এই গ্রুপটার একটা মজার দিক আমার চোখে পড়েছে। আমার বিশ্বাস আপনাদের সবারই চোখে পড়েছে। সেটা হল, কিছু পোস্ট। যেমন, মাত্র পাঁচ হাজার টাকায় ঘুরে আসুন দার্জিলিং। কিংবা, শিমলা, মানালি, আগ্রা, জয়পুর, হ্যান, ত্যান ঘুরে আসুন মাত্র দশ হাজার টাকায়। কেউ যদি বলে আগ্রা জয়পুর ঘুরে আসুন দশ হাজার টাকায়, তাহলে আরেকজন সেই একই জায়গা "ঘুরে আসুন নয় হাজার পাঁচশো টাকায়" বলে লোভনীয় পোস্ট দেয়। দুই দিন পর অন্য একজন বলে, আরে ধ্যাত! এত টাকা লাগে নাকি এইসব জায়গা ঘুরতে? ঘুরে আসুন আগ্রা, জয়পুর, ফতেপুর, সিঙ্গাপুর, মাত্র সাত হাজার টাকায়। আমার কাছে মনে হয় নিলাম হচ্ছে। কে কত কম টাকায় কোনো জায়গা ঘুরে আসতে পারবে সেটার নিলাম। কিন্তু এইসব পোস্ট যদি আপনি ফলো করেন, আপনি কি ঠিক একই খরচে সেসব জায়গায় আদৌ যেতে পারবেন? কিংবা গেলেও কি আপনার ভাল লাগবে? আপনি তো বেড়াতে যাবেন, যুদ্ধ করতে তো না, তাই না? তাছাড়া যিনি পোস্টটা দিচ্ছেন, তাঁর রুচির সাথে আপনার রুচি মিলবে, এমনটা তো নাও হতে পারে। তাই আমার স্বল্প অভিজ্ঞতা থেকে আগ্রা, জয়পুর সহ যেকোন জায়গায় বেড়ানোর জন্য আমি কিছু সাধারণ টিপস্‌ দিতে চাই। হয়তো সেগুলো আপনাদের কাজে লাগতে পারে।

১। যে কোন জায়গা যাবার আগে TripAdvisor.com এর সাহায্য নিন। এই সাইটের ফোরামগুলো অ-সা-ধা-র-ণ! আগ্রা, কিংবা শিমলা, কিংবা পৃথিবীর যেকোন জায়গার ট্যুরিস্ট স্পটের জন্য এত তথ্য সমৃদ্ধ ফোরাম আর কোথাও পাবেন না। এখানে আপনি আপনার যাবতীয় প্রশ্নের উত্তর পেয়ে যাবেন, না পেলে সেখানে প্রশ্ন করতে পারেন। আপনার প্রশ্নের উত্তর কেউ না কেউ দেবেই।

২। যে কোন জায়গায় বেড়ানোর অন্তত বেশ কিছুদিন আগে থেকে প্রস্তুতি নিন। প্রস্তুতি মোট তিনটি। আর্থিক, মানসিক এবং শারীরিক। টাকা জমান। যাতে অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতিতে উদ্ধার পেতে পারেন। যে যত কম টাকার প্যাকেজের লোভই দেখাক না কেন, অবশ্যই বেশ কিছু এক্সট্রা টাকা হাতে রাখবেন। যদি হাঁটার অভ্যাস না থাকে, হাঁটা শুরু করুন। হাঁটা ছাড়া পৃথিবীর কোথাও ঘুরে মজা পাবেন না। মানসিক প্রস্তুতিতে সাহায্য করবে লেখাপড়া। সেটা নিয়ে পরে বলছি।

৩। যাঁরা বাসে ইন্ডিয়া ঘুরতে যেতে চান এবং ভিসাতে শুধুমাত্র হরিদাসপুর বর্ডার সিলেক্ট করবেন তাঁদের বলছি। ভিসা অ্যাপ্লিকেশনে কিন্তু By Air / Haridaspur অপশন টা থাকে। শুধু হারিদাসপুর সিলেক্ট না করে যদি বাই এয়ার / হরিদাসপুর সিলেক্ট করেন তাতে কিন্তু আপনার বাড়তি খরচ হবে না। বরং এই সিলেকশনের কারণে একটা এন্ট্রি / এক্সিট অপশন আপনি বাড়তি পাচ্ছেন। কোন একটা এমারজেন্সি কেস-এ সেটা আপনার কাজে লাগতে পারে। ধরুন আপনি বাই রোডে কোলকাতা হয়ে ট্রেনে বেড়াতে গেছেন দিল্লি। কোন কারণে আপনার হঠাৎ ঢাকায় ফেরত আসার দরকার হয়ে পড়ল। এখন দিল্লি থেকে ঢাকায় সরাসরি আসার কোন বাস নেই। কোলকাতায় আসতে গেলেও আপনাকে হয় ট্রেন কিংবা প্লেন ধরেই আসতে হবে। তারপর সেখান থেকে চাইলেও আপনি প্লেনে ঢাকায় আসতে পারবেন না, কারণ আপনার ভিসা সেটা পারমিট করবে না। অথচ আপনার যদি By Air / Haridaspur ভিসা থাকত, তাহলে কিন্তু দিল্লি থেকে সারাসরি ঢাকায় চলে আসতে পারতেন। কিংবা দিল্লি-কোলকাতা-ঢাকা এভাবেও এয়ারে চলে আসতে পারতেন। তাই বায়বীয় রাস্তায় চলুন কিংবা না চলুন, ভিসা নেবার সময় By Air / Haridaspur সিলেক্ট করে রাখাটা অনেক বেশি কনভেনিয়েন্ট।

৪। ইউটিউবে যেখানে বেড়াতে যেতে চান, সেখানকার উপর কোন ডকুমেন্টারি থাকলে দেখে ফেলুন। আমি শিওর দার্জিলিং, কালিম্পং, আগ্রা, জয়পুর, উদয়পুর, যোধপুর, জয়সলমীর, ফতেহ্‌-পুর-সিক্রি, আজমের, কোলকাতা, দিল্লি, শিমলা, কুলু, মানালি, ধর্মশালা, মুসোরি, জম্মু, শ্রীনগর, পেহেলগাম, হৃষিকেশ, লছমনঝুলা, হরিদ্বার সহ এমন কোন বেড়াবার জায়গা নেই, যে জায়গার উপর লিটারেলি শত শত ভিডিও আপনি ইউটিউবে পাবেন না। কিন্তু তাই বলে কি আপনি সব ভিডিও দেখবেন? না। আপনি বেছে বেছে দেখবেন একেবারে রিসেন্ট টাইমের ভিডিওগুলো যাতে এখন সেখানে কি হচ্ছে সেটা জানা যায়। আর ডকুমেন্টারি টাইপ ভিডিওগুলো যেগুলোতে আপনি জায়গাটার উপর ওভারঅল একটা আইডিয়া পাবেন।

৫। আগ্রা বেড়ানোর জন্য সবচেয়ে বেস্ট হচ্ছে কোলকাতা থেকে ট্রেনে চলে যাওয়া। আমি একটা লিঙ্ক দিচ্ছি, সেখান থেকে আইডিয়া পাবেন কোন ট্রেন কি বারে কোলকাতা থেকে আগ্রা যায়। http://www.indianrail.gov.in/. এখান থেকে Reserved Train Between Important Stations মেনুতে যান। গিয়ে Source Station এ সিলেক্ট করুন 'Kolkata - HWH' এবং Destination Station এ সিলেক্ট করুন 'Agra Fort - AF'. Class সিলেক্ট করুন 'ALL CLASS'. তারপর কোন একটা তারিখ দিয়ে 'Get Details' বাটন চেপে দেখে নিন কোন ট্রেন আপনি সিলেক্ট করতে পারবেন। এই পুরো ব্যাপারটা, যেমন কোন ক্লাসের মানে কি, ভাড়া কিভাবে দেখতে হয় সেগুলো একটু গুগোল করলেই পেয়ে যাবেন। না হয় পরে আরেকটা লেখায় ডিটেইল গুলো জানাব।

৬। যেকোন জায়গায় হোটেল নেবার জন্য বেস্ট অপশন হচ্ছে নিজে গিয়ে পছন্দ এবং দরদাম করে হোটেল বেছে নেয়া। কিন্তু পরিবার নিয়ে বেড়াতে গেলে সেটা অনেক সময়ই সম্ভব হয় না। এজন্য আপনাকে সাহায্য করতে পারে কিছু হোটেল বুকিং সাইট। আমার সবচেয়ে পছন্দের সাইট হচ্ছে Booking.com. এই সাইটের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, এখানের প্রায় সব হোটেলেই আপনি কোন অ্যাডভান্স পেমেন্ট না করে অনলাইনে রুম বুকিং দিতে পারেন। তারপর হোটেলে পৌঁছে ক্যাশ টাকায় কিংবা ক্রেডিট কার্ডের মাধ্যমে টাকা পরিশোধ করতে পারেন। এজন্য অবশ্য আপনার নিজের একটা ভ্যালিড ক্রেডিট কার্ড থাকতে হবে। যেকোন ব্যাংক থেকে একটা ডুয়াল কারেন্সি ক্রেডিট কার্ড করিয়ে নেয়া আজকাল তেমন কোন কঠিন কাজ নয়। তবে একটা খুব গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। এই সাইটের একটা রেপুটেশন আছে। বাঙালী হিসেবে নিজেদের মর্যাদা ধরে রাখার বিষয়টাও আমাদের দেখতে হবে। আপনি ইচ্ছামত হোটেল বুকিং করলেন, তারপর সেখানে গেলেন না, হোটেলকেও জানালেন না, কিংবা ইচ্ছেমত ক্যান্সেল করে দিলেন, এইসব করলে হয়ত এই অপশনটা আমরা হারাব। তাই বিবেচনাবোধের পরিচয় দিয়ে সাইটটি ব্যবহার করুন। এর বাইরে আরেকটা ভাল সাইট হল Hotels.com. এখানে পেমেন্ট ক্রেডিট কার্ডের মাধ্যমে অগ্রিম দিয়েই হোটেল বুক করতে হয়। আরেকটা সাইট AirBnb.com বেশ জনপ্রিয় হচ্ছে ইদানীং। এখানে নিজেদের একটা রুম, কিংবা পুরো বাড়িটাই অনেকে ভাড়া দেয় থাকার জন্য। ন্যাচারালি, এতে আপনি কমফোর্ট পেলেও হোটেল সিকিউরিটি টা হয়ত পাবেন না।

৭। পড়ুন। পড়ার কোন বিকল্প নেই। যে জায়গায় যাবেন তার ইতিহাস জানুন। দেখবেন, যখন ঘুরবেন তখন অনেক বেশি কানেক্ট করতে পারবেন জায়গাটার সঙ্গে। তাজমহল আপনার সাথে কথা বলবে যদি আপনি জানেন, কিভাবে তাজমহলের ভাষায় কথা বলতে হয়। আপনার জ্ঞান, আপনার লেখাপড়া আপনাকে তাজের সাথে কথা বলিয়ে দেবে। আপনার ভ্রমণের আনন্দ বাড়িয়ে দেবে অনেকগুণ।

৮। আগ্রা ঘুরতে দু'দিনের বেশি লাগার কথা না। তবে আপনি যদি অনেক বেশি রোমান্টিক হয়ে থাকেন, কাটিয়ে দিতে পারেন আরো একটি দিন। তাজমহল ছাড়াও, আগ্রা ফোর্ট, ফতেহ্‌পুর সিক্রি আর আকবরের সমাধিটা দেখতে ভুলবেন না। শুধু Things to see in Agra দিয়ে একবার গুগোল করেই দেখুন না। আপনার চোখ ছানাবড়া হয়ে যাবে।

৯। আগ্রা থেকে জয়পুর যাবার বেস্ট অপশন হল রেন্ট-এ-কার। যদি খরচ কমাতে যান, স্টেশনে চলে যান। টিকেট কেটে ফেলুন জয়পুরের। পাঁচ ঘন্টার মত লাগবে জয়পুরে পৌঁছাতে। বলে রাখা ভাল, আগ্রায় কিন্তু দু'টো রেল স্টেশন। একটা হল আগ্রা ফোর্ট, আরেকটা আগ্রা ক্যান্ট।

১০। আমি হাঁপিয়ে উঠেছি লিখতে লিখতে। জয়পুরে যে কত কিছু আছে, আমি বলে কিভাবে শেষ করব? শুধু এতটুকু বলি, আম্বের ফোর্ট, হাওয়া মহল, নাহারগড় ফোর্ট আর জয়গড় ফোর্ট টা মিস করবেন না। সোনার কেল্লার মন্দার বোসের কথা মনে আছে? যোধপুর দেখে সে বলেছিল, এরা তো দেখি যেখানেই পেরেছে একটা করে কেল্লা গুঁজে রেখেছে। কথাটা যে কতটা সত্যি, রাজস্থানের যেকোন শহরে গেলেই বুঝবেন। আর সোনার কেল্লা? সেটা দেখতে গেলে যেতে হবে জয়সলমীর। সে আরেক গপ্পো। সেটা হবে অন্য কোনদিন।