পুরী ভ্রমণ কথা
প্রথম পর্ব ( ভূমিকা ) -
আবার বেড়ানো | গরমের ছুটিতে এ বছর সিল্করুটের পাহাড়ী বেড়ানোর পর, বছর শেষে শীতকালের ছুটি কাটানোর পরিকল্পনা সমুদ্রতীরে | গন্তব্য উড়িষ্যার প্রাচীন জনপদ "পুরী" | কলকাতা থেকে প্রায় ৫১০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত পুরী শুধু সমুদ্র সৈকত নয়, জগন্নাথদেবের মন্দিরের জন্যেও বিখ্যাত তীর্থস্থান। বাঙ্গালীদের সবচেয়ে প্রিয় তিনটে বেড়ানোর জায়গা দীঘা-পুরী-দার্জিলিং । তবে বঙ্গোপসাগরের পশ্চিম তীরে ভারতবর্ষের পূর্ব উপকূলে অবস্থিত পুরীর মাহাত্ম্য সমুদ্র আর মন্দির দুটোর জন্যই । বহুল জনপ্রিয় বেড়ানোর জায়গা হওয়ার কারনে পুরীর অলিগলি, আনাচে-কানাচে অনেকেরই মুখস্ত | পত্র-পত্রিকা, প্রবন্ধ, গল্প, উপন্যাস, ইন্টারনেট ইত্যাদির সূত্রে পুরীর কুষ্টিঠিকুজি প্রায় সকলেরই নখদর্পনে | আর তাই এবারের ভ্রমনকাহিনী লেখা বেশ চ্যালেঞ্জিং | দেখাই যাক চেনার মাঝে কোনও অচেনার স্বাদ আনা যায় কিনা |
অন্য অনেক বারের তুলনায় এবারের বেড়ানো অনেক পরিকল্পনা প্রসূত | চারমাস আগেই টিকিট কাটা ও হোটেল বুকিং সারা | তা সত্ত্বেও ছোটখাট বিঘ্ন যে আসেনি তা নয় | যেদিন ঠিক চার মাসের উইন্ডো খুলল, সেদিন সকাল সাড়ে আটটায় ইন্টারনেটে টিকিট কেটেও হল ওয়েটিং লিস্ট ৬৪ | সুতরাং ধূপধূনো জ্বেলে আবার প্রচেষ্টা পরের দিন এবং লটারীর টিকিট লাগার মত পুরী এক্সপ্রেসের কনফার্মড টিকিট সকাল আটটা বেজে দুই মিনিটে | চার মাস আগে টিকিট কাটতে গিয়েও আমার মত তথাকথিত শহুরে,কিঞ্চিত প্রযুক্তিতে অভ্যস্ত মানুষেরই যদি এমন নাজেহাল পরিস্থিতি তবে ভারতের আপামর সাধারন মানুষের হাল সহজেই অনুমেয় | যাই হোক আমার বেয়ারা প্রশ্নের বদভ্যাস সরিয়ে রেখে হোটেলের কথায় আসি | ঠিকই ধরেছেন, আমার ঝটকা লাগা বাকি ছিল | সরাসরি যোগাযোগে বা ট্রাভেল এজেন্টের মাধ্যমে খোঁজাখুঁজি করে দেখা গেল কোনও হোটেলে ঘর খালি নেই | হ্যাঁ চার মাস আগেই | যে সময়টা আমরা বেছেছি বেড়ানোর জন্য, মানে বড়দিন আর ইংরাজী বছর শেষের দিনগুলি নাকি পুরীতে এরকমই নাভিশ্বাস ওঠে | আর নিশ্চিত করে অধিকাংশ ভ্রমন পিপাসুই বাঙালী |
আমাদের দল এবার একটু ভারী | মানে তিন জনের পরিবর্তে চারজন প্রাপ্তবয়স্ক - আমি, আমার স্ত্রী, মা ও শ্বাশুড়ী মা | সঙ্গে আমার দুটি বাচ্চা - দশ বছরের মেয়ে এবং পাঁচ বছরের ছেলে | সিল্ক রুটের গল্প যাঁরা পডেছেন তাঁরা জানেন যে গত ডিসেম্বরে হঠাৎ করে আমার শ্বশুরমশাই মারা যাবার পর শ্বাশুড়ী মা কিছু মাস হায়দ্রাবাদে দাদার কাছে ছিলেন | ফলতঃ গরমের ছুটির বেড়ানোতে আমরা ওনাকে সঙ্গে পাই নি | এবারের পুরী ভ্রমনের পরিকল্পনা শ্বাশুড়ী মার জন্যেই | ওনার অনেক দিনের ইচ্ছে ছিল পুরী যাওয়ার | অন্যথায় আমরা বাকীরা ( ছেলে বাদে) আগে পুরী গিয়েছি | আমি আর মা তো একাধিক বার গিয়েছি | আর তাই আমাদের নিজেদের কাছেও চেনা জিনিষ নতুন রূপে খুঁজে পাওয়ার তাগিদ রয়েছে | পারিবারিক, ব্যবসায়িক বহুবিধ কর্মভারে বিপর্যস্ত, প্রযুক্তি নির্ভর অসামাজিক এক ক্ষয়িষ্ণু সময়ে, পরিবারের সকলের সাথে একান্তে কদিনের বেড়ানো অনেকটা বুকভরে শ্বাস নেওয়ার মত |
আর শীতের বেড়ানো বড় মজার | আমার মনে পড়ে ছেলেবেলার কথা | তখন দুর্গাপুজোর সময় থেকেই শীত পড়া শুরু হত | আর ডিসেম্বরে বার্ষিক পরীক্ষা শেষ হয়েই সেশন শেষ | তারপরেই শুরু হত মজা | চিড়িয়াখানা, মিউজিয়াম,তারামন্ডল, ঝিলমিল(এখনকার নিক্কোপার্ক ! ), বইমেলা (তখন বিগ্রেডে হত ),সার্কাস ( বাঘ, সিংহ সহযোগে) তো ছিলই, উপরি মজা ছিল দলবেঁধে বেড়াতে যাওয়া | বাবার বেশ কিছু অফিসের বন্ধুরা পরিবার সহ একসাথে বেড়াতে যাওয়া হত | ভারতের বিভিন্ন জায়গায় গিয়েছি সেই দিনগুলোতে আর তাই বেড়ানোর নেশা মিশে গিয়েছে রক্তে সেই ছেলেবেলা থেকেই |
"জল পড়ে, পাতা নড়ে"র মত আমার মাথায় নড়ে পোকা | নিজের ব্যবসা চালু করার পর থেকেই আমার মাথায় ঘোরে আমার মত আরো যারা উদ্যোগপতি তারা মিলে পারিবার সহযোগে যদি বেড়াতে যাওয়া যায় তবে কেমন হয় | নিজস্ব উদ্যোগে ব্যবসা করার জ্বালা-যন্ত্রণা-ভালোলাগা-সাফল্য-আনন্দ-উত্তেজনার রসায়ন আরেকজন উদ্যোগপতি ছাড়া উপলধ্বি করা দুষ্কর নয়, অসম্ভব | ব্যবসার বাইরে নিছক মজায় পরিবার সহযোগে একসাথে বেড়াতে গেলে শুধুই ভাবের আদান প্রদান নয়, পারিবারিক একটা যোগসূত্রও গড়ে ওঠে এই একলা আত্মকেন্দ্রিক সময়ে | কিন্তু তেল-জলে যেমন মিশ যায় না, সেইরকমই এই চলমান সময়ে বাঙালী উদ্যোগপতীদের একসূত্রে বাঁধা কার্যত কুকুরের লেজ সোজা করার মত | মানে "আশায় মরে চাষা" আর কি | এবারের বেড়ানো যেহেতু পূর্ব পরিকল্পিত এবং অনেক সময় হাতে ছিল, আমরা ছাড়াও আরো চারটি পরিবার যোগাড় হল একসাথে যাবার জন্যে | ফলত আমার স্ফূর্তির প্রাণ গড়ের মাঠ | কিন্তু বেলুন গেল চুপসে কদিনেই | ব্যবসা, ব্যস্ততা , অসুস্থতা, বিয়ে বিভিন্ন বহুল পরিচিত অজুহাতে কেটে গেল সকলেই | সুতরাং আজ যাচ্ছি আমি ও আমার পরিবারই শুধু |
সঙ্গে থাকুন | আগামী কয়েক দিন ঘুরে আসি পুরী থেকে l
"বড়দিনের আড়ম্বরে, পৌষ গিয়েছে চুরি,
ডিসেম্বরের সন্ধ্যারাতে যাত্রা এবার পুরী |
যিশু দিবস - বাড়ছে হুজুগ, হুল্লোড়ে সব মাত,
পান ভোজনে বাংলা ভেসে, নেশার মায়া রাত |
অচেনা ঠেকে আমার শহর, সেও কি আমায় চেনে?
সাগর ডাকে, জগন্নাথও , পালিয়ে যাই ট্রেনে |"
Last edited by ভ্রমন পাখি on Wed Mar 07, 2018 1:55 pm; edited 1 time in total
প্রথম পর্ব ( ভূমিকা ) -
আবার বেড়ানো | গরমের ছুটিতে এ বছর সিল্করুটের পাহাড়ী বেড়ানোর পর, বছর শেষে শীতকালের ছুটি কাটানোর পরিকল্পনা সমুদ্রতীরে | গন্তব্য উড়িষ্যার প্রাচীন জনপদ "পুরী" | কলকাতা থেকে প্রায় ৫১০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত পুরী শুধু সমুদ্র সৈকত নয়, জগন্নাথদেবের মন্দিরের জন্যেও বিখ্যাত তীর্থস্থান। বাঙ্গালীদের সবচেয়ে প্রিয় তিনটে বেড়ানোর জায়গা দীঘা-পুরী-দার্জিলিং । তবে বঙ্গোপসাগরের পশ্চিম তীরে ভারতবর্ষের পূর্ব উপকূলে অবস্থিত পুরীর মাহাত্ম্য সমুদ্র আর মন্দির দুটোর জন্যই । বহুল জনপ্রিয় বেড়ানোর জায়গা হওয়ার কারনে পুরীর অলিগলি, আনাচে-কানাচে অনেকেরই মুখস্ত | পত্র-পত্রিকা, প্রবন্ধ, গল্প, উপন্যাস, ইন্টারনেট ইত্যাদির সূত্রে পুরীর কুষ্টিঠিকুজি প্রায় সকলেরই নখদর্পনে | আর তাই এবারের ভ্রমনকাহিনী লেখা বেশ চ্যালেঞ্জিং | দেখাই যাক চেনার মাঝে কোনও অচেনার স্বাদ আনা যায় কিনা |
অন্য অনেক বারের তুলনায় এবারের বেড়ানো অনেক পরিকল্পনা প্রসূত | চারমাস আগেই টিকিট কাটা ও হোটেল বুকিং সারা | তা সত্ত্বেও ছোটখাট বিঘ্ন যে আসেনি তা নয় | যেদিন ঠিক চার মাসের উইন্ডো খুলল, সেদিন সকাল সাড়ে আটটায় ইন্টারনেটে টিকিট কেটেও হল ওয়েটিং লিস্ট ৬৪ | সুতরাং ধূপধূনো জ্বেলে আবার প্রচেষ্টা পরের দিন এবং লটারীর টিকিট লাগার মত পুরী এক্সপ্রেসের কনফার্মড টিকিট সকাল আটটা বেজে দুই মিনিটে | চার মাস আগে টিকিট কাটতে গিয়েও আমার মত তথাকথিত শহুরে,কিঞ্চিত প্রযুক্তিতে অভ্যস্ত মানুষেরই যদি এমন নাজেহাল পরিস্থিতি তবে ভারতের আপামর সাধারন মানুষের হাল সহজেই অনুমেয় | যাই হোক আমার বেয়ারা প্রশ্নের বদভ্যাস সরিয়ে রেখে হোটেলের কথায় আসি | ঠিকই ধরেছেন, আমার ঝটকা লাগা বাকি ছিল | সরাসরি যোগাযোগে বা ট্রাভেল এজেন্টের মাধ্যমে খোঁজাখুঁজি করে দেখা গেল কোনও হোটেলে ঘর খালি নেই | হ্যাঁ চার মাস আগেই | যে সময়টা আমরা বেছেছি বেড়ানোর জন্য, মানে বড়দিন আর ইংরাজী বছর শেষের দিনগুলি নাকি পুরীতে এরকমই নাভিশ্বাস ওঠে | আর নিশ্চিত করে অধিকাংশ ভ্রমন পিপাসুই বাঙালী |
আমাদের দল এবার একটু ভারী | মানে তিন জনের পরিবর্তে চারজন প্রাপ্তবয়স্ক - আমি, আমার স্ত্রী, মা ও শ্বাশুড়ী মা | সঙ্গে আমার দুটি বাচ্চা - দশ বছরের মেয়ে এবং পাঁচ বছরের ছেলে | সিল্ক রুটের গল্প যাঁরা পডেছেন তাঁরা জানেন যে গত ডিসেম্বরে হঠাৎ করে আমার শ্বশুরমশাই মারা যাবার পর শ্বাশুড়ী মা কিছু মাস হায়দ্রাবাদে দাদার কাছে ছিলেন | ফলতঃ গরমের ছুটির বেড়ানোতে আমরা ওনাকে সঙ্গে পাই নি | এবারের পুরী ভ্রমনের পরিকল্পনা শ্বাশুড়ী মার জন্যেই | ওনার অনেক দিনের ইচ্ছে ছিল পুরী যাওয়ার | অন্যথায় আমরা বাকীরা ( ছেলে বাদে) আগে পুরী গিয়েছি | আমি আর মা তো একাধিক বার গিয়েছি | আর তাই আমাদের নিজেদের কাছেও চেনা জিনিষ নতুন রূপে খুঁজে পাওয়ার তাগিদ রয়েছে | পারিবারিক, ব্যবসায়িক বহুবিধ কর্মভারে বিপর্যস্ত, প্রযুক্তি নির্ভর অসামাজিক এক ক্ষয়িষ্ণু সময়ে, পরিবারের সকলের সাথে একান্তে কদিনের বেড়ানো অনেকটা বুকভরে শ্বাস নেওয়ার মত |
আর শীতের বেড়ানো বড় মজার | আমার মনে পড়ে ছেলেবেলার কথা | তখন দুর্গাপুজোর সময় থেকেই শীত পড়া শুরু হত | আর ডিসেম্বরে বার্ষিক পরীক্ষা শেষ হয়েই সেশন শেষ | তারপরেই শুরু হত মজা | চিড়িয়াখানা, মিউজিয়াম,তারামন্ডল, ঝিলমিল(এখনকার নিক্কোপার্ক ! ), বইমেলা (তখন বিগ্রেডে হত ),সার্কাস ( বাঘ, সিংহ সহযোগে) তো ছিলই, উপরি মজা ছিল দলবেঁধে বেড়াতে যাওয়া | বাবার বেশ কিছু অফিসের বন্ধুরা পরিবার সহ একসাথে বেড়াতে যাওয়া হত | ভারতের বিভিন্ন জায়গায় গিয়েছি সেই দিনগুলোতে আর তাই বেড়ানোর নেশা মিশে গিয়েছে রক্তে সেই ছেলেবেলা থেকেই |
"জল পড়ে, পাতা নড়ে"র মত আমার মাথায় নড়ে পোকা | নিজের ব্যবসা চালু করার পর থেকেই আমার মাথায় ঘোরে আমার মত আরো যারা উদ্যোগপতি তারা মিলে পারিবার সহযোগে যদি বেড়াতে যাওয়া যায় তবে কেমন হয় | নিজস্ব উদ্যোগে ব্যবসা করার জ্বালা-যন্ত্রণা-ভালোলাগা-সাফল্য-আনন্দ-উত্তেজনার রসায়ন আরেকজন উদ্যোগপতি ছাড়া উপলধ্বি করা দুষ্কর নয়, অসম্ভব | ব্যবসার বাইরে নিছক মজায় পরিবার সহযোগে একসাথে বেড়াতে গেলে শুধুই ভাবের আদান প্রদান নয়, পারিবারিক একটা যোগসূত্রও গড়ে ওঠে এই একলা আত্মকেন্দ্রিক সময়ে | কিন্তু তেল-জলে যেমন মিশ যায় না, সেইরকমই এই চলমান সময়ে বাঙালী উদ্যোগপতীদের একসূত্রে বাঁধা কার্যত কুকুরের লেজ সোজা করার মত | মানে "আশায় মরে চাষা" আর কি | এবারের বেড়ানো যেহেতু পূর্ব পরিকল্পিত এবং অনেক সময় হাতে ছিল, আমরা ছাড়াও আরো চারটি পরিবার যোগাড় হল একসাথে যাবার জন্যে | ফলত আমার স্ফূর্তির প্রাণ গড়ের মাঠ | কিন্তু বেলুন গেল চুপসে কদিনেই | ব্যবসা, ব্যস্ততা , অসুস্থতা, বিয়ে বিভিন্ন বহুল পরিচিত অজুহাতে কেটে গেল সকলেই | সুতরাং আজ যাচ্ছি আমি ও আমার পরিবারই শুধু |
সঙ্গে থাকুন | আগামী কয়েক দিন ঘুরে আসি পুরী থেকে l
"বড়দিনের আড়ম্বরে, পৌষ গিয়েছে চুরি,
ডিসেম্বরের সন্ধ্যারাতে যাত্রা এবার পুরী |
যিশু দিবস - বাড়ছে হুজুগ, হুল্লোড়ে সব মাত,
পান ভোজনে বাংলা ভেসে, নেশার মায়া রাত |
অচেনা ঠেকে আমার শহর, সেও কি আমায় চেনে?
সাগর ডাকে, জগন্নাথও , পালিয়ে যাই ট্রেনে |"
Last edited by ভ্রমন পাখি on Wed Mar 07, 2018 1:55 pm; edited 1 time in total