বিক্রমশীলা মহাবিহার
ঝাড়খন্ড ছাড়িয়ে বিহারে ঢুকলে কোনো সাইনবোর্ড ছাড়াই বোঝা যায় যে, বিহারে ঢুকলাম। রাস্তাই বলে দেয়। মানে,ঝাড়খন্ডে যাকে রাস্তা বলে,বিহারে সেটাকে খাস্তা বলাই সঙ্গত। বিরাট বিরাট গর্ত, পিচের ছাল-বাকল উঠে খোয়া বেরোনো পথে প্রবল ঝাঁকুনি ।
জিপিএস দেখাচ্ছে আর মাত্র সাতানব্বই কিমি আছে কিন্তু সময় লাগবে প্রায় তিন ঘন্টা। স্বাভাবিক। এটাই বিহারের বৈশিষ্ট্য। এখন ঘড়িতে আটটা। রাস্তা ঠিক থাকলে সাড়ে ন'টার মধ্যে গন্তব্যে পৌঁছনোর কথা ছিল। মনে হচ্ছে এগারোটা,সাড়ে এগারোটা বাজবে। আর এক প্রস্থ চা খেয়ে মা দূর্গা ও বিশ্বকর্মাকে স্মরণ করে রওনা হলাম।
খ্রীষ্টিয় অষ্টম শতকে বিশ্ববিদ্যালয় হিসাবে নালন্দার মান নিম্নমুখী হতে শুরু করে। বাংলায় তখন ধর্মপালের সগৌরব উপস্থিতি, ত্রিশক্তি দ্বন্দ্বে গুর্জর-প্রতিহারদের দম্ভ চূর্ণ করেছেন তিনি। বাংলা বিহারের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে তাঁর সাম্রাজ্য ক্রমবর্ধমান।একই সাথে শিক্ষানুরাগী, ধার্মিক শাসক মন দিলেন শিক্ষা ও ধর্মের প্রসারে। বঙ্গ(অবিভক্ত)-মগধ জুড়ে গড়ে উঠল সোমপুরা, ওদন্তপুরা ও বিক্রমশীলা মহাবিহার।মিনহাজ-উস-সিরাজের তবকাৎ-ই-নাসিরী গ্রন্থে এগুলির উল্লেখ পাওয়া যায়। বিশেষত,বিক্রমশীলার বিস্তারিত তথ্য জানা যায় তিব্বতি গ্রন্থাবলী - আরো সুনির্দিষ্ট ভাবে বলতে গেলে, তারানাথের রচনায়। এখানে আবাসিক ছাত্র বা ভিক্ষু ছিলেন প্রায় সহস্রাধিক। শিক্ষকদের মধ্যে প্রধান ছিলেন অধ্যক্ষ।মোট ছয়জন অধ্যক্ষ ছয়টি 'দিশ' বা wings-এর ভারপ্রাপ্ত ছিলেন। এগুলি হলো, পূর্ব,পশ্চিম,উত্তর,দক্ষিণ, প্রথমমধ্য ও দ্বিতীয় মধ্য।তাঁদের নিচে ছিলেন মহাপন্ডিত ও তাঁদের নিচে পন্ডিতরা, যাঁদের মিলিত সংখ্যা ছিল শতাধিক। পাঠ্যক্রমের অন্তর্ভুক্ত ছিল, দর্শন,ব্যকরণ,অধিবিদ্যা বা metaphysics, তর্কশাস্ত্র এবং অবশ্যই ধর্মশাস্ত্র। বিশেষ করে,সমগ্র এশিয়ায়, তন্ত্রাশ্রিত বৌদ্ধধর্ম শিক্ষার প্রধানতম কেন্দ্র ছিল বিক্রমশীলা। বজ্রযানী বৌদ্ধদর্শন মূলতঃ এই বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যক্ষদের হাত ধরেই বিশ্বের দরবারে ছড়িয়ে পড়েছিল। ধর্মপালের সময়ে দুইজন বজ্রযানী অধ্যক্ষের নাম পাওয়া যায় - বুদ্ধজ্ঞানপাদ ও দীপঙ্করভদ্র - যিনি পরবর্তীকালে অতীশ শ্রীজ্ঞান উপাধি নিয়ে তিব্বতে যাবেন এবং সেখানে জীবিত ঈশ্বরের মর্যাদা লাভ করে সরমা প্রথা বা লামাতন্ত্রের প্রবর্তন করবেন।এমনকি লামাদের চারটি শাখাও(কাগয়ু,শাক্য,কাদম ও গেলুক) তাঁর উত্তরকালে, তাঁরই মতাদর্শের ভিন্ন ভিন্ন ব্যাখ্যার ভিত্তিতে গড়ে উঠেছিল। এঁরা ছাড়াও দেবপালের পরবর্তীতে শ্রীলঙ্কার তান্ত্রিক শ্রমণ জয়ভদ্রের নামও জানা যায় বিক্রমশীলার অধ্যক্ষ রৃপে।ভিক্ষুদের সমাবর্তনে স্বীকৃতি দিতে আসতেন স্বয়ং পালরাজারা। ১১৯৩ সালে অন্যান্য বৌদ্ধবিহারগুলির সাথে সাথে, বখতিয়ার খিলজীর আক্রমনের শিকার হয় বিক্রমশীলাও। ধ্বংস হয়ে যায় এখানকার মূল্যবান লাইব্রেরিটি, মুছে যায় জ্ঞানের বহু আকর।
-'দিদি, বো সিমারিয়া পুল হ্যয় না? কহাঁ আ গ্যয়ে হমলোগ?ইধারহি হ্যঁয় আপকা বো কলেজ?'
ড্রাইভারের কথায় খেয়াল করি। সত্যি তো! সামনে বারাউনির তৈল শোধনাগারই তো মনে হচ্ছে। এরই বাঁপাশে রাজেন্দ্রনগর সেতু বা মনোজের ভাষায় সিমারিয়া পুল। জিপিএস বলছে আর মাত্র বাইশ কিমি। কিন্তু যন্ত্রের ওপর আর ভরসা রাখা যাচ্ছেনা। সামনের রাস্তা সোজা oil refinery -তে ঢোকাচ্ছে।
-'ইসকে অন্দর হ্যঁয় আপকা কলেজ?'
-'আ খেলে যা ! আমার কলেজ হতে যাবে কেন? আর, এর মধ্যেই বা ঢুকবো কেন? এরা কি আমার গাড়িতে তেল ভরবে? দাঁড়া, কাউকে জিজ্ঞেস করি।'
বলতে বলতেই এক সিকিউরিটি গার্ড হাত তুলে আমাদের থামালেন,'ইধার কঁহা জা রহেঁ হ্যঁয়? ইধার রস্তা বন্ধ্ হ্যঁয়।'
সে তো দেখতেই পাচ্ছি। কিন্তু যাব কোথা দিয়ে ? অগত্যা অসহায় প্রশ্ন ছুঁড়লাম,'ভাইয়া,হমে বিক্রমশীলা জানা হ্যঁয়। কিধর সে জায়ে?'
-' বো খোদাইবালা খন্ডহর?'
-'হাঁ,হাঁ, বোহি, বোহি।'
-'কঁহা সে হ্যঁয় আপলোগ?'
-'বঙ্গাল সে'।
গার্ডের মুখভঙ্গী দেখে ওর অনুচ্চারিত কথাগুলো বুঝে নিলাম - এই সাতসকালে বাঙ্গালী ছাড়া আর কোন পাগলই বা ধ্বংসস্তুপ দেখতে চাইবে? তবু দয়াপরবশ হয়ে রাস্তা বুঝিয়ে দিল। গাড়ি ঘুরিয়ে পনেরো কিমি পথ পেরিয়ে দশটা চল্লিশে এসে পৌঁছলাম গন্তব্যে।
উঁচু পাঁচিল ঘেরা কম্পাউন্ড। বাইরে লেখা - RUINS OF VIKRAMSHILA MAHAVIHAR. গেটের ফাঁক দিয়ে সুসজ্জিত বাগান চোখে পড়লো। বিরাট পার্কিং লট।একটিমাত্র অটো দাঁড়িয়ে। পঁচিশ টাকা করে টিকিট আর পনেরো টাকা পার্কিং ফি দিয়ে ভেতরে ঢুকলাম। বাঁহাতে মিউজিয়াম, পানীয় জল ও শৌচাগার। ছোট্ট কিন্তু সুন্দর মিউজিয়াম। খননকার্যে প্রাপ্ত বিভিন্ন সামগ্রী রাখা আছে। বহু পাথর ও ধাতুমূর্তি, অলংকার,অস্ত্র,তৈজসপত্র - সমৃদ্ধ সংগ্রহ। কিউরেটর প্রভাত ঠাকুর অত্যন্ত অমায়িক ও সজ্জন মানুষ। জানালেন, বিদেশী পর্যটকের সংখ্যা নগন্য, কারন যথাযথ প্রচার ও ভালো রাস্তার অভাব। তবে স্থানীয় লোকজন আসে,পুরাতত্ত্বের টানে নয়, পার্কে সময় কাটাতে। মাঝে মাঝে স্থানীয় স্কুলগুলো শিক্ষামুলক ভ্রমণে আসে।
মিউজিয়াম থেকে বেড়িয়ে সামনে একটু এগিয়ে ডানহাতে ঘুরতেই দর্শন দিল মহাবিহার।
পাটনা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক বি.পি.সিনহা ১৯৬০-'৬৯ সালে সর্বপ্রথম এটির খনন শুরু করেন।১৯৭২-'৮২ দায়িত্বভার গ্রহণ করে ASI.। বিহার সরকার অতি সযত্নে,অতি নিপুণ ভাবে এটিকে সংরক্ষণ করছে।একই সঙ্গে উপযুক্ত প্রচার ও পর্যটন উপযোগী পরিকাঠামো গড়ে তুলতে পারলে এটি বিহারের অহংকার হয়ে উঠতে পারে। চতুষ্কোণী প্রত্নক্ষেত্রটির ঠিক মাঝখানে প্রধান স্তুপটি।সমকালীন ভারতবর্ষের বৃহত্তম। মূলতঃ পোড়া ইঁটে তৈরী।কাদামাটির ও কালো ব্যসাল্ট পাথরের স্তম্ভ ছাতটি ধরে রেখেছে।একটি চারকোণা বেদীর ওপর স্তুপটি নির্মিত। বেদীর গায়ে টেরাকোটা ও স্ট্যাকোর বুদ্ধমূর্তির সজ্জা। কিছু পাথরের মূর্তিও আছে, সম্ভবত দশম শতাব্দীর পরের কাজ সেগুলি।বেদীটির একদম ওপরের স্তরটি পদ্মদলের অনুরূপ।স্তুপের চারটি মুখেই একটি করে ভূগর্ভস্থ ইঁটের antichamber-এর সন্ধান পাওয়া গেছে, যেগুলি সম্ভবত শ্রমণদের ধ্যান কক্ষ হিসাবে ব্যবহার হতো। বিহারের দক্ষিণ পশ্চিম কোণে, একটি সরু অলিন্দ পেরিয়ে আয়তাকার লাইব্রেরি আছে।একেবারে সামনে ভিক্ষুদের কক্ষ, ডানহাতে জল সংরক্ষণের স্থান। এখান থেকে সরু নালিকার সাহায্যে শীতল জল কক্ষের দেওয়ালে নিয়ে যাওয়া হতো - প্রাচীন এসির ধারণা। শ্রমণদের কক্ষের সামনের অংশে ও ডানদিকে বৃহদায়তন, গোলাকাকৃতি votive স্তুপ। ছোট ও চতুষ্কোণগুলি শেষ পর্যায়ের বলে মনে হয়। অধিকাংশ পিলারই মনোলিথিক ও ব্যসল্ট পাথরের। কিছু বেলেপাথরের স্তম্ভও পাওয়া গেছে।
মহাবিহারের সিঁড়িতে বসলাম। গায়ে কাঁটা দিল। মনে হলো সমাবর্তন আসন্নপ্রায়। মহারাজ ধর্মপাল এখনি হয়তো আসবেন। স্তুপে হাত রাখলাম - কানে এল সহস্রকন্ঠের মহামন্ত্রোচ্চারণ - "বুদ্ধং শরণং গচ্ছামি।" চোখ বুজলাম। হ্রেষারব,অস্ত্রের ঝনৎকার,আর্তনাদ, উষ্ণ শোণিতস্রোতে ভিজে যাচ্ছে আমার পাদুটো - চমকে চোখ খুললাম। আর কতদিন,আর কতযুগ লাগবে মানুষের?যুদ্ধের ঊর্ধ্বে শান্তিকে, দম্ভের ঊর্ধ্বে জ্ঞানকে,মৃত্যুর ঊর্ধ্বে জীবনকে, পাশবতার অবসান ঘটিয়ে মানবতাকে প্রতিষ্ঠা করতে!হে মহামানব, এখনও কি সময় হয়নি তোমার পুনরাবির্ভাবের? আর একবার এসে দাঁড়াও মানবতার মাঝে। উচ্চারিত হোক -
অসতো মা সদগময়,
তমসো মা জ্যোতির্গময়,
মৃত্যুর্মা অমৃতমগময়
ওম্ শান্তি !শান্তি !শান্তি !
Bikram shila maha bihar
ঝাড়খন্ড ছাড়িয়ে বিহারে ঢুকলে কোনো সাইনবোর্ড ছাড়াই বোঝা যায় যে, বিহারে ঢুকলাম। রাস্তাই বলে দেয়। মানে,ঝাড়খন্ডে যাকে রাস্তা বলে,বিহারে সেটাকে খাস্তা বলাই সঙ্গত। বিরাট বিরাট গর্ত, পিচের ছাল-বাকল উঠে খোয়া বেরোনো পথে প্রবল ঝাঁকুনি ।
জিপিএস দেখাচ্ছে আর মাত্র সাতানব্বই কিমি আছে কিন্তু সময় লাগবে প্রায় তিন ঘন্টা। স্বাভাবিক। এটাই বিহারের বৈশিষ্ট্য। এখন ঘড়িতে আটটা। রাস্তা ঠিক থাকলে সাড়ে ন'টার মধ্যে গন্তব্যে পৌঁছনোর কথা ছিল। মনে হচ্ছে এগারোটা,সাড়ে এগারোটা বাজবে। আর এক প্রস্থ চা খেয়ে মা দূর্গা ও বিশ্বকর্মাকে স্মরণ করে রওনা হলাম।
খ্রীষ্টিয় অষ্টম শতকে বিশ্ববিদ্যালয় হিসাবে নালন্দার মান নিম্নমুখী হতে শুরু করে। বাংলায় তখন ধর্মপালের সগৌরব উপস্থিতি, ত্রিশক্তি দ্বন্দ্বে গুর্জর-প্রতিহারদের দম্ভ চূর্ণ করেছেন তিনি। বাংলা বিহারের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে তাঁর সাম্রাজ্য ক্রমবর্ধমান।একই সাথে শিক্ষানুরাগী, ধার্মিক শাসক মন দিলেন শিক্ষা ও ধর্মের প্রসারে। বঙ্গ(অবিভক্ত)-মগধ জুড়ে গড়ে উঠল সোমপুরা, ওদন্তপুরা ও বিক্রমশীলা মহাবিহার।মিনহাজ-উস-সিরাজের তবকাৎ-ই-নাসিরী গ্রন্থে এগুলির উল্লেখ পাওয়া যায়। বিশেষত,বিক্রমশীলার বিস্তারিত তথ্য জানা যায় তিব্বতি গ্রন্থাবলী - আরো সুনির্দিষ্ট ভাবে বলতে গেলে, তারানাথের রচনায়। এখানে আবাসিক ছাত্র বা ভিক্ষু ছিলেন প্রায় সহস্রাধিক। শিক্ষকদের মধ্যে প্রধান ছিলেন অধ্যক্ষ।মোট ছয়জন অধ্যক্ষ ছয়টি 'দিশ' বা wings-এর ভারপ্রাপ্ত ছিলেন। এগুলি হলো, পূর্ব,পশ্চিম,উত্তর,দক্ষিণ, প্রথমমধ্য ও দ্বিতীয় মধ্য।তাঁদের নিচে ছিলেন মহাপন্ডিত ও তাঁদের নিচে পন্ডিতরা, যাঁদের মিলিত সংখ্যা ছিল শতাধিক। পাঠ্যক্রমের অন্তর্ভুক্ত ছিল, দর্শন,ব্যকরণ,অধিবিদ্যা বা metaphysics, তর্কশাস্ত্র এবং অবশ্যই ধর্মশাস্ত্র। বিশেষ করে,সমগ্র এশিয়ায়, তন্ত্রাশ্রিত বৌদ্ধধর্ম শিক্ষার প্রধানতম কেন্দ্র ছিল বিক্রমশীলা। বজ্রযানী বৌদ্ধদর্শন মূলতঃ এই বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যক্ষদের হাত ধরেই বিশ্বের দরবারে ছড়িয়ে পড়েছিল। ধর্মপালের সময়ে দুইজন বজ্রযানী অধ্যক্ষের নাম পাওয়া যায় - বুদ্ধজ্ঞানপাদ ও দীপঙ্করভদ্র - যিনি পরবর্তীকালে অতীশ শ্রীজ্ঞান উপাধি নিয়ে তিব্বতে যাবেন এবং সেখানে জীবিত ঈশ্বরের মর্যাদা লাভ করে সরমা প্রথা বা লামাতন্ত্রের প্রবর্তন করবেন।এমনকি লামাদের চারটি শাখাও(কাগয়ু,শাক্য,কাদম ও গেলুক) তাঁর উত্তরকালে, তাঁরই মতাদর্শের ভিন্ন ভিন্ন ব্যাখ্যার ভিত্তিতে গড়ে উঠেছিল। এঁরা ছাড়াও দেবপালের পরবর্তীতে শ্রীলঙ্কার তান্ত্রিক শ্রমণ জয়ভদ্রের নামও জানা যায় বিক্রমশীলার অধ্যক্ষ রৃপে।ভিক্ষুদের সমাবর্তনে স্বীকৃতি দিতে আসতেন স্বয়ং পালরাজারা। ১১৯৩ সালে অন্যান্য বৌদ্ধবিহারগুলির সাথে সাথে, বখতিয়ার খিলজীর আক্রমনের শিকার হয় বিক্রমশীলাও। ধ্বংস হয়ে যায় এখানকার মূল্যবান লাইব্রেরিটি, মুছে যায় জ্ঞানের বহু আকর।
-'দিদি, বো সিমারিয়া পুল হ্যয় না? কহাঁ আ গ্যয়ে হমলোগ?ইধারহি হ্যঁয় আপকা বো কলেজ?'
ড্রাইভারের কথায় খেয়াল করি। সত্যি তো! সামনে বারাউনির তৈল শোধনাগারই তো মনে হচ্ছে। এরই বাঁপাশে রাজেন্দ্রনগর সেতু বা মনোজের ভাষায় সিমারিয়া পুল। জিপিএস বলছে আর মাত্র বাইশ কিমি। কিন্তু যন্ত্রের ওপর আর ভরসা রাখা যাচ্ছেনা। সামনের রাস্তা সোজা oil refinery -তে ঢোকাচ্ছে।
-'ইসকে অন্দর হ্যঁয় আপকা কলেজ?'
-'আ খেলে যা ! আমার কলেজ হতে যাবে কেন? আর, এর মধ্যেই বা ঢুকবো কেন? এরা কি আমার গাড়িতে তেল ভরবে? দাঁড়া, কাউকে জিজ্ঞেস করি।'
বলতে বলতেই এক সিকিউরিটি গার্ড হাত তুলে আমাদের থামালেন,'ইধার কঁহা জা রহেঁ হ্যঁয়? ইধার রস্তা বন্ধ্ হ্যঁয়।'
সে তো দেখতেই পাচ্ছি। কিন্তু যাব কোথা দিয়ে ? অগত্যা অসহায় প্রশ্ন ছুঁড়লাম,'ভাইয়া,হমে বিক্রমশীলা জানা হ্যঁয়। কিধর সে জায়ে?'
-' বো খোদাইবালা খন্ডহর?'
-'হাঁ,হাঁ, বোহি, বোহি।'
-'কঁহা সে হ্যঁয় আপলোগ?'
-'বঙ্গাল সে'।
গার্ডের মুখভঙ্গী দেখে ওর অনুচ্চারিত কথাগুলো বুঝে নিলাম - এই সাতসকালে বাঙ্গালী ছাড়া আর কোন পাগলই বা ধ্বংসস্তুপ দেখতে চাইবে? তবু দয়াপরবশ হয়ে রাস্তা বুঝিয়ে দিল। গাড়ি ঘুরিয়ে পনেরো কিমি পথ পেরিয়ে দশটা চল্লিশে এসে পৌঁছলাম গন্তব্যে।
উঁচু পাঁচিল ঘেরা কম্পাউন্ড। বাইরে লেখা - RUINS OF VIKRAMSHILA MAHAVIHAR. গেটের ফাঁক দিয়ে সুসজ্জিত বাগান চোখে পড়লো। বিরাট পার্কিং লট।একটিমাত্র অটো দাঁড়িয়ে। পঁচিশ টাকা করে টিকিট আর পনেরো টাকা পার্কিং ফি দিয়ে ভেতরে ঢুকলাম। বাঁহাতে মিউজিয়াম, পানীয় জল ও শৌচাগার। ছোট্ট কিন্তু সুন্দর মিউজিয়াম। খননকার্যে প্রাপ্ত বিভিন্ন সামগ্রী রাখা আছে। বহু পাথর ও ধাতুমূর্তি, অলংকার,অস্ত্র,তৈজসপত্র - সমৃদ্ধ সংগ্রহ। কিউরেটর প্রভাত ঠাকুর অত্যন্ত অমায়িক ও সজ্জন মানুষ। জানালেন, বিদেশী পর্যটকের সংখ্যা নগন্য, কারন যথাযথ প্রচার ও ভালো রাস্তার অভাব। তবে স্থানীয় লোকজন আসে,পুরাতত্ত্বের টানে নয়, পার্কে সময় কাটাতে। মাঝে মাঝে স্থানীয় স্কুলগুলো শিক্ষামুলক ভ্রমণে আসে।
মিউজিয়াম থেকে বেড়িয়ে সামনে একটু এগিয়ে ডানহাতে ঘুরতেই দর্শন দিল মহাবিহার।
পাটনা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক বি.পি.সিনহা ১৯৬০-'৬৯ সালে সর্বপ্রথম এটির খনন শুরু করেন।১৯৭২-'৮২ দায়িত্বভার গ্রহণ করে ASI.। বিহার সরকার অতি সযত্নে,অতি নিপুণ ভাবে এটিকে সংরক্ষণ করছে।একই সঙ্গে উপযুক্ত প্রচার ও পর্যটন উপযোগী পরিকাঠামো গড়ে তুলতে পারলে এটি বিহারের অহংকার হয়ে উঠতে পারে। চতুষ্কোণী প্রত্নক্ষেত্রটির ঠিক মাঝখানে প্রধান স্তুপটি।সমকালীন ভারতবর্ষের বৃহত্তম। মূলতঃ পোড়া ইঁটে তৈরী।কাদামাটির ও কালো ব্যসাল্ট পাথরের স্তম্ভ ছাতটি ধরে রেখেছে।একটি চারকোণা বেদীর ওপর স্তুপটি নির্মিত। বেদীর গায়ে টেরাকোটা ও স্ট্যাকোর বুদ্ধমূর্তির সজ্জা। কিছু পাথরের মূর্তিও আছে, সম্ভবত দশম শতাব্দীর পরের কাজ সেগুলি।বেদীটির একদম ওপরের স্তরটি পদ্মদলের অনুরূপ।স্তুপের চারটি মুখেই একটি করে ভূগর্ভস্থ ইঁটের antichamber-এর সন্ধান পাওয়া গেছে, যেগুলি সম্ভবত শ্রমণদের ধ্যান কক্ষ হিসাবে ব্যবহার হতো। বিহারের দক্ষিণ পশ্চিম কোণে, একটি সরু অলিন্দ পেরিয়ে আয়তাকার লাইব্রেরি আছে।একেবারে সামনে ভিক্ষুদের কক্ষ, ডানহাতে জল সংরক্ষণের স্থান। এখান থেকে সরু নালিকার সাহায্যে শীতল জল কক্ষের দেওয়ালে নিয়ে যাওয়া হতো - প্রাচীন এসির ধারণা। শ্রমণদের কক্ষের সামনের অংশে ও ডানদিকে বৃহদায়তন, গোলাকাকৃতি votive স্তুপ। ছোট ও চতুষ্কোণগুলি শেষ পর্যায়ের বলে মনে হয়। অধিকাংশ পিলারই মনোলিথিক ও ব্যসল্ট পাথরের। কিছু বেলেপাথরের স্তম্ভও পাওয়া গেছে।
মহাবিহারের সিঁড়িতে বসলাম। গায়ে কাঁটা দিল। মনে হলো সমাবর্তন আসন্নপ্রায়। মহারাজ ধর্মপাল এখনি হয়তো আসবেন। স্তুপে হাত রাখলাম - কানে এল সহস্রকন্ঠের মহামন্ত্রোচ্চারণ - "বুদ্ধং শরণং গচ্ছামি।" চোখ বুজলাম। হ্রেষারব,অস্ত্রের ঝনৎকার,আর্তনাদ, উষ্ণ শোণিতস্রোতে ভিজে যাচ্ছে আমার পাদুটো - চমকে চোখ খুললাম। আর কতদিন,আর কতযুগ লাগবে মানুষের?যুদ্ধের ঊর্ধ্বে শান্তিকে, দম্ভের ঊর্ধ্বে জ্ঞানকে,মৃত্যুর ঊর্ধ্বে জীবনকে, পাশবতার অবসান ঘটিয়ে মানবতাকে প্রতিষ্ঠা করতে!হে মহামানব, এখনও কি সময় হয়নি তোমার পুনরাবির্ভাবের? আর একবার এসে দাঁড়াও মানবতার মাঝে। উচ্চারিত হোক -
অসতো মা সদগময়,
তমসো মা জ্যোতির্গময়,
মৃত্যুর্মা অমৃতমগময়
ওম্ শান্তি !শান্তি !শান্তি !
Bikram shila maha bihar