কালীঞ্জর দূর্গ, ইতিহাসের এক রহস্যময় দূর্গ

বহুদিন আগে ২০০৪ সালের অক্টোবর মাসে পূজোর দিনগুলোতে একবার বুন্দেলখণ্ড ভ্রমণে গিয়েছিলাম।বুন্দেলখণ্ড হোল মধ্যভারতের একটি ভৌগলিক ও সাংস্কৃতিক অঞ্চল যার বেশিরভাগই পার্বত্য ভূমি।বিন্ধ্য পর্বতমালা এই ভৌগলিক অঞ্চলে বিস্তৃত।এখানকার রুক্ষ বন্ধুর মালভূমি, তার মধ্যে মধ্যে সবুজ ঝোপঝাড় ও বৃহৎ বনস্পতি এবং দিকচক্রবালে সবুজ ও বাদামি পাহাড়ের সারির সৌন্দর্য মনকে মোহিত করে তোলে। বর্তমানে এই অঞ্চলটি উত্তরপ্রদেশ ও মধ্যপ্রদেশের সীমান্তে অবস্থিত, যার বেশিরভাগই মধ্যপ্রদেশে অবস্থিত। আমার প্রধান উদ্দেশ্য ছিল খাজুরাহোর জগদ্বিখ্যাত মন্দিররাজী দর্শন করা। সেই যাত্রায় আমি বর্ধমান স্টেশন থেকে চম্বল এক্সপ্রেসে উঠে চিত্রকূটধাম কার্ভী স্টেশনে নেমেছিলাম।চিত্রকূটে এক দিন অবস্থান এবং তার মধ্যে কিছু প্রধান দ্রষ্টব্য স্থান দেখে সেখান থেকে বাসে সাতনা চলে গিয়েছিলাম। তারপর দুদিন খাজুরাহো দেখে বাড়ি চলে আসতে হয়েছিল। তবু আমি তারই মধ্যে হোটেল ম্যানেজারকে কালীঞ্জর দূর্গ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করেছিলাম। কিন্তু তিনি আমাকে নিরুৎসাহিত করলেন। তিনি বললেন "কোন্ উধার যাতা হ্যায় সাব্?সারে সাহাব লোগ তো ইধারই ঘুমতে হ্যায়,মন্দির,বাগিচা,ঝর্ণো বগাড়া,এহি সব ঘুমকে দেখতে হ্যায়।উধার মত যাইয়ে সাব,বহুত সারে তকলিফ্ উঠানা পরেগা,ঔর উধার দেখনে কা লায়েক চীজ তো হ্যায় নেহি কুছ।" বুঝলাম প্রাচীন ঐতিহাসিক খণ্ডহর সম্পর্কে এদের কোন উৎসাহ নেই। আমার কাছে সেইসময় অত সময়ও ছিল না,তাই সে যাত্রায় কালীঞ্জর না দেখেই বাড়ি ফিরে চলে আসতে হয়েছিল।
গত বছর(২০১৮) পূজোর সময় ভাবলাম চিত্রকূটটা একবার ভালো করে দেখা দরকার।চিত্রকূট এবং তার আশেপাশের দ্রষ্টব্য স্থানগুলো ঘুরে দেখতে মোটামুটি চার পাঁচটা দিন সময় লাগে। দুদিন ধরে এবার চিত্রকূট দেখলাম, আশেপাশে দেখার অনেক কিছুই বাঁকি থেকে গেল।কালীঞ্জর সম্পর্কে একটা আকর্ষন তো আগে থেকেই ছিল।তার উপরে "রং রুট" নামে ভ্রমণ বিষয়ক এক পত্রিকার দূরদর্শনের অনুষ্ঠানে কালীঞ্জরকে এমন একটি রহস্যের মোড়কে পরিবেশন করা হয়েছিল যে তাতে কালীঞ্জর সম্পর্কে কৌতুহলটা আরো বেড়ে গিয়েছিল।তাই এবার চিত্রকূট দুদিন দেখে দুপুরে পৌঁছে গেলাম চিত্রকূটধাম কার্ভী রেলস্টেশন সংলগ্ন কার্ভী বাসস্ট্যান্ডে।এখনে এসে ভাবলাম গণেশ বাগ্ দেখে এলে কেমন হয়?এপথে তো সহসা আসা হয় না,তাই একটা অটোরিকশা ভাড়া করে গণেশ বাগ্ দর্শনের উদ্দেশ্যে যাত্রা করলাম।
গণেশ বাগ হোল চিত্রকূট থেকে এগারো কিলোমিটার দূরে কার্ভী দেবাঙ্গনা রোডের উপর অবস্থিত একটি প্রমোদ উদ্যান যেটি পেশোয়া বিনায়ক রাও ১৮৮০ সালে তাঁর গ্রীষ্মকালীন আবাসস্থল হিসেবে গড়ে তোলেন। পেশোয়াদের ক্রীড়াক্ষেত্র ছিল এটি।এই বাগিচার প্রধান আকর্ষণ হলো সুন্দর কারুকার্য খচিত একটি শিব মন্দির, একটি সাততলা বিশিষ্ট কল্যাণী বা Step Well, যাকে স্থানীয় ভাষায় বাউলি বলে এবং পেশোয়ার বসবাসের জন্য একটি প্রাসাদ।
প্রবেশদ্বার দিয়ে ঢুকেই প্রথমেই সাত তলা বিশিষ্ট বাউলি বা কল্যাণীটি (Step Well) নজরে এলো। আমি এর স্তম্ভযুক্ত ও খিলান দেওয়া সর্বাপেক্ষা উপরের তলাতেই ঘুরে বেড়ালাম।এর নিচে আরো দুটি তলা দৃষ্টিগোচর হলো কারণ এই দুটি জলস্তরের উপরে ছিল। জলের নিচে আরো একটি তলা দেখা যাচ্ছিল, কিন্তু তার নিচের তলাগুলো আর দেখা যাচ্ছিল না। দুপাশে খিলান দেওয়া বারান্দার মাঝে লম্বা ক্যানেল অনেকদূর অবধি বিস্তৃত। একটি নির্দিষ্ট দূরত্ব অন্তর অন্তর দুপাশের বারান্দা পরস্পরের সঙ্গে অনুভূমিক পাথরের Platform দ্বারা পরস্পরের সঙ্গে যুক্ত।দূরে একটি বৃহৎ গোলাকার কূপের মত স্থাপত্য দেখা যায়।এটিও জলে পরিপূর্ণ, কতখানি যে গভীর বোঝা খুব মুশকিল। তবে শুনলাম এতই গভীর যে পড়ে গেলে মৃত্যু অবধারিত। কূপের চারদিকে ঢাকা বৃত্তাকার বারান্দা দেখা যায়।এই স্থান সম্ভবতঃ অভিজাত শ্রেণীর মানুষের স্নানের স্থান হিসেবে ব্যবহার করা হতো।
কল্যাণীটির অপর দিকে একটি ছোট দরজা খোলা মাঠে উন্মুক্ত হয়।এই খোলা মাঠে একটি আমগাছ দাঁড়িয়ে আছে। কল্যাণীটির গঠন,গঠনশৈলী এবং এতে সদাসর্বদা জলের উপস্থিতি একটি ঠাণ্ডা বাতাবরণ তৈরি করে যা বুন্দেলখণ্ডের প্রবল গরম থেকে আরাম প্রদান করে। প্রকৃতির সঙ্গে খাপ খাওয়ানোর জন্য এর স্থাপত্যশৈলী বিস্ময়ের উদ্রেক করে।সেই সময়ে মানুষ প্রকৃতির প্রতিকূলতাকে প্রশমিত করার জন্য পরিবেশ বান্ধব উপায়ে তার আরাম ও বিলাসের জন্য নির্মাণ কাজ করতো। কিন্তু আজ উন্নয়নের নামে ও নিজের স্বাচ্ছন্দ্যের জন্য প্রকৃতিকে ধ্বংস ও দূষিত করে চলেছে।নিকটেই একটি পেশোয়ার বসবাসের জন্য প্রাসাদ আছে যেটি আংশিক ভাবে ধ্বংস প্রাপ্ত হলেও কিছু কিছু খিলান ও বারান্দা এখনও অক্ষত আছে যা অতীত দিনের গৌরবগাথা স্মরণ করিয়ে দেয়। প্রাসাদটি আংশিক ভাবে জলে নিমজ্জিত।
শিবমন্দিরটি একটি উঁচু ভিতের উপর প্রতিষ্ঠিত। এখানে স্তম্ভযুক্ত ঢাকা বারান্দার একপ্রান্তে তিনটি কক্ষে(গর্ভগৃহে) পাথরের ফ্রেমযুক্ত দরজা দেখা যায়,যাতে বিভিন্ন দেবদেবীর মূর্তি খোদিত আছে। কিছু কিছু প্রতিকৃতিতে নীল, গোলাপী ও বেগুনী রঙের অবশেষ দেখতে পাওয়া যায়।কোন গর্ভগৃহতেই কোন বিগ্রহ নেই। কোন পূজোপাঠ এখানে হয় না। কিন্তু স্থানীয় মানুষ শ্রাবণ মাস ও শিবরাত্রির সময়ে এখানে ভীড় করেন।
এই শিবমন্দিরের গর্ভগৃহের সামনে যে বারান্দা চলে গিয়েছে তা খুবই ইন্টারেস্টিং। বারান্দার মেঝেতে চৌপড় (চোপাদ বা চৌপদ পচিসী) খেলার কোর্ট খোদাই করা আছে। বারান্দাতে বসে ভক্তজন সাধন ভজন ও প্রার্থনা করে থাকেন। এখানে এইরকম খেলার ব্যবস্থা সত্যিই খুব ইন্টারেস্টিং। বারান্দার অপর প্রান্ত থেকে দুপাশের দুটি সিঁড়ি দিয়ে ছাদে ওঠা যায়। বারান্দার কয়েক ফুট সামনে একটি ডিম্বাকৃতি ছোট পুকুরো মতো জলাশয় দেখা যায়।
ছাদে উঠে দেখলাম কারুকার্য খচিত মন্দিরের শিখরগুলি হাত দিয়ে ধরা যাচ্ছে।এই রকম অভিনব স্থাপত্য দেখা যায় না।শিখরগুলিতে নানা দেবদেবীর মূর্তি, পৌরাণিক জীবজন্তু ও কিছু কামদ্দীপক ভাস্কর্য দেখা যায়।সরু সেতুর মত পথের সাহায্যে ছাদ থেকে প্রাসাদে যাওয়া যেত।শিখরের সামনে একটি ঢাকা প্ল্যাটফর্মের উপর গণেশ ঠাকুরের মূর্তি বসানো আছে। সেইজন্য অনেক স্থানীয় মানুষ এই মন্দিরকে গণেশ মন্দির বলে থাকেন, যদিও এই মন্দিরের প্রধান দেবতা শিব।
গণেশ বাগের অপর একটি সৌন্দর্য হোলো মন্দিরের কাছে একটি বড় পুষ্করিনী যার চারিদিকে বাঁধানো সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামা যায়।পুষ্করিনীটি বর্গাকার।এর চারদিকে কয়েকটি কয়েকটি ছত্রী এখনও অবিকৃত আছে।এই রকমের আরো কিছু স্থাপত্য এর চারদিকে ছিল।
গণেশ বাগ্ Archeological Survey of India (ASI) দ্বারা সংরক্ষিত।এর পারিপার্শিক পরিবেশ পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন ও নিরালা।আজও এখানে এলে মনের আনন্দ ও আত্মার শান্তি পাওয়া যায় যা ক্লান্ত হৃদয় ও স্নায়ুকে শান্ত করে তোলে।গণেশ বাগের চারিদিকে খোলা মাঠ, গাছপালা এবং ছোট্ট ছোট্ট গ্রাম দেখতে পাওয়া যায়। যাদের একাকিত্ব, ইতিহাস, স্থাপত্য এবং প্রকৃতি ভালোলাগে তাদের এই স্থানে ভ্রমণের সুযোগ হাতছাড়া করা উচিত হবে না। এখানে ভ্রমণের সবচেয়ে ভালো সময় হোল সেপ্টেম্বর, অক্টোবর, জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি মাস। গণেশ বাগ কেবল দিনের বেলায় ভ্রমণ করা উচিত।
ছাদের উপর থেকে চারপাশের দৃশ্যাবলী খুবই মনোরম। যদি এটা বর্ষার মরসুম হয় তবে দেখা যাবে যে চারপাশে দূরে নীল কুয়াশা ঢাকা বিন্ধ্য পর্বতমালার ক্যানভাসে সবুজের সব রকমের শেডে রাঙানো প্রকৃতি আঁকা রয়েছে। আমি নিশ্চিত, ছাদের উপর বসে নিরবতার গান শোনা একটি অবিস্মরণীয় অভিজ্ঞতা হয়ে থাকবে।
দেড় ঘণ্টা সময় এখানে অতিবাহিত করে আমি আমার ভাড়া করা অপেক্ষারত অটোরিকশায় চেপে কার্ভী বাসস্ট্যান্ডে চলে এলাম।এর পরের গন্তব্য কালীঞ্জর।কালীঞ্জরের গল্প এর পরের দিন বলবো।
ক্রমশ..…....….............…........

Kalinjar historical mysterious Fort