এই প্রথমবার কালীঘাটের ৪৫০ বছরের ইতিহাসে প্রকাশ্যে জনসম্মুখে আসছে চলেছে সতীর বস্ত্রখণ্ড।
মহাতীর্থ কালীঘাট সতীপীঠ তো বটেই, অন্যতম শক্তিপীঠও। সেই কালীঘাট পা দিতে চলেছে ৪৫০ বছরে।

মন্দিরে বিগ্রহ রূপে হাজার হাজার ভক্ত যাঁকে চাক্ষুষ করেন, মাতৃ-মহিমায় তিনিই সবটুকু নন। মাতৃমূর্তির অন্তরালে থাকে সেই বিগ্রহ, যার সঙ্গে মিশে আছে মিথ। সেই বিগ্রহ থাকে সাধারণ ভক্তের দৃষ্টির আড়ালে।

কথিত আছে, অন্তরালে থাকা সতীর সেই দেহাংশ চাক্ষুষ করলে দৃষ্টিহীন হতে হবে। তাই কখনও প্রকাশ্যে আসে না সেই মূর্তি। কিন্তু আজ থেকে কয়েক শতাব্দী আগে যে বস্ত্রখণ্ডে জড়িয়ে দেবীর প্রথম অধিষ্ঠান হয়েছিল, সেই বস্ত্রখানিও এখন লোকচক্ষুর অন্তরালে। কালীঘাটের সাড়ে চারশো বছরের উদ্যাপনে সতীর বস্ত্রখণ্ডটি এবার ভক্তদের সামনে আসতে চলেছে।

সতীর বস্ত্রখণ্ডের মহিমা কতটা ? ফিরতে হবে রূপকথার মতো এক কাহিনীতে।

১৫৬৯ সালের সাবর্ণ বংশীয় জিয়া গঙ্গোপাধ্যায় এবং স্ত্রী পদ্মাবতীদেবী সন্তানের আশায় হালিশহর থেকে কালীক্ষেত্রে এলেন। মহাযোগী আত্মারাম ঠাকুরের শরণ নিলেন তাঁরা। তন্ত্রমতে দীক্ষা হল তাঁদের।

জিয়া গঙ্গোপাধ্যায়ের ঝুলিতে রাখা ছিল তাঁর ইষ্টদেবতা ভুবনেশ্বরীর ছোট্ট বিগ্রহ। তা দেখে রীতিমতো বিস্মিত আত্মারাম ঠাকুর। তিনি স্বপ্নাদিষ্ট একটি ব্রহ্মশীলা পেয়েছিলেন ঠিকই। তার নিত্য পুজোও হয়। কিন্তু এই তো সেই মূর্তি, যে মাতৃরূপের সন্ধান তিনি এতদিন করে আসছেন।

যে ব্রহ্মশীলা খণ্ডটির এতদিন পুজো হতো, সেটিতে নির্মিত হল ভুবনেশ্বরীর আদলে ত্রিনয়নী মাতৃকা রূপ। শুরু হল অর্চনা। কিন্তু আত্মারাম ঠাকুর তখনও সন্তুষ্ট হননি। বাকি রয়ে গিয়েছে। তিনি যে স্বপ্ন দেখেছেন, সতীখণ্ডের সন্ধান পাবেন। তার কী হবে ?

রোজ কালীকুণ্ডে স্নান করতেন পদ্মাবতীদেবী। একদিন মা কালীর স্বপ্নাদেশ পেলেন, তাঁর স্নানের স্থানে আটকে আছে একটি পাথরের টুকরো। সেটিই মায়ের দেহাংশ। সতীখণ্ড। ডান পায়ের আঙুল। পরদিন জলের নীচ থেকে সেই পাথরের টুকরোটি তুলে আনলেন আত্মারাম ঠাকুর।

১৫৭০ সালের আষাঢ় মাসে স্নানযাত্রার দিন একটি লাল পট্টবস্ত্রে প্রতিষ্ঠিত হলেন ঈশ্বরী। সেই পর্ণকুটির লোকমুখে ফিরল মহাতীর্থ কালীঘাট নামে। সেবছরই পুত্রসন্তান লাভ করলেন সাবর্ণ দম্পতি। ইতিহাস বলছে, আজকের আশুতোষ কলেজ এবং প্রেসিডেন্সি জেলের মাঝামাঝি কোনও স্থানে ওই সতীখণ্ডের পুজো শুরু হয়েছিল। পরবর্তীকালে তা মন্দিরে উঠে আসে, যা আজকের কালীঘাট নামে পরিচিত।

সতীর সেই দেহাংশ শতাব্দীর পর শতাব্দী লোকচক্ষুর আড়ালে। ফি বছর স্নানযাত্রায় চোখ বন্ধ অবস্থায় সতীখণ্ডের স্নান করান পূজারিরা। আড়ালে থাকে সেই লাল পট্টবস্ত্রটিও। সাবর্ণ পরিবারের জিম্মায় থাকা সতীর সেই বস্ত্রখণ্ডটি এবার প্রকাশ্যে আসতে চলেছে।

সাবর্ণ রায় চৌধুরী পরিবার পরিষদের আয়োজনে আগামী ২ থেকে ৫ ফেব্রুয়ারি বড়িশার বড়বাড়িতে শুরু হবে ১৫তম আন্তর্জাতিক ইতিহাস উৎসব। এবার সেই উৎসবের থিম কান্ট্রি ফ্রান্স। সেখানেই সর্বসাধারণের সামনে আনা হবে সতীর সেই বস্ত্রখণ্ড।

পরিষদের সম্পাদক দেবর্ষি রায় চৌধুরীর কথায়, সারাবছরই আমাদের সাবর্ণ সংগ্রহশালায় ইতিহাস চাক্ষুষ করতে পারেন সাধারণ মানুষ। বাৎসরিক উৎসবে আমরা নতুন কিছু আনতে চাই। কালীঘাটের জন্মলগ্ন থেকে সাবর্ণরা যেভাবে জড়িয়ে আছেন, সেই ইতিহাসই দেখাব আমরা। এবার সতীখণ্ডের বস্ত্রের পাশাপাশি থাকবে শ্রীমা সারদার তৈরি আমসত্ত্ব, তাঁর মৃত্যুর পর পা মোছানো কাপড় সহ আরও কিছু।

.

জয় মা কালী

.

( সংগৃহীত)