দেবপ্রয়াগ : গঙ্গার জন্মস্থল :-
গঙ্গা মাঝেমাঝে রাস্তা থেকে অনেকদূরে দৃষ্টির বাইরে চলে যাচ্ছে । আমরা গঙ্গার উজানে যাত্রা করছি । গঙ্গার যাত্রাপথের শেষাংশের থেকে উৎসের সমীপে চলেছি । মর্ত হতে স্বর্গের দিকে চলেছি । আমার শহর কলকাতায় গঙ্গার নাম ভাগিরথী হুগলী । আমার প্রদেশের গঙ্গাসাগরে গঙ্গা তার যাত্রাপথ সম্পূর্ণ করে সাগরে মিলিত হয় । আর এই উত্তরাখন্ড প্রদেশের গঙ্গোত্রী হিমবাহের গোমূখ থেকে গঙ্গা তথা ভাগিরথীর উৎপত্তি হয় । গঙ্গাসাগর আমার অনেকবার যাওয়া । গঙ্গোত্রী একবারো যাওয়া নয় ।
আবার দূ্রে গঙ্গা দেখা দিতে থাকে । পাহাড়ের গঠন ও কাঠিন্য অনুযায়ী কুঞ্চিত গতিপথ তার । রাস্তায় টোলি , বছেরিখাল , কোটা কুন্ডলি বলে জায়গা পড়ে । শ্রাবণমাস হলেও রৌদ্রজ্জ্বল দিন । আমরা ভাবছিলাম এরকমই যদি পরিষ্কার আবহাওয়া থাকে গোটা ট্যুরে , তাহলে কতই না ভালো হয় !
উত্তরাখন্ডকে দেব ভূমি অথবা ইশ্বরের ভূমি বলা হয় কারন এখানে বিভিন্ন ধর্মীয় স্থান এবং মন্দির দেখা যায় যেগুলিকে এই অঞ্চলের অত্যন্ত পবিত্র তীর্থস্থান বলে মনে করা হয়।
উত্তরপ্রদেশের উত্তর–পশ্চিম অংশ এবং হিমালয় পর্বতমালার একটি অংশের বেশ কয়েকটি জেলা নিয়ে উত্তরাখণ্ড অঞ্চলটি গঠিত। রাজ্যটি হিমালয়ের তরাই ও ভাবর অঞ্চলের নিজস্ব প্রাকৃতিক সৌন্দ্যর্য ও সম্পদের জন্য বিখ্যাত। রাজ্যের উত্তরে স্বায়ত্ত শাসিত অঞ্চল তিব্বত অবস্থিত।
২০০৭ সালে এই রাজ্যটির নাম উত্তরাঞ্চল থেকে উত্তরাখন্ড করা হয়েছে। দেরাদুন, রাজ্যের রাজধানী এবং এটি এই রাজ্যের বৃহত্তম শহর। উত্তরাখন্ডের প্রধান বিচারালয় নৈনিতালে অবস্থিত, যেটি হল এই রাজ্যের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ শহর। হস্তশিল্প ও তাঁত এই দুই হল রাজ্যের প্রধান শিল্প। ‘চিপকো’ আন্দোলনের উৎস হিসাবে এই রাজ্য পরিচিত।
২০০০ সালের ৯-ই নভেম্বর থেকে এটি পৃথক রাজ্য সরকার সহ ভারতের একটি পূর্ণাঙ্গ রাজ্যে পরিনত হয়। ভারতের বৃহত্তম জনবহুল রাজ্য, উত্তরপ্রদেশকে বিভাজন করে এই রাজ্যটি গঠিত হয়েছে।
২০০৭ সালে এই রাজ্যটির নাম উত্তরাঞ্চল থেকে উত্তরাখন্ড করা হয়েছে। দেরাদুন, রাজ্যের রাজধানী এবং এটি এই রাজ্যের বৃহত্তম শহর। উত্তরাখন্ডের প্রধান বিচারালয় নৈনিতালে অবস্থিত, যেটি হল এই রাজ্যের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ শহর। হস্তশিল্প ও তাঁত এই দুই হল রাজ্যের প্রধান শিল্প। ‘চিপকো’ আন্দোলনের উৎস হিসাবে এই রাজ্য পরিচিত।
২০০০ সালের ৯-ই নভেম্বর থেকে এটি পৃথক রাজ্য সরকার সহ ভারতের একটি পূর্ণাঙ্গ রাজ্যে পরিনত হয়। ভারতের বৃহত্তম জনবহুল রাজ্য, উত্তরপ্রদেশকে বিভাজন করে এই রাজ্যটি গঠিত হয়েছে।
রাজ্য ৫৩,৪৮৩ বর্গ কিমি অঞ্চল জুড়ে অবস্থিত। বেশীর ভাগ অংশ জঙ্গল এবং পর্বত বেষ্ঠিত। এখানে পৃথক ধরনের উদ্ভিদকুল ও প্রাণিকুল দেখা যায়, যেমন- তুষার চিতা, ভড়াল, বাঘ, চিতাবাঘ এবং অসাধারণ কিছু গুল্ম ও বৃক্ষ। ভারতীয় প্রজাতন্ত্রের দুই প্রধান নদী গঙ্গা ও যমুনার উৎসস্হল হল এই রাজ্য। উত্তরাখণ্ডের প্রধান ভৌগোলিক বৈশিষ্ট্য গুলি :
পর্বতময় গুল্মজ এবং সমতল ভূ-ভাগ।
পশ্চিম হিমালয়ের আলপাইন গুল্ম জাতীয় বৃক্ষ এবং চারণভূমি
সরলবর্গীয় বনাঞ্চল
পশ্চিম হিমালয়ের উপজাত– আলপাইন বৃক্ষ এবং সরলবর্গীয় বনাঞ্চল
পশ্চিম হিমালয়ের শঙ্কু-আকৃতি সূঁচালো বনাঞ্চল
হিমালয় পর্বতশ্রেণীর পাইন বনাঞ্চল
তরাই-ডুয়ার্স নিম্ন ভূমি এবং সাভানা বনাঞ্চল
উচ্চ গাঙ্গেয় সমভূমির আর্দ্র সরলবর্গীয় অরণ্য
এই রাজ্যের অর্থনীতি সাম্প্রতিক কালে দ্রুত গতিতে এগোচ্ছে। কৃষি উত্তরাখণ্ডের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র। চাল, সয়াবিন, গম, চীনাবাদাম, ডাল, মোটা শস্য এবং তৈল বীজ হল এই অঞ্চলের প্রধান ফসল। আপেল, নাসপাতি, কমলা লেবু, পীচ, কুল এবং লিচু এখানে ব্যাপকভাবে জন্মায় এবং তাই খাদ্য শিল্প এখানকার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এই রাজ্যের প্রধান অর্থকারী ফসল হল আখ। এই রাজ্যে পর্যটনক্ষেত্রের উন্নতির উচ্চ প্রত্যাশা রয়েছে। পর্যটনের প্রভূত উন্নতি এই রাজ্যের বার্ষিক আয়ের সাথে যুক্ত হয়। এই রাজ্যে পর্যটন শিল্পে আরো বিনিয়োগ তথা আরো অন্বেষণ করা প্রয়োজন। অন্য আরেকটি ক্ষেত্র, কৃষি-উদ্যোগে রাজ্যের অর্থনৈতিক উন্নতি প্রয়োজন, যা রাজস্ব বৃ্দ্ধিতে সাহায্য করবে।
উত্তরাখণ্ড ভারতবর্ষের উত্তর প্রান্তে অবস্থিত। এই অঞ্চলটির মোট ভূমির আয়তন ৫৩,৪৮৩ বর্গ কিমি। ২০১১ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী এখানকার মোট জনসংখ্যা হল ১,০০,৮৬,২৯২। সর্বশেষ আদমশুমারি অনুযায়ী এই রাজ্যের জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ১৯.১৭ শতাংশ। মহিলা ও পুরুষের অনুপাত হল ১০০০: ৯৬৩। এই অঞ্চলের জনঘনত্ব হলো প্রতি বর্গ কিমিতে ১৮৩ জন। উত্তরাখণ্ডের স্বাক্ষরতার হার ৭৯.৬৩ শতাংশ। এই রাজ্যটি তিব্বত, নেপাল, হিমাচল প্রদেশ ও উত্তর প্রদেশের সমতল জেলার সীমানাগুলি নিয়ে বেষ্টিত। রাজ্যের রাজধানী দেরাদুন ও ভারতের রাজধানী নতুন-দিল্লীর মধ্যে দূরত্ব হল ২৪০ কিমি। উত্তরাখণ্ডে মোট ১৩-টি জেলা বর্তমান- পিথোরাগড়, আলমোড়া, নৈনিতাল, বাগেশ্বর, চমপাওয়াত, উত্তর-কাশী, উধাম সিং নগর, চামোলি, দেরাদুন, পৌরি গাড়োয়াল, টেহরি গাড়োয়াল, রুদ্র প্রয়াগ এবং হরিদ্বার (শহর)।
উত্তরাখণ্ডের ইতিহাস এই রাজ্যের গুরুত্বপূর্ণ অতীতের কথা বলে। বেশ কিছু রাজ্য এবং মহান রাজাদের উল্লেখ সহ এই রাজ্যের একটি লম্বা ইতিহাস আছে- যেখানে কূষান, কুদিনা, কনিষ্ক, সমুদ্রগুপ্ত, কাটুরিয়া, পাল, চন্দ্র এবং পাওয়ারদের নাম উল্লেখ আছে। উত্তরাখণ্ডের ইতিহাস এর কথা বহু পবিত্র হিন্দু ধর্মগ্রন্থে লেখা আছে। কিন্তু এর সেরা ইতিহাস গাড়োয়াল এবং কুমায়ুনের ইতিহাসের মাধ্যমে ভালো বোঝা যাবে।
রাজ্যের জীবনধারা, রীতিনীতি ও ঐতিহ্য উত্তরাখণ্ডের সমাজকে প্রভাবিত করে। এখানকার সংস্কৃতি উত্তরাখণ্ডের সামাজিক দিককে আরোও প্রসারিত করে। এটি হল কুমায়ুন ও গাড়োয়াল অঞ্চলের বিভিন্ন জাতিগত গোষ্ঠীর একটি ভিন্নধর্মী সংস্কৃতির সংমিশ্রণ। রাজ্যের বেশীরভাগ মানুষ হিন্দু ও বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী, কিছু সংখ্যক শিখ ধর্মাবলম্বীও রয়েছে, যারা ১৯৪৭ সালে পশ্চিম-পাঞ্জাব থেকে এসে উত্তরাখণ্ডে বসতি স্থাপন করেছে। নৃত্য এই অঞ্চলের মানুষের জীবন এবং অস্তিত্বের সাথে অহরহ ভাবে যুক্ত, যা অগণিত মানবিক ভাবনাকে প্রকাশ করে। সংগীত উত্তরাখণ্ডের সংস্কৃতির অভিন্ন অংশ। লোকগীতির মধ্যে জনপ্রিয় বিভাগগুলি হল বাসন্তী, মঙ্গল, খুদেদ এবং ছোপাটি। এখানকার স্থানীয় কারুশিল্পের মধ্যে বিশিষ্ট হল কাঠ খোদাই। উত্তরাখন্ডের হরিদ্বারে হিন্দুধর্মের গুরুত্বপূর্ণ তীর্থ কুম্ভ মেলা হয় এবং এটিকে বিশ্বের বৃহত্তম ধর্ম সম্মেলন বলে মনে করা হয়। এখানকার অন্যান্য উৎসবগুলি হল– ঘি-সংক্রান্তি, বাতসাবিত্রী, খাতারুয়া, ফুল দেই, হারেলা মেলা, নন্দাদেবী মেলা ইত্যাদি ।
এখানকার দুই প্রধান আঞ্চলিক ভাষা হল- গাড়োয়ালি এবং কুমাউনি, কিন্তু হিন্দি হল এখানকার কথ্য ভাষা। গাড়োয়ালি এবং কুমাউনি উপভাষা গাড়োয়াল এবং কুমায়ুন অঞ্চলে উচ্চারিত হয়। পশ্চিম ও উত্তর অঞ্চলের কিছু আদিবাসী সম্প্রদায় জাউন্সারি এবং ভোটিয়া উপভাষায় কথা বলে। অন্য দিকে, শহুরে জনসংখ্যার বেশিরভাগই হিন্দি ভাষায় কথা বলে যা সংস্কৃত সহ উত্তরাখণ্ডের আধিকারিক ভাষা।
২০০০ সালে গঠিত এই নতুন রাজ্যের উন্নতিতে উত্তরাখণ্ড সরকার বহু প্রগতিশীল কর্মসূচী গ্রহন করেছে। এটি একটি সুদক্ষ বিধান পরিষদ, যা সমভাবে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ নির্বাহী বিভাগ ও আইন সভা নিয়ে গঠিত। রাজ্যের রাজধানী গাড়োয়াল বিভাগের দেরাদুন, যেখানে সকল সরকারী অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হয়। এখানে মোট পাঁচটি সংসদীয় আসন এবং ৭০-টি একক কক্ষবিশিষ্ট বিধানসভা আসন রয়েছে।
প্রকৃতি, বন্যপ্রাণী, রোমাঞ্চকর কাজ বা তীর্থস্থান যে কারণই হোক, পর্যটনের এখানে প্রচুর সম্ভাবনা রয়েছে। এই অঞ্চলের প্রধান পর্যটন কেন্দ্রগুলি হল- হরিদ্বার, হৃষিকেশ, দেরাদুন, মুসৌরি, আলমোড়া, কেদারনাথ, বদ্রীনাথ, যমুনোত্রী, গঙ্গোত্রী, জিম করবেট জাতীয় উদ্যান, নৈনিতাল, রানিখেত এবং পিথোরাগড়। যদি আপনি দু:সাহসী হন এবং কঠিন প্রতিবন্ধকতা উপভোগ করতে আগ্রহী হন, তাহলে আপনি – উচ্চ এবং নিম্ন উচ্চতায় ট্রেকিং, প্যারা গ্লাইডিং, পর্বতারোহণ, স্কাইং, রিভার র্যাফটিং এবং অন্যান্য অনেক কার্যক্রম করতে পারেন।
ভারতের উত্তরাখণ্ড বিমান, রেল ও সড়ক পথ দ্বারা সহজে প্রবেশযোগ্য। দেরাদুনের কাছাকাছি জলি গ্রান্ট বিমানবন্দর এই অঞ্চলের সবচেয়ে জনপ্রিয় বিমানবন্দর। দেরাদুনে কিছু অন্তর্দেশীয় বিমান সংস্থা, বিমান চালনা করে। উত্তরাখণ্ড, ভারতীয় শহর ও উপ-শহরগুলির মধ্যে একটি চমৎকার রেলপথের জালবিন্যাস ঘটিয়েছে। দেশের অন্যান্য অংশের সঙ্গে রাজ্যের সংযোগ স্থাপনকারী, কিছু প্রধান রেলওয়ে স্টেশনগুলি হল- দেরাদুন রেল স্টেশন, হরিদ্বার রেল স্টেশন এবং কাঠগোদাম রেল স্টেশন । উত্তরাখণ্ড-এর ৫৮,৭৩,৭৪,৮৭-নং জাতীয় মহাসড়কগুলি অন্যান্য ভারতীয় রাজ্যগুলির মধ্যে সংযোগ স্থাপন করেছে। রাজ্য সড়ক পরিবহন কর্পোরেশন (এস.আর.টি.সি), এই রাজ্যের বাস পরিষেবা পরিচালনা করে।
উত্তরাখন্ডের কুমায়ুন বিভাগ ও গাড়োয়াল বিভাগ , এইদুটি বিভাগের অন্তর্গত জেলাগুলি হল:-
কুমায়ুন বিভাগ : আলমোড়া , বাগেশ্বর , চম্পাব, নৈনিতা, পিথোরাগড় , উধম সিং নগর ।
গাড়োয়াল বিভাগ: দেরাদুন , হরিদ্বার, তেহরি গাড়োয়াল (সাধারণত তেহরি নামে পরিচিত), উত্তরকাশী , চামোলি, পৌরি গাড়োয়াল (সাধারণত পৌরি নামে পরিচিত), রুদ্রপ্রয়াগ ।
তিনধারা বলে একটা জায়গায় আমরা খাবার খেয়েছিলাম । দুটো তন্দুরি রুটি , তরকারি , ডাল, 60 টাকা প্লেট । চা 10 টাকা। খেয়ে পেট ভরেছিলো , তৃপ্তিও হয়েছিল যথেষ্ট ।
তিনধারার অল্পকিছুক্ষণ পরেই এসে গেল দেবপ্রয়াগ । সেই চিরচেনা , আইকনিক , অনিন্দ্যসুন্দর দৃশ্য । চমকে গেছিলাম প্রথমে । তারপরে মন ভরে উঠলো কিছুটা সন্তোষ , কিছুটা স্ফূর্তি , কিছুটা আশায় । দেবপ্রয়াগ দর্শন হয়ে গেল , আমাদের ট্যুরের একটা পর্ব সম্পূর্ণ হয়ে গেল । বাকি ট্যুরটাও সাফল্যের সঙ্গে সম্পূর্ণ হয়ে যাবে এমন একটা আশ্বাস মনের ভেতর থেকে উঠে এল ।
কতবার কত বইতে , ছবিতে যে এদৃশ্য দেখেছি । আসলে এতটা ওয়াইড অ্যাঙ্গেলে নয় , অনেকটা টপ অ্যাঙ্গেল থেকেই ছবি সবাই তোলেন । আমি নেহাত সুযোগ পেয়ে গেছি এত ওয়াইড অ্যাঙ্গেলে বিস্তৃত দৃশ্যাবলীসহ ছবিটা তোলার । গঙ্গার উৎপত্তিস্হল এই দেবপ্রয়াগ । বাঁদিকের তুঁতে রঙের জলরাশি উত্তরকাশি জেলার গঙ্গোত্রী থেকে আগত ভাগিরথী নদীর আর ডানদিকের মেটে রঙের জলরাশি চামোলি জেলার অলকাপূরী থেকে আগত অলকানন্দা নদীর । দুই নদী মিলিত হয়ে এখানে থেকে গঙ্গা নাম নিয়ে দক্ষিণে প্রবাহিত হয়েছে ভারতবর্ষের উদ্ধারহেতু ।
দেবপ্রয়াগ তেহরি গাড়োয়াল জেলার অন্তর্গত একটা মফস্বল শহর ও মিউনিসিপ্যালিটী । দেবপ্রয়াগের সঙ্গমে স্নান করে কিছু পূণ্যার্জনের ইচ্ছা ইত্যবসরে মনেই আসন গ্রহণ করে রইলো । দর্শন ইস্তক আমার কেন যেন কন্যাকুমারিকার কথা মনে হচ্ছিলো । দেবপ্রয়াগ হল পঞ্চপ্রয়াগের অন্যতম এক প্রয়াগ ।
পৌরাণিক মতে বামদিক থেকে আসা গোমুখ নিঃসৃত সবজে নীল জলের ভাগিরথী হল গঙ্গার মুখ্য ধারা । তাই গঙ্গার মন্দিরও অবস্থিত গঙ্গোত্রীধামে। আর ভৌগোলিক মতে ডানদিক থেকে আসা অনেকবেশি জলপ্রবাহসমন্বিত ঘোলা জলের অলকানন্দা হল গঙ্গার প্রধান জলধারা । মতপার্থক্য যাই থাক তা আমাদের ভক্তি ও প্রকৃতিপ্রেম থেকে নিরস্ত কখনোই করেনা । এই ভারতবর্ষের বৈশিষ্ট্য । বিবিধের মাঝে দেখ মিলন মহান ।
গঙ্গাকে ও সঙ্গমকে ডানদিকে রেখে দেবপ্রয়াগের বাজার ও বাসস্ট্যান্ড পার করে ভাগিরথীর পার ধরে যাত্রা শুরু করলাম আমরা ।
ভাগীরথী অলকানন্দার সঙ্গম ও গঙ্গার জন্মস্থল । যে অ্যাঙ্গেল থেকে বেশিরভাগ ফোটোগ্রাফার ছবি নেয় । সেই বহুল পরিচিত ছবি আমিও নিয়েছি । নস্টালজিয়াকে কি করে ছাড়তে পারি
এখন এই ঘনঘোর বর্ষায় পাহাড়ের মাটি ধুয়ে জলস্রোতে মিশে প্রায় সব নদীরই জল ঘোলা হয়ে আছে । যেসব ছবিতে স্বচ্ছ নীল সবুজ জলের রঙ দেখা যায় , সেই ছবিগুলো বেশিরভাগই এপ্রিল , মে বা অক্টোবর নভেম্বর মাসে তোলা । সে সুযোগ আমার হয়নি এখনো পর্যন্ত ।
তারপর ডানদিকে ঘুরে একটা ব্রিজ পার করে ভাগিরথীর উল্টো পারে গিয়ে আবার সঙ্গম অভিমুখে যাত্রা করলাম ।
এবং সঙ্গম পার করে এবার অলকানন্দার পার ধরে এগোতে থাকলাম আমরা ।
জীবনে প্রথমবার অলকানন্দার দর্শন পেলাম আমরা । বহুশ্রুত এই নাম সাক্ষাতের সৌভাগ্য হল জীবনের বহুকাল পার করে দেবপ্রয়াগে এসে ।
রাস্তায় অনেক জায়গাতেই মহিলা শ্রমিকরা রাস্তা তৈরির কাজ করছে । উত্তরাখন্ডে মহিলাদের সম্মান উচ্চ ।
দেবপ্রয়াগ থেকে কিছুক্ষণ যাওয়ার পর শ্রীনগর বলে একটা শহর পড়লো , যেটা এতদঞ্চলের সব থেকে বড় শহর । শ্রীনগরের বাল্মিকী মন্দির দেখলাম ।
এই শ্রীনগর সেই কাশ্মীরের শ্রীনগর নয় । আমাদের ভারতবর্ষের বুকে অনেকগুলি শ্রীনগর আছে । আমাদের পশ্চিমবঙ্গেও একটি আছে । উত্তরাখন্ডের পৌড়ি গাড়োয়াল জেলার অন্তর্গত একটি বড় মিউনিসিপ্যাল বোর্ড হল শ্রীনগর ।
উচ্চতা মাত্র 1680 ফিট হওয়ার কারণে উত্তরাখন্ডের সবচেয়ে গরম শহর হল শ্রীনগর । মে - জুলাই মাসে কখনো কখনো এর তাপমাত্রা 45 ডিগ্রিতেও পৌঁছে যায় । তবে চিকিৎসা ও শিক্ষাব্যবস্থার সুযোগ এখানেই সবচেয়ে বেশি । 2014 সালে আমি NIM এর কোর্স করার সময় আমার মা বাবা যখন একা বদ্রীনাথ গেছিলো তখন ফেরার পথে বাবা অসুস্থ হয়ে পড়লে বাবাকে এই শ্রীনগরের জেলা হাসপাতালে ভর্তি করা হলে তাঁরা সম্পূর্ণ বিনামূল্যে ভালোভাবে চিকিৎসা করে একরাত রেখে ,সুস্থ করে , ছেড়ে দেন ।
শ্রীনগর শহরটা এতটাই বড় যে একবার শুরু হলে শেষই হতে চায় না । এখানে শ্রীনগর বেস হসপিটাল মেডিকেল কলেজে MBBS ও MS এর ছাত্ররা পড়াশোনা করে । এবং হেমবতী নন্দন বহুগণা গাড়োয়াল ইউনিভার্সিটি আছে, যা 2009 সালে কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয় হয়ে গেছে । এছাড়াও NIT আছে , ITI , পলিটেকনিক কলেজ , বিএড কলেজ , SSB ক্যাডেট ট্রেনিং সেন্টার আছে ।
শ্রীনগর শহরটির ইতিহাসও প্রাচীন । 1506 খ্রীষ্টাব্দে রাজা অজয় পাল গাড়োয়াল রাজ্য স্থাপন করে রাজধানী পরিবর্তন করেন চাঁদপুর গার্হি থেকে শ্রীনগরে । বহুদিন পর্যন্ত গাড়োয়ালের কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত এই শহর গুরুত্বপূর্ণ স্থান রক্ষা করে যায় । গোর্খারা নেপালিদের হারিয়ে কাঠমান্ডু দখল করার পর 1806 সালে শ্রীনগরসহ গাড়োয়াল রাজ্যটিও দখল করে । 1815 সালে আবার ব্রিটিশরা গোর্খাদের হারিয়ে শ্রীনগর দখল করে ও ব্রিটিশ গাড়োয়ালের অন্তর্ভুক্ত করে ।
পুরনো শ্রীনগর শহরটি তার সমস্ত প্রাচীন মূর্তি ও স্থাপত্যসহ গোহনা লেক ড্যাম বার্স্ট এর ফলে সম্পূর্ণরুপে ধ্বংস প্রাপ্ত হয় ।
গঙ্গা মাঝেমাঝে রাস্তা থেকে অনেকদূরে দৃষ্টির বাইরে চলে যাচ্ছে । আমরা গঙ্গার উজানে যাত্রা করছি । গঙ্গার যাত্রাপথের শেষাংশের থেকে উৎসের সমীপে চলেছি । মর্ত হতে স্বর্গের দিকে চলেছি । আমার শহর কলকাতায় গঙ্গার নাম ভাগিরথী হুগলী । আমার প্রদেশের গঙ্গাসাগরে গঙ্গা তার যাত্রাপথ সম্পূর্ণ করে সাগরে মিলিত হয় । আর এই উত্তরাখন্ড প্রদেশের গঙ্গোত্রী হিমবাহের গোমূখ থেকে গঙ্গা তথা ভাগিরথীর উৎপত্তি হয় । গঙ্গাসাগর আমার অনেকবার যাওয়া । গঙ্গোত্রী একবারো যাওয়া নয় ।
আবার দূ্রে গঙ্গা দেখা দিতে থাকে । পাহাড়ের গঠন ও কাঠিন্য অনুযায়ী কুঞ্চিত গতিপথ তার । রাস্তায় টোলি , বছেরিখাল , কোটা কুন্ডলি বলে জায়গা পড়ে । শ্রাবণমাস হলেও রৌদ্রজ্জ্বল দিন । আমরা ভাবছিলাম এরকমই যদি পরিষ্কার আবহাওয়া থাকে গোটা ট্যুরে , তাহলে কতই না ভালো হয় !
উত্তরাখন্ডকে দেব ভূমি অথবা ইশ্বরের ভূমি বলা হয় কারন এখানে বিভিন্ন ধর্মীয় স্থান এবং মন্দির দেখা যায় যেগুলিকে এই অঞ্চলের অত্যন্ত পবিত্র তীর্থস্থান বলে মনে করা হয়।
উত্তরপ্রদেশের উত্তর–পশ্চিম অংশ এবং হিমালয় পর্বতমালার একটি অংশের বেশ কয়েকটি জেলা নিয়ে উত্তরাখণ্ড অঞ্চলটি গঠিত। রাজ্যটি হিমালয়ের তরাই ও ভাবর অঞ্চলের নিজস্ব প্রাকৃতিক সৌন্দ্যর্য ও সম্পদের জন্য বিখ্যাত। রাজ্যের উত্তরে স্বায়ত্ত শাসিত অঞ্চল তিব্বত অবস্থিত।
২০০৭ সালে এই রাজ্যটির নাম উত্তরাঞ্চল থেকে উত্তরাখন্ড করা হয়েছে। দেরাদুন, রাজ্যের রাজধানী এবং এটি এই রাজ্যের বৃহত্তম শহর। উত্তরাখন্ডের প্রধান বিচারালয় নৈনিতালে অবস্থিত, যেটি হল এই রাজ্যের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ শহর। হস্তশিল্প ও তাঁত এই দুই হল রাজ্যের প্রধান শিল্প। ‘চিপকো’ আন্দোলনের উৎস হিসাবে এই রাজ্য পরিচিত।
২০০০ সালের ৯-ই নভেম্বর থেকে এটি পৃথক রাজ্য সরকার সহ ভারতের একটি পূর্ণাঙ্গ রাজ্যে পরিনত হয়। ভারতের বৃহত্তম জনবহুল রাজ্য, উত্তরপ্রদেশকে বিভাজন করে এই রাজ্যটি গঠিত হয়েছে।
২০০৭ সালে এই রাজ্যটির নাম উত্তরাঞ্চল থেকে উত্তরাখন্ড করা হয়েছে। দেরাদুন, রাজ্যের রাজধানী এবং এটি এই রাজ্যের বৃহত্তম শহর। উত্তরাখন্ডের প্রধান বিচারালয় নৈনিতালে অবস্থিত, যেটি হল এই রাজ্যের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ শহর। হস্তশিল্প ও তাঁত এই দুই হল রাজ্যের প্রধান শিল্প। ‘চিপকো’ আন্দোলনের উৎস হিসাবে এই রাজ্য পরিচিত।
২০০০ সালের ৯-ই নভেম্বর থেকে এটি পৃথক রাজ্য সরকার সহ ভারতের একটি পূর্ণাঙ্গ রাজ্যে পরিনত হয়। ভারতের বৃহত্তম জনবহুল রাজ্য, উত্তরপ্রদেশকে বিভাজন করে এই রাজ্যটি গঠিত হয়েছে।
রাজ্য ৫৩,৪৮৩ বর্গ কিমি অঞ্চল জুড়ে অবস্থিত। বেশীর ভাগ অংশ জঙ্গল এবং পর্বত বেষ্ঠিত। এখানে পৃথক ধরনের উদ্ভিদকুল ও প্রাণিকুল দেখা যায়, যেমন- তুষার চিতা, ভড়াল, বাঘ, চিতাবাঘ এবং অসাধারণ কিছু গুল্ম ও বৃক্ষ। ভারতীয় প্রজাতন্ত্রের দুই প্রধান নদী গঙ্গা ও যমুনার উৎসস্হল হল এই রাজ্য। উত্তরাখণ্ডের প্রধান ভৌগোলিক বৈশিষ্ট্য গুলি :
পর্বতময় গুল্মজ এবং সমতল ভূ-ভাগ।
পশ্চিম হিমালয়ের আলপাইন গুল্ম জাতীয় বৃক্ষ এবং চারণভূমি
সরলবর্গীয় বনাঞ্চল
পশ্চিম হিমালয়ের উপজাত– আলপাইন বৃক্ষ এবং সরলবর্গীয় বনাঞ্চল
পশ্চিম হিমালয়ের শঙ্কু-আকৃতি সূঁচালো বনাঞ্চল
হিমালয় পর্বতশ্রেণীর পাইন বনাঞ্চল
তরাই-ডুয়ার্স নিম্ন ভূমি এবং সাভানা বনাঞ্চল
উচ্চ গাঙ্গেয় সমভূমির আর্দ্র সরলবর্গীয় অরণ্য
এই রাজ্যের অর্থনীতি সাম্প্রতিক কালে দ্রুত গতিতে এগোচ্ছে। কৃষি উত্তরাখণ্ডের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র। চাল, সয়াবিন, গম, চীনাবাদাম, ডাল, মোটা শস্য এবং তৈল বীজ হল এই অঞ্চলের প্রধান ফসল। আপেল, নাসপাতি, কমলা লেবু, পীচ, কুল এবং লিচু এখানে ব্যাপকভাবে জন্মায় এবং তাই খাদ্য শিল্প এখানকার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এই রাজ্যের প্রধান অর্থকারী ফসল হল আখ। এই রাজ্যে পর্যটনক্ষেত্রের উন্নতির উচ্চ প্রত্যাশা রয়েছে। পর্যটনের প্রভূত উন্নতি এই রাজ্যের বার্ষিক আয়ের সাথে যুক্ত হয়। এই রাজ্যে পর্যটন শিল্পে আরো বিনিয়োগ তথা আরো অন্বেষণ করা প্রয়োজন। অন্য আরেকটি ক্ষেত্র, কৃষি-উদ্যোগে রাজ্যের অর্থনৈতিক উন্নতি প্রয়োজন, যা রাজস্ব বৃ্দ্ধিতে সাহায্য করবে।
উত্তরাখণ্ড ভারতবর্ষের উত্তর প্রান্তে অবস্থিত। এই অঞ্চলটির মোট ভূমির আয়তন ৫৩,৪৮৩ বর্গ কিমি। ২০১১ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী এখানকার মোট জনসংখ্যা হল ১,০০,৮৬,২৯২। সর্বশেষ আদমশুমারি অনুযায়ী এই রাজ্যের জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ১৯.১৭ শতাংশ। মহিলা ও পুরুষের অনুপাত হল ১০০০: ৯৬৩। এই অঞ্চলের জনঘনত্ব হলো প্রতি বর্গ কিমিতে ১৮৩ জন। উত্তরাখণ্ডের স্বাক্ষরতার হার ৭৯.৬৩ শতাংশ। এই রাজ্যটি তিব্বত, নেপাল, হিমাচল প্রদেশ ও উত্তর প্রদেশের সমতল জেলার সীমানাগুলি নিয়ে বেষ্টিত। রাজ্যের রাজধানী দেরাদুন ও ভারতের রাজধানী নতুন-দিল্লীর মধ্যে দূরত্ব হল ২৪০ কিমি। উত্তরাখণ্ডে মোট ১৩-টি জেলা বর্তমান- পিথোরাগড়, আলমোড়া, নৈনিতাল, বাগেশ্বর, চমপাওয়াত, উত্তর-কাশী, উধাম সিং নগর, চামোলি, দেরাদুন, পৌরি গাড়োয়াল, টেহরি গাড়োয়াল, রুদ্র প্রয়াগ এবং হরিদ্বার (শহর)।
উত্তরাখণ্ডের ইতিহাস এই রাজ্যের গুরুত্বপূর্ণ অতীতের কথা বলে। বেশ কিছু রাজ্য এবং মহান রাজাদের উল্লেখ সহ এই রাজ্যের একটি লম্বা ইতিহাস আছে- যেখানে কূষান, কুদিনা, কনিষ্ক, সমুদ্রগুপ্ত, কাটুরিয়া, পাল, চন্দ্র এবং পাওয়ারদের নাম উল্লেখ আছে। উত্তরাখণ্ডের ইতিহাস এর কথা বহু পবিত্র হিন্দু ধর্মগ্রন্থে লেখা আছে। কিন্তু এর সেরা ইতিহাস গাড়োয়াল এবং কুমায়ুনের ইতিহাসের মাধ্যমে ভালো বোঝা যাবে।
রাজ্যের জীবনধারা, রীতিনীতি ও ঐতিহ্য উত্তরাখণ্ডের সমাজকে প্রভাবিত করে। এখানকার সংস্কৃতি উত্তরাখণ্ডের সামাজিক দিককে আরোও প্রসারিত করে। এটি হল কুমায়ুন ও গাড়োয়াল অঞ্চলের বিভিন্ন জাতিগত গোষ্ঠীর একটি ভিন্নধর্মী সংস্কৃতির সংমিশ্রণ। রাজ্যের বেশীরভাগ মানুষ হিন্দু ও বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী, কিছু সংখ্যক শিখ ধর্মাবলম্বীও রয়েছে, যারা ১৯৪৭ সালে পশ্চিম-পাঞ্জাব থেকে এসে উত্তরাখণ্ডে বসতি স্থাপন করেছে। নৃত্য এই অঞ্চলের মানুষের জীবন এবং অস্তিত্বের সাথে অহরহ ভাবে যুক্ত, যা অগণিত মানবিক ভাবনাকে প্রকাশ করে। সংগীত উত্তরাখণ্ডের সংস্কৃতির অভিন্ন অংশ। লোকগীতির মধ্যে জনপ্রিয় বিভাগগুলি হল বাসন্তী, মঙ্গল, খুদেদ এবং ছোপাটি। এখানকার স্থানীয় কারুশিল্পের মধ্যে বিশিষ্ট হল কাঠ খোদাই। উত্তরাখন্ডের হরিদ্বারে হিন্দুধর্মের গুরুত্বপূর্ণ তীর্থ কুম্ভ মেলা হয় এবং এটিকে বিশ্বের বৃহত্তম ধর্ম সম্মেলন বলে মনে করা হয়। এখানকার অন্যান্য উৎসবগুলি হল– ঘি-সংক্রান্তি, বাতসাবিত্রী, খাতারুয়া, ফুল দেই, হারেলা মেলা, নন্দাদেবী মেলা ইত্যাদি ।
এখানকার দুই প্রধান আঞ্চলিক ভাষা হল- গাড়োয়ালি এবং কুমাউনি, কিন্তু হিন্দি হল এখানকার কথ্য ভাষা। গাড়োয়ালি এবং কুমাউনি উপভাষা গাড়োয়াল এবং কুমায়ুন অঞ্চলে উচ্চারিত হয়। পশ্চিম ও উত্তর অঞ্চলের কিছু আদিবাসী সম্প্রদায় জাউন্সারি এবং ভোটিয়া উপভাষায় কথা বলে। অন্য দিকে, শহুরে জনসংখ্যার বেশিরভাগই হিন্দি ভাষায় কথা বলে যা সংস্কৃত সহ উত্তরাখণ্ডের আধিকারিক ভাষা।
২০০০ সালে গঠিত এই নতুন রাজ্যের উন্নতিতে উত্তরাখণ্ড সরকার বহু প্রগতিশীল কর্মসূচী গ্রহন করেছে। এটি একটি সুদক্ষ বিধান পরিষদ, যা সমভাবে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ নির্বাহী বিভাগ ও আইন সভা নিয়ে গঠিত। রাজ্যের রাজধানী গাড়োয়াল বিভাগের দেরাদুন, যেখানে সকল সরকারী অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হয়। এখানে মোট পাঁচটি সংসদীয় আসন এবং ৭০-টি একক কক্ষবিশিষ্ট বিধানসভা আসন রয়েছে।
প্রকৃতি, বন্যপ্রাণী, রোমাঞ্চকর কাজ বা তীর্থস্থান যে কারণই হোক, পর্যটনের এখানে প্রচুর সম্ভাবনা রয়েছে। এই অঞ্চলের প্রধান পর্যটন কেন্দ্রগুলি হল- হরিদ্বার, হৃষিকেশ, দেরাদুন, মুসৌরি, আলমোড়া, কেদারনাথ, বদ্রীনাথ, যমুনোত্রী, গঙ্গোত্রী, জিম করবেট জাতীয় উদ্যান, নৈনিতাল, রানিখেত এবং পিথোরাগড়। যদি আপনি দু:সাহসী হন এবং কঠিন প্রতিবন্ধকতা উপভোগ করতে আগ্রহী হন, তাহলে আপনি – উচ্চ এবং নিম্ন উচ্চতায় ট্রেকিং, প্যারা গ্লাইডিং, পর্বতারোহণ, স্কাইং, রিভার র্যাফটিং এবং অন্যান্য অনেক কার্যক্রম করতে পারেন।
ভারতের উত্তরাখণ্ড বিমান, রেল ও সড়ক পথ দ্বারা সহজে প্রবেশযোগ্য। দেরাদুনের কাছাকাছি জলি গ্রান্ট বিমানবন্দর এই অঞ্চলের সবচেয়ে জনপ্রিয় বিমানবন্দর। দেরাদুনে কিছু অন্তর্দেশীয় বিমান সংস্থা, বিমান চালনা করে। উত্তরাখণ্ড, ভারতীয় শহর ও উপ-শহরগুলির মধ্যে একটি চমৎকার রেলপথের জালবিন্যাস ঘটিয়েছে। দেশের অন্যান্য অংশের সঙ্গে রাজ্যের সংযোগ স্থাপনকারী, কিছু প্রধান রেলওয়ে স্টেশনগুলি হল- দেরাদুন রেল স্টেশন, হরিদ্বার রেল স্টেশন এবং কাঠগোদাম রেল স্টেশন । উত্তরাখণ্ড-এর ৫৮,৭৩,৭৪,৮৭-নং জাতীয় মহাসড়কগুলি অন্যান্য ভারতীয় রাজ্যগুলির মধ্যে সংযোগ স্থাপন করেছে। রাজ্য সড়ক পরিবহন কর্পোরেশন (এস.আর.টি.সি), এই রাজ্যের বাস পরিষেবা পরিচালনা করে।
উত্তরাখন্ডের কুমায়ুন বিভাগ ও গাড়োয়াল বিভাগ , এইদুটি বিভাগের অন্তর্গত জেলাগুলি হল:-
কুমায়ুন বিভাগ : আলমোড়া , বাগেশ্বর , চম্পাব, নৈনিতা, পিথোরাগড় , উধম সিং নগর ।
গাড়োয়াল বিভাগ: দেরাদুন , হরিদ্বার, তেহরি গাড়োয়াল (সাধারণত তেহরি নামে পরিচিত), উত্তরকাশী , চামোলি, পৌরি গাড়োয়াল (সাধারণত পৌরি নামে পরিচিত), রুদ্রপ্রয়াগ ।
তিনধারা বলে একটা জায়গায় আমরা খাবার খেয়েছিলাম । দুটো তন্দুরি রুটি , তরকারি , ডাল, 60 টাকা প্লেট । চা 10 টাকা। খেয়ে পেট ভরেছিলো , তৃপ্তিও হয়েছিল যথেষ্ট ।
তিনধারার অল্পকিছুক্ষণ পরেই এসে গেল দেবপ্রয়াগ । সেই চিরচেনা , আইকনিক , অনিন্দ্যসুন্দর দৃশ্য । চমকে গেছিলাম প্রথমে । তারপরে মন ভরে উঠলো কিছুটা সন্তোষ , কিছুটা স্ফূর্তি , কিছুটা আশায় । দেবপ্রয়াগ দর্শন হয়ে গেল , আমাদের ট্যুরের একটা পর্ব সম্পূর্ণ হয়ে গেল । বাকি ট্যুরটাও সাফল্যের সঙ্গে সম্পূর্ণ হয়ে যাবে এমন একটা আশ্বাস মনের ভেতর থেকে উঠে এল ।
কতবার কত বইতে , ছবিতে যে এদৃশ্য দেখেছি । আসলে এতটা ওয়াইড অ্যাঙ্গেলে নয় , অনেকটা টপ অ্যাঙ্গেল থেকেই ছবি সবাই তোলেন । আমি নেহাত সুযোগ পেয়ে গেছি এত ওয়াইড অ্যাঙ্গেলে বিস্তৃত দৃশ্যাবলীসহ ছবিটা তোলার । গঙ্গার উৎপত্তিস্হল এই দেবপ্রয়াগ । বাঁদিকের তুঁতে রঙের জলরাশি উত্তরকাশি জেলার গঙ্গোত্রী থেকে আগত ভাগিরথী নদীর আর ডানদিকের মেটে রঙের জলরাশি চামোলি জেলার অলকাপূরী থেকে আগত অলকানন্দা নদীর । দুই নদী মিলিত হয়ে এখানে থেকে গঙ্গা নাম নিয়ে দক্ষিণে প্রবাহিত হয়েছে ভারতবর্ষের উদ্ধারহেতু ।
দেবপ্রয়াগ তেহরি গাড়োয়াল জেলার অন্তর্গত একটা মফস্বল শহর ও মিউনিসিপ্যালিটী । দেবপ্রয়াগের সঙ্গমে স্নান করে কিছু পূণ্যার্জনের ইচ্ছা ইত্যবসরে মনেই আসন গ্রহণ করে রইলো । দর্শন ইস্তক আমার কেন যেন কন্যাকুমারিকার কথা মনে হচ্ছিলো । দেবপ্রয়াগ হল পঞ্চপ্রয়াগের অন্যতম এক প্রয়াগ ।
পৌরাণিক মতে বামদিক থেকে আসা গোমুখ নিঃসৃত সবজে নীল জলের ভাগিরথী হল গঙ্গার মুখ্য ধারা । তাই গঙ্গার মন্দিরও অবস্থিত গঙ্গোত্রীধামে। আর ভৌগোলিক মতে ডানদিক থেকে আসা অনেকবেশি জলপ্রবাহসমন্বিত ঘোলা জলের অলকানন্দা হল গঙ্গার প্রধান জলধারা । মতপার্থক্য যাই থাক তা আমাদের ভক্তি ও প্রকৃতিপ্রেম থেকে নিরস্ত কখনোই করেনা । এই ভারতবর্ষের বৈশিষ্ট্য । বিবিধের মাঝে দেখ মিলন মহান ।
গঙ্গাকে ও সঙ্গমকে ডানদিকে রেখে দেবপ্রয়াগের বাজার ও বাসস্ট্যান্ড পার করে ভাগিরথীর পার ধরে যাত্রা শুরু করলাম আমরা ।
ভাগীরথী অলকানন্দার সঙ্গম ও গঙ্গার জন্মস্থল । যে অ্যাঙ্গেল থেকে বেশিরভাগ ফোটোগ্রাফার ছবি নেয় । সেই বহুল পরিচিত ছবি আমিও নিয়েছি । নস্টালজিয়াকে কি করে ছাড়তে পারি
এখন এই ঘনঘোর বর্ষায় পাহাড়ের মাটি ধুয়ে জলস্রোতে মিশে প্রায় সব নদীরই জল ঘোলা হয়ে আছে । যেসব ছবিতে স্বচ্ছ নীল সবুজ জলের রঙ দেখা যায় , সেই ছবিগুলো বেশিরভাগই এপ্রিল , মে বা অক্টোবর নভেম্বর মাসে তোলা । সে সুযোগ আমার হয়নি এখনো পর্যন্ত ।
তারপর ডানদিকে ঘুরে একটা ব্রিজ পার করে ভাগিরথীর উল্টো পারে গিয়ে আবার সঙ্গম অভিমুখে যাত্রা করলাম ।
এবং সঙ্গম পার করে এবার অলকানন্দার পার ধরে এগোতে থাকলাম আমরা ।
জীবনে প্রথমবার অলকানন্দার দর্শন পেলাম আমরা । বহুশ্রুত এই নাম সাক্ষাতের সৌভাগ্য হল জীবনের বহুকাল পার করে দেবপ্রয়াগে এসে ।
রাস্তায় অনেক জায়গাতেই মহিলা শ্রমিকরা রাস্তা তৈরির কাজ করছে । উত্তরাখন্ডে মহিলাদের সম্মান উচ্চ ।
দেবপ্রয়াগ থেকে কিছুক্ষণ যাওয়ার পর শ্রীনগর বলে একটা শহর পড়লো , যেটা এতদঞ্চলের সব থেকে বড় শহর । শ্রীনগরের বাল্মিকী মন্দির দেখলাম ।
এই শ্রীনগর সেই কাশ্মীরের শ্রীনগর নয় । আমাদের ভারতবর্ষের বুকে অনেকগুলি শ্রীনগর আছে । আমাদের পশ্চিমবঙ্গেও একটি আছে । উত্তরাখন্ডের পৌড়ি গাড়োয়াল জেলার অন্তর্গত একটি বড় মিউনিসিপ্যাল বোর্ড হল শ্রীনগর ।
উচ্চতা মাত্র 1680 ফিট হওয়ার কারণে উত্তরাখন্ডের সবচেয়ে গরম শহর হল শ্রীনগর । মে - জুলাই মাসে কখনো কখনো এর তাপমাত্রা 45 ডিগ্রিতেও পৌঁছে যায় । তবে চিকিৎসা ও শিক্ষাব্যবস্থার সুযোগ এখানেই সবচেয়ে বেশি । 2014 সালে আমি NIM এর কোর্স করার সময় আমার মা বাবা যখন একা বদ্রীনাথ গেছিলো তখন ফেরার পথে বাবা অসুস্থ হয়ে পড়লে বাবাকে এই শ্রীনগরের জেলা হাসপাতালে ভর্তি করা হলে তাঁরা সম্পূর্ণ বিনামূল্যে ভালোভাবে চিকিৎসা করে একরাত রেখে ,সুস্থ করে , ছেড়ে দেন ।
শ্রীনগর শহরটা এতটাই বড় যে একবার শুরু হলে শেষই হতে চায় না । এখানে শ্রীনগর বেস হসপিটাল মেডিকেল কলেজে MBBS ও MS এর ছাত্ররা পড়াশোনা করে । এবং হেমবতী নন্দন বহুগণা গাড়োয়াল ইউনিভার্সিটি আছে, যা 2009 সালে কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয় হয়ে গেছে । এছাড়াও NIT আছে , ITI , পলিটেকনিক কলেজ , বিএড কলেজ , SSB ক্যাডেট ট্রেনিং সেন্টার আছে ।
শ্রীনগর শহরটির ইতিহাসও প্রাচীন । 1506 খ্রীষ্টাব্দে রাজা অজয় পাল গাড়োয়াল রাজ্য স্থাপন করে রাজধানী পরিবর্তন করেন চাঁদপুর গার্হি থেকে শ্রীনগরে । বহুদিন পর্যন্ত গাড়োয়ালের কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত এই শহর গুরুত্বপূর্ণ স্থান রক্ষা করে যায় । গোর্খারা নেপালিদের হারিয়ে কাঠমান্ডু দখল করার পর 1806 সালে শ্রীনগরসহ গাড়োয়াল রাজ্যটিও দখল করে । 1815 সালে আবার ব্রিটিশরা গোর্খাদের হারিয়ে শ্রীনগর দখল করে ও ব্রিটিশ গাড়োয়ালের অন্তর্ভুক্ত করে ।
পুরনো শ্রীনগর শহরটি তার সমস্ত প্রাচীন মূর্তি ও স্থাপত্যসহ গোহনা লেক ড্যাম বার্স্ট এর ফলে সম্পূর্ণরুপে ধ্বংস প্রাপ্ত হয় ।