অযোধ্যা পাহাড় ভ্রমণ :
প্রথমেই এই গ্রূপের মেম্বার উজ্জ্বল কুমার বসুকে ধন্যবাদ জানাই। ওনার দেওয়া তথ্য নিয়েই গত 30 মার্চ দুই দিনের জন্য অযোধ্যা এর উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়েছিলাম। আমার এই ভ্রমণের অভিজ্ঞতা অবশ্যই আপনাদের সাথে share করবো যাতে আপনারা যারা অযোধ্যা যাবেন তাদের সুবিধা হয়।
আমরা 10 জন (2 টি 4 বছরের শিশু)2 টি গাড়িতে (Maruti swift dezire ও Alto k10) এ সকল 11 টায় কৃষ্ণনগর (আমার বাড়ি) থেকে বেরিয়েছিলাম। নিজেরাই ড্রাইভ করতে পারি তাই ড্রাইভার এর প্রয়োজন হয় নি। আমরা প্রথমে কৃষ্ণগর থেকে বর্ধমান হয়ে দুর্গাপুর এক্সপ্রেসওয়ে দিয়ে বিকেল 6 নাগাদ পুরুলিয়া পৌঁছলাম। পুরুলিয়ার আগেই পড়লো জয়চন্ডী পাহাড় ও গড় পঞ্চকোট। আর 20 কিলোমিটারের মধ্যেই আছে বারণতি। আমি আগে এই তিনটি স্থান ই দেখেছি, কিন্তু দাদার অনুরোধে জয়চন্ডী পাহাড় আবার দেখা হলো।আমি যেকোন ভ্রমণের আগেই অনলাইনে হোটেল বুক করে নিই (goibibo বেশি ব্যবহার করি)। অফ সিজনে যাচ্ছি, অনলাইনের থেকে সস্তায় হোটেল পাওয়া যাবে এই চিন্তা করে এইবার হোটেল বুক না করেই বেরিয়ে পড়েছিলাম। সুতরাং পুরুলিয়া পৌঁছনোর পর হোটেল খুঁজতে বেরোতে হল। বাস্তবে এর ঠিক উল্টো হলো। পুরুলিয়া বাস স্ট্যান্ডের কাছেই 5 থেকে 6 টা হোটেল ঘুরলাম। সবার rate ই অনলাইনের থেকে বেশি। জানতে চাইলাম যে অনলাইনে rate কম কেন। হোটেল মালিক জানালেন যে অনলাইনে আপনারা ছাড় দিয়ে কম rate এ পেতে পারেন কিন্তু আমরা actual rate মানে ছাড় ছাড়া rate টাই পেয়ে যাই। কোম্পানি কি ভাবে ছাড় দেয় সেটা আমাদের জানা নেই। শেষ পর্যন্ত হোটেল নেস্ট এ আশ্রয় নিলাম। Non Ac double বেডরুম 500 টাকা করে পড়লো। হোটেলে 2 গাড়ি পার্কিং এর জায়গা ছিল। রুম এর কন্ডিশন খুব ভালো না হলেও আমাদের অসুবিধা হয় নি। এই হোটেলে খাবারের ব্যবস্থা নেই। তাই হোটেলের বাইরে দোকান থেকে রাতের খাওয়া টা সারলাম। পরদিন সকাল 8 am এ অযোধ্যার উদ্দেশে বেরিয়ে পড়লাম। পুরুলিয়া শহর থেকে 1/2 km পেরোতেই রাস্তার ধারে দেখলাম বেশ বড় বড় সাইজের লুচি ভাজা হচ্ছে। লুচি খেয়েই ব্রেএকফাস্ট সাড়া হলো। শহর থেকে কিছু দূর যাওয়ার পর পেলাম পলাশের দেখা। এই সময় পলাশ গরমে শুকিয়ে যায়। তবে কিছু গাছে এখনো পলাশ আছে। আমরা পুরুলিয়া শহর থেকে বেরিয়ে ডামদা মোড় থেকে ডান দিকে বাঁক নিয়ে থেকে 30 কিমি রাস্তা পেরোনোর পর অবশেষে পৌছালাম অযোধ্যা এর পাদদেশে। এইবার মনে একটু ভয় এলো। সমতলে গাড়ি চালাতে জানলেও পাহাড়ে চালানোর কোনো অভিজ্ঞতা নেই। ভগবান কে স্মরণ করে আঁকা বাঁকা পথ দিয়ে পাহাড়ে ওঠা শুরু করলাম। পাহাড়ে ওঠার অনেকগুলো রাস্তা আছে। এই রাস্তা দিয়ে পাহাড়ে উঠে upper dam, lower dam (এই রাস্তাটা পাহাড়ে ওঠার প্রধান রাস্তা বলে মনে হলো, কারণ রাস্তাটি পিচের ও চওড়া )এর রাস্তা দিয়ে সমতলে নামলে পুরো পাহারটাই দেখা হয়ে যায়। এই রাস্তায় কিছুটা পাহাড়ে উঠলেই আপনি দেখতে পাবেন S bend যেটি অযোধ্যা পাহাড়ের দর্শনীয় স্থান গুলির একটি। এরপর আমরা পৌঁছে গেলাম অযোধ্যা হিল টপ এ। ওখানে wbcadc এর গেস্ট হাউসে। রুম পাওয়া যাবে না জেনেও খোঁজ নিতে ঢুকলাম। receptionist বললেন ac রুম নেই। ac রুম নিতে হলে আরেকটু এগিয়ে গেলে আরও কয়েকটি হোটেল পাওয়া যাবে। এখানে একটা 13 বেডের ডর্মিটোরি পাওয়া গেলো। 150 টাকা প্রতি বেড। আমরা মাত্র 8 জন তাই তখনই বুক না করে ফোন নাম্বার নিয়ে এলাম। এবার নীহারিকা ছাড়িয়ে একটু এগিয়ে পেলাম পরিবার হোটেল, এটি একটা রেস্টুয়ারেন্ট। খুব ন্যায্য মূল্যে অনেক কিছুই পাওয়া যায়। আমরা সবজি ভাত খেয়ে রওনা দিলাম মুরুগুমা ড্যাম এর উদ্দেশে। ড্যাম দেখার পর আমাদের পরবর্তী গন্তব্য ছিল খইরাবেড়া ড্যাম। আমাদের যাত্রাপথের প্রথম থেকেই আমার মোবাইলের(mi max 2) google map সাথে ছিল। এবার ও map দেখে ড্যামের কাছাকাছি চলে এলাম। কিন্ত ড্যাম দেখতে পাচ্ছি না। শেষে স্থানীয় একজন কে জিজ্ঞাসা করতেই ওদের টানে বলে উঠলেন " বাবু কলকাতা থেকে যারা ইন্টারনেট দেখে এই ড্যাম দেখতে আসে তারা এটা খুঁজে পায় না, আপনারা ড্যামের কাছেই আছেন কিন্তু গাড়ি নিয়ে যেতে পারবেন না, এই ড্যাম দেখতে হলে আপনাকে সমতলে নেমে বাগমুন্ডি দিয়ে যেতে হবে। আপনার এখন থেকে বামনি ফলস দেখতে চলে যান। আমার মোটর সাইকেল এ তেল থাকলে আপনাদের রাস্তা চিনিয়ে দিয়ে আসতাম।" ওই লোকের , ভুল বললাম ওই ভদ্রলোকের (যথেষ্ট সন্মান দিয়ে ভদ্রলোক বলতে ইচ্ছা হল) এই শেষ কথাটা বুকে একটা আঘাত করলো ! এই আমরা যারা শহরে থাকি তারা কি এই ভাবে সাহায্য করার কথা ভাবতে পারি কখনো ? যাইহোক এরপর আমরা বামনি ফলস এ পৌঁছে গেলাম। এই ফলস দেখতে গেলে আপনাকে পাহাড়ি রাস্তা দিয়ে অনেক নীচে নামতে হবে। দুটো কারণে নামতে সাহস হলো না। প্রথমত ফলস দেখে যারা ওপরে উঠছে এমন 5 থেকে 6 জন কে প্রশ্ন করতেই বললেন " দাদা আমার কথা শুনুন নীচে নামতে যাবেন না, ওপরে ফিরে আসতে কি অবস্থা হবে আমাদের দেখেই বুঝতে পারছেন " আর দ্বিতীয়ত প্রচন্ড মেঘ ও সাথে হাওয়া দিচ্ছিল। এরপর আমরা ওখান থেকে থুঙ্গা ফলস ও ড্যাম এর পাস দিয়ে সমতলে নামলাম এবং আরণ্যক লজের পাস দিয়ে গিয়ে পাহাড়ে ওঠার অপর রাস্তা দিয়ে প্রথমে পৌঁছলাম lower dam view poient এ। কিছু ছবি তোলার পর আরো ওপরে উঠতে উঠতে পোঁছে গেলাম upper dam এ। কিছু ছবি তোলা হলো। এরপর সন্ধে হয়ে আসায় তাড়াতাড়ি হিল টপ এ পৌঁছে গেলাম ও নীহারিকা তে শেষ পর্যন্ত 13 বেডের ডর্মিটোরি বুক করলাম ও রাতের খাবার এর কথা জানিয়ে দিলাম। এই প্রসঙ্গে জানাই নীহারিকা খুবই সুন্দর। ভেতরে সুন্দর বাগান আছে, খাঁচার মধ্যে আছে রাজ হাঁস, টার্কি পাখি, খরগোশ, দোলনাও আছে যা বাচ্ছাদের খুব আনন্দ দেবে। গাড়ি পার্কিং এর ভালো ব্যবস্থা আছে। আর পাশেই আছে মিলিটারি ক্যাম্প, যা আপনাকে বাড়তি সাহস দেবে। নীহারিকার গেটের পাশেই একটা ATM ও চোখে পড়লো। এদের এখানে উনুনে কাঠ দিয়ে রান্না হয়। রান্নার জায়গাটাও বেশ পরিষ্কার। বাগানের মধ্যে খাওয়ার জায়গাও আছে। পরদিন 7 am এ উঠে পড়লাম। চা চলে এলো। প্রসঙ্গত জানাই সকালের চা কিন্ত বিনামূল্যে। 8 am এ নীহারিকা কে টাটা করে বেরিয়ে পড়লাম ও পরিবার হোটেলে লুচি/ রুটি দিয়ে ব্রেএকফাস্ট সারলাম। এরপর বেরিয়ে পড়লাম ও একটু এগিয়েই পেয়ে গেলাম ময়ূর পাহাড়। ময়ূর পাহাড় দেখার পর গেলাম দুর্গাবেড়া তে (বামনি ফলস এর রাস্তা তেই পড়বে)। স্থানীয় দোকান থেকে জানতে পারলাম যে এই স্থান থেকে পাথর কেটে নিয়ে গিয়ে upper dam ও lower dam তৈরি করা হয়েছে। আর পাথর কেটে নিয়ে যাওয়ার ফলে এখানে এই lake এর সৃষ্টি হয়েছে। এরপর আমরা upper dam এর পাশ দিয়ে সমতলে নামলাম ও বাগমুন্ডি দিয়ে খইরাবেড়া দেখতে এগোলাম। পথে পড়লো মুখোশের গ্রাম চরিদা। কিছু মুখোশ কেনা হলো। তারপর পৌঁছে গেলাম খইরাবেড়া। অপূর্ব দৃশ্য এখানকার। এবার আমাদের ঘরে ফেরার পালা। ওই পথেই বাঘমুন্ডি এসে নিত্যানন্দ হোটেলে খায়দাওয়া সেরে ঠিক করলাম যে এবার পাখি পাহাড় দেখে পুরুলিয়া যাবো এবং পুরুলিয়া থেকে আসানসোল দিয়ে কৃষ্ণনগর ফিরবো। কিন্তু হঠাৎ প্রচন্ড ঝড় বৃষ্টি শুরু হলো। বৃষ্টি একটু কমতেই পাখি পাহাড়ের উদ্দেশে বেরিয়ে পড়লাম বিকেল 5 pm এ। পাখি পাহাড়ে যখন পৌঁছলাম তখন একটু অন্ধকার হয়ে গেছে আর সাথে বৃষ্টি, কোনো মানুষ নেই ওখানে। একটু ভয় লাগলো। আর এগোতে সাহস হলো না। এবার ফেরার জন্য গাড়ি ঘোরালাম। বর্ধমানে পৌঁছে গাড়ির চাকা puncture। বাড়ি পৌছালাম রাত 3 am এ।
এবার কয়েকটা টিপস দিই।
1, পাহাড়ে গাড়ি চালানোর অভিজ্ঞাতা না থাকলেও আপনি অযোধ্যায় চালাতে পারবেন। তবে একটু সাবধানে। 1st gear এ বা 2nd gear এ গাড়ি ওপরে তুলবেন ও প্রয়োজনমত gear পরিবর্তন করবেন। পাহাড় থেকে নামার সময় 1 st ও 2nd gear ব্যবহার করবেন। কম gear একপ্রকার break এর কাজ করে। পাহাড়ের ওপরে পেট্রোল পাম্প চোখে পড়ে নি। আমার মতে সমতল থেকেই পর্যাপ্ত তেল ভরে নেওয়াই ভালো।
2, পাহাড়ের ঢালে গাড়ি পার্ক করতে হলে হ্যান্ড break দেয়ার সাথে সাথে 1st gear এ গাড়ি রাখবেন। এখানে শুধু হ্যান্ড break use করলে গাড়ি গড়িয়ে যেতে পারে।
3, যদি নিজে গাড়ি চালান তাহলে google map ব্যবহার করবেন। অজানা পাহাড়ি রাস্তায় রাস্তা চিনে আমার গাড়ি চালানো দেখে আমার বৃদ্ধা মা অবাক হয়ে গিয়েছিলেন। আপনি লোকাল গাইড অথবা ড্রাইভার ও নিতে পারেন। যে হোটেলে থাকবেন সেখানেই খোঁজ পাবেন।
4, গাড়ির কোনো প্রবলেম থাকলে সেটা ভালো করে repair করে তবেই পাহাড়ে যাবেন। কারণ ওখানে জনবসতি কম হওয়ায় অসুবিধায় পড়তে পারেন।
5, অনেকের মনেই হয়তো প্রশ্ন আছে এই সময় ওখানে গরম কেমন। সত্যি কথা বলতে আমি ওখানে গরমের সম্মুখীন খুবই কম হয়েছি। গাড়িতে ac ছিল। বিকেলের দিকে যখন পুরুলিয়া পৌঁছলাম তখন ac এর প্রয়োজন হয় নি। সন্ধেবেলায় বেশ ঠান্ডা হাওয়া দিচ্ছিল। Non ac রুম এ থাকতে কোনো কষ্টই হয় নি। আর পাহাড়ের আবহাওয়ার কথা বললে অনেকেই বিশ্বাস করবেন না। সন্ধের পর পাহাড়ে রীতিমতো শীত করছিল ! বাড়ি থেকে নিয়ে যাওয়া চাদর ব্যবহার করতে হয়েছিল।
6, আমি পুরুলিয়াতে হোটেল নেস্ট এ থেকেছিলাম। এই সাধারণ মাপের গেস্ট হাউস। আমি কয়েকটা হোটেলে রুম আছে কিনা জানতে গিয়েছিলাম। সেগুলির রুমগুলি হোটেল নেস্ট এর থেকে ভালো। কয়েকটা নাম বলি। Hotel Genius(এদের রুমগুলি 2nd floor এ। লিফট নেই। Ac ট্রিপল বেড 900/night. নন AC 600/ নাইট। goibibo তে এই হোটেলের AC রুম 736 টাকা ছিল। গাড়ি পার্কিং হোটেলের সামনে রাস্তার পাশে।) Hotel Mayur, ভালো পার্কিং ব্যাবস্থা আছে। Hotel Sagar Ratan। আর একটি হোটেলের কথা অনেকেই বলেন, সেটি হলো আরণ্যক lodge। এটি অযোধ্যা পাহারের পাদদেশে। শুনেছি ভালো lodge। কিন্তু আমি পাহাড়ের ওপরেই থাকতে পছন্দ করেছিলাম।
6, আর একটা কথা বলে শেষ করি, ওখানকার মানুষ খুব helpful, ওনাদের সন্মান করবেন। খইরাবেড়া ড্যাম এর কাছে কিছু মানুষের সাথে কথা বলে জানতে পারলাম যে ওনাদের বাড়ি সমতল থেকে 6km পাহাড়ের ওপরে। ওনারা পাহাড় থেকে শুকনো কাঠ কেটে পাহাড় থেকে নিচে এসে বিক্রি করেন ও চাল, ডাল ইত্যাদি কিনে এই পাহাড়ি পথেই বাড়ি ফেরেন। শুকনো কাঠ বিক্রি টাই ওদের প্রধান জীবিকা। বুঝতে পারলাম খুবই কষ্ট করে ওনারা জীবন ধারণ করেন। আমার স্বীকার করতে লজ্জা নেই যে আমি খুব কৃপণ কিন্তু পাহাড়ে যখন কয়েকজন কিছু সাহায্য চাইলেন তখন খুব সহজেই আমার হাত থেকে 50 বা 100 টাকা বেরিয়ে গেল। আর সব থেকে ভালো লাগলো যখন ওনাদের ছেড়ে চলে আসছিলাম এমন ভাবে আমাদের বিদায় জানাচ্ছিলেন যেন আমরা ওনাদের খুব আপন।
আমি লেখক নই। যা মনে এলো লিখলাম যদি কারোর উপকারে লাগে এই উদ্দেশ্য নিয়েই। এই গ্রূপের একজন লিখেছিলেন যে বাংলায় লিখলে শুদ্ধ বানান লিখবেন। ওনাকে শ্রদ্ধা জানিয়েই বলি যে মোবাইলে ও হাতে লেখার মধ্যে তফাৎ আছে। মোবাইলের সফটওয়ারের সাহায্য সব সময় পাওয়া যায় না। সবাই ভালো থাকবেন।
প্রথমেই এই গ্রূপের মেম্বার উজ্জ্বল কুমার বসুকে ধন্যবাদ জানাই। ওনার দেওয়া তথ্য নিয়েই গত 30 মার্চ দুই দিনের জন্য অযোধ্যা এর উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়েছিলাম। আমার এই ভ্রমণের অভিজ্ঞতা অবশ্যই আপনাদের সাথে share করবো যাতে আপনারা যারা অযোধ্যা যাবেন তাদের সুবিধা হয়।
আমরা 10 জন (2 টি 4 বছরের শিশু)2 টি গাড়িতে (Maruti swift dezire ও Alto k10) এ সকল 11 টায় কৃষ্ণনগর (আমার বাড়ি) থেকে বেরিয়েছিলাম। নিজেরাই ড্রাইভ করতে পারি তাই ড্রাইভার এর প্রয়োজন হয় নি। আমরা প্রথমে কৃষ্ণগর থেকে বর্ধমান হয়ে দুর্গাপুর এক্সপ্রেসওয়ে দিয়ে বিকেল 6 নাগাদ পুরুলিয়া পৌঁছলাম। পুরুলিয়ার আগেই পড়লো জয়চন্ডী পাহাড় ও গড় পঞ্চকোট। আর 20 কিলোমিটারের মধ্যেই আছে বারণতি। আমি আগে এই তিনটি স্থান ই দেখেছি, কিন্তু দাদার অনুরোধে জয়চন্ডী পাহাড় আবার দেখা হলো।আমি যেকোন ভ্রমণের আগেই অনলাইনে হোটেল বুক করে নিই (goibibo বেশি ব্যবহার করি)। অফ সিজনে যাচ্ছি, অনলাইনের থেকে সস্তায় হোটেল পাওয়া যাবে এই চিন্তা করে এইবার হোটেল বুক না করেই বেরিয়ে পড়েছিলাম। সুতরাং পুরুলিয়া পৌঁছনোর পর হোটেল খুঁজতে বেরোতে হল। বাস্তবে এর ঠিক উল্টো হলো। পুরুলিয়া বাস স্ট্যান্ডের কাছেই 5 থেকে 6 টা হোটেল ঘুরলাম। সবার rate ই অনলাইনের থেকে বেশি। জানতে চাইলাম যে অনলাইনে rate কম কেন। হোটেল মালিক জানালেন যে অনলাইনে আপনারা ছাড় দিয়ে কম rate এ পেতে পারেন কিন্তু আমরা actual rate মানে ছাড় ছাড়া rate টাই পেয়ে যাই। কোম্পানি কি ভাবে ছাড় দেয় সেটা আমাদের জানা নেই। শেষ পর্যন্ত হোটেল নেস্ট এ আশ্রয় নিলাম। Non Ac double বেডরুম 500 টাকা করে পড়লো। হোটেলে 2 গাড়ি পার্কিং এর জায়গা ছিল। রুম এর কন্ডিশন খুব ভালো না হলেও আমাদের অসুবিধা হয় নি। এই হোটেলে খাবারের ব্যবস্থা নেই। তাই হোটেলের বাইরে দোকান থেকে রাতের খাওয়া টা সারলাম। পরদিন সকাল 8 am এ অযোধ্যার উদ্দেশে বেরিয়ে পড়লাম। পুরুলিয়া শহর থেকে 1/2 km পেরোতেই রাস্তার ধারে দেখলাম বেশ বড় বড় সাইজের লুচি ভাজা হচ্ছে। লুচি খেয়েই ব্রেএকফাস্ট সাড়া হলো। শহর থেকে কিছু দূর যাওয়ার পর পেলাম পলাশের দেখা। এই সময় পলাশ গরমে শুকিয়ে যায়। তবে কিছু গাছে এখনো পলাশ আছে। আমরা পুরুলিয়া শহর থেকে বেরিয়ে ডামদা মোড় থেকে ডান দিকে বাঁক নিয়ে থেকে 30 কিমি রাস্তা পেরোনোর পর অবশেষে পৌছালাম অযোধ্যা এর পাদদেশে। এইবার মনে একটু ভয় এলো। সমতলে গাড়ি চালাতে জানলেও পাহাড়ে চালানোর কোনো অভিজ্ঞতা নেই। ভগবান কে স্মরণ করে আঁকা বাঁকা পথ দিয়ে পাহাড়ে ওঠা শুরু করলাম। পাহাড়ে ওঠার অনেকগুলো রাস্তা আছে। এই রাস্তা দিয়ে পাহাড়ে উঠে upper dam, lower dam (এই রাস্তাটা পাহাড়ে ওঠার প্রধান রাস্তা বলে মনে হলো, কারণ রাস্তাটি পিচের ও চওড়া )এর রাস্তা দিয়ে সমতলে নামলে পুরো পাহারটাই দেখা হয়ে যায়। এই রাস্তায় কিছুটা পাহাড়ে উঠলেই আপনি দেখতে পাবেন S bend যেটি অযোধ্যা পাহাড়ের দর্শনীয় স্থান গুলির একটি। এরপর আমরা পৌঁছে গেলাম অযোধ্যা হিল টপ এ। ওখানে wbcadc এর গেস্ট হাউসে। রুম পাওয়া যাবে না জেনেও খোঁজ নিতে ঢুকলাম। receptionist বললেন ac রুম নেই। ac রুম নিতে হলে আরেকটু এগিয়ে গেলে আরও কয়েকটি হোটেল পাওয়া যাবে। এখানে একটা 13 বেডের ডর্মিটোরি পাওয়া গেলো। 150 টাকা প্রতি বেড। আমরা মাত্র 8 জন তাই তখনই বুক না করে ফোন নাম্বার নিয়ে এলাম। এবার নীহারিকা ছাড়িয়ে একটু এগিয়ে পেলাম পরিবার হোটেল, এটি একটা রেস্টুয়ারেন্ট। খুব ন্যায্য মূল্যে অনেক কিছুই পাওয়া যায়। আমরা সবজি ভাত খেয়ে রওনা দিলাম মুরুগুমা ড্যাম এর উদ্দেশে। ড্যাম দেখার পর আমাদের পরবর্তী গন্তব্য ছিল খইরাবেড়া ড্যাম। আমাদের যাত্রাপথের প্রথম থেকেই আমার মোবাইলের(mi max 2) google map সাথে ছিল। এবার ও map দেখে ড্যামের কাছাকাছি চলে এলাম। কিন্ত ড্যাম দেখতে পাচ্ছি না। শেষে স্থানীয় একজন কে জিজ্ঞাসা করতেই ওদের টানে বলে উঠলেন " বাবু কলকাতা থেকে যারা ইন্টারনেট দেখে এই ড্যাম দেখতে আসে তারা এটা খুঁজে পায় না, আপনারা ড্যামের কাছেই আছেন কিন্তু গাড়ি নিয়ে যেতে পারবেন না, এই ড্যাম দেখতে হলে আপনাকে সমতলে নেমে বাগমুন্ডি দিয়ে যেতে হবে। আপনার এখন থেকে বামনি ফলস দেখতে চলে যান। আমার মোটর সাইকেল এ তেল থাকলে আপনাদের রাস্তা চিনিয়ে দিয়ে আসতাম।" ওই লোকের , ভুল বললাম ওই ভদ্রলোকের (যথেষ্ট সন্মান দিয়ে ভদ্রলোক বলতে ইচ্ছা হল) এই শেষ কথাটা বুকে একটা আঘাত করলো ! এই আমরা যারা শহরে থাকি তারা কি এই ভাবে সাহায্য করার কথা ভাবতে পারি কখনো ? যাইহোক এরপর আমরা বামনি ফলস এ পৌঁছে গেলাম। এই ফলস দেখতে গেলে আপনাকে পাহাড়ি রাস্তা দিয়ে অনেক নীচে নামতে হবে। দুটো কারণে নামতে সাহস হলো না। প্রথমত ফলস দেখে যারা ওপরে উঠছে এমন 5 থেকে 6 জন কে প্রশ্ন করতেই বললেন " দাদা আমার কথা শুনুন নীচে নামতে যাবেন না, ওপরে ফিরে আসতে কি অবস্থা হবে আমাদের দেখেই বুঝতে পারছেন " আর দ্বিতীয়ত প্রচন্ড মেঘ ও সাথে হাওয়া দিচ্ছিল। এরপর আমরা ওখান থেকে থুঙ্গা ফলস ও ড্যাম এর পাস দিয়ে সমতলে নামলাম এবং আরণ্যক লজের পাস দিয়ে গিয়ে পাহাড়ে ওঠার অপর রাস্তা দিয়ে প্রথমে পৌঁছলাম lower dam view poient এ। কিছু ছবি তোলার পর আরো ওপরে উঠতে উঠতে পোঁছে গেলাম upper dam এ। কিছু ছবি তোলা হলো। এরপর সন্ধে হয়ে আসায় তাড়াতাড়ি হিল টপ এ পৌঁছে গেলাম ও নীহারিকা তে শেষ পর্যন্ত 13 বেডের ডর্মিটোরি বুক করলাম ও রাতের খাবার এর কথা জানিয়ে দিলাম। এই প্রসঙ্গে জানাই নীহারিকা খুবই সুন্দর। ভেতরে সুন্দর বাগান আছে, খাঁচার মধ্যে আছে রাজ হাঁস, টার্কি পাখি, খরগোশ, দোলনাও আছে যা বাচ্ছাদের খুব আনন্দ দেবে। গাড়ি পার্কিং এর ভালো ব্যবস্থা আছে। আর পাশেই আছে মিলিটারি ক্যাম্প, যা আপনাকে বাড়তি সাহস দেবে। নীহারিকার গেটের পাশেই একটা ATM ও চোখে পড়লো। এদের এখানে উনুনে কাঠ দিয়ে রান্না হয়। রান্নার জায়গাটাও বেশ পরিষ্কার। বাগানের মধ্যে খাওয়ার জায়গাও আছে। পরদিন 7 am এ উঠে পড়লাম। চা চলে এলো। প্রসঙ্গত জানাই সকালের চা কিন্ত বিনামূল্যে। 8 am এ নীহারিকা কে টাটা করে বেরিয়ে পড়লাম ও পরিবার হোটেলে লুচি/ রুটি দিয়ে ব্রেএকফাস্ট সারলাম। এরপর বেরিয়ে পড়লাম ও একটু এগিয়েই পেয়ে গেলাম ময়ূর পাহাড়। ময়ূর পাহাড় দেখার পর গেলাম দুর্গাবেড়া তে (বামনি ফলস এর রাস্তা তেই পড়বে)। স্থানীয় দোকান থেকে জানতে পারলাম যে এই স্থান থেকে পাথর কেটে নিয়ে গিয়ে upper dam ও lower dam তৈরি করা হয়েছে। আর পাথর কেটে নিয়ে যাওয়ার ফলে এখানে এই lake এর সৃষ্টি হয়েছে। এরপর আমরা upper dam এর পাশ দিয়ে সমতলে নামলাম ও বাগমুন্ডি দিয়ে খইরাবেড়া দেখতে এগোলাম। পথে পড়লো মুখোশের গ্রাম চরিদা। কিছু মুখোশ কেনা হলো। তারপর পৌঁছে গেলাম খইরাবেড়া। অপূর্ব দৃশ্য এখানকার। এবার আমাদের ঘরে ফেরার পালা। ওই পথেই বাঘমুন্ডি এসে নিত্যানন্দ হোটেলে খায়দাওয়া সেরে ঠিক করলাম যে এবার পাখি পাহাড় দেখে পুরুলিয়া যাবো এবং পুরুলিয়া থেকে আসানসোল দিয়ে কৃষ্ণনগর ফিরবো। কিন্তু হঠাৎ প্রচন্ড ঝড় বৃষ্টি শুরু হলো। বৃষ্টি একটু কমতেই পাখি পাহাড়ের উদ্দেশে বেরিয়ে পড়লাম বিকেল 5 pm এ। পাখি পাহাড়ে যখন পৌঁছলাম তখন একটু অন্ধকার হয়ে গেছে আর সাথে বৃষ্টি, কোনো মানুষ নেই ওখানে। একটু ভয় লাগলো। আর এগোতে সাহস হলো না। এবার ফেরার জন্য গাড়ি ঘোরালাম। বর্ধমানে পৌঁছে গাড়ির চাকা puncture। বাড়ি পৌছালাম রাত 3 am এ।
এবার কয়েকটা টিপস দিই।
1, পাহাড়ে গাড়ি চালানোর অভিজ্ঞাতা না থাকলেও আপনি অযোধ্যায় চালাতে পারবেন। তবে একটু সাবধানে। 1st gear এ বা 2nd gear এ গাড়ি ওপরে তুলবেন ও প্রয়োজনমত gear পরিবর্তন করবেন। পাহাড় থেকে নামার সময় 1 st ও 2nd gear ব্যবহার করবেন। কম gear একপ্রকার break এর কাজ করে। পাহাড়ের ওপরে পেট্রোল পাম্প চোখে পড়ে নি। আমার মতে সমতল থেকেই পর্যাপ্ত তেল ভরে নেওয়াই ভালো।
2, পাহাড়ের ঢালে গাড়ি পার্ক করতে হলে হ্যান্ড break দেয়ার সাথে সাথে 1st gear এ গাড়ি রাখবেন। এখানে শুধু হ্যান্ড break use করলে গাড়ি গড়িয়ে যেতে পারে।
3, যদি নিজে গাড়ি চালান তাহলে google map ব্যবহার করবেন। অজানা পাহাড়ি রাস্তায় রাস্তা চিনে আমার গাড়ি চালানো দেখে আমার বৃদ্ধা মা অবাক হয়ে গিয়েছিলেন। আপনি লোকাল গাইড অথবা ড্রাইভার ও নিতে পারেন। যে হোটেলে থাকবেন সেখানেই খোঁজ পাবেন।
4, গাড়ির কোনো প্রবলেম থাকলে সেটা ভালো করে repair করে তবেই পাহাড়ে যাবেন। কারণ ওখানে জনবসতি কম হওয়ায় অসুবিধায় পড়তে পারেন।
5, অনেকের মনেই হয়তো প্রশ্ন আছে এই সময় ওখানে গরম কেমন। সত্যি কথা বলতে আমি ওখানে গরমের সম্মুখীন খুবই কম হয়েছি। গাড়িতে ac ছিল। বিকেলের দিকে যখন পুরুলিয়া পৌঁছলাম তখন ac এর প্রয়োজন হয় নি। সন্ধেবেলায় বেশ ঠান্ডা হাওয়া দিচ্ছিল। Non ac রুম এ থাকতে কোনো কষ্টই হয় নি। আর পাহাড়ের আবহাওয়ার কথা বললে অনেকেই বিশ্বাস করবেন না। সন্ধের পর পাহাড়ে রীতিমতো শীত করছিল ! বাড়ি থেকে নিয়ে যাওয়া চাদর ব্যবহার করতে হয়েছিল।
6, আমি পুরুলিয়াতে হোটেল নেস্ট এ থেকেছিলাম। এই সাধারণ মাপের গেস্ট হাউস। আমি কয়েকটা হোটেলে রুম আছে কিনা জানতে গিয়েছিলাম। সেগুলির রুমগুলি হোটেল নেস্ট এর থেকে ভালো। কয়েকটা নাম বলি। Hotel Genius(এদের রুমগুলি 2nd floor এ। লিফট নেই। Ac ট্রিপল বেড 900/night. নন AC 600/ নাইট। goibibo তে এই হোটেলের AC রুম 736 টাকা ছিল। গাড়ি পার্কিং হোটেলের সামনে রাস্তার পাশে।) Hotel Mayur, ভালো পার্কিং ব্যাবস্থা আছে। Hotel Sagar Ratan। আর একটি হোটেলের কথা অনেকেই বলেন, সেটি হলো আরণ্যক lodge। এটি অযোধ্যা পাহারের পাদদেশে। শুনেছি ভালো lodge। কিন্তু আমি পাহাড়ের ওপরেই থাকতে পছন্দ করেছিলাম।
6, আর একটা কথা বলে শেষ করি, ওখানকার মানুষ খুব helpful, ওনাদের সন্মান করবেন। খইরাবেড়া ড্যাম এর কাছে কিছু মানুষের সাথে কথা বলে জানতে পারলাম যে ওনাদের বাড়ি সমতল থেকে 6km পাহাড়ের ওপরে। ওনারা পাহাড় থেকে শুকনো কাঠ কেটে পাহাড় থেকে নিচে এসে বিক্রি করেন ও চাল, ডাল ইত্যাদি কিনে এই পাহাড়ি পথেই বাড়ি ফেরেন। শুকনো কাঠ বিক্রি টাই ওদের প্রধান জীবিকা। বুঝতে পারলাম খুবই কষ্ট করে ওনারা জীবন ধারণ করেন। আমার স্বীকার করতে লজ্জা নেই যে আমি খুব কৃপণ কিন্তু পাহাড়ে যখন কয়েকজন কিছু সাহায্য চাইলেন তখন খুব সহজেই আমার হাত থেকে 50 বা 100 টাকা বেরিয়ে গেল। আর সব থেকে ভালো লাগলো যখন ওনাদের ছেড়ে চলে আসছিলাম এমন ভাবে আমাদের বিদায় জানাচ্ছিলেন যেন আমরা ওনাদের খুব আপন।
আমি লেখক নই। যা মনে এলো লিখলাম যদি কারোর উপকারে লাগে এই উদ্দেশ্য নিয়েই। এই গ্রূপের একজন লিখেছিলেন যে বাংলায় লিখলে শুদ্ধ বানান লিখবেন। ওনাকে শ্রদ্ধা জানিয়েই বলি যে মোবাইলে ও হাতে লেখার মধ্যে তফাৎ আছে। মোবাইলের সফটওয়ারের সাহায্য সব সময় পাওয়া যায় না। সবাই ভালো থাকবেন।