...
কোণারক / কোণার্ক (Konark) - ওড়িশার মন্দির ভাস্কর্যের শ্রেষ্ঠ নিদর্শন নিঃসন্দেহে কোণারকের সূর্যমন্দির। ইউনেস্কোর বিশ্ব ঐতিহ্যের তালিকাতেও রয়েছে এর নাম। প্রায় একহাজার বছরের স্থাপত্যের ইতিহাসের শেষ পর্যায়ে অসাধারণ এই মন্দিরটি নির্মিত হয়। মন্দিরটি ঠিক কবে তৈরি হয়েছিল আর কেইবা ছিলেন এর স্রষ্টা তা নিয়ে ইতিহাসে, পুরাণে, গল্পকথায় নানান কাহিনী ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। পুরাণ মতে, কৃষ্ণপুত্র শাম্ব পিতার অভিশাপে কুষ্ঠ রোগাক্রান্ত হওয়ার পর চন্দ্রভাগা নদীর তীরে সূর্যের আরাধনা করেন। ১২ বছর সাধনা করার পর তাঁর রোগমুক্তি হয়। এরপর শাম্ব একটি সূর্যমন্দির নির্মাণ করেন। পুরী থেকে ৩৫ কিলোমিটার ও ভুবনেশ্বর থেকে ৬৫ কিলোমিটার দূরত্বে এই মন্দির। মোটামুটিভাবে, গঙ্গরাজবংশের রাজা নরসিংহদেব লাঙ্গুলীয় পুরন্দর কেশরী (১২৩৮-৬৪)-র আমলেই বর্তমান মন্দিরটির নির্মাণ হয় বলে অনেকেই মনে করেন। তবে এর প্রায় তিনশ বছর পরে মুঘল সম্রাট আকবরের সভাসদ আবুল-ফজলের আইন-ই-আকবরী গ্রন্থে কোণারকের সূর্যমন্দিরের যে উল্লেখ পাওয়া যায় সেই বর্ণনা পড়লে মনে হয় মন্দিরটি আরও প্রাচীন। খুব সম্ভব পুরনো মন্দিরের ওপর নরসিংহদেব নতুন মন্দিরটি তৈরি করান।
কলিঙ্গ স্থাপত্যের রীতি অনুযায়ী ওড়িশার মন্দিরগুলির চারটি অংশ - ভোগমন্ডপ, নাটমন্দির, জগমোহন ও দেউল। কোণারকের মন্দিরে এই নীতি পুরোপুরি মানা হয়নি। এখানে নাটমন্দির নেই। দেউল ও জগমোহন মিলিয়ে একটা ইউনিট হিসেবে তৈরি হয়েছিল। এখন আমরা কোণারকে যে মন্দিরটি দেখতে পাই সেটি মন্দিরের জগমোহন ও ভোগমন্ডপ অংশ। মূল মন্দির বা রেখ দেউল বহু শতাব্দী আগেই ধ্বংস হয়ে গেছে। ষোড়শ শতাব্দীর শেষপদে যবন আক্রমনে ক্ষতিগ্রস্ত হয় মূল মন্দিরটি। ক্রমশঃ কালের গহ্বরে তা বিলীন হয়ে যায়। ১৮২৫ সালে এস্টারলিং-এর বর্ণনায় রেখ দেউলের ভগ্নাবশেষের উল্লেখ পাওয়া যায়। ১৮৩৭ সালে জেমস ফার্গুসনের হাতে আঁকা ছবিতে রেখ দেউলের একটা অংশ দেখা যায় যার উচ্চতা ছিল ১৪০-১৫০ফুট। অর্থাৎ বর্তমান জগমোহনের চেয়ে উঁচু। কোণারক মন্দিরের প্রকৃত সংরক্ষণ শুরু হয় ১৯০১ সালে, লর্ড কার্জনের আমলে। পুরাতত্ত্ববিদ জন হান্টারের নেতৃত্বে রথের চাকা আর রথের ঘোড়া বালি সরিয়ে বের করে আনা হয়। জগমোহনের ভেতরটাও এই সময়েই বালি দিয়ে বুজিয়ে বন্ধ করে দেওয়া হয়।
রথারূঢ় সূর্য এই মন্দিরের উপাস্য দেবতা। মন্দিরটিও তাই যেন গড়া রথের আদলেই। উপাস্য ভাস্করমূর্তিটি মুসলিম আক্রমনের সময়েই তৎকালীন সম্রাট মুকুন্দদেব পুরীর মন্দিরে স্থানান্তরিত করেন। রথের দুটি অংশ - মূল অংশ অর্থাৎ যেখানে রথী বসেন, তা হল বড়দেউল। আর সারথির অংশটাই জগমোহন। সূর্যের এই রথের মোট ৭টি অশ্ব- সপ্তাহের সাতবার নির্দেশ করে। একেকদিকে ১২টি করে মোট চব্বিশটি চক্র। একএকটি চক্র এক এক পক্ষকাল। এই প্রকান্ড রথটি দৈর্ঘ্যে প্রায় ৬৬মি, প্রস্থে সবচেয়ে চওড়া অংশে ৩০.৫মি। জগমোহনের উচ্চতা ৩৯মি। মূল মন্দিরটি ছিল অন্ততঃ ৭৭মি উচ্চ।
জগমোহনের পূর্বদিকে যে সিঁড়ি আছে তার প্রত্যেকদিকে দুটি করে মোট চারটি চক্র আছে। দক্ষিণ দিকে ছিল চারটি রথাশ্ব। তার ভিতর দুটির মাথা আছে- দ্বিতীয়টির অনেকটাই এখনো অক্ষত আছে। চক্রগুলি মোটামুটি একই রকম, যদিও কারুকাজে তফাত আছে। রথচক্রগুলির ব্যাস ২.৭৪মি, এতে আটটি বড় স্পোক এবং আটটি ছোট স্পোক আছে। বড় স্পোকগুলির মাঝে মোট আটটি এবং চক্রের মাঝে একটি গোলাকার অংশ রয়েছে। তাতে স্ত্রী, পুরুষ, মিথুনচিত্র, দেবদেবীর মূর্তি খোদিত রয়েছে।
সবার নিচে উপান অংশে আছে হাতির সারি, শিকারের দৃশ্য, শোভাযাত্রার দৃশ্য। উপানের ওপরের অংশের ভিতর পাটায় জীবজন্তুর চিত্র ও নানান নকশা কাটা। তলজঙ্ঘাতে কিছু দূরে স্তম্ভের কুলুঙ্গিতে নানান দৃশ্য। দুটি স্তম্ভের মাঝে কখনও দুটি বা তিন-চারটি খাড়া পাথর। এই খাড়া পাথর গুলিতেও নানা ভাস্কর্যের নিদর্শন- মিথুনমূর্তি, অলসকন্যা, বিরাল অথবা নাগমূর্তি। তলজঙ্ঘার ওপরে বন্ধনের তিনটি অংশে নানান নকশা কাটা। উপর জঙ্ঘাতে, নিচের তলজঙ্ঘার স্তম্ভের ওপর আবার একটি করে পদ্মশীর্ষ অর্ধস্তম্ভ, তলজঙ্ঘার মূর্তিগুলির ঠিক ওপর ওপর এখানেও একসারি মূর্তি।
ওপর জঙ্ঘার ওপরে বড়ণ্ডি অংশও অক্ষত নেই। এর কিছুটা ঝোলা বারান্দার মত বাইরে বেরিয়ে আছে। তার গায়ে অপরূপ নকশাকাটা। জগমোহনের তিনদিকে তিনটি দরজা। পূর্বদিকে সিংহদ্বার। তিন দরজার পর বিস্তৃত চাতাল শেষে ধাপে ধাপে সিঁড়ি নেমে গেছে। চতুর্থদিক অর্থাৎ পশ্চিমদিকে বড় দেউলে যাবার দ্বার। জগমোহনটি পঞ্চরথ পীড় দেউল বা ভদ্রদেউল। বাড় অংশে পাঁচ ভাগ- পা-ভাগ, তল জঙ্ঘা, বন্ধন, উপর জঙ্ঘা এবং বরণ্ডি। পা-ভাগের ওপরে তল-জঙ্ঘায় দুই জোড়া করে অর্ধস্তম্ভের মাঝে মাঝে কুলুঙ্গি করা হয়েছে। তাতে অপেক্ষাকৃত বড় মূর্তিগুলি ছিল, যার অনেকগুলিই এখন আর নেই। অলসকন্যা, মিথুনমূর্তি এখনও কিছু কিছু আছে আর রয়েছে রাহাপাগের উল্লম্বনরত বিড়াল, কোনাপাগ ও অনুরথ পাগের খাঁজে গজবিড়াল ও রাক্ষস বিড়ালের মূর্তিগুলি। উপর জঙ্ঘার পরিকল্পনা তলজঙ্ঘার মতই। সবার ওপরে বড়ণ্ডিতেও নানান নকশা রয়েছে।
বড় দেউলের তিনদিকে সূর্যদেবের তিন মূর্তি - দক্ষিণে দন্ডায়মান পূষা, পশ্চিমে দন্ডায়মান সূর্যদেব ও উত্তরে অশ্বপৃষ্ঠে হরিদশ্ব। জগমোহনের পূর্বদ্বারের সামনে ছিল একটি ধ্বজস্তম্ভ। তার শীর্ষে ছিল সূর্যসারথি অরুণের মূর্তি। এই মূর্তিটি এখন পুরীর মন্দিরে আছে।
জগমোহনের তিনদ্বারের সামনে সোপানের কাছে ও মন্দিরের চত্ত্বরের ভিতরেই প্রকান্ড পাদপীঠের ওপর রয়েছে তিনজোড়া বিশালকায় মূর্তি। উত্তরদ্বারের দিকে দুটি হস্তি, দক্ষিণদ্বারে দুটি অশ্ব এবং পূর্বদ্বারে হস্তিদলনকারী শার্দুল মূর্তি।
পীর দেউলের গন্ডিতে তিন পোতাল। প্রথম পোতালের চাতালের চারদিকে চারটি করে মোট ষোলটি কন্যামূর্তি। আর রাহা অবস্থানে ঝুঁকে থাকা আটটি নৃত্যশীল ভৈরবমূর্তি। দ্বিতীয় পোতালেও ষোলটি কন্যামূর্তি। তৃতীয় পোতালে রয়েছে করালদ্রংস্ট্রা সিংহ। তার ওপরে ঘন্টা-শ্রী, আমলক প্রভৃতি। কন্যামূর্তিগুলি সম্ভবত নৃত্যরতা দেবদাসীর। কঙ্কন, কেয়ূর, শতনরী, কর্ণাভরণ মুকুট - অলঙ্কারে শোভিত দেবদাসীদের কেউবা পাখোয়াজ, মাদল, বাঁশি, খঞ্জনি, করতাল, ঝাঁঝর হাতে গীতবাদ্যে মত্ত, কেউবা দর্পনহাতে ব্যস্ত প্রসাধনে।
মূল মন্দিরের দক্ষিণ-পশ্চিমে সূর্যপত্নী মায়াদেবীর মন্দির।
মন্দিরে পাওয়া ভাস্কর্যের বেশকিছু নিদর্শন নিয়ে কাছেই কোণারক মিউজিয়াম। শুক্রবার ছাড়া রোজই খোলা থাকে।
কোণারক থেকে ৩ কিলোমিটার দূরত্বে চন্দ্রভাগা সংগম- চন্দ্রভাগা নদী মিলেছে বঙ্গোপসাগরে। এখানে সূর্যাস্ত অপরূপ।
কোণারক থেকে ৮ কিলোমিটার দূরে কুরুম গ্রামে আবিস্কৃত হয়েছে বৌদ্ধযুগের ধ্বংসাবশেষ। ভূমিস্পর্শ বুদ্ধমূর্তি এবং ১৭ মিটার লম্বা ইঁটের প্রাচীর দ্রষ্টব্য। হিউয়েন সাঙের ভ্রমণকাহিনিতেও এর উল্লেখ আছে।
কোণারক থেকে ৭ কিলোমিটার দূরত্বে কুশভদ্রী নদী ও সমুদ্রের মোহনায় দেবী রামচন্ডীর মন্দির। কোণারক থেকে ৪৫ কিলোমিটার দূরে কাকতাপুরে মঙ্গলাদেবী ও বনদুর্গার মন্দির। কাকতাপুর থেকে ১০ কিলোমিটার দূরে অস্তরঙ্গা লবণ তৈরি এবং মাছ ধরার কেন্দ্র, এখানে সূর্যাস্তও ভারি সুন্দর। কাকতাপুর থেকে কোণারকের পথে ১৪ কিলোমিটার দূরে চৌরাশি। এখানে রয়েছে নবম শতকের তান্ত্রিক দেবী বরাহমাতার মন্দির আর অমরেশ্বর লক্ষ্মীনারায়ণ মন্দির।
যাওয়াঃ- নিকটতম স্টেশন পুরী ও ভুবনেশ্বর। পুরী থেকে ৩৫ কিলোমিটার দূরত্বে এখানে আসার জন্য সরাসরি বাস আছে। পুরী বা ভুবনেশ্বর থেকে দিনে দিনেও কন্ডাকটেড ট্যুরে বা স্বব্যবস্থায় বাসে, গাড়িতে দেখে নেওয়া যায়। তবে দুয়েকদিন থাকলে মন্দির সহ অন্যান্য স্থানীয় জায়গাগুলো বেড়িয়ে নেওয়া সম্ভব।
থাকাঃ- সূর্যমন্দিরের কাছেই ওটিডিসি-র পান্থনিবাস ও ট্র্যাভেলার্স লজ। মিউজিয়ামের কাছে ওড়িশা ট্যুরিজমের যাত্রীনিবাস। এছাড়াও কয়েকটি হোটেল আছে আশেপাশে। কোনারকের এস টি ডি কোডঃ- ০৬৭৫৮।
উৎসবঃ- ফেব্রুয়ারিতে কোণারক ডান্স ফেস্টিভাল অনুষ্ঠিত হয়। প্রতিবছর ডিসেম্বর মাসের ১ থেকে ৫ তারিখ পর্যন্ত ভারতীয় শাস্ত্রীয় নৃত্যের উৎসব অনুষ্ঠিত হয়, যা কোণারক উৎসব নামে খ্যাত।
.
.
..
.
.
.
.
.
#puri #orissa #Odisha #sealda #Howrah #jagannath #temple #lingaraj #buddha #konark #sun
#পুরী #উড়িষ্যা#ওড়িশা #শিয়ালদা #হাওড়া #জগন্নাথ #লিঙ্গরাজ #বুদ্ধ #কোনারক #সূর্য #মন্দির.
কোণারক / কোণার্ক (Konark) - ওড়িশার মন্দির ভাস্কর্যের শ্রেষ্ঠ নিদর্শন নিঃসন্দেহে কোণারকের সূর্যমন্দির। ইউনেস্কোর বিশ্ব ঐতিহ্যের তালিকাতেও রয়েছে এর নাম। প্রায় একহাজার বছরের স্থাপত্যের ইতিহাসের শেষ পর্যায়ে অসাধারণ এই মন্দিরটি নির্মিত হয়। মন্দিরটি ঠিক কবে তৈরি হয়েছিল আর কেইবা ছিলেন এর স্রষ্টা তা নিয়ে ইতিহাসে, পুরাণে, গল্পকথায় নানান কাহিনী ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। পুরাণ মতে, কৃষ্ণপুত্র শাম্ব পিতার অভিশাপে কুষ্ঠ রোগাক্রান্ত হওয়ার পর চন্দ্রভাগা নদীর তীরে সূর্যের আরাধনা করেন। ১২ বছর সাধনা করার পর তাঁর রোগমুক্তি হয়। এরপর শাম্ব একটি সূর্যমন্দির নির্মাণ করেন। পুরী থেকে ৩৫ কিলোমিটার ও ভুবনেশ্বর থেকে ৬৫ কিলোমিটার দূরত্বে এই মন্দির। মোটামুটিভাবে, গঙ্গরাজবংশের রাজা নরসিংহদেব লাঙ্গুলীয় পুরন্দর কেশরী (১২৩৮-৬৪)-র আমলেই বর্তমান মন্দিরটির নির্মাণ হয় বলে অনেকেই মনে করেন। তবে এর প্রায় তিনশ বছর পরে মুঘল সম্রাট আকবরের সভাসদ আবুল-ফজলের আইন-ই-আকবরী গ্রন্থে কোণারকের সূর্যমন্দিরের যে উল্লেখ পাওয়া যায় সেই বর্ণনা পড়লে মনে হয় মন্দিরটি আরও প্রাচীন। খুব সম্ভব পুরনো মন্দিরের ওপর নরসিংহদেব নতুন মন্দিরটি তৈরি করান।
কলিঙ্গ স্থাপত্যের রীতি অনুযায়ী ওড়িশার মন্দিরগুলির চারটি অংশ - ভোগমন্ডপ, নাটমন্দির, জগমোহন ও দেউল। কোণারকের মন্দিরে এই নীতি পুরোপুরি মানা হয়নি। এখানে নাটমন্দির নেই। দেউল ও জগমোহন মিলিয়ে একটা ইউনিট হিসেবে তৈরি হয়েছিল। এখন আমরা কোণারকে যে মন্দিরটি দেখতে পাই সেটি মন্দিরের জগমোহন ও ভোগমন্ডপ অংশ। মূল মন্দির বা রেখ দেউল বহু শতাব্দী আগেই ধ্বংস হয়ে গেছে। ষোড়শ শতাব্দীর শেষপদে যবন আক্রমনে ক্ষতিগ্রস্ত হয় মূল মন্দিরটি। ক্রমশঃ কালের গহ্বরে তা বিলীন হয়ে যায়। ১৮২৫ সালে এস্টারলিং-এর বর্ণনায় রেখ দেউলের ভগ্নাবশেষের উল্লেখ পাওয়া যায়। ১৮৩৭ সালে জেমস ফার্গুসনের হাতে আঁকা ছবিতে রেখ দেউলের একটা অংশ দেখা যায় যার উচ্চতা ছিল ১৪০-১৫০ফুট। অর্থাৎ বর্তমান জগমোহনের চেয়ে উঁচু। কোণারক মন্দিরের প্রকৃত সংরক্ষণ শুরু হয় ১৯০১ সালে, লর্ড কার্জনের আমলে। পুরাতত্ত্ববিদ জন হান্টারের নেতৃত্বে রথের চাকা আর রথের ঘোড়া বালি সরিয়ে বের করে আনা হয়। জগমোহনের ভেতরটাও এই সময়েই বালি দিয়ে বুজিয়ে বন্ধ করে দেওয়া হয়।
রথারূঢ় সূর্য এই মন্দিরের উপাস্য দেবতা। মন্দিরটিও তাই যেন গড়া রথের আদলেই। উপাস্য ভাস্করমূর্তিটি মুসলিম আক্রমনের সময়েই তৎকালীন সম্রাট মুকুন্দদেব পুরীর মন্দিরে স্থানান্তরিত করেন। রথের দুটি অংশ - মূল অংশ অর্থাৎ যেখানে রথী বসেন, তা হল বড়দেউল। আর সারথির অংশটাই জগমোহন। সূর্যের এই রথের মোট ৭টি অশ্ব- সপ্তাহের সাতবার নির্দেশ করে। একেকদিকে ১২টি করে মোট চব্বিশটি চক্র। একএকটি চক্র এক এক পক্ষকাল। এই প্রকান্ড রথটি দৈর্ঘ্যে প্রায় ৬৬মি, প্রস্থে সবচেয়ে চওড়া অংশে ৩০.৫মি। জগমোহনের উচ্চতা ৩৯মি। মূল মন্দিরটি ছিল অন্ততঃ ৭৭মি উচ্চ।
জগমোহনের পূর্বদিকে যে সিঁড়ি আছে তার প্রত্যেকদিকে দুটি করে মোট চারটি চক্র আছে। দক্ষিণ দিকে ছিল চারটি রথাশ্ব। তার ভিতর দুটির মাথা আছে- দ্বিতীয়টির অনেকটাই এখনো অক্ষত আছে। চক্রগুলি মোটামুটি একই রকম, যদিও কারুকাজে তফাত আছে। রথচক্রগুলির ব্যাস ২.৭৪মি, এতে আটটি বড় স্পোক এবং আটটি ছোট স্পোক আছে। বড় স্পোকগুলির মাঝে মোট আটটি এবং চক্রের মাঝে একটি গোলাকার অংশ রয়েছে। তাতে স্ত্রী, পুরুষ, মিথুনচিত্র, দেবদেবীর মূর্তি খোদিত রয়েছে।
সবার নিচে উপান অংশে আছে হাতির সারি, শিকারের দৃশ্য, শোভাযাত্রার দৃশ্য। উপানের ওপরের অংশের ভিতর পাটায় জীবজন্তুর চিত্র ও নানান নকশা কাটা। তলজঙ্ঘাতে কিছু দূরে স্তম্ভের কুলুঙ্গিতে নানান দৃশ্য। দুটি স্তম্ভের মাঝে কখনও দুটি বা তিন-চারটি খাড়া পাথর। এই খাড়া পাথর গুলিতেও নানা ভাস্কর্যের নিদর্শন- মিথুনমূর্তি, অলসকন্যা, বিরাল অথবা নাগমূর্তি। তলজঙ্ঘার ওপরে বন্ধনের তিনটি অংশে নানান নকশা কাটা। উপর জঙ্ঘাতে, নিচের তলজঙ্ঘার স্তম্ভের ওপর আবার একটি করে পদ্মশীর্ষ অর্ধস্তম্ভ, তলজঙ্ঘার মূর্তিগুলির ঠিক ওপর ওপর এখানেও একসারি মূর্তি।
ওপর জঙ্ঘার ওপরে বড়ণ্ডি অংশও অক্ষত নেই। এর কিছুটা ঝোলা বারান্দার মত বাইরে বেরিয়ে আছে। তার গায়ে অপরূপ নকশাকাটা। জগমোহনের তিনদিকে তিনটি দরজা। পূর্বদিকে সিংহদ্বার। তিন দরজার পর বিস্তৃত চাতাল শেষে ধাপে ধাপে সিঁড়ি নেমে গেছে। চতুর্থদিক অর্থাৎ পশ্চিমদিকে বড় দেউলে যাবার দ্বার। জগমোহনটি পঞ্চরথ পীড় দেউল বা ভদ্রদেউল। বাড় অংশে পাঁচ ভাগ- পা-ভাগ, তল জঙ্ঘা, বন্ধন, উপর জঙ্ঘা এবং বরণ্ডি। পা-ভাগের ওপরে তল-জঙ্ঘায় দুই জোড়া করে অর্ধস্তম্ভের মাঝে মাঝে কুলুঙ্গি করা হয়েছে। তাতে অপেক্ষাকৃত বড় মূর্তিগুলি ছিল, যার অনেকগুলিই এখন আর নেই। অলসকন্যা, মিথুনমূর্তি এখনও কিছু কিছু আছে আর রয়েছে রাহাপাগের উল্লম্বনরত বিড়াল, কোনাপাগ ও অনুরথ পাগের খাঁজে গজবিড়াল ও রাক্ষস বিড়ালের মূর্তিগুলি। উপর জঙ্ঘার পরিকল্পনা তলজঙ্ঘার মতই। সবার ওপরে বড়ণ্ডিতেও নানান নকশা রয়েছে।
বড় দেউলের তিনদিকে সূর্যদেবের তিন মূর্তি - দক্ষিণে দন্ডায়মান পূষা, পশ্চিমে দন্ডায়মান সূর্যদেব ও উত্তরে অশ্বপৃষ্ঠে হরিদশ্ব। জগমোহনের পূর্বদ্বারের সামনে ছিল একটি ধ্বজস্তম্ভ। তার শীর্ষে ছিল সূর্যসারথি অরুণের মূর্তি। এই মূর্তিটি এখন পুরীর মন্দিরে আছে।
জগমোহনের তিনদ্বারের সামনে সোপানের কাছে ও মন্দিরের চত্ত্বরের ভিতরেই প্রকান্ড পাদপীঠের ওপর রয়েছে তিনজোড়া বিশালকায় মূর্তি। উত্তরদ্বারের দিকে দুটি হস্তি, দক্ষিণদ্বারে দুটি অশ্ব এবং পূর্বদ্বারে হস্তিদলনকারী শার্দুল মূর্তি।
পীর দেউলের গন্ডিতে তিন পোতাল। প্রথম পোতালের চাতালের চারদিকে চারটি করে মোট ষোলটি কন্যামূর্তি। আর রাহা অবস্থানে ঝুঁকে থাকা আটটি নৃত্যশীল ভৈরবমূর্তি। দ্বিতীয় পোতালেও ষোলটি কন্যামূর্তি। তৃতীয় পোতালে রয়েছে করালদ্রংস্ট্রা সিংহ। তার ওপরে ঘন্টা-শ্রী, আমলক প্রভৃতি। কন্যামূর্তিগুলি সম্ভবত নৃত্যরতা দেবদাসীর। কঙ্কন, কেয়ূর, শতনরী, কর্ণাভরণ মুকুট - অলঙ্কারে শোভিত দেবদাসীদের কেউবা পাখোয়াজ, মাদল, বাঁশি, খঞ্জনি, করতাল, ঝাঁঝর হাতে গীতবাদ্যে মত্ত, কেউবা দর্পনহাতে ব্যস্ত প্রসাধনে।
মূল মন্দিরের দক্ষিণ-পশ্চিমে সূর্যপত্নী মায়াদেবীর মন্দির।
মন্দিরে পাওয়া ভাস্কর্যের বেশকিছু নিদর্শন নিয়ে কাছেই কোণারক মিউজিয়াম। শুক্রবার ছাড়া রোজই খোলা থাকে।
কোণারক থেকে ৩ কিলোমিটার দূরত্বে চন্দ্রভাগা সংগম- চন্দ্রভাগা নদী মিলেছে বঙ্গোপসাগরে। এখানে সূর্যাস্ত অপরূপ।
কোণারক থেকে ৮ কিলোমিটার দূরে কুরুম গ্রামে আবিস্কৃত হয়েছে বৌদ্ধযুগের ধ্বংসাবশেষ। ভূমিস্পর্শ বুদ্ধমূর্তি এবং ১৭ মিটার লম্বা ইঁটের প্রাচীর দ্রষ্টব্য। হিউয়েন সাঙের ভ্রমণকাহিনিতেও এর উল্লেখ আছে।
কোণারক থেকে ৭ কিলোমিটার দূরত্বে কুশভদ্রী নদী ও সমুদ্রের মোহনায় দেবী রামচন্ডীর মন্দির। কোণারক থেকে ৪৫ কিলোমিটার দূরে কাকতাপুরে মঙ্গলাদেবী ও বনদুর্গার মন্দির। কাকতাপুর থেকে ১০ কিলোমিটার দূরে অস্তরঙ্গা লবণ তৈরি এবং মাছ ধরার কেন্দ্র, এখানে সূর্যাস্তও ভারি সুন্দর। কাকতাপুর থেকে কোণারকের পথে ১৪ কিলোমিটার দূরে চৌরাশি। এখানে রয়েছে নবম শতকের তান্ত্রিক দেবী বরাহমাতার মন্দির আর অমরেশ্বর লক্ষ্মীনারায়ণ মন্দির।
যাওয়াঃ- নিকটতম স্টেশন পুরী ও ভুবনেশ্বর। পুরী থেকে ৩৫ কিলোমিটার দূরত্বে এখানে আসার জন্য সরাসরি বাস আছে। পুরী বা ভুবনেশ্বর থেকে দিনে দিনেও কন্ডাকটেড ট্যুরে বা স্বব্যবস্থায় বাসে, গাড়িতে দেখে নেওয়া যায়। তবে দুয়েকদিন থাকলে মন্দির সহ অন্যান্য স্থানীয় জায়গাগুলো বেড়িয়ে নেওয়া সম্ভব।
থাকাঃ- সূর্যমন্দিরের কাছেই ওটিডিসি-র পান্থনিবাস ও ট্র্যাভেলার্স লজ। মিউজিয়ামের কাছে ওড়িশা ট্যুরিজমের যাত্রীনিবাস। এছাড়াও কয়েকটি হোটেল আছে আশেপাশে। কোনারকের এস টি ডি কোডঃ- ০৬৭৫৮।
উৎসবঃ- ফেব্রুয়ারিতে কোণারক ডান্স ফেস্টিভাল অনুষ্ঠিত হয়। প্রতিবছর ডিসেম্বর মাসের ১ থেকে ৫ তারিখ পর্যন্ত ভারতীয় শাস্ত্রীয় নৃত্যের উৎসব অনুষ্ঠিত হয়, যা কোণারক উৎসব নামে খ্যাত।
.
.
..
.
.
.
.
.
#puri #orissa #Odisha #sealda #Howrah #jagannath #temple #lingaraj #buddha #konark #sun
#পুরী #উড়িষ্যা#ওড়িশা #শিয়ালদা #হাওড়া #জগন্নাথ #লিঙ্গরাজ #বুদ্ধ #কোনারক #সূর্য #মন্দির.