#উত্তরবঙ্গ_ভ্রমণ #পেডং (প্রথম পর্ব)
দুগ্গা, দুগ্গা করে অবশেষে বেরিয়ে পড়া গেল দার্জিলিং মেল-এর উদ্দেশ্যে এবং শিয়ালদহ ষ্টেশনে পৌঁছে-ই বোঝা গেল দুগ্গা'র মাহাত্ম্য কারণ উত্তরবঙ্গগামী প্রায় সব ট্রেন বাতিল হয়ে গেছে আচমকা, ট্রেন লাইনে কাজ চলছে বলে, ব্যতিক্রম একমাত্র দার্জিলিং মেল! ট্রেন চলতে শুরু করতে-ই বোঝা গেল এ এক পৈশাচিক যাত্রা হতে চলেছে। আগের বাতিল দুটো ট্রেন-এর যাত্রীরা অনেকেই, যে যেখানে পেরেছেন উঠে পড়েছেন, কীভাবে জানিনা। রাত সাড়ে বারোটা'র পরে-ও তুমুল হট্টগোল, চেকার এবং আরপিএফ-এর সঙ্গে বচসা বা রফা করা'র চেষ্টা, মোদ্দা কথা, দু-চোখের পাতা এক করা গেল না সারারাত। বাঁচোয়া এইটাই যে ট্রেন মাত্র মিনিট দশেক লেট ছিল। এনজেপি নেমে আমার বর প্রবল মাথা নেড়ে জানালো যে চা-কফি কিচ্ছু খাবেনা, খেলেই উদরে চাপ, চাপ হলে-ই ইয়ে আর কী। আমি আর আমার পুত্র অবশ্য কফি এবং স্যান্ডউইচ খেয়ে ফেললাম। জুলজুল করে দেখলো বেচারা :/
এরপর শুরু হল গাড়ি'র খোঁজ। আমাদের গন্তব্য পেডং বা পেদং (নেপালী উচ্চারণ), কালিম্পং থেকে আরো ২৩ কিমি। যেহেতু আগের ট্রেন সব বাতিল হয়েছে, খুব স্বাভাবিকভাবেই দেখা গেল যেকোন গাড়ি-ই বেশী ভাড়া চাইছে। আমরা তিনজন মাত্র হলে-ও ছোট গাড়ি নেই, নিতে হলে বড় এইট-সিটার বা টেন-সিটার গাড়ি নিতে হবে।
আমরা একজন সহৃদয় ড্রাইভারের পরামর্শ মতন, একটা অটোরিক্শা নিয়ে শিলিগুড়ি পানিট্যাঙ্কি চলে গেলাম, সেখান থেকে অনায়াসে পাওয়া গেল কালিম্পং যাওয়া'র শেয়ার গাড়ি।
শিলিগুড়ি শহরটা অন্য আর পাঁচটা বড় শহরের মতন হলে-ও, এই যে সেবক রোড ধরে শালুগাড়া ছাড়ালেই এক লহমায় বদলে যায় দু-পাশের দৃশ্যপট, বিভিন্ন শেডের সবুজ রঙ প্রকৃতি'র প্যালেটে ভরে যায়-- এ আমায় প্রতিবার মুগ্ধ করে। বাঁকে, বাঁকে শান্ত, সবুজ তিস্তা, তারপর কালিম্পং-এর অপূর্ব রাস্তা আর ফুলের সমারোহ দেখতে দেখতে আড়াই ঘন্টায় পৌঁছে গেলাম স্ট্যান্ড-এ, সেখান থেকে একটা আলাদা ছোট গাড়ি ভাড়া করে রওনা দিলাম পেডং-এর পথে।
মাত্র তেইশ কিলোমিটার রাস্তা হলে-ও, যেতে এক ঘন্টা বা তার বেশী সময় লাগতে পারে কারণ বেশ কয়েকটা "হেয়ার-পিন" বা চুলে'র কাঁটা'র মতন বাঁক থাকায়, গাড়ি খুব ধীরে এবং সাবধানে চালাতে হয়। পেডং আসলে একটা অসাধারণ সুন্দর ছোট্ট পাহাড়ী গ্রাম, অবস্থান পূর্ব হিমালয়ের শৈলশিরা-তে (ridge)। লেপ্চা, নেপালী এবং ভুটিয়া, এই তিন ধরণের মানুষের বসবাস হলে-ও, ভাষা নেপালী। তবে, হিন্দি তো বটেই এবং মোটামুটি ইংরিজি-ও প্রায় সবাই বোঝে। দারুণ হাসিখুশি, সরল এই মানুষগুলো-কে দেখলে এমনিতেই বড় ভাল লাগে। সমস্ত মেয়েরা বেশ সুন্দরী এবং আধুনিক কেতাদুরস্ত, চুলের হাইলাইট আর লিপস্টিক-এর রঙ দেখে আমি তো প্রায় ফিদা হয়ে গেছি O:)। ও, ভুটিয়া ভাষায় "পেদং" অর্থ ফার গাছের রাজ্য।
আমাদের গাড়ি যখন পেডং মার্কেট ছাড়িয়ে একটু উপরে উঠে, "সাঁইলক্ষ্মী হোম-স্টে",মানে যেখানে আমাদের থাকা'র কথা, সেখানে এসে দাঁড়াল, তখন সামনে সারিবাঁধা প্রহরী'র মতন পাহাড় আর এক ঝলক টাট্কা অক্সিজেন প্রবল অভ্যর্থনা জানালো। এই হোম-স্টে দেখাশোনা করেন রবি সাঁই, অত্যন্ত ভদ্র এবং হেল্পফুল একজন মানুষ। আমরা পৌঁছনো'র কিছু পরেই ওনাকে বিশেষ জরুরি কোন কাজে কলকাতা রওনা দিতে হয়, সেজন্য উনি দুঃখপ্রকাশ-ও করেন। যে দু-দিন আমরা ছিলাম, মোটামুটি আমাদের দেখভাল করেছিল সেবিকা নামে একটা বাচ্চা মেয়ে আর তার মা। সেবিকা ক্লাস টেন-এ পড়ে, অসম্ভব ভাল রান্না করে, ভীষণ মিষ্টি আর দিব্যি ফুটবল-ও খেলে।
এবার বলে রাখা ভাল, আপনি যদি নিছক প্রকৃতি না ভালবাসেন, তাহলে পেডং আসা'র দরকার নেই।এখানে জীবন নিস্তরঙ্গ, রাত সাড়ে সাতটা বা আটটা'র মধ্যে সবাই খেয়েদেয়ে শুয়ে পড়ে, অনেক সময় ইলেকট্রিসিটি বা ইন্টারনেট, দুটোর কোনটা-ই থাকেনা। এসবে'র পরিবর্তে যা পাবেন, তা হল, রঙিন ফুল আর সবুজের অশেষ সমারোহ, পাহাড়ের গায়ে টুপ্ করে ডুবে-যাওয়া সূর্য, আর মায়াবী কুয়াশা-ঢাকা রাস্তা। প্রথম রাত্রে আকাশ ঝক্ঝকে পরিষ্কার পেয়েছিলাম আমরা, ঘরের সামনের বারান্দায় বসে গরম গরম মোমো খেতে খেতে মুগ্ধ হয়ে দেখছিলাম কীভাবে প্রকৃতি তার নিজস্ব ভাষায় অজস্র তারা'র আঁকিবুঁকি কেটে চলেছে আকাশ'র স্লেটে, পূর্ণিমা কাছাকাছি হওয়ায় হালকা, হলুদ চাঁদের আলো নরম একটা আস্তরণ বিছিয়ে দিচ্ছে চারদিকে আর সামনে পাহাড়ের গায়ে জুগ্জুগ্ করছে দূরের কোন শহরের আলোকমালা।
ট্যুরিস্ট স্পট হিসেবে পেডং এখন-ও তেমন বিখ্যাত হয়ে ওঠেনি (ঠিক এই কারণেই আমরা এই জায়গাটা বেছেছিলাম) তাই জায়গাটা এখন-ও যাকে বলে প্রিস্টিন, নিজস্ব আদিম সৌন্দর্যে ভরপুর। সফরের দ্বিতীয় দিনে কাছাকাছি কয়েকটা জায়গা দেখতে বেরোলাম গাড়ি নিয়ে। আমাদের ড্রাইভার একটি বছর ছাব্বিশের নেপালী যুবক, নাম এডু। আমাদের প্যারাগ্লাইডিং করা'র ইচ্ছে ছিল, ফলে প্রথমে ডেলো (বিখ্যাত বা কুখ্যাত) ভিউ পয়েন্টে যাওয়া হল। ডেলো বাংলো দেখে, কফি খেয়ে, দারুণ সাজানো বাগানে কিছুক্ষণ কাটিয়ে নেমেই দেখি প্রকৃতি'র মেজাজ আচমকা-ই বিগড়ে গেছে, আকাশ ঢেকে যাচ্ছে মেঘে, সাথে ঝিরঝিরে বৃষ্টি। প্যারাগ্লাইডিং যদি-ও করা সম্ভব কিন্তু মওকা বুঝে জনপ্রতি আড়াই হাজার হয়ে গেছে ভাড়া। তাও হয়ত যেতাম কিন্তু কুয়াশা বাড়তে থাকায় এবং আমরা একেবারেই নভিস হওয়ায় রিস্ক না নেওয়াই যুক্তিসঙ্গত বলে মনে হল। আমি প্যারাসেইলিং করেছি আগে, গ্লাইডিং করা'র ইচ্ছে এবার পূর্ণ হল না, হয়ত পরের বার....।
বৃষ্টিস্নাত পাহাড়ের পথ ধরে আমরা এগোলাম তিনচুলে ভিউ পয়েন্টের দিকে। এখানে গাড়ি শেষ পর্যন্ত যায়না, কিছুটা পথ আপনাকে হেঁটে যেতে হবে রডোডেন্ড্রন, ফার আর পাইনের জঙ্গলের মধ্য দিয়ে। কিছুটা চড়াই হলেও জঙ্গলের সৌন্দর্য উপভোগ করতে করতে টের-ও পাওয়া যায়না। তবে, বৃষ্টি'র জন্য ঘন কুয়াশার পর্দা ভেদ করে উপরে উঠে খুব ভাল "ভিউ" কিছু পাইনি। ভাগ্য ভাল থাকলে, প্রকৃতি সদয় হলে, এখান থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘা, জেলেপ লা এবং নাথু লা অসাধারণ রূপে ধরা দেয়। তিনচুলে থেকে নেমে আমরা গেলাম ১৭০৬ খ্রীষ্টাব্দে নির্মিত সাংচেন দোরজি গোম্ফা বা মনাস্ট্রি দেখতে। এখানকার বৌদ্ধ সন্ন্যাসীরা দারুণ হাসিখুশি। ছবি তুলবো বলতে-ই একজন বললেন "রুকো জরা, মুঝে ঠিক্সে পোজ লেনে দো" :-D এনারা খেলাধূলা করেন নিয়মিত। এক জায়গায় দেখলাম "নাইফ-থ্রোয়িং" প্র্যাক্টিস হচ্ছে। ঠিক সেই "জয় বাবা ফেলুনাথ"-এর তেরো নাম্বার বক্সা'র মতন একটা বাক্স রাখা আছে, সেখান থেকে বেশ বড় ছুরি টাইপের ডার্ট তুলে ছুঁড়ছেন সবাই একটা বোর্ডে, যেটা মাটির একটু ওপরে লাগানো। একজন পরপর তিনখানা ডার্ট এক্কেবারে মাঝখানে বুল'স আই হিট করতেই আমরা এবং অন্য সন্ন্যাসীরা সবাই হাততালি দিয়ে উঠলাম। এইটি-ই পশ্চিমবঙ্গের একমাত্র মনাস্ট্রি যেখানে "ছম" নাচ উৎসব হয় তিনদিন ধরে। সেটি দেখতে গেলে জানুয়ারি-তে যেতে হবে। প্রচুর বিদেশি ট্যুরিস্ট সেইসময় পেডং আসেন। এখানে বেশ খানিকক্ষণ কাটিয়ে, ক্রস-হিল পয়েন্ট, (এখান থেকে তিব্বত এবং রেশি নদী চোখে পড়বে) ছোট্ট আরেকটা নির্জন মনাস্ট্রি, হনুমান মন্দির দেখে আমরা এগোলাম শেষ লেপ্চা রাজা গ্যবো আকিয়োক-এর তৈরি ড্যামসাং ফোর্ট-এর দিকে। ফোর্ট ওঠা'র পথ পুরোটাই চড়াই এবং ঘন পাইন-ফার জঙ্গলের মধ্য দিয়ে। এডু আমাদের ওপরে যেতে বারণ করলো কারণ দু-বছর ধরে নাকি সেরকম কোন রক্ষণাবেক্ষণ হয়নি ফোর্ট-টার এবং আগে গেলেও এখন ওখানে আর কেউ যায়না। সে ওই ঘন নির্জন জঙ্গলে আমাদের একা ছাড়তে নারাজ। নীচ থেকে দেখে মনে হল যে জঙ্গল বেশ দুর্ভেদ্য; সার দিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে বন্য, আদিম মহা দ্রুম।
অগত্যা ফেরা'র পথ। অগুন্তি বাচ্চা স্কুল থেকে ফিরছে রঙিন ছাতা মাথায় দিয়ে বৃষ্টি'র মধ্যে। মুখে তাদের অমলিন হাসি, বাইরের মানুষ দেখে চোখে কৌতূহল ঝিলিক মারছে। এই ছোট্ট গ্রামে সাতটা হাই স্কুল আর তিনটে কিণ্ডারগার্ডেন আছে; সেন্ট জেভিয়ার্স এবং সেন্ট জর্জ'স তো বেশ বিখ্যাত স্কুল এখানকার। হোম-স্টে-তে ফিরে এডু-কে জানালাম যে কাল আমরা রিশপ যাবো। সে একগাল হেসে জানালো গাড়ি লেকে সাড়ে-আট বজে চলে আয়েঙ্গে।
পরদিন রিশপ যাওয়া'র পথে হয়েছিল এক ভয়ঙ্কর সুন্দর অভিজ্ঞতা। পরের কিস্তি-তে সেই লেখা থাকবে।
****পেডং যেতে গেলে****
এনজেপি থেকে সরাসরি গাড়ি পাওয়া গেলেও একটু অফ্বিট স্পট বলে ভাড়া বেশি। দলে ভারি হলে ঠিক আছে, নয়ত, অটো নিয়ে শিলিগুড়ি পানিট্যাঙ্কি, ভাড়া ১৪০/-, তারপর ওখান থেকে কালিম্পং-এর শেয়ার গাড়ি, ভাড়া জনপ্রতি ১৫০/-। কালিম্পং স্ট্যান্ড থেকে পেডং-এ যাওয়ার গাড়িভাড়া ৮০০/১০০০/-
সাঁইলক্ষ্মী হোম-স্টে ভাড়া জনপ্রতি ৮০০/- প্রতিদিন খাওয়াসহ (বেশি বা কম হতে পারে। নির্ভর করছে কতজন যাচ্ছেন তার ওপর)
দুগ্গা, দুগ্গা করে অবশেষে বেরিয়ে পড়া গেল দার্জিলিং মেল-এর উদ্দেশ্যে এবং শিয়ালদহ ষ্টেশনে পৌঁছে-ই বোঝা গেল দুগ্গা'র মাহাত্ম্য কারণ উত্তরবঙ্গগামী প্রায় সব ট্রেন বাতিল হয়ে গেছে আচমকা, ট্রেন লাইনে কাজ চলছে বলে, ব্যতিক্রম একমাত্র দার্জিলিং মেল! ট্রেন চলতে শুরু করতে-ই বোঝা গেল এ এক পৈশাচিক যাত্রা হতে চলেছে। আগের বাতিল দুটো ট্রেন-এর যাত্রীরা অনেকেই, যে যেখানে পেরেছেন উঠে পড়েছেন, কীভাবে জানিনা। রাত সাড়ে বারোটা'র পরে-ও তুমুল হট্টগোল, চেকার এবং আরপিএফ-এর সঙ্গে বচসা বা রফা করা'র চেষ্টা, মোদ্দা কথা, দু-চোখের পাতা এক করা গেল না সারারাত। বাঁচোয়া এইটাই যে ট্রেন মাত্র মিনিট দশেক লেট ছিল। এনজেপি নেমে আমার বর প্রবল মাথা নেড়ে জানালো যে চা-কফি কিচ্ছু খাবেনা, খেলেই উদরে চাপ, চাপ হলে-ই ইয়ে আর কী। আমি আর আমার পুত্র অবশ্য কফি এবং স্যান্ডউইচ খেয়ে ফেললাম। জুলজুল করে দেখলো বেচারা :/
এরপর শুরু হল গাড়ি'র খোঁজ। আমাদের গন্তব্য পেডং বা পেদং (নেপালী উচ্চারণ), কালিম্পং থেকে আরো ২৩ কিমি। যেহেতু আগের ট্রেন সব বাতিল হয়েছে, খুব স্বাভাবিকভাবেই দেখা গেল যেকোন গাড়ি-ই বেশী ভাড়া চাইছে। আমরা তিনজন মাত্র হলে-ও ছোট গাড়ি নেই, নিতে হলে বড় এইট-সিটার বা টেন-সিটার গাড়ি নিতে হবে।
আমরা একজন সহৃদয় ড্রাইভারের পরামর্শ মতন, একটা অটোরিক্শা নিয়ে শিলিগুড়ি পানিট্যাঙ্কি চলে গেলাম, সেখান থেকে অনায়াসে পাওয়া গেল কালিম্পং যাওয়া'র শেয়ার গাড়ি।
শিলিগুড়ি শহরটা অন্য আর পাঁচটা বড় শহরের মতন হলে-ও, এই যে সেবক রোড ধরে শালুগাড়া ছাড়ালেই এক লহমায় বদলে যায় দু-পাশের দৃশ্যপট, বিভিন্ন শেডের সবুজ রঙ প্রকৃতি'র প্যালেটে ভরে যায়-- এ আমায় প্রতিবার মুগ্ধ করে। বাঁকে, বাঁকে শান্ত, সবুজ তিস্তা, তারপর কালিম্পং-এর অপূর্ব রাস্তা আর ফুলের সমারোহ দেখতে দেখতে আড়াই ঘন্টায় পৌঁছে গেলাম স্ট্যান্ড-এ, সেখান থেকে একটা আলাদা ছোট গাড়ি ভাড়া করে রওনা দিলাম পেডং-এর পথে।
মাত্র তেইশ কিলোমিটার রাস্তা হলে-ও, যেতে এক ঘন্টা বা তার বেশী সময় লাগতে পারে কারণ বেশ কয়েকটা "হেয়ার-পিন" বা চুলে'র কাঁটা'র মতন বাঁক থাকায়, গাড়ি খুব ধীরে এবং সাবধানে চালাতে হয়। পেডং আসলে একটা অসাধারণ সুন্দর ছোট্ট পাহাড়ী গ্রাম, অবস্থান পূর্ব হিমালয়ের শৈলশিরা-তে (ridge)। লেপ্চা, নেপালী এবং ভুটিয়া, এই তিন ধরণের মানুষের বসবাস হলে-ও, ভাষা নেপালী। তবে, হিন্দি তো বটেই এবং মোটামুটি ইংরিজি-ও প্রায় সবাই বোঝে। দারুণ হাসিখুশি, সরল এই মানুষগুলো-কে দেখলে এমনিতেই বড় ভাল লাগে। সমস্ত মেয়েরা বেশ সুন্দরী এবং আধুনিক কেতাদুরস্ত, চুলের হাইলাইট আর লিপস্টিক-এর রঙ দেখে আমি তো প্রায় ফিদা হয়ে গেছি O:)। ও, ভুটিয়া ভাষায় "পেদং" অর্থ ফার গাছের রাজ্য।
আমাদের গাড়ি যখন পেডং মার্কেট ছাড়িয়ে একটু উপরে উঠে, "সাঁইলক্ষ্মী হোম-স্টে",মানে যেখানে আমাদের থাকা'র কথা, সেখানে এসে দাঁড়াল, তখন সামনে সারিবাঁধা প্রহরী'র মতন পাহাড় আর এক ঝলক টাট্কা অক্সিজেন প্রবল অভ্যর্থনা জানালো। এই হোম-স্টে দেখাশোনা করেন রবি সাঁই, অত্যন্ত ভদ্র এবং হেল্পফুল একজন মানুষ। আমরা পৌঁছনো'র কিছু পরেই ওনাকে বিশেষ জরুরি কোন কাজে কলকাতা রওনা দিতে হয়, সেজন্য উনি দুঃখপ্রকাশ-ও করেন। যে দু-দিন আমরা ছিলাম, মোটামুটি আমাদের দেখভাল করেছিল সেবিকা নামে একটা বাচ্চা মেয়ে আর তার মা। সেবিকা ক্লাস টেন-এ পড়ে, অসম্ভব ভাল রান্না করে, ভীষণ মিষ্টি আর দিব্যি ফুটবল-ও খেলে।
এবার বলে রাখা ভাল, আপনি যদি নিছক প্রকৃতি না ভালবাসেন, তাহলে পেডং আসা'র দরকার নেই।এখানে জীবন নিস্তরঙ্গ, রাত সাড়ে সাতটা বা আটটা'র মধ্যে সবাই খেয়েদেয়ে শুয়ে পড়ে, অনেক সময় ইলেকট্রিসিটি বা ইন্টারনেট, দুটোর কোনটা-ই থাকেনা। এসবে'র পরিবর্তে যা পাবেন, তা হল, রঙিন ফুল আর সবুজের অশেষ সমারোহ, পাহাড়ের গায়ে টুপ্ করে ডুবে-যাওয়া সূর্য, আর মায়াবী কুয়াশা-ঢাকা রাস্তা। প্রথম রাত্রে আকাশ ঝক্ঝকে পরিষ্কার পেয়েছিলাম আমরা, ঘরের সামনের বারান্দায় বসে গরম গরম মোমো খেতে খেতে মুগ্ধ হয়ে দেখছিলাম কীভাবে প্রকৃতি তার নিজস্ব ভাষায় অজস্র তারা'র আঁকিবুঁকি কেটে চলেছে আকাশ'র স্লেটে, পূর্ণিমা কাছাকাছি হওয়ায় হালকা, হলুদ চাঁদের আলো নরম একটা আস্তরণ বিছিয়ে দিচ্ছে চারদিকে আর সামনে পাহাড়ের গায়ে জুগ্জুগ্ করছে দূরের কোন শহরের আলোকমালা।
ট্যুরিস্ট স্পট হিসেবে পেডং এখন-ও তেমন বিখ্যাত হয়ে ওঠেনি (ঠিক এই কারণেই আমরা এই জায়গাটা বেছেছিলাম) তাই জায়গাটা এখন-ও যাকে বলে প্রিস্টিন, নিজস্ব আদিম সৌন্দর্যে ভরপুর। সফরের দ্বিতীয় দিনে কাছাকাছি কয়েকটা জায়গা দেখতে বেরোলাম গাড়ি নিয়ে। আমাদের ড্রাইভার একটি বছর ছাব্বিশের নেপালী যুবক, নাম এডু। আমাদের প্যারাগ্লাইডিং করা'র ইচ্ছে ছিল, ফলে প্রথমে ডেলো (বিখ্যাত বা কুখ্যাত) ভিউ পয়েন্টে যাওয়া হল। ডেলো বাংলো দেখে, কফি খেয়ে, দারুণ সাজানো বাগানে কিছুক্ষণ কাটিয়ে নেমেই দেখি প্রকৃতি'র মেজাজ আচমকা-ই বিগড়ে গেছে, আকাশ ঢেকে যাচ্ছে মেঘে, সাথে ঝিরঝিরে বৃষ্টি। প্যারাগ্লাইডিং যদি-ও করা সম্ভব কিন্তু মওকা বুঝে জনপ্রতি আড়াই হাজার হয়ে গেছে ভাড়া। তাও হয়ত যেতাম কিন্তু কুয়াশা বাড়তে থাকায় এবং আমরা একেবারেই নভিস হওয়ায় রিস্ক না নেওয়াই যুক্তিসঙ্গত বলে মনে হল। আমি প্যারাসেইলিং করেছি আগে, গ্লাইডিং করা'র ইচ্ছে এবার পূর্ণ হল না, হয়ত পরের বার....।
বৃষ্টিস্নাত পাহাড়ের পথ ধরে আমরা এগোলাম তিনচুলে ভিউ পয়েন্টের দিকে। এখানে গাড়ি শেষ পর্যন্ত যায়না, কিছুটা পথ আপনাকে হেঁটে যেতে হবে রডোডেন্ড্রন, ফার আর পাইনের জঙ্গলের মধ্য দিয়ে। কিছুটা চড়াই হলেও জঙ্গলের সৌন্দর্য উপভোগ করতে করতে টের-ও পাওয়া যায়না। তবে, বৃষ্টি'র জন্য ঘন কুয়াশার পর্দা ভেদ করে উপরে উঠে খুব ভাল "ভিউ" কিছু পাইনি। ভাগ্য ভাল থাকলে, প্রকৃতি সদয় হলে, এখান থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘা, জেলেপ লা এবং নাথু লা অসাধারণ রূপে ধরা দেয়। তিনচুলে থেকে নেমে আমরা গেলাম ১৭০৬ খ্রীষ্টাব্দে নির্মিত সাংচেন দোরজি গোম্ফা বা মনাস্ট্রি দেখতে। এখানকার বৌদ্ধ সন্ন্যাসীরা দারুণ হাসিখুশি। ছবি তুলবো বলতে-ই একজন বললেন "রুকো জরা, মুঝে ঠিক্সে পোজ লেনে দো" :-D এনারা খেলাধূলা করেন নিয়মিত। এক জায়গায় দেখলাম "নাইফ-থ্রোয়িং" প্র্যাক্টিস হচ্ছে। ঠিক সেই "জয় বাবা ফেলুনাথ"-এর তেরো নাম্বার বক্সা'র মতন একটা বাক্স রাখা আছে, সেখান থেকে বেশ বড় ছুরি টাইপের ডার্ট তুলে ছুঁড়ছেন সবাই একটা বোর্ডে, যেটা মাটির একটু ওপরে লাগানো। একজন পরপর তিনখানা ডার্ট এক্কেবারে মাঝখানে বুল'স আই হিট করতেই আমরা এবং অন্য সন্ন্যাসীরা সবাই হাততালি দিয়ে উঠলাম। এইটি-ই পশ্চিমবঙ্গের একমাত্র মনাস্ট্রি যেখানে "ছম" নাচ উৎসব হয় তিনদিন ধরে। সেটি দেখতে গেলে জানুয়ারি-তে যেতে হবে। প্রচুর বিদেশি ট্যুরিস্ট সেইসময় পেডং আসেন। এখানে বেশ খানিকক্ষণ কাটিয়ে, ক্রস-হিল পয়েন্ট, (এখান থেকে তিব্বত এবং রেশি নদী চোখে পড়বে) ছোট্ট আরেকটা নির্জন মনাস্ট্রি, হনুমান মন্দির দেখে আমরা এগোলাম শেষ লেপ্চা রাজা গ্যবো আকিয়োক-এর তৈরি ড্যামসাং ফোর্ট-এর দিকে। ফোর্ট ওঠা'র পথ পুরোটাই চড়াই এবং ঘন পাইন-ফার জঙ্গলের মধ্য দিয়ে। এডু আমাদের ওপরে যেতে বারণ করলো কারণ দু-বছর ধরে নাকি সেরকম কোন রক্ষণাবেক্ষণ হয়নি ফোর্ট-টার এবং আগে গেলেও এখন ওখানে আর কেউ যায়না। সে ওই ঘন নির্জন জঙ্গলে আমাদের একা ছাড়তে নারাজ। নীচ থেকে দেখে মনে হল যে জঙ্গল বেশ দুর্ভেদ্য; সার দিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে বন্য, আদিম মহা দ্রুম।
অগত্যা ফেরা'র পথ। অগুন্তি বাচ্চা স্কুল থেকে ফিরছে রঙিন ছাতা মাথায় দিয়ে বৃষ্টি'র মধ্যে। মুখে তাদের অমলিন হাসি, বাইরের মানুষ দেখে চোখে কৌতূহল ঝিলিক মারছে। এই ছোট্ট গ্রামে সাতটা হাই স্কুল আর তিনটে কিণ্ডারগার্ডেন আছে; সেন্ট জেভিয়ার্স এবং সেন্ট জর্জ'স তো বেশ বিখ্যাত স্কুল এখানকার। হোম-স্টে-তে ফিরে এডু-কে জানালাম যে কাল আমরা রিশপ যাবো। সে একগাল হেসে জানালো গাড়ি লেকে সাড়ে-আট বজে চলে আয়েঙ্গে।
পরদিন রিশপ যাওয়া'র পথে হয়েছিল এক ভয়ঙ্কর সুন্দর অভিজ্ঞতা। পরের কিস্তি-তে সেই লেখা থাকবে।
****পেডং যেতে গেলে****
এনজেপি থেকে সরাসরি গাড়ি পাওয়া গেলেও একটু অফ্বিট স্পট বলে ভাড়া বেশি। দলে ভারি হলে ঠিক আছে, নয়ত, অটো নিয়ে শিলিগুড়ি পানিট্যাঙ্কি, ভাড়া ১৪০/-, তারপর ওখান থেকে কালিম্পং-এর শেয়ার গাড়ি, ভাড়া জনপ্রতি ১৫০/-। কালিম্পং স্ট্যান্ড থেকে পেডং-এ যাওয়ার গাড়িভাড়া ৮০০/১০০০/-
সাঁইলক্ষ্মী হোম-স্টে ভাড়া জনপ্রতি ৮০০/- প্রতিদিন খাওয়াসহ (বেশি বা কম হতে পারে। নির্ভর করছে কতজন যাচ্ছেন তার ওপর)