দেবী নলহাটেশ্বরী
◆◆◆◆◆◆◆◆◆◆◆
বহুদিন থেকেই ইচ্ছে ছিল বীরভূমের আরেক শক্তিপীঠ নলহাটির কাছে নলাটেশ্বরী মা-কে দর্শন করবো। তাই গত শনিবার সকালে যাত্রা করলাম মাতৃ দর্শনের উদ্দেশ্যে। ভোরের গণদেবতা এক্সপেসে চেপে বেলা পৌনে এগারোটা নাগাদ পৌঁছে গেলাম নলহাটি জংশন। ষ্টেশন থেকে বেরিয়ে টোটো তে মিনিট দশেক পথ। এসে নামলাম মন্দিরের তোরণ দ্বারের সামনে। দুএকটি পুজোর ডালার দোকানের একটিতে মাখা সন্দেশ নৈবেদ্য নিয়ে এগিয়ে গেলাম মন্দিরের দিকে। বীরভূম জেলার ম্যাপ দেখলে দেখবেন এই জেলা উল্টো কূর্ম আকৃতির পৃষ্ঠের ন্যায় । শাস্ত্র মতে এমন স্থান শক্তি উপাসনার জন্য যথাযোগ্য । নলহাটি পীঠ এই জেলায় । এখানে দেবী সতীর নলা পতিত হয়েছিলো । যথা পীঠনির্ণয়তন্ত্র শাস্ত্রে লেখা আছে-

নলহাট্যাং নলাপাতো যোগীশো ভৈরব স্তথা ।
তত্র মা কালিকা দেবী সর্বসিদ্ধি প্রদায়িকা ।।

উক্ত তন্ত্র শাস্ত্র মতে দেবীর নাম কালিকা । ভৈরবের নাম যোগীশ বা যোগেশ । এই কালিকা দেবী সর্বসিদ্ধি প্রদান করেন। নারায়নের চক্রে খন্ডিত হয়ে মহামায়া পরমাপ্রকৃতি আদ্যাশক্তি মা সতী দেবীর কন্ঠের নলী এই স্থানে পড়েছিলো বলে বলা হয়। ইতিহাস বলছে, স্মরনাথ শর্মা নামক এক সাধক ছিলেন । একদা তাঁকে মা কালী স্বপ্নে দেখা দিয়ে বললেন- “এই স্থানে দেবী সতীর নলী পতিত হয়েছে । আমি এই স্থানে নলাটেশ্বরী দেবীরূপে অবস্থান করছি । তুই শীঘ্র সেই সতী অঙ্গ উদ্ধার করে আমার প্রতিষ্ঠা কর।” সাধক স্মরনাথ শর্মা তাই করলেন । সেই স্থানে এসে দেবীর অঙ্গ উদ্ধার করে প্রতিষ্ঠা করলেন। অপর একটি মতবাদ আছে। কাশীধামে একজন হরগৌরী উপাসক ছিলেন । তাঁর নাম ব্রহ্মচারী কামদেব। একদা তিনি মাতা পার্বতীর আদেশ পান। জগৎমাতা হরপ্রিয়া বলেন- “বঙ্গে তিনি নলাটেশ্বরী রূপে বিরাজ করছেন। সেখানে প্রতিষ্ঠা কর।” ২৫২ বঙ্গাব্দে ব্রহ্মচারী কামদেব এখানে এসে সতী পীঠ উদ্ধার করে প্রতিষ্ঠা ও নিত্যপূজার ব্যবস্থা করলেন। এভাবে দেবীর পূজা প্রচলন হোলো। নাটোরের রানী ভবানী এখানে মন্দির নির্মাণ করেন। পরবর্তী কালে নন্দীপুরের রাজা রনেন্দ্র নারায়ণ এই মন্দির রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব নেন। রাজমহল পর্বতের একাংশে পশ্চিম দিকে মা নলাটেশ্বরীর মন্দির। এদিকের পাহাড় “নলাটেশ্বরী পাহার” নামেই পরিচিত। পাহাড়ের ঢালে একদিকে মায়ের মন্দির।
মন্দিরটি একটি টিলা বিশিষ্ট স্থানে অবস্থিত। বেশ কিছুটা সিঁড়ি উঠে তারপর গর্ভগৃহের সন্ধান মিলল। মন্দির ছিমছাম বাংলার চার চালা বিশিষ্ট, সিঁড়ির একাংশ ফুলের টবে সজ্জিত। উপরে গর্ভমন্দিরের বাইরেই ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংস দেব এবং শ্রীমা সারদা দেবীর দুটি বিশালাকার ফ্রেমে বাঁধানো ছবি। গর্ভগৃহের দরজার উপর সিদ্ধিদাতা গণেশ মূষিক পৃষ্ঠে বিরাজমান। গর্ভগৃহ অত্যন্ত স্বল্প পরিসর। মাতৃ বিগ্রহ বলতে পাথরের ওপর বসানো ত্রিনয়নী মায়ের মুখ, সোনার চোখ নাক জিভ- তবে উজ্জ্বল জীবন্ত দৃষ্টি। অপূর্ব স্নিগ্ধ ভরা মায়ের মুখ। সেই রূপ দেখলে পথশ্রমের ক্লান্তি দূর হবে। বলা হয়ে থাকে এখানে মায়ের গলার নলি পড়েছিল। কথিত আছে, মূর্তির নিচে পাথরের মধ্যে মা নলাটেশ্বরীর গলার নলিতে জলের স্তর সবসময় একই রকম থাকে। যতই জল দেওয়া হোক, তা কম বা বেশি হয় না। সতী পীঠের অঙ্গশিলা গুপ্ত থাকে। সাধারনের এটি দর্শন করা মানা। তাই কোনো শক্তিপীঠে গিয়ে অঙ্গশিলা দেখতে যাবেন না। ভক্তিভরে মাকে দেখুন, ভৈরব শিবকে দেখুন। দর্শনার্থীদের পূজার নৈবেদ্য এবং বস্ত্র সাথে সাথেই মাকে নিবেদন করে পরিয়ে দেওয়া হয়। ফোনে 9434009435 উল্লেখিত নম্বরে যোগাযোগ করে গেলে দুপুর ২ টার পর মায়ের অন্নপ্রসাদ পাবার ব্যবস্থা আছে। বাইরে প্রশস্ত মার্বেল পাথরে বাঁধানো পরিচ্ছন্ন চাতাল পেরিয়ে পাশেই ভৈরব যোগেশের মন্দির। অনেক গুলি শিবলিঙ্গ থাকলেও আকারে সর্ব বৃহৎ প্রায় চতুষ্কোণাকার বিশিষ্ট শিবই হলেন ভৈরব। মায়ের মন্দির যেমন পরিপাটি ভৈরবের মন্দির আদৌ তেমন না। ভক্তি ভরে মায়ের পুজো দিয়ে নলাটেশ্বরী মন্দির থেকে আমরা রওয়ানা দিলাম ভদ্রপুরের সংলগ্ন ছোট্ট গ্রাম অকালিপুরে।