ভ্রমন কাহিনী । উত্তরাখণ্ডের হারিদ্বার – কানকচৌরি – কার্ত্তিকস্বামী মান্দির – সারি গ্রাম – দেউরিয়াতাল – চোপতা – তুঙ্গনাথ মান্দির – আউলি – গরসন বুগিয়াল – দেবপ্রায়াগ – ঋষিকেশ ভ্রমন ।
===============================================
আমরা কলকাতা থেকে হারিদ্বারে পৌঁছে গঙ্গায় প্রদীপ ভাসিয়ে আমাদের যাত্রা শুরু করেছিলাম।এখান থেকে আমাদের গন্তব্য কনকচোউরি । প্রায় ২০৫ কিমি পথ পাড়ি দিতে হবে। সেখান থেকে কার্তিকস্বামী মন্দির প্রায় তিন কিমি পায়ে হেঁটে উঠতে হয়।

হরিদ্বার থেকে লম্বা পথ পাড়ি দিয়ে কনকচৌরি এসে রাত্রিটা কোনমতে বিশ্রাম নিয়ে পরদিন ভোর তিনটের সময় রওনা দিলাম কার্তিকস্বামী মন্দিরের উদ্দেশ্যে পায়ে হেঁটে হাতে টর্চ নিয়ে । এ এক অসাধারন অনুভূতি । প্রথম প্রথম অন্ধকারে চড়াই পেরোতে বেশ কষ্ট হচ্ছিলো , কিন্তু দিনের আলো ফুটতেই চারিদিকের অপরূপ শোভায় মন প্রান ভরে গিয়ে নিমেষে সব ক্লান্তি দূর হয়ে গেলো ।তবে পথটা আমাদের মতো সাধারন মানুষের কাছে বেশ কঠিন । পথের মাঝে অনেকটা জঙ্গলাঘেরা পাহাড়ি পথ পেরোতে হয় । প্রচুর পাখির কলতান আর রডোডেনড্রনের শোভায় মোহিত হলাম।মন্দিরটি পাহাড়ের চূড়ায় অবস্থিত এবং সেখান থেকে হাতের সামনে প্রায় ১৮০ ডিগ্রী সীমানা জুড়ে তুষারশৃঙ্গ আমাদের মনপ্রান জুড়িয়ে দিলো ।আমরা সাত্তিই খুব উপভোগ করলাম ।পরবর্তী গন্ত্যব্য সারি গ্রাম তারপর সেখান থেকে পায়ে হেঁটে দেউরিয়াতাল ।

কার্তিকস্বামী মন্দির থেকে কনকচৌরি ফেরার পথে যে অংশগুলো রাতের অন্ধকারে পার করেছিলাম তা দিনের আলোয় নতুনভাবে আবিষ্কার করলাম ।পাহাড়ি পথে সবথেকে আরামের বিষয়টা হোলো উতরাই ।উঠতে যতটাই কষ্ট হয় , নামতে ততোধিক আনন্দ ।আর সবথেকে ভালোলাগে যখন নামার সময় কোনো ওপরের দিকে উঠতে থাকা ব্যাক্তি হাঁপাতে হাঁপাতে জিগ্গেস করেন ..." দাদা/ ভাই আর কতো দূর "। তখন মনের ভিতর একরাশ আনন্দ নিয়ে মুখে সহানুভূতির সাথে বলি " আর বেশী নয় , ধীরে ধীরে চলুন , ঠিক পৌঁছে যাবেন " ।যাইহোক , কনকচৌরি ফিরে এসে বিশ্রাম নিয়ে স্নান আহারাদি সারলাম । এরপর রওনা হলাম সারি গ্রামের উদ্দেশ্যে সেখানে আমরা রাত্রিযাপন করবো কনকচৌরি থেকে সারি গ্রামের দূরত্ব প্রায় ৬০ কিলোমিটার । সমগ্র পথের অপরূপ শোভা সকালের ক্লান্তি দূর করে দিলো ।সারি গ্রামে আমাদের কোনো হোটেল ঠিক করা ছিলোনা.. আমাদের সহযাত্রী , আমাদের প্রিয় দাদা Avijit Mukhopadhyay যেতে যেতে তার মোবাইল থেকে একটি হোটেল বুক করলেন যার নাম Cafe Buransh । গাড়োয়ালি ভাষায় বুরহানস শব্দের অর্থ রডোডেনড্রন ।হোটেলটি সারি গ্রাম থেকে দেউরিয়াতালের পথে অবস্থিত। মালিক কেরালার বাসিন্দা । তিনি একবার এখানে ঘুরতে এসে জায়গা কিনে এই হোমস্টেটি বানিয়েছিলেন। ছোট্ট এবং পরিপাটি করে সাজানো । সবথেকে ভালোলাগার বিষয় ওখানকার কর্মচারীদের আন্তরিকতা ।আমরা পৌঁছে ছবির মতো সুন্দর এই গ্রামটি উপভোগ করলাম । পাহাড়ের কোলে ধাপে ধাপে চাষ করা হয়েছে , পাকা গমের শীষে পাখিদের খুনসুটি ।আমাদের ঘরের পাশদিয়েই দেউরিয়াতালের রাস্তা । সারাদিন টুং টাং শব্দে মালবাহী ঘোড়া হেঁটে চলেছে ।ছেলের আব্দারে তাকে ঘোড়ায় চড়ানো হোলো ।আজ এখানে পূর্নদিন বিশ্রাম নিয়ে কাল পাড়ি দেবো দেউরিয়াতালের উদ্দেশ্যে ।

সারি গ্রামের কাফে বুরহানসে মধ্যাহ্নভোজন সেরে একটু বিশ্রাম নিয়ে রুকস্যাক পিঠে আর লাঠি হাতে বেরিয়ে পরলাম দেউরিয়াতালের উদ্দেশ্যে।সারি গ্রাম থেকে দেউরিয়াতালের পায়ে হাঁটা পথের দূরত্ব প্রায় ২.৪ কিলোমিটার । পথটা বেশ খাড়া ।আমরা ধীরে ধীরে পথের দুপাশের শোভা উপভোগ করতে করতে পৌঁছে গেলাম আমাদের গন্ত্যব্য দেউরিয়াতালে. পাহাড়ের ওপর এটি খুব সুন্দর একটি হ্রদ । এখান থেকে পাহাড়ের বরফে ঢাকা শৃঙ্গগুলো কুব কাছ থেকে দেখা যায় ।আমরা দেউরিয়াতালের সূর্যাস্ত উপভোগ করে আমাদের টেন্টে ফিরে গেলাম । টেন্টে থাকার ব্যাবস্থা বেশ ভালো । আমরা পরদিন সকালে আবার দেউরিয়াতালের সৌন্দর্য চেটেপুটে উপভোগ করলাম । দেউরিয়াতালের টেন্টে প্রাতঃরাশ সেরে বেরিয়ে পারলাম । প্রথমে সারি গ্রাম তারপর সেখান থেকে মালপত্র নিয়ে গাড়ি করে চোপ্তা। তারপর সেখান থেকে তুঙ্গনাথ-চন্দ্রশিলা।দেউরিয়াতালের টেন্টের ছেলেগুলোর ব্যাবহার ও আন্তরিকতা সারাজীবনে ভোলার নয় ।

দেউরিয়াতাল থেকে কাফে বুরহানসে ফিরে এসে একটু চাপাণের বিরতি পাওয়া গেলো।আমরা একটু জিরিয়ে নিয়ে মালপত্র সমেত আবার গাড়িতে চেপে বসলাম ।এবারের গন্ত্যব্য চোপ্তা ।সারি গ্রাম থেকে চোপ্তার দূরত্ব প্রায় ৭৪ কিলোমিটার ।গাড়ি যত এগোতে লাগলো ততই প্রকৃতির রূপ পাল্টাতে শুরু করলো ।
রাস্তা খুবই মশৃন কিন্তু অসংখ্য বাঁক ও বেশ খাড়া ।তাপমাত্রাও কমাতে লাগলো ধীরে ধীরে।এই পথেই প্রথম দেখা পেলাম গোলাপী রডোডেনড্রনের ।চোপ্তা পৌঁছে মনটা খারাপ হয়ে গেলো কারন আকাশের মুখ ভার আর প্রচুর মেঘের আনাগোনা চলছে ।হোটেলে পৌঁছে ম্যানেজারের সাথে কথা বলে জানলাম যে আজ বৃষ্টি হবার প্রচুর সম্ভাবনা সাথে উপরি পাওনা হিসাবে তুষারপাতও জুটে যেতে পারে অ।মনটা তুষারপাত উপভোগের আশায় নেচে উঠলো । কিন্তু আবার ভাবলাম যদি তুষারপাতে তুঙ্গনাথের রাস্তা বন্ধ হয়ে যায় ?বিকেলের দিকে ঝেপে বৃষ্টি নামলো আর আমি মনখারাপ করে ঘরে চলে গেলাম।হঠাৎ করে শুনতে পেলাম লোকজন চেঁচামেচি করছে বরফ! বরফ! দৌড়ে বাইরে এসে দেখি অগুনিত ঝুরঝুরে সাদা বরফের কুচি নেমে আসছে আকাশ থেকে।আমরা ভীষন উপভোগ করলাম চোপ্তার তুষারপাত। প্রায় রাত আটটা পর্যন্ত বেশ কয়েক কিস্তিতে তুষারপাত হোলো ।
আমরা একরাশ চিন্তা নিয়ে একটু তাড়াতাড়ি বিছানায় গেলাম কারন পরদিন আবার ভোর তিনটেয় শুরু হবে আমাদের তুঙ্গনাথ অভিযান।

চোপ্তায় ভোর তিনটের সময় ঘুম থেকে উঠে মনটা ভালো হয়ে গেলো ।আকাশ খুব পরিষ্কার , প্রচুর তারা আর একটা ঘোলা চাঁদ দেখা যাচ্ছে ।আমাদের এগারো সদস্যের দল তৈরী হয়ে রওনা দিলো তুঙ্গনাথ - চন্দ্রশীলার উদ্দেশ্যে ।আগের সন্ধায় তুষারপাতের ঠেলায় তুঙ্গনাথের রাস্তা ও তার চারিদিকে প্রচুর বরফ পরে আছে ।চোপ্তা থেকে তুঙ্গনাথের দূরত্ব প্রায় ৩.৫ কিলোমিটার এবং তুঙ্গনাথ থেকে চন্দ্রশীলার দূরত্ব প্রায় ১.৫ কিলোমিটার ।হাল্কা চাঁদের আলোয় তুঙ্গনাথের পথ ও তার পার্শবর্তী এলাকায় এক মায়াবী রূপ দেখতে পাওয়া গেলো ।তুঙ্গনাথে পৌঁছাবার পর বুঝতে পারলাম যে চন্দ্রশীলায় যাওয়া আমাদের মতো সাধারন মানুষের পক্ষে প্রায় অসম্ভব । আমরা দূর থেকে লক্ষ্য করলাম যে তিনজন অনেক চেস্টা করেও চন্দ্রশীলার মাঝপথ থেকে ফিরে আসছেন ।কি আর করা যাবে ! আমরা চন্দ্রশীলার আশা ত্যাগ করে তুঙ্গনাথ মন্দির ও তার আশেপাশের এলাকার সৌন্দর্য প্রানভরে উপভোগ করলাম ।প্রায় ঘন্টা দুয়েক ওখানে ছিলাম । ঠান্ডায় হাতপা প্রায় অবশ হবার জোগাড় । মন্দিরের ঠিক নিচেই একটি চায়ের দোকান খোলা ছিলো।সকালে চা পান করে একটু আরাম পেলাম ।এবার নামার পালা । বেলা বাড়ার সাথে সাথে তুঙ্গনাথ মন্দিরের দিকে ওঠার সংখ্যাটা বাড়তে লাগলো আর তার সাথে মানুষের পায়ের চাপে রাস্তার বারাফও গালতে শুরু করলো ।বরফঢাকা রাস্তায় ওঠার থেকে নামাটা বেশি কষ্টকর ও ঝুকিপূর্ন ।আমাদের মধ্যে অনেকেই আছাড় , পিছল ইত্যাদি খেলেন ।আমরা ভীষন ভীষন উপভোগ করলাম ।এবারের মতো ভ্রমন প্রায় শেষের পথে বাকি আছে শুধু আউলি ও সেখান থেকে গার্সান বুগিয়াল অবধি একটি ছোট্ট ট্রেক ।চোপ্তায় ফিরে এসে প্রাতঃরাশ সেরে বেরিয়ে পারলাম আউলির উদ্দেশ্যে ।

চোপ্তা থেকে আউলির দূরত্ব প্রায় ১৪৬ কিলোমিটার ।আমরা চোপ্তায় ভারী জলখাবার খেয়ে বেলা বারোটা নাগাদ আউলির উদ্দেশ্যে রানা হলাম ।গাড়োয়ালের প্রায় সব রাস্তাই ভীষন মশৃন ও সুন্দর আর রাস্তার আশেপাশের দৃশ্যপট ও ততোধিক মনোরম ।ভোরবেলার তুঙ্গনাথ অভিযানের জন্য আজ আমাদের অনেকেই ক্লান্ত ।আমরা যখন জোশিমঠের কাছাকাছি তখন আমার ছেলের একটু শারীরিক অস্থিরতার জন্য আমাদের গাড়ী থামাতে হলো।আমি ও ছেলে নিচে নামলাম । আমি অনেকবার দেখেছি এই সময় ও যদি একটু খোলা বাতাসে থাকে তবে খুব তাড়াতাড়ি স্বাভাবকি হয়ে যায় ।গাড়িটা যেখানে দাঁড়িয়েছিল ঠিক তার পাশেই গভীর খাত দিয়ে বয়ে চলেছে অলকানন্দা নদী আর নদীর ওপারে অনেক দূরে জংগলঘেরা পাহাড় ।দূরের পাহাড়ের দিকে তাকিয়ে আছি , হঠাৎ মনে হলো যেনো কালো বিন্দুর মতো কিছু একটা নাড়ছে ।একটা উত্তেজনা অনুভব করলাম , সঙ্গে সঙ্গে মাথায় এলো গাড়োয়ালের " হিমালয়ান ব্ল্যাক বিয়ার " নয়তো ? দৌড়ে গিয়ে গাড়ি থেকে ক্যামেরা বের করে তাক করেই উত্তেজিত হয়ে চ্যাঁচাতে লাগলাম ভাল্লু... ভাল্লুক ... । আমার চিৎকারে সবাই হুড়মুড় করে নেমে এলো গাড়ী থেকে ।দেখতে দেখতে প্রচুর ভীড় জমে গেলো ।জীবনে প্রথম উন্মুক্ত স্থানে স্বাধীনভাবে ঘোরাঘুরি করতে দেখলাম মোগলির ভালুকে।আমার মনে হয় এই ট্যুরের সব থেকে বড় প্রাপ্তি এই ভাল্লুক দর্শন ।আমরা সবাই গাড়ীতে উঠে রওনা হলাম আউলির উদ্দেশ্যে .. ছেলে অবশ্যই ভাল্লুক দেখে একদম সুস্থ ।সবাই বাহবা দিলো আমার ছেলেকে সঠিক সময় সঠিক স্থানে ওর গা গোলানোর জন্য ।

আউলি পৌঁছাতে প্রায় বিকেল হয়ে গেলো । আউলিকে আউলি-বুগিয়াল ও বলা হয় । আউলি মূলতঃ স্কি প্রেমীদের স্বর্গ । আউলি থেকে গার্সন বুগিয়াল হয়ে কূঁয়ারি পাস ট্রেক করা যায় । আমরা এখানে দুরাত থাকবো এবং ইচ্ছে আছে পরেরদিন গার্সন বুগিয়াল যাবার । আউলি ঘুরতে চাইলে কেউ ইচ্ছে করলে জোশিমঠে থাকতে পারেন , সেখান থেকে কেবল কারে আউলি ঘুরে জোশিমঠে ফিরে যেতে পারেন । আবার কেউ ইচ্ছে করলে আউলিতে ও থাকতে পারেন । আউলি থেকে চেয়ার লিফট চড়ে আউলির সৌন্দর্য উপভোগ করতে পারেন । আমারা আউলি পৌঁছে আউলির সৌন্দর্য ভীষনভাবে উপভোগ করলাম । আমাদের রেস্ট হাউসের লবিতে বসে সামনের তুষারশৃঙ্গগুলির দিকে তাকিয়ে থেকে সারাদিন কাটিয়ে দেওয়া যায় । আজ পূর্ন বিশ্রাম । কাল যাবো গার্সন বুগিয়াল ।

আউলিতে দ্বিতীয়দিনের সকাল একটু দেরিতে শুরু হলো । সকাল থেকে ভীষন জোরে জোরে হাওয়া বইছে । আমরা ঠিক করলাম আজ স্নান ও প্রাতঃরাশ সেরে গর্সন বুগিয়ালের উদ্দেশ্যে রওনা দেবো । আউলি থেকে গর্সন বুগিয়াল যেতে হলে প্রথমে আউলি স্কি রেসর্টের ওপর থেকে চেয়ার লিফ্ট করে আউলি টপে গিয়ে সেখান থেকে পায়ে হেঁটে বা ঘোড়ায় চড়ে প্রায় তিন কিলোমিটার পথ অতিক্রম করে গর্সন বুগিয়ালে পৌঁছানো যায় । আমরা চেয়ার লিফটের টিকিট কাটতে গিয়ে জানতে পারলাম যে প্রচন্ড হাওয়া চলায় যাত্রীদের নিরাপত্তার জন্য আজ চেয়ার লিফ্ট বন্ধ করা আছে । আমরা ইচ্ছে করলে অতিরক্তি এক কিলোমিটার অসম্ভব খাড়া পথে পায়ে হেঁটে আউলি টপে পৌঁছে সেখান থেকে আরও তিন কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে গর্সন বুগিয়ালে পৌঁছাতে পারবো ।
আমরা দলের বাকি সদস্যদের সাথে আলোচনা করে জানতে পারলাম যে কেউ ফিরে যেতে রাজি নয় । শুধু বাচ্চাগুলো রোপওয়ে না চড়তে পারার জন্য একটু বিদ্রোহ করলো । পরেরদিন সকালে রোপওয়ে চড়াবার প্রতিশ্রুতিতে বিদ্রোহোর অবসান হয় ।
আমরা যাত্রা শুরু করলাম আউলি টপের উদ্দেশ্যে । এতদিন ধরে ট্রেকিং করার পর এই এক কিলোমিটার খাড়া পথ বেয়ে উঠতে গিয়ে আমাদের অনেকেরই দম ফুরিয়ে আসার জোগাড় ।
আউলি টপে উঠে একটু চাপানের পর আমরা বাকি পথটুকু ঘোড়ায় চড়ে যাবার জন্য মনস্থ করলাম । শুরু হলো আমাদের ঘোড়ায় চড়ে গর্সন বুগিয়ালের উদ্দেশ্যে যাত্রা । প্রথমে কিছুটা ফাঁকা এলাকা পার করার পর শুরু হলো পাহাড়ি জংগল আর জংগলের পথে জায়গায় জায়গায় বরফ পারে আছে । ঘোড়াগুলো ভয়ানক অসভ্য প্রকৃতির । কিছুতেই ওরা সোজা পথে চলতে পারেনা । ওদের পছন্দের রাস্তা হয় সবথেকে চড়াই আর না হলে খাদের একদম পাশের অংশ । একসময় ঘোড়ায় পাহাড়ি পথে অভিযানের ভুল সিদ্ধান্তের জন্য খুব আক্ষেপ হচ্ছিলো । মনে হচ্ছিলো এক্ষুনি নেমে গেলে বোধহয় বেঁচে যাবো ।
অনেক বেশী কষ্ট করে আমরা গর্সন বুগিয়াল পৌঁছালাম । বুগিয়াল সম্বন্ধে আমার এর আগে কোনও অভিগ্গতা ছিলোনা । এখানকার রূপ ঠিক লিখে বোঝাতে পারবোনা । পাহাড়ের মাথায় জঙ্গলঘেরা এক ঢেউখেলানো সবুজ ঘাসে ঢাকা ভূমি যারা ওপর জায়গায় জায়গায় বরফ জমে আছে । আমার মনে হলো যেনো আমরা পাহাড়ের মাথায় কোনো গল্ফ কোর্সে দাঁড়িয়ে আছি । আমরা প্রচুর উপভোগ করলাম । বরফের স্তুপের ওপর থেকে নিচে রোল করে করে নামা , বরফের ওপর হুটোপুটি , সবই হলো ।
আমরা অনেক সময় কাটানোর পর পায়ে হেঁটে রওনা হলাম আউলির উদ্দেশ্যে । দারুনভাবে উপভোগ্য ও স্মরনীয় হয়ে থাকলো আমাদের গর্সন বুগিয়াল অভিযান ।
ফিরতে ফিরতে মনটা খারাপ হয়ে এলো কারন আমাদের বেড়ানোর দিন প্রায় শেষ । এবার ফেরার পালা । কাল সকালে রওনা দেবো ঋষিকেশের উদ্দেশ্যে । সেখান থেকে দেরাদুন , দিল্লী হয়ে কলকাতা । অবশ্য অনেকদিন বাইরে থাকার পর বাড়ির জন্য মনটা একটু তো উতলা হয় বৈকি !

পরেরদিন আউলিতে স্নান ও প্রাতঃরাশ সেরে আউলির পর্ব চুকিয়ে আমরা রওনা হলাম । আমাদের লক্ষ্য ঋষিকেশ বা তার কাছাকাছি পৌঁছানো ।
এই পথে প্রথম এসেছিলাম ঠিক দশবছর আগে কেদারনাথ ও বদ্রিনাথ যাত্রায় । এরপর আরও একবার আসা হয়েছে কিন্তু কোনবারই আউলিতে আসতে পারিনি । যেহেতু আমাদের এইবারের ভ্রমনের অনেকটাই অংশ জুড়ে ছিলো ট্রেকিং তাই দুদিনের পূর্ন বিশ্রাম ও বিনোদনের জন্য রাখা হয়েছিলো আউলিকে ।
আউলির স্মৃতি নিয়ে আমরা এগিয়ে চললাম ফিরতি পথে । পথে নন্দপ্রায়াগে দ্বিপ্রাহরিক আহার সেরে একটু বিশ্রাম নিয়ে আবার রওনা দিলাম । পথের মাঝে মাঝে রাস্তার কাজের জন্য আমাদের যাত্রাপথের অগ্রগতি বিলম্বিত হচ্ছিলো । আমরা যখন দেবপ্রয়াগে পৌঁছালাম তখন প্রায় রাত আটটা । আমাদের গাড়ির চালক তখন ঋষিকেশ পর্যন্ত যেতে রাজি না হওয়ায় আমরা রাতটা দেবপ্রয়াগে কাটাতে বাধ্য হলাম ।
দেবপ্রয়াগের সঙ্গমে অলকানন্দা ও ভাগীরথী মিশে গিয়ে গঙ্গা নাম নিয়ে প্রবাহিত হয় । আমরা ঠিক সঙ্গমের ওপরেই একটি হোটেলে আশ্রয় নিলাম । সবকিছুই ভালো শুধু গঙ্গা মায়ের পাশে হবার কারনে এই হোটেলে আমিষ খাবার সম্পূর্নভাবে নিষিদ্ধ । আজ আসার সময় আমাদের ছানাপোনারা লম্বা লম্বা আমিষ পদের ফিরিস্তি দিচ্ছিলো যেগুলো ওদের রাত্রের খাবারের সাথে পরিবেশিত হবার কথা কিন্তু আবারও নিরামিষ শুনে সবাই বিদ্রোহ করলো । অবশ্য শেষ পর্যন্ত অনশন আন্দোলন হয়নি । দেবপ্রয়াগে রাত্রিযাপনটা ভালোই হয়েছিল ।
পরদিন ঘুমথেকে উঠে দেখলাম এখানে প্রচুর পাখির বাস । বেশকিছু পাখির ছবি তোলা হলো । সকালটা বেশ ভালোই কাটলো পাখি আর অলকানন্দা-ভাগীরথীর সঙ্গম দেখে । আউলি থেকে দেবপ্রয়াগের দূরত্ব প্রায় ১৮০ কিলোমিটার আর এখান থেকে মাত্র ৭৪ কিলোমিটার গেলেই ঋষিকেশ । তাই সকলেই আজ একটু ঢিলেঢালাভাবে চলছে । দেবপ্রয়াগে স্নান ও প্রাতঃরাশ সেরে আবারও বেরিয়ে পারলাম ঋষিকেশের উদ্দেশ্যে ।
আমাদের যাত্রাপথ প্রায় শেষের পথে । ঋষিকেশ পৌঁছে খুব একটা ভালো লাগলোনা । আমরা অফ সিজিনে এই ট্যুর করায় এখন পর্যন্ত কোথাও মানুষের কোলাহল শুনতে পাইনি । কিন্তু ঋষিকেশে পৌঁছে মনে হলো যেনো কলকাতার বড়বাজার বা ধর্মতলা চত্ত্বরকে কোনো এক পাহাড়ঘেরা নদীর পাশে স্থানান্তরিত করা হয়েছে । যাইহোক , আমরা কিছুটা সময় গঙ্গা নদীর পাড়ে কাটিয়ে মনস্থির করলাম দেরাদুনের দিকে এগিয়ে যাবার ।
আমাদের যাত্রা শুরু হয়েছিল হরিদ্বার থেকে আর শেষ হবে দেরাদুনে । দেরাদুনে পৌঁছে আমরা ভীষন ভীষন আনন্দ করলাম । আজ আমার ভাইরা ভাইয়ের ছেলে ঋভুর জন্মদিন । কেক কাটা হলো প্রচুর নাচগান চললো অনেক রাত অবধি । আর অবশ্যই ছানাপোনাদের জন্য প্রচুর আমিষ পদ পরিবেশিত হোলো । আমরাও অবশ্য কেউই বাদ পড়িনি । এবারের মতো শেষ । কাল দেশের রাজধানী হয়ে আমাদের রাজ্যের রাজধানীতে ফেরা ।