ট্রেনে উঠে চা বিস্কুট খেয়ে চোখ টা একটু লেগেই গেলো। সে ঘুম ভাঙতেও বেশী সময় লাগলো না, যতই ভোরের ট্রেন হোক, যাচ্ছি তো নামখানা লোকালে। শুরু থেকে বলি দাঁড়ান।
শুক্রুবার বিকালে হঠাৎ মনে হলো, কোথাও যাওয়া হয়নি অনেকদিন। পকেটে মালকড়ি ও বেশী নেই। এমনকি, দিঘা যেতেও খরচা নয় নয় করে হাজার খানেক তো বটেই। শেষমেস ঠিক করলাম বকখালী। সেইসূত্রেই শানি বার সকাল 5টা 12 এর নামখানা লোকালে উঠে পড়লাম আমি আর আমার এক সঙ্গী। সেও আমার মতই ‘গরিব’ আর ভ্রমণপিপাসু।
সাউথ এর ট্রেন বলতে সাধারণত আমরা যা বুঝি, সেদিন কিন্তু অতটা ভীড় ছিল না। প্রায় শুয়ে শুয়েই গেলাম দুজনে। রাস্তায় পরবে লক্ষিকান্তপুর আর সেই কাকদ্বীপ। কাকদ্বীপ নামটা শুনলেই কতো কি মনে পড়ে, অধিকাংশই রাজনৈতিক। তাই সেকথা আর বলবো না। যা বলছিলাম, হ্যাঁ, যাত্রাপথে, ঘুগনী, পাউরুটি, বাদামচাক, ঝুড়িভাজার সাথে ছোট খাটো খাঁড়ি আর তাদের উপরে লোহার ব্রিজ ও পড়বে বেশ কয়েকটা। 8 টায় ঢোকার কথা থাকলেও ট্রেন 10 মিনিট লেট করেই ঢুকলো। স্টেশন থেকে নেমে হেঁটেই গেলাম খেয়া পর্যন্ত। ফেরার সময়, সময় এর টান ছিল বলে টোটো তে করে আসতে হয়েছিল। 1 টাকার খেয়ার টিকিট কেটে পৌঁছে গেলাম বাস স্ট্যান্ড। বাসে বকখালী যেতে সময় লাগলো 45 মিনিট এর মত। বকখালী পৌঁছে অবাক হবার প্রথম কারণ টি যদি হয় শান্ত সমুদ্র, দ্বিতীয় কারণটি অবশ্যই মোবাইল নেটওয়ার্ক এর অনুপস্থিতি। আছে বলতে এয়ারটেল আর ভোডাফোন এর 2G নেটওয়ার্ক, তাও মাঝে মধ্যে চলে যাচ্ছে। Jio তো নেই ই। রাস্তার ধারে কোনো wifi হটস্পট ও নেই।
সে যাইহোক, মোবাইলের নেটওয়ার্ক নেই বলে ছোট ছোট লাল কাঁকড়া দেরও কোনো নেটওয়ার্ক থাকবে না, তা কিন্তু নয়। একটু বাম বা ডান দিকে বীচ বরাবর হেঁটে গেলেই বালির উপুড় অসংখ্য লাল ফুটকি নজর পড়বে। কাছে গেলেই দেখছি, কোথাও তো কিচ্ছু নেই, শুধু কিছু উপড়ানো বলি। আর একটু দূরে তাকালে ঠিক দেখা যাচ্ছে লাল ফুটকি। অথচ আরো এগিয়ে কাছে গেলেই আবার কিচ্ছু নেই। লাল কাঁকড়ার তৈরী জীবন্ত মরীচিকা। এটাও বালির উপরেই কিন্তু।
বাসস্ট্যান্ড থেকে সমুদ্রের তটরেখা ওই মিনিট পাঁচ সাতেকের হাঁটা রাস্তা। ট্রেনে চা বিস্কুট ছাড়া আর কিছুই খাওয়া হয়নি, তাই এবার খান চারেক কচুরি, আলুর দম , একটা ডিম ভাজা আর এক কাপ চা দিয়ে প্রাতঃরাশ সেরে নিলাম। খেয়ে দেয়ে আবার সমুদ্রের পাশে। খুব রোদ ছিলো সেদিন। তবে খুব একটা অসুবিধা হবে না, 10 টাকা প্রতি ঘন্টা একটা প্লাস্টিকের চেয়ার আর ওই একই দামে একটা ছাতা ভাড়া নিলেই হলো। যারা নোনা জল গায়ে মাখছে তাদের জন্য প্রশাসনের তরফ থেকে একটা লক্ষনরেখা অবশ্য টেনে দেওয়া হয়েছে। বেশ সুদৃশ্য, মনে হবে হলুদ বালিশের মালা। অবশ্য, সেযুগে সীতা যখন লক্ষনরেখা পার হতে পেরেছে, এ যুগের সীতা দেরও পার হতে কোনো অসুবিধা নেই। শুনলাম আগের সপ্তাহেই নাকি একটি মেয়ে তলিয়ে গেছে। চোরাবালিতে নয়, অতি সাহসের গর্ভে। যাইহোক আমরা নোনা জল নয়, নোনা হাওয়া গায়ে মেখেই তৃপ্ত হলাম। রোদ চড়া বলে জলটিও বেশ রাজকীয় লাগছে। সুজ্জি মামা একটু ঝিমোতে শুরু করলে মনে হয়না এত ভালো লাগবে। আর হ্যাঁ, শুধু সামনে দেখলেই কিন্তু হবে না, পিছনেও দেখতে হবে। ক্যামেরায় একটু পাকা হাত হলে এই বালিয়াড়ির বিভাজিকা আর ফণীমনসার ছবি দেখিয়েই বন্ধুমহলে রাজস্থানের তুলনা টেনে দিতে পারেন। এবারে আর একটু পিছিয়ে, ওই বাসস্ট্যান্ড এর দিকে হাঁটা লাগলাম। বাসস্ট্যান্ডের পাশেই বনদপ্তরের গেট। টিকিট কেটে ভিতরে ঢুকে খুব একটা আফসোস করতে হলো না। এই গরমেও বেশ কয়েকটি নোনা জলের কুমির দেখতে পেলাম রোদ পোয়াচ্ছে। মাত্র একহাত দূরত্বে (মাঝে অবশ্যই লোহার জাল) এতো বড়ো কুমির, এতো কাছ থেকে আমি আগে কখনো দেখিনি। একটি হরিণ প্রজনন কেন্দ্র ঠিক তার পাশেই। ওহো, তারও আগে পড়বে সাজানো একটা মন্দির। অধিষ্ঠাত্রী দেবীর নাম নিশ্চই বলে দিতে হবে না, বনবিবি।
বনদপ্তরের গেট থেকে এবারে খাবার হোটেল, দাম আহামরি কিছু না। আমি খেলাম কাঁকড়ার ঝাল, ডাল, ভাত, বাঁধাকপির তরকারি আর চাটনি। মাত্র 100 টাকা। খেয়ে দেয়ে 10 মিনিট ওই হোটেলেই ফ্যান এর তলায় জিরিয়ে নিলাম। এরপর যাবো হেনরি আইল্যান্ড। এখানে একটা সমস্যা হয়েছিল। আমি শুনে এসেছিলাম , বকখালী থেকে হেনরি আইল্যান্ড টোটো যে যেতে 120 টাকা নেয়। ওই টোটো ই আবার ফেরত নিয়ে আসবে। মাঝে এক ঘন্টা দাঁড়াবেও ওখানে। কিন্তু সেদিন দরদাম শুরুই হলো 250 টাকা থেকে। শেষমেষ 30 মিনিট ধরে প্রায় খান পাঁচ ছয় টোটো র সাথে কথা বলে 140 টাকায় রফা হলো। গ্রাম্য একফালি রাস্তায় যেতে যেতে চোখে পরবে প্রচুর মাছের ভেড়ি। শুরুর দিকে বেশ কয়েকটা প্রাইভেট ভেড়ি দেখতে পেলেও, শেষের দিকে প্রায় সবগুলোই রাজ্য মৎস্য দফতরের। কাছা কাছি পৌঁছাতেই বেশ সাজসাজ রব। বিশাল কর্মযজ্ঞ শুরু হয়েছে। বেশ কয়েকটা রিসর্ট ও তাদের লাগোয়া রেস্টুরেন্ট ও চোখে পড়লো। তবে টোটো থেকে নেমেই কিন্তু চমক। শুরু হচ্ছে ম্যানগ্রোভ অরণ্য। চমক কিন্তু এটা নয়, ম্যানগ্রোভ এর পরেই রয়েছে অসংখ্য বাবলা ও ঝাউ গাছের সারি। আর সবচেয়ে ভালো লাগবে বাবলা গাছের ঝুঁকে পড়া ডাল দেখে। কাশ্মীর উপত্যক্যায় প্রবেশের মুখে ‘গ্রীন টানেল’ যেরকম, অনেকটা সেরকম। আর একটা ব্যাপার, ম্যানগ্রোভ, ঝাউ আর বাবলা একসঙ্গে এই তিন ধরণের গাছের এতো বিপুল সমারোহ ভূভারতে আর কোথায় পাওয়া যায় কিনা আমি অন্তত জানি না। উৎসাহী রা কেউ জানালে বাধিত থাকব। সে যাইহোক, ওই সবুজ ঢাকা রাস্তা দিয়ে ঢুকে পেয়ে গেলাম হেনরী আইল্যান্ড বীচ। জায়গাটার বর্ণনার আগে একটা কৌতূহল হলো। এটা ‘দ্বীপ’ কি করে হলো ঠিক বুঝলাম না। google map দেখেও বুঝলাম না, আর স্বচক্ষে দেখে তো বুঝলাম ই না। তবে একটা কথা না বলে পারছি না, এই ‘বীচ’ কিন্তু এখনো ‘কুমারী’। একটা দোকান বা স্টল, বা চেয়ার ভাড়া দেবার লোক, কেউ নেই। শুধু একজন পুলিশ, আর আমাদের মতন জন্য চারেক সহ ভ্রমনার্থী। বেশ মনে আছে, ফেরার সময় দেখলাম, আমরা দুজন আর ওই পুলিশ ছাড়া ওই পুরো বীচ এ আর কেউ নেই। একটা পুরানো লোহার ‘বুয়া’ রয়েছে দেখলাম, এক কালে মনে হয় এখানে জাহাজ নোঙর করতো। ওই জং ধরা ‘বুয়া’ একটা অন্য রকম অনুভূতি দেয়। আর দেরী না করে যাদের এখনো দেখা হয়নি, তারা বেড়িয়ে পড়ুন। খরচ খুব সামান্য, লেখার শেষে একটু ছোটো করে খরচের হিসাব টাও দিয়েছি। একদিনের তো ব্যাপার। এতো ফাঁকা বীচ কিন্তু খুব বেশী দিন আর থাকবে না। এমনিতেই বকখালী তে এখন ‘কাপল’ দের ই রমরমা। বাসস্ট্যান্ড থেকেই একটা লোক বারবার ফিসফিস করে বলে গেলো, “দাদা কাপল রুম হয়ে যাবে , কোনো অসুবিধা হবে না, এই তো পাশেই হোটেল।” লোকটির গলার ফিসফিসানিতে একটা নিষিদ্ধ জিনিসের আঁশটে গন্ধ পেলাম মনে হলো। যাইহোক, ঘন্টা দেড়েক থেকে আবার বকখালী তে ফিরলাম। কেনো জানিনা, বকখালী তে সূর্যাস্তের মুহূর্ত টা কোনো এক কারণে মনের মণিকোঠায় গেঁথে রাখার মতো হলো না। ‘গোল্ডেন আওয়ার’ এমনিতেই ক্ষণস্থায়ী, তার উপরে সেদিন একটু বেশি ই তাড়া ছিলো যেন। তবে ওই দুকখু সুদে আসলে মিটিয়ে তবেই ফিরেছি। বীচে বেড়াতে যাবো আর মাছ ভাজা না খেয়ে ফিরবো? হরেক রকম চিংড়ী, বেলে, আমোদী, কাঁকড়া, স্কুইড, আরো কত রকমের মাছ। তাদের নাম মনে রাখতে পারিনি বলে দুঃখিত, তবে একটা জিনিস নিশ্চিত, সব মাছ টাটকা। একদম নিজে বেছে বলে দিন কোনটা কতগুলো খাবেন, সঙ্গে সঙ্গে পেয়ে যাবেন। ওই বাছতে আর ভাজতে যেটুকু সময়। আমি একটা বেলে আর খান তিরিশেক ছোটো চিংড়ি ভাজা খেয়ে নিলাম। এবারে কিন্তু তাড়াহুড়ো করার সময়, নামখানা থেকে শিয়ালদহ যাবার ট্রেন ধরতে গেলে সন্ধ্যা 6 টার মধ্যেই বাস এ উঠতে হবে, নাহলে 7.35 এর লোকাল ট্রেন পাবেন না। আসলে বাসগুলো, স্টেশন থেকে আসার সময় একবারে লোক তুলে নেয়, জাস্ট নামাতে নামাতে যায়। কিন্তু স্টেশন ফেরার সময় লোক তুলতে তুলতে যায়, তাই সময় টা একটু বেশী লাগে আরকি। এবারে একটু কাজের কথা বলি, খরচের হিসাব।
ট্রেন ভাড়া: 25
খেয়া: 1
বাস ভাড়া :15
ফরেস্ট এন্ট্রি :10
হেনরী টোটো ভাড়া: 140
হেনরী তে এন্ট্রি ফি :5
টোটো তে যদি 4 হন এক সঙ্গে যান, তাহলে শিয়ালদা ফেরা অব্দি জনা প্রতি খরচা 50 + 82=132, খাওয়াদাওয়া মিলে আর 200 টাকা যোগ করলেও 350 পার করবে না। আর একটা ছোট তথ্য, খাবার জল হয় বয়ে নিয়ে যেতে হবে বা কিনে খেতে হবে। কিনে খেতে চাইলে, বার বার 1 লিটার এর বোতল না কিনে একটা 5 লিটার কিনে নেওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ হবে।
এটা গরিবের খরচের হিসাব। পয়সা আর সময় দুটোই আরো একটু বেশী খরচা করলে আশেপাশের আরো কিছু ঘুরে দেখতে পাবেন। সেটা নাহয় পরেরবারের জন্য তোলা থাক।
শুক্রুবার বিকালে হঠাৎ মনে হলো, কোথাও যাওয়া হয়নি অনেকদিন। পকেটে মালকড়ি ও বেশী নেই। এমনকি, দিঘা যেতেও খরচা নয় নয় করে হাজার খানেক তো বটেই। শেষমেস ঠিক করলাম বকখালী। সেইসূত্রেই শানি বার সকাল 5টা 12 এর নামখানা লোকালে উঠে পড়লাম আমি আর আমার এক সঙ্গী। সেও আমার মতই ‘গরিব’ আর ভ্রমণপিপাসু।
সাউথ এর ট্রেন বলতে সাধারণত আমরা যা বুঝি, সেদিন কিন্তু অতটা ভীড় ছিল না। প্রায় শুয়ে শুয়েই গেলাম দুজনে। রাস্তায় পরবে লক্ষিকান্তপুর আর সেই কাকদ্বীপ। কাকদ্বীপ নামটা শুনলেই কতো কি মনে পড়ে, অধিকাংশই রাজনৈতিক। তাই সেকথা আর বলবো না। যা বলছিলাম, হ্যাঁ, যাত্রাপথে, ঘুগনী, পাউরুটি, বাদামচাক, ঝুড়িভাজার সাথে ছোট খাটো খাঁড়ি আর তাদের উপরে লোহার ব্রিজ ও পড়বে বেশ কয়েকটা। 8 টায় ঢোকার কথা থাকলেও ট্রেন 10 মিনিট লেট করেই ঢুকলো। স্টেশন থেকে নেমে হেঁটেই গেলাম খেয়া পর্যন্ত। ফেরার সময়, সময় এর টান ছিল বলে টোটো তে করে আসতে হয়েছিল। 1 টাকার খেয়ার টিকিট কেটে পৌঁছে গেলাম বাস স্ট্যান্ড। বাসে বকখালী যেতে সময় লাগলো 45 মিনিট এর মত। বকখালী পৌঁছে অবাক হবার প্রথম কারণ টি যদি হয় শান্ত সমুদ্র, দ্বিতীয় কারণটি অবশ্যই মোবাইল নেটওয়ার্ক এর অনুপস্থিতি। আছে বলতে এয়ারটেল আর ভোডাফোন এর 2G নেটওয়ার্ক, তাও মাঝে মধ্যে চলে যাচ্ছে। Jio তো নেই ই। রাস্তার ধারে কোনো wifi হটস্পট ও নেই।
সে যাইহোক, মোবাইলের নেটওয়ার্ক নেই বলে ছোট ছোট লাল কাঁকড়া দেরও কোনো নেটওয়ার্ক থাকবে না, তা কিন্তু নয়। একটু বাম বা ডান দিকে বীচ বরাবর হেঁটে গেলেই বালির উপুড় অসংখ্য লাল ফুটকি নজর পড়বে। কাছে গেলেই দেখছি, কোথাও তো কিচ্ছু নেই, শুধু কিছু উপড়ানো বলি। আর একটু দূরে তাকালে ঠিক দেখা যাচ্ছে লাল ফুটকি। অথচ আরো এগিয়ে কাছে গেলেই আবার কিচ্ছু নেই। লাল কাঁকড়ার তৈরী জীবন্ত মরীচিকা। এটাও বালির উপরেই কিন্তু।
বাসস্ট্যান্ড থেকে সমুদ্রের তটরেখা ওই মিনিট পাঁচ সাতেকের হাঁটা রাস্তা। ট্রেনে চা বিস্কুট ছাড়া আর কিছুই খাওয়া হয়নি, তাই এবার খান চারেক কচুরি, আলুর দম , একটা ডিম ভাজা আর এক কাপ চা দিয়ে প্রাতঃরাশ সেরে নিলাম। খেয়ে দেয়ে আবার সমুদ্রের পাশে। খুব রোদ ছিলো সেদিন। তবে খুব একটা অসুবিধা হবে না, 10 টাকা প্রতি ঘন্টা একটা প্লাস্টিকের চেয়ার আর ওই একই দামে একটা ছাতা ভাড়া নিলেই হলো। যারা নোনা জল গায়ে মাখছে তাদের জন্য প্রশাসনের তরফ থেকে একটা লক্ষনরেখা অবশ্য টেনে দেওয়া হয়েছে। বেশ সুদৃশ্য, মনে হবে হলুদ বালিশের মালা। অবশ্য, সেযুগে সীতা যখন লক্ষনরেখা পার হতে পেরেছে, এ যুগের সীতা দেরও পার হতে কোনো অসুবিধা নেই। শুনলাম আগের সপ্তাহেই নাকি একটি মেয়ে তলিয়ে গেছে। চোরাবালিতে নয়, অতি সাহসের গর্ভে। যাইহোক আমরা নোনা জল নয়, নোনা হাওয়া গায়ে মেখেই তৃপ্ত হলাম। রোদ চড়া বলে জলটিও বেশ রাজকীয় লাগছে। সুজ্জি মামা একটু ঝিমোতে শুরু করলে মনে হয়না এত ভালো লাগবে। আর হ্যাঁ, শুধু সামনে দেখলেই কিন্তু হবে না, পিছনেও দেখতে হবে। ক্যামেরায় একটু পাকা হাত হলে এই বালিয়াড়ির বিভাজিকা আর ফণীমনসার ছবি দেখিয়েই বন্ধুমহলে রাজস্থানের তুলনা টেনে দিতে পারেন। এবারে আর একটু পিছিয়ে, ওই বাসস্ট্যান্ড এর দিকে হাঁটা লাগলাম। বাসস্ট্যান্ডের পাশেই বনদপ্তরের গেট। টিকিট কেটে ভিতরে ঢুকে খুব একটা আফসোস করতে হলো না। এই গরমেও বেশ কয়েকটি নোনা জলের কুমির দেখতে পেলাম রোদ পোয়াচ্ছে। মাত্র একহাত দূরত্বে (মাঝে অবশ্যই লোহার জাল) এতো বড়ো কুমির, এতো কাছ থেকে আমি আগে কখনো দেখিনি। একটি হরিণ প্রজনন কেন্দ্র ঠিক তার পাশেই। ওহো, তারও আগে পড়বে সাজানো একটা মন্দির। অধিষ্ঠাত্রী দেবীর নাম নিশ্চই বলে দিতে হবে না, বনবিবি।
বনদপ্তরের গেট থেকে এবারে খাবার হোটেল, দাম আহামরি কিছু না। আমি খেলাম কাঁকড়ার ঝাল, ডাল, ভাত, বাঁধাকপির তরকারি আর চাটনি। মাত্র 100 টাকা। খেয়ে দেয়ে 10 মিনিট ওই হোটেলেই ফ্যান এর তলায় জিরিয়ে নিলাম। এরপর যাবো হেনরি আইল্যান্ড। এখানে একটা সমস্যা হয়েছিল। আমি শুনে এসেছিলাম , বকখালী থেকে হেনরি আইল্যান্ড টোটো যে যেতে 120 টাকা নেয়। ওই টোটো ই আবার ফেরত নিয়ে আসবে। মাঝে এক ঘন্টা দাঁড়াবেও ওখানে। কিন্তু সেদিন দরদাম শুরুই হলো 250 টাকা থেকে। শেষমেষ 30 মিনিট ধরে প্রায় খান পাঁচ ছয় টোটো র সাথে কথা বলে 140 টাকায় রফা হলো। গ্রাম্য একফালি রাস্তায় যেতে যেতে চোখে পরবে প্রচুর মাছের ভেড়ি। শুরুর দিকে বেশ কয়েকটা প্রাইভেট ভেড়ি দেখতে পেলেও, শেষের দিকে প্রায় সবগুলোই রাজ্য মৎস্য দফতরের। কাছা কাছি পৌঁছাতেই বেশ সাজসাজ রব। বিশাল কর্মযজ্ঞ শুরু হয়েছে। বেশ কয়েকটা রিসর্ট ও তাদের লাগোয়া রেস্টুরেন্ট ও চোখে পড়লো। তবে টোটো থেকে নেমেই কিন্তু চমক। শুরু হচ্ছে ম্যানগ্রোভ অরণ্য। চমক কিন্তু এটা নয়, ম্যানগ্রোভ এর পরেই রয়েছে অসংখ্য বাবলা ও ঝাউ গাছের সারি। আর সবচেয়ে ভালো লাগবে বাবলা গাছের ঝুঁকে পড়া ডাল দেখে। কাশ্মীর উপত্যক্যায় প্রবেশের মুখে ‘গ্রীন টানেল’ যেরকম, অনেকটা সেরকম। আর একটা ব্যাপার, ম্যানগ্রোভ, ঝাউ আর বাবলা একসঙ্গে এই তিন ধরণের গাছের এতো বিপুল সমারোহ ভূভারতে আর কোথায় পাওয়া যায় কিনা আমি অন্তত জানি না। উৎসাহী রা কেউ জানালে বাধিত থাকব। সে যাইহোক, ওই সবুজ ঢাকা রাস্তা দিয়ে ঢুকে পেয়ে গেলাম হেনরী আইল্যান্ড বীচ। জায়গাটার বর্ণনার আগে একটা কৌতূহল হলো। এটা ‘দ্বীপ’ কি করে হলো ঠিক বুঝলাম না। google map দেখেও বুঝলাম না, আর স্বচক্ষে দেখে তো বুঝলাম ই না। তবে একটা কথা না বলে পারছি না, এই ‘বীচ’ কিন্তু এখনো ‘কুমারী’। একটা দোকান বা স্টল, বা চেয়ার ভাড়া দেবার লোক, কেউ নেই। শুধু একজন পুলিশ, আর আমাদের মতন জন্য চারেক সহ ভ্রমনার্থী। বেশ মনে আছে, ফেরার সময় দেখলাম, আমরা দুজন আর ওই পুলিশ ছাড়া ওই পুরো বীচ এ আর কেউ নেই। একটা পুরানো লোহার ‘বুয়া’ রয়েছে দেখলাম, এক কালে মনে হয় এখানে জাহাজ নোঙর করতো। ওই জং ধরা ‘বুয়া’ একটা অন্য রকম অনুভূতি দেয়। আর দেরী না করে যাদের এখনো দেখা হয়নি, তারা বেড়িয়ে পড়ুন। খরচ খুব সামান্য, লেখার শেষে একটু ছোটো করে খরচের হিসাব টাও দিয়েছি। একদিনের তো ব্যাপার। এতো ফাঁকা বীচ কিন্তু খুব বেশী দিন আর থাকবে না। এমনিতেই বকখালী তে এখন ‘কাপল’ দের ই রমরমা। বাসস্ট্যান্ড থেকেই একটা লোক বারবার ফিসফিস করে বলে গেলো, “দাদা কাপল রুম হয়ে যাবে , কোনো অসুবিধা হবে না, এই তো পাশেই হোটেল।” লোকটির গলার ফিসফিসানিতে একটা নিষিদ্ধ জিনিসের আঁশটে গন্ধ পেলাম মনে হলো। যাইহোক, ঘন্টা দেড়েক থেকে আবার বকখালী তে ফিরলাম। কেনো জানিনা, বকখালী তে সূর্যাস্তের মুহূর্ত টা কোনো এক কারণে মনের মণিকোঠায় গেঁথে রাখার মতো হলো না। ‘গোল্ডেন আওয়ার’ এমনিতেই ক্ষণস্থায়ী, তার উপরে সেদিন একটু বেশি ই তাড়া ছিলো যেন। তবে ওই দুকখু সুদে আসলে মিটিয়ে তবেই ফিরেছি। বীচে বেড়াতে যাবো আর মাছ ভাজা না খেয়ে ফিরবো? হরেক রকম চিংড়ী, বেলে, আমোদী, কাঁকড়া, স্কুইড, আরো কত রকমের মাছ। তাদের নাম মনে রাখতে পারিনি বলে দুঃখিত, তবে একটা জিনিস নিশ্চিত, সব মাছ টাটকা। একদম নিজে বেছে বলে দিন কোনটা কতগুলো খাবেন, সঙ্গে সঙ্গে পেয়ে যাবেন। ওই বাছতে আর ভাজতে যেটুকু সময়। আমি একটা বেলে আর খান তিরিশেক ছোটো চিংড়ি ভাজা খেয়ে নিলাম। এবারে কিন্তু তাড়াহুড়ো করার সময়, নামখানা থেকে শিয়ালদহ যাবার ট্রেন ধরতে গেলে সন্ধ্যা 6 টার মধ্যেই বাস এ উঠতে হবে, নাহলে 7.35 এর লোকাল ট্রেন পাবেন না। আসলে বাসগুলো, স্টেশন থেকে আসার সময় একবারে লোক তুলে নেয়, জাস্ট নামাতে নামাতে যায়। কিন্তু স্টেশন ফেরার সময় লোক তুলতে তুলতে যায়, তাই সময় টা একটু বেশী লাগে আরকি। এবারে একটু কাজের কথা বলি, খরচের হিসাব।
ট্রেন ভাড়া: 25
খেয়া: 1
বাস ভাড়া :15
ফরেস্ট এন্ট্রি :10
হেনরী টোটো ভাড়া: 140
হেনরী তে এন্ট্রি ফি :5
টোটো তে যদি 4 হন এক সঙ্গে যান, তাহলে শিয়ালদা ফেরা অব্দি জনা প্রতি খরচা 50 + 82=132, খাওয়াদাওয়া মিলে আর 200 টাকা যোগ করলেও 350 পার করবে না। আর একটা ছোট তথ্য, খাবার জল হয় বয়ে নিয়ে যেতে হবে বা কিনে খেতে হবে। কিনে খেতে চাইলে, বার বার 1 লিটার এর বোতল না কিনে একটা 5 লিটার কিনে নেওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ হবে।
এটা গরিবের খরচের হিসাব। পয়সা আর সময় দুটোই আরো একটু বেশী খরচা করলে আশেপাশের আরো কিছু ঘুরে দেখতে পাবেন। সেটা নাহয় পরেরবারের জন্য তোলা থাক।