সে অনেক দিন আগের ঘটনা ভূপ্রকৃতি একই রকম থাকলেও নদীর গতিপথ ছিলো অনেকটাই আলাদা । জন সংখ্যাও ছিলো অনেক কম । কতটা ? এখনকার প্রতি ১২ -১৩ জনে , ১জন । হ্যাঁ এতটাই কম । বাতাস ছিলো আরো নির্মল , সমাজ জীবনে ছিলোনা এত হিংসা , লোভ , স্বার্থপরতা আর ধর্মান্ধতা। তখন বাংলায় দুটি স্বাধীন রাজ্য বর্তমান ছিলো একটি গৌড় অন্যটি বঙ্গ ।
৭৮১ খ্রিষ্টাব্দ, গৌড়ের রাজধানী ছিল বহু সৌধ , হর্ম্য, আপণ বিপনিতে সমৃদ্ধ । এক সন্ধ্যায় বীণাবাদ্য আর সুমধুর সঙ্গীতের সুরে ভেসে যাচ্ছে রাজদরবার । মহামন্ত্রী গর্গ বেশ বুঝতে পারছেন বিগত কয়েক দিনের মত মহারাজ আজও সঙ্গীত সুধা পান করছেন না । তিনি যেন খানিকটা অন্য চিন্তাই মগ্ন । রাজ অন্তঃপূরে মহারানি রন্নাদেবী সান্ধ্য কালীন প্রসাধনে ব্যস্ত থাকলেও আজ দুপুরের ঘটনাটা তার মনোজগৎ গ্রাস করে আছে। দ্বিপ্রাহরিক আহারান্তে মহারাজ প্রতিদিন কিছুটা সময় ব্যয় করেন দুই যুবরাজ ত্রিভুবন পাল ও দেবপাল এর সাথে । তখন তিনি আর মহারাজ ধর্মপাল নন , তিনি তখন স্নেহশীল পিতা । দীর্ঘ দিনের সেই অভ্যেস এর আজ অন্যথা হল । রাত্রি অবসানে প্রভাতে পূর্বদিকে দেখা দিয়েছে রক্তিম ছটা। সুবর্ণ রশ্মিতে ভেসে যাচ্ছে বিশ্বচরাচর । প্রসন্ন মুখে মহারাজ শয্যা ত্যাগ করে তাঁর অনুচর কে দিয়ে বৌদ্ধ আচার্য হরিভদ্র ও মহামন্ত্রী গর্গ কে রাজ অন্তঃপূরে ডেকে পাঠালেন । তাঁদের সাথে আলোচনায় মহারাজ ব্যক্ত করলেন যে বেশ কিছুদিন যাবত তিনি অনুভব করছেন নালন্দার শিক্ষার মান পরে গেছে, তাই তিনি নতুন এক মহাবিহার নির্মাণ করতে চান । রাজ নির্দেশে মহাবিহারের স্থান নির্ধারিত হল গঙ্গার তীরে অন্তিচকে । সৃষ্টি হল নতুন মহাবিহার , নাম রাখা হল " শ্রী রাজগৃহ মহাবিহার " । দীর্ঘ চারশো বছর ধরে নির্মাণ কাজ চলেছিলো ।মহাবিহারের সমগ্র অবয়ব জুড়ে পাল যুগের বিখ্যাত টেরাকোটা কাজ । মহাবিহারের ৬টি প্রবেশ দ্বার । প্রতিটি দ্বারে ১জন করে পণ্ডিত দ্বারপাল রূপে নিযুক্ত । দেশ বিদেশ থেকে অনেক জ্ঞান তপস্বী অধ্যয়নের উচ্চাশা নিয়ে আসতেন , দ্বারপালের নিকট পরীক্ষাই উত্তীর্ণ হলে তবেই ছাত্র রূপে মহাবিহারে প্রবেশ করতে পারতেন নতুবা ভগ্ন মনোরথে ফিরে যেতে হত । মহাবিহারের মূল প্রবেশ পথ টি ছিল উত্তর মুখি । এইখানে ব্যকরণ , তর্কশাস্ত্র , অধিবিদ্যা , নানা ধর্মীয় শাস্ত্র পড়ান হলেও মূলত তন্ত্র শিক্ষার জন্য প্রসিদ্ধ ছিল। ১০৮ জন পণ্ডিত শিক্ষক ছিলেন, ছাত্র সংখ্যা দু হাজারেরে উপর । মহাবিহারে ছিল বিরাট লাইব্রেরী । বাঙালী পণ্ডিত " অতীশ দীপঙ্কর " এর পদ ধুলি ধন্য এই মহাবিহার । তিনি এখানে ১০৩৪ থেকে ১০৩৮ খ্রী পর্যন্ত অধ্যক্ষের পদ অলংকৃত করেন । বিশিষ্ট পণ্ডিত দের নিয়ে গঠিত পরিচালক মণ্ডলীর দ্বারা পরিচালিত হত । বার্ষিক সমাবর্তন সভায় উপাধি প্রদান করতেন স্বয়ং রাজা । নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে শিক্ষক আদান প্রদান চলত । সর্বচ্চ শিখর আরোহণ করে ১২ শতকের গোড়াই রাজা রামপালের সময় । একদিন এল সেই দুর্যোগের দিন । তখন সেন বংশের রাজত্বকাল । মহম্মদ বখতিয়ার খিলজী নামিয়ে আনল ধ্বংস লীলা ।গর্বের বিশ্ববিদ্যালয় মুহুর্তে বিলিন হয়ে গেল। শতাব্দীর পর শতাব্দীর বিস্মৃত থাকল । তিব্বত্বের পুঁথি থেকে সন্ধান পেয়ে দীর্ঘ খনন কাজের মধ্য দিয়ে পুনঃ আবিষ্কৃত হল । কিন্তু নাম গেল বদলে , কারণ তিব্বতে এই মহাবিহার " বিক্রমশীলা মহাবিহার " নামে পরিচিত । আমাদের কাছেও এর নাম এখন " বিক্রমশীলা মহাবিহার " ।

#বিক্রমশীলা মহাবিহার