🌺 বক্রেশ্বর শক্তিপীঠ দর্শন 🌺

শক্তিপীঠের নাম - বক্রেশ্বর
দেবী - মহিষমর্দিনী / জয়দুর্গা
ভৈরব - বক্রেশ্বর / বক্রনাথ / বটুকনাথ

শক্তি উপাসনার জন্য পশ্চিমবঙ্গের বীরভূম জেলা অতি প্রাচীনকাল থেকেই উল্লেখ্য । এইখানেই সিদ্ধপীঠ তথা বক্রেশ্বর শক্তিপীঠ অবস্থিত । এখানে দেবীর "মন" মতান্তরে দেবীর "দুই ভ্রুর মধ্যবর্তী" অংশ পতিত হয়েছিলো ।

“পীঠমালামহাতন্ত্র” শাস্ত্র মতে দেবী সতীর মন এইস্থানে পড়েছিলো বলে বলা হয় । দেবীর নাম মহিষমর্দিনী, ভৈরব হলেন বক্রেশ্বর । পাপহরা বক্রেশ্বর নদীর পাশে এই পীঠ অবস্থিত । “শিবচরিত” মতে এইস্থানে দেবীর দক্ষিণ বাহু পতিত হয়েছিলো । দেবীর নাম বক্রেশ্বরী ভৈরব হলেন বক্রেশ্বর । তবে এখানে দশভুজা মহিষাসুরনাশিনী চণ্ডী রূপে দেবীর পূজা হয় । মহিষাসুরকে বধ করে দেবীর একনাম হয়েছিলো মহিষমর্দিনী । এই পীঠ শিবভক্তির জন্য বিখ্যাত । মহামুনি অষ্টবক্র মুনি এইস্থানে শিব উপাসনা করেছিলেন । “ব্রহ্মাণ্ড পুরাণে” এর ঘটনা আছে ।

“ক্রোধ” হোলো মহা শত্রু। ক্রোধের জন্য অনেক সর্বনাশের পথ উন্মোচন হয়। পুরাণ গুলিতে সেই তত্ত্ব কথাই নানান গল্পে প্রকাশিত হয়েছে বারবার। সেটা সমুদ্র মন্থনের পরবর্তী ঘটনা। মা লক্ষ্মীর সাথে ভগবান বিষ্ণুর বিবাহের আয়োজন চলছে। সমস্ত মুনি ঋষি গণ আমন্ত্রিত। এমন সময় ঋষি লোমশ ও ঋষি সুব্রত সেই বিবাহে যোগদান করতে এসেছেন। দেবরাজ ইন্দ্র দুই ঋষিকে সাদর অভ্যর্থনা জানিয়ে প্রথমে লোমশ মুনিকে পাদ্যঅর্ঘ্য দিলেন। এতে মুনি সুব্রত ক্রুদ্ধ হলেন, কেন কি তিনি ভেবেছিলেন মহেন্দ্র প্রথমে তাঁকে আপ্যায়ন করবেন। মুনি ইন্দ্রদেবতাকে অভিশাপ দিতে উদ্যত হলেন। শাপ দিতে গিয়ে তাঁর বিবেকবোধ জাগ্রত হোলো, তিনি বুঝলেন ঋষির কর্তব্য হোলো ক্রোধের ওপর বিজয় প্রাপ্তি করা। মুনি সুব্রত ক্রোধকে নিয়ন্ত্রন করতে গেলে তাঁর শরীর আট অংশে বক্র হোলো- সেই থেকে তিনি অষ্ট বক্র নামে পরিচিত হলেন।

এরপর মহামুনি তীর্থ ভ্রমণে বের হলেন। বর্ধমানে এসে কালী উপাসনা শুরু করলেও দেবী তাঁকে ক্ষমা করলেন না। অষ্টবক্র মুনি এরপর বক্রেশ্বরে এসে ভগবান শিবের উপাসনা শুরু করলেন। ভগবান শিব প্রসন্ন হয়ে দর্শন দিয়ে তাঁকে স্বাভাবিক সুস্থ করলেন। মহেশ্বর বরপ্রদান করে বললেন- “তোমার নামের সাথে বক্রেশ্বর শিব নামে আমি পূজিত হবো এখানে। আমার অগ্রে এখানে তোমার পূজা হবে।” এই থেকে এখানে মহামুনি অষ্টবক্রের নামে একটি শিবলিঙ্গ স্থাপন হোলো। ভৈরবের আগে এখানে মহামুনির পূজা হয় ।

বীরভূমের বক্রেশ্বরে এই শক্তিপীঠে ৮টি কুণ্ড দেখা যায়। এই কুণ্ডগুলির মাহাত্ম্য এক একটি এক রকম।

১) “ক্ষারকুণ্ড”- এর একটি ঘটনা আছে। একবার মহর্ষি অগস্ত্য সাগর বারি এক গণ্ডূষে পান করতে আরম্ভ করেছিলেন। সেসময় লবণ সাগর এখানে একটি কুণ্ড আকারে আশ্রয় নেয়। আষাঢ় মাসের পূর্ণিমা তে এই কুণ্ডে অবগাহন করলে অক্ষয় কাল স্বর্গে তার স্থান হয়।

২) “অগ্নিকুণ্ড”- হিরন্যকশিপু কে বধ করতে ভগবান বিষ্ণু নৃসিংহ অবতার নিয়েছিলেন। অসুর বধের পর ভগবান নৃসিংহের ক্রোধে সমগ্র ব্রহ্মাণ্ড ধ্বংস হবার উপক্রম হলে ভক্ত প্রহ্লাদ, ভগবানের চরণে পড়ে স্তবস্তুতি করলে ভগবান হরি তুষ্ট হন। ভগবান বিষ্ণুর সবথেকে উগ্র অবতার হলেন নৃসিংহ অবতার। ভগবান নৃসিংহ তাঁর তেজ থেকে এক কুণ্ড নির্মাণ করেন এখানে, এর নাম অগ্নিকুণ্ড। এখানে কেউ স্নান করেন না। কারন এই কুণ্ডের তাপ অনেক। তবে বৈশাখী পূর্ণিমা তে এখানে পিণ্ড দিলে পিতৃপুরুষেরা মুক্তি লাভ করেন।

৩) “ভৈরবকুণ্ড” – ভগবান শিব সর্ব পবিত্র নদী, পুষ্করিণীর জল একত্র করে এখানে একটি কুণ্ড নির্মাণ করেন। যাঁর নাম ভৈরবকুণ্ড। এখানে চৈত্র মাসের শুক্ল অষ্টমীতে স্নান করলে রাজসূয় যজ্ঞের ফল লাভ হয়।

৪) “সৌভাগ্যকুণ্ড”- দেবাদিদেব ভগবান শিব ও তাঁর সহধর্মিণী মাতা ভবানীর সমস্ত অঙ্গের স্বেদ বিন্দু থেকে এই কুণ্ডের উৎপত্তি হয়। এখানে স্নান করলে সর্ব পাপ নষ্ট হয়ে, ভক্তেরা দেহান্তে কৈলাস লোক প্রাপ্তি করেন।

৫) “জীবিতকুণ্ড”—নিশানাথ সোমদেব এখানে স্নান করে সুস্থ হন। অনেক আগে সর্বনাম নামক এক ব্রাহ্মণ তাঁর পত্নী চারুমতির সাথে এখানে তীর্থ করতে আসেন। ব্রাহ্মণ এখানে বাঘের পেটে গেলে, ব্রাহ্মণী ভগবান শিবের আরাধনা করেন। ভগবান শিব প্রকট হয়ে ব্রাহ্মণীকে আদেশ দেন, ব্রাহ্মণের অস্থি এই কুণ্ডে নিক্ষেপ করতে। ব্রাহ্মণী তা করতেই কোথা থেকে যেনো ব্রাহ্মণ বেঁচে ফিরে এলেন। মাঘ মাসের শুক্ল অষ্টমীতে এই কুণ্ডে স্নান করলে অপমৃত্যু হয় না।

৬) “ব্রহ্মাকুণ্ড”- প্রজাপতি ব্রহ্মা এখানে পাপ স্ফলনের জন্য এখানে কুণ্ড খনন করে ‘ত্যম্বক’ মন্ত্রে আহুতি দিয়ে যজ্ঞ করেন। এই কুণ্ডে স্নান করলে ব্যভিচারাদি পাপ দূর হয় ।

৭) “শ্বেতগঙ্গা”- এই স্থানে সত্য যুগে শ্বেত নামক এক রাজা থাকতেন। তিনি রোজ এখানে ভৈরব বক্রনাথের পূজা দিতে আসতেন। বক্রনাথ তুষ্ট হয়ে বর দিলেন যে এই তীর্থের সাথে রাজা শ্বেতের নাম জড়িয়ে থাকবে। এই বলে ভৈরব বক্রনাথ এখানে এক কুণ্ড সৃষ্টি করলেন। ঐ কুণ্ডের নাম শ্বেতগঙ্গা। মাঘ মাসে এই কুণ্ডে স্নান করলে গঙ্গা স্নানের পুন্য প্রাপ্তি হয়।

৮) “বৈতরণী”- বৈতরণী পার হলে যম লোক থেকে মুক্তি পাওয়া যায়। তাই এই কুণ্ডে অবগাহনে নরক ভয় দূর হয়।
এই হোলো এই অষ্ট কুণ্ডের কথা। এই তীর্থ অনেক প্রাচীন।

চৈতন্য ভাগবতেও এই তীর্থের কথা আছে । একস্থানে মহাপ্রভু বলেছেন -

বক্রেশ্বর আছেন যে বনে
তথায় যাইনু মুঁঞি থাকিমু নির্জনে ।

বক্রেশ্বর তীর্থ এক সময় গভীর জঙ্গলে ঢাকা ছিলো। সেই অরন্যে সাধারন মানুষ থাকতো না। থাকতো কেবল বীরাচারী তন্ত্র সাধক, অঘোরী সাধু, কাপালিক। দেবীর কৃপা প্রাপ্তির জন্য তাঁরা কঠিন সব সাধনায় নিমগ্ন থাকতো। মা মহিষমর্দিনী কৃপা করতেন এই ভক্তদের। মায়ের কৃপা প্রাপ্তির জন্য তাই আজ কত ভক্ত এখানে আসেন। মহামায়া ভক্তদের কৃপা করবার জন্যই সতী রূপে অবতীর্ণা হয়ে স্বীয় অঙ্গ দ্বারা দেবীপীঠ সৃষ্টি করলেন। মহাশক্তি রূপে তিনি সেখানে বিরাজিতা থেকে অশেষ কল্যাণ সাধন করছেন। এই পীঠকে কাশীর সাথে তুলনা করা যেতে পারে। কাশীতে যেমন গঙ্গা কলি কলুষ নাশ করে চলেছেন, এখানেও তেমনি শ্বেতগঙ্গা পাপ দূরীকরণ করেন। আর আছেন মা মহিষমর্দিনী ও ভৈরব বক্রনাথ। এই স্থানের পাশেই বক্রেশ্বর নদীর পাশেই মহাশ্মশান আছে। শ্মশানের ভেতরে সিদ্ধতান্ত্রিক অঘোরীবাবার সমাধি আছে। এখনও নাকি রাতের দিকে সেই অঘোরীবাবার পবিত্র বিদেহী আত্মাকে ভাগ্যবানেরা দর্শন করে থাকেন।

ভৈরব বক্রনাথের মন্দিরের ডানদিকে দেবীর মন্দির দেখা যায়। দেবীর এখানে পিতলের মূর্তি দেখা যায়। এই মূর্তি দশভুজা ও মহিষাসুর কে বধ করছেন এমন রূপ- যেমন আমরা দুর্গা মূর্তি দেখি। তবে এই পীঠে অনেক আগে কষ্টি পাথরের মূর্তিতে পূজা হতো। কালাপাহাড়ের আক্রমণের সময় পূজারীরা সেই মূর্তি একটি পুকুরে ডুবিয়ে পালিয়ে যায়। পরবর্তী কালে পুকুর সংস্কার করবার সময় সেই পুরানো মূর্তি পাওয়া যায়। পুরানো মূর্তি এখন ডিহি বক্রেশ্বর গ্রামে নিয়ে রাখা আছে। সেখানেই পূজা হয়। প্রাচীন এই কষ্টি পাথরের মূর্তিতে অষ্টাভুজা মহিষমর্দিনী চণ্ডী মূর্তি আছে। তাঁর সাথে নয়টি শক্তি দেবীও আছেন। যথা- কৌমারী, ইন্দ্রাণী, বৈষ্ণবী, বারাহী, তারা, ষোড়শী, ভুবনেশ্বরী, ভৈরবী ও দেবী চন্দ্রঘণ্টা ।