওর কাছ থেকে বিদায় নিলাম। যেহেতু পারো একটু দূরে তাই ট্যাক্সিতে যাওয়া যাবে না।
রাতের খাবার খেয়ে হোটেল মালিক আর তার মেয়েদের সাথে অনেকক্ষণ আড্ডা মারলাম,ছবি তুললাম আর শেষমেশ ক্লান্ত শরীর নিয়ে গেলাম বিছানায়।
পরের দিন খুব সকালে উঠতে হল ,ব্যাগ গুছিয়ে তৈরি হয়ে নেমে গেলাম নাস্তা খেতে। গাড়ি চলে এসেছে আগেই তাই দেরি না করে ঝটপট রওয়ানা দিলাম। এবারের ড্রাইভারটা একটু গোমরামুখো ,কথা বলে কম। একদল যাত্রী নিয়ে পারো থেকে থিম্ফু এসেছে গতরাতে আর সকালে আমাদের নিয়ে আবার যাচ্ছে পারো।কথায় কথায় জানতে পারলাম থিম্ফু তার পছন্দ না কারন এখানে অনেক ভীর হইচই । শুনেই আমরা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলাম ।বলে কি লোকটা ? একে যদি নিউমার্কেট ওভার ব্রিজ এ দাড় করানো হয় তাইলে তো সে হার্ট ফেল করবে। যাক যেথায় যেমন । পথিমধ্যে দুবার থেমে চা খেয়ে নিলাম।
এর মাঝে ঘটলো এক আজব ঘটনা ।পারোতে প্রবেশ করার একটু আগে রাস্তায় বেশ জ্যাম ছিল কারন একতা বিদ্যুতের খুঁটি দেখলাম উপড়ে গেছে । পিছনের গাড়ির এক ভদ্রলোক গাড়ি থেকে নেমে হাতজোড় করে বার বার ক্ষমা চাচ্ছে আর বলছে তার জরুরি মিটিং আছে তাই সে লাইন ব্রেক করে আগে যেতে চায়। সবাই রাজি হলে সে হুশ করে ওভারটেক করে আগে চলে গেল। পরে ড্রাইভার বলল তোমরা কিছু মনে কর না উনি একজন মন্ত্রি আর রাজার সাথে তার জরুরি মিটিং আছে তাই আগে গেল !!! একি শুনলাম ! আমাদের দেশে তো ...
পারো তে গিয়ে উঠলাম হোটেল পেলজরলিং এ ।এই হোটেলের ম্যানেজার চমৎকার বাংলা বলতে পারে। আসলে সে অনেকদিন ফুয়েন্টশোলিং ছিল। সেখানে প্রচুর ভারতীয় কাজ করে ,তাদের কাছ থেকেই শেখা।
সন্ধ্যা নামতেই দেখি ঘুটঘুটে অন্ধকার ,কিছু দোকানপাট এ মোম বা অন্য আলো জ্বলছে ।ভাবছি তাইলে ভুটানেও লোড শেডিং হয়। নিচে গিয়ে জানলাম একটু আগে ল্যান্ডস্লাইড এ খুঁটি উপড়ে পরাতে এই বিপত্তি । কিছুক্ষণ পরেই বিদ্যুৎ চলে এল।
আমরাও বাইরে বের হয়ে কিছুক্ষণ ঘোরাফেরা করলাম। ওদিকে আমরা যখন বাইরে টুকটাক কেনাকাটা করছিলাম কেয়া তখন কিনে নিয়ে আসলো পিচ ফল।
এখানে ওদের নিজস্ব নকশায় তৈরি রুপার দুল আর পুতির ব্যাগ দেখলাম তুলনামুলক ভাবে সস্তা ।আর সস্তা জ্যাম ,জেলি মারমালেড। আমরা অনেকগুলা কিনলাম ।
তারপর রাতের খাবার খেয়ে রুমে ফিরে ঘুম । তবে খেতে বসে আমরা জি জাঙ্গ এর খাবার খুব মিস করলাম কারন ওদের রান্নাটা ছিল আসলেই অনেক মজাদার। আর ঘুমানোর আগে আমার আর অনুর উপর চলল চরম মানসিক নির্যাতন । আমাদের পিচ ফল খেতে হবে ।দেখতে সুন্দর হলেও স্বাদটা আমার কাছে গাব এর মত মনে হচ্ছিল। অনেক কষ্টে দুইজন দুই পিস খেলাম ।
সকাল বেলা ঘুম থেকে উঠেই মনটা ভাল হয়ে গেল ।এখানকার আবহাওয়াটা আসলেই চমৎকার । সেপ্টেম্বর মাস কিন্তু রাতে ফ্যান চালাতে হয়নি। এখানে সারা বছর তেমন গরম পড়ে না।
https://i.imgur.com/xMmAg0s.jpg" alt=""/>
:পারো এর আকাশ:
পরোটা সবজি দিয়ে ভরপেট নাস্তা খেয়ে বের হলাম পারো দর্শনে ।সারদিনের জন্য গাড়ি নেয়া হল আর ড্রাইভার সেই গতকালের জন। যিনি আমাদের থিম্ফু থেকে পারো নিয়ে এসেছে। আমার কাছে আগে থেকেই লিস্ট করা ছিল কোন কোন জায়গায় যাব । প্রথমেই গেলাম পারো ন্যাশনাল মিউজিয়াম এ। এটা অনেক বড় একটা দুর্গ । আগে ছিল ওয়াচ টাওয়ার । ভিতরে প্রবেশ করে ঢালু রাস্তা বেয়ে নেমে গেলাম।
:তা জং বা ন্যাশনাল মিউজিয়াম:
সতেরশ শতকে নির্মিত তা জং এখন পারো ন্যাশনাল মিউজিয়াম। ভিতরে প্রদর্শনীতে আছে নানা রকম গয়না , যুদ্ধের সরঞ্জাম ইত্যাদি ।
ওখান থেকে বের হয়ে গেলাম দ্রুকগিয়েল জং দেখার জন্য। এই জং এর সাথে জড়িয়ে আছে অগ্নিকান্ডের এক ইতিহাস। কোন এক অজ্ঞাত কারনে এই জং টা বার বার আগুনে পুড়ে যায় । পাহাড়ের উপর এর অবস্থান। গাড়ি থেকে নেমে আমরা উপরে উঠতে থাকলাম ।বেশ চড়াই। কোথা থেকে যেন জলের কলকল শব্দ আসছিল ।বুঝতে পারছিলাম কাছে কোন নদী বা ঝর্ণা আছে। যত উপরে উঠছিলাম জলের কলকলানি তত বাড়ছিল ।শব্দের উৎস কিছুতেই খুজে পেলাম না।
https://i.imgur.com/lylmN8R.jpg" alt=""/>
: দ্রুকগিয়েল জং :
অবশেষে দুর্গের আঙ্গিনায় প্রবেশ করলাম। চারপাশে ঝোপঝাড় আর অযত্নে বেড়ে ওঠা গাছপালা । আর ওপাশে দাঁড়িয়ে আছে আগুনে পোড়া দুর্গের ভাঙ্গাচোরা কাঠামো । আমরা ছাড়াও আরও দুইজন পর্যটক আসল । কিছু সময় কাটিয়ে ধরলাম ফিরতি পথ।ফেরার পথে গাড়ি থেকে নেমে দেখলাম আপেল বাগান ।সবুজ লাল আপেলে গিজগিজ করছে গাছগুলো ।
: আপেল বাগান :
দুপুরের খাবার খেয়ে একটু বিশ্রাম নিয়ে বের হয়ে গেলাম ।প্রথমেই গেলাম কিছু লাখাং এ। ওখানে একটা গাছে অনেক পাকা কমলা দেখে ভাবলাম অনুমতি নিয়ে দুই একটা ছিঁড়ব, কিন্তু সন্ন্যাসী কে বলতেই সে বলল ওরা গাছ থেকে ফল ছিড়ে না। আমাকে বলে কি না গাছের কাছে দাঁড়িয়ে প্রেয়ার কর একটা যদি পড়ে তাইলে নিও । কি আজব কথা।
: লাখাং এর কমলা গাছ :
এখানে অনেক খানি সময় পার করে গেলাম টাইগার নেস্ট বা তাক সাঙ্গ এ। সমতল থেকে অনেক উঁচুতে এর অবস্থান। পাহাড়ের পাদদেশে গাড়ি রেখে হেটে যেতে হয় এখানে। ওদের লাগে ঘন্টা তিনেক আর আমাদের মত মানুষদের লাগবে সাড়ে চার কি পাঁচ ঘন্টা।
: তাক সাঙ্গ বা টাইগার নেস্ট :
চিন্তা করছি কি করা যায় এমন সময় দেখি একটা দল তাক সাঙ্গ ঘুরে নেমে এল। আমাদের দেখে এসে নিজেরাই আলাপ করল ।একজন ছাড়া সবাই ভারতীয় দূতাবাসের কর্মকর্তা ।একজন এসেছেন লেসোথো থেকে । উনারা আমাদের খুব ইন্সিস্ট করল উপরে ওঠার জন্য । তবে দেরি হয়ে যাওয়ায় আমরা গেলাম না।
: তাক সাঙ্গ বা টাইগার নেস্ট (এই ছবিটা বন্ধু তেন দরজির কাছ থেকে নেয়া) :
সন্ধ্যা সন্ধ্যা হোটেলে ফিরে এলাম। কারন পরের দিন আবার যেতে হবে ফুয়েন্টশলিং ।সকাল বেলা নাস্তা খেয়ে ব্যাগ বোঁচকা নিয়ে চলে গেলাম বাস স্ট্যান্ড । তারপর দুপুরের এক্তু পর পর পৌঁছলাম ফুয়েন্টশলিং। ফ্রেশ হয়ে খাবার খেতে বের হলাম তারপর শপিং। এখানে খুব সুন্দর ডিজাইনের চাইনিজ স্যান্ডেল পাওয়া যায়।
সন্ধ্যার পর কেয়াদি কে পটিয়ে পাটিয়ে ভুটান গেট পার হয়ে গেলাম ইন্ডিয়ায়। প্রচুর লোক জাওয়া আসা করছে। ওখানে কিছু কেনা কাটা করে রাতের খাবার খেয়ে ফিরলাম।
পরের দিন দেশে ফেরার পালা।
ফিরতে ফিরতে মনে হল আহা কত কিছুই দেখা হল না । তাই ভাবছি আবার যাব তবে অবশ্যই বসন্তে।