কাশ্মীর ভ্রমন - 1
...................................................
আর্টিকেল ৩৭০ উইথড্রল নিয়ে সারাভারত উদ্বেলিত। কাশ্মীর আবার সংবাদ শিরোনামে। আর এই সব সময়ে আমার খুব 'কাশ্মীর' পাচ্ছে। আপাতত যখন সেরম কোনও প্ল্যান নেই, তখন মনের সিন্দুক থেকে নামিয়ে মহামূল্যবান স্মৃতির অলংকারগুলোই আরেকবার দেখেশুনে, মুছে-টুছে তুলে রাখা যাক!
......................................
দিল্লী বিমানবন্দরের রানওয়েতে আমাদের বিমানটি গতি নিতেই বুকভরে শ্বাস নিলাম। যাক্, আর মাত্র ঘন্টা দেড়েক পরেই পৌঁছে যাবো আমার আশৈশব স্বপ্নের ভূস্বর্গে। সকলের বারণ অমান্য করে, প্রত্যেকের সাবধানবানী অগ্রাহ্য করে কাশ্মীর যাত্রায় অনড় থেকে গেছি।
অফিসের বাকি সহকর্মীরা যখন এবারকার মত তাদের কাশ্মীর যাত্রা স্থগিত রেখে পুজোয় বেছে নিচ্ছেন অন্য গন্তব্য, আমি তখনও আশা-নিরাশার দোলাচলে দুলতে দুলতে দুবেলা চোখ রাখছি সংবাদপত্রে আর টিভি চ্যানেলে।
২০১৪, অক্টোবরের মাঝামাঝি যাত্রা শুরুর আগে ভরসা বলতে দূরভাষে বলা হাউসবোটের ম্যানেজার আব্দুল ভাইয়ের কথাগুলো,
"বাঢ় তো আয়েগী, যায়েগী! পর, জিন্দেগী নহি রুকেগী, ওহ তো বহতি রয়েগি অপনি খুদ কী লয় মে"!
জীবনের কী অমোঘ সত্য সেদিন তথাকথিত সেই অশিক্ষিত মানুষটির থেকে শিখলাম, তা বুঝতে আরেকটু সময় লেগেছিল।
শ্রীনগর এয়ারপোর্টের বাইরে বেরিয়ে প্রথমেই চোখে পড়ল, বিশাল মিলিটারি ক্যান্টনমেন্ট, রাইফেল হাতে অতন্দ্র পাহারায় সেনা-জওয়ান অার অবিশ্বাস্য রকম শুনশান, জনহীন রাস্তাঘাট। এই মারাত্মক বন্যা শ্রীনগরের শ্রী কে নষ্ট করে ফেলেছে অনেকটাই। রাস্তার দুপাশের হোটেল এবং বাড়িগুলোর দোতলার গায়ে অবধি জলের দাগ এখনও সুষ্পষ্ট। আমাদের হোটেলটি ডালগেটের একদম কাছেই। এখান থেকেই শুরু ডাল বুলেভার্ড রোড আর বাঁদিকে বিখ্যাত ডাল লেক। লেকের জল বন্যার পরে বেশ অপরিষ্কার। হৃদের জলে ভাসমান দারুন সুন্দর কারুকার্য করা হাউস বোটগুলোরও ক্ষতি হয়েছে বিপুলভাবে। বেশিরভাগ হোটেল এবং দোকানপাট বন্ধ। মরসুমের এইসময় যখন বাঙালি পর্যটকের ভিড়ে ডাল রোডে হাঁটা আর বড়বাজারে হাঁটা প্রায় এক হওয়া উচিৎ ছিল, সেখানে এই মুহূর্তে হাতে গোনা কিছু পর্যটক।
অথচ এত কিছুর মাঝেই সেবার উপত্যকার যে অন্য রূপটি আমাদের চোখে পড়েছিল তা সত্যিই ভোলার নয়।
গরীব কাশ্মীরি শাল বিক্রেতা থেকে অতিথি বৎসল হোটেল মালিক,শিকারা চালক, প্রত্যেকের আন্তরিকতা আর অফুরান প্রাণশক্তিতে জীবনের উপর বিশ্বাসটাই ফিরে আসে বারে বারে।
প্রকৃতির ভ্রূকুটি উপেক্ষা করে লক্ষ লক্ষ টাকার ব্যবসা নষ্ট হবার পরেও এই মানুষগুলো যেভাবে আবার স্বাভাবিক জীবনের ছন্দে ফেরার চেষ্টা করে চলেছিল, সবকিছু আবার আগের মত করে গড়ে তোলার লড়াই করে চলেছিল তাকে কুর্নিশ জানাতেই হয়।
আমাদের অতি সামান্য অসুবিধেতেই যেভাবে তারা হাতজোড় করে ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছিলেন, তাতে কুন্ঠিত হচ্ছিলাম আমরাই।
বাড়ি ফিরে এসে অনেক নিরালা মুহূর্তে অনাত্মীয় সেই মানুষগুলোর আন্তরিকতা চোখে এনে দিয়েছিল অশ্রু। বিশেষত, বিদায় নেবার আগে আমাদের ট্রিপের ড্রাইভার মজিদ ভাইয়ের শেষবারের মত বলা কথাগুলো, "অগলি বার তুম অকেলি আ জানা। তুমহারা ভাই হ্যায় না ইধার। ডর কী কোঈ বাত হি নহি।"
এত জায়গায় গেছি, কিন্তু মজিদভাইয়ার মত বিনম্র, শান্ত, সুভদ্র ড্রাইভার আর কোথাও, কখনো পাই নি।
এই মানুষগুলোর সহযোগিতাতেই বন্যাবিধ্বস্ত শ্রীনগরে থেকেছি এবং শ্রীনগরকে
কেন্দ্র করেই নির্ঝঞ্ঝাট ঘুরেওছি। বিশেষত ভিড় কম হওয়ায় কাশ্মীরের ভেতরে অন্য কাশ্মীরের রূপটাও চোখে পড়েছে সহজেই।
প্রথম দিনে শ্রীনগর সাইটসিইং এ আমাদের প্রথম দ্রষ্টব্য হল তখত-এ-সুলেমান পাহাড়ের মাথায় শংকরাচার্যের মন্দির। শোনা যায় খ্রীস্টপূর্ব ২০০ সালে সম্রাট অশোকের পুত্র এই মন্দির তৈরি করেন। কাশ্মীর ভ্রমণকালে জ্ঞানতপস্বী শংকরাচার্য দীর্ঘ দিন ধ্যান করেন এই মন্দিরে। ২৪২ টি সিঁড়ি ভেঙে উঠতে হয় মন্দির প্রাংগনে। সেখান থেকে দেখা যায় ঝিলম ও ডাল লেক সহ সমগ্র শ্রীনগরের শহরটিকে।
মন্দির থেকে নেমে ডাল লেককে বাঁপাশে রেখে আমরা ছুটে চললাম রাজকীয় মুঘল গার্ডেন গুলির উদ্দেশ্যে।
পথের প্রথমেই পড়লো 'চশমেশাহি'। সম্রাট শাহজাহানের অামলে এই অপূর্ব উদ্যানটি তৈরি হয়েছে এক প্রাকৃতিক প্রস্রবনকে কেন্দ্র করে। এর কাছেই রয়েছে আরও একটি ছয়মহলা উদ্যান। শাহজাদা দারার প্রিয় 'পরিমহল'। দারাশুকো জ্যোতিষচর্চাকেন্দ্র ও সুফি সাধকদের বাসস্থান হিসেবে এটি নির্মান করান। পরিমহল থেকে দেখা যায় ডাললেক আর দূরের সবজে-নীল পাহাড়।
মুঘল বাদশাহ দের অতিপ্রিয় গ্রীষ্মাবাস শ্রীনগরে রয়েছে আরও দুটি বিখ্যাত প্রমোদকানন--
'নিশাতবাগ' আর 'শালিমার বাগ'।
মুঘল গার্ডেনগুলির মধ্যে সবচেয়ে বড় 'নিশাতবাগ' নির্মান করেন নুরজাহানের ভ্রাতা আসফ খান। পাহাড়ের ঢালে ১২ টি ধাপে তৈরি এই বাগানের মাঝখানে বয়ে চলেছে পাহাড়ি জলধারা আর উদ্যানের ফোয়ারাগুলো তৈরি হয়েছে সেই জলে। দুপাশে বাঁধানো রাস্তা দিয়ে উঠতেই চোখ জুড়ালো রং-বেরঙের অজস্র ফুলের সমারোহে। বাগান জুড়ে রয়েছে বিশাল বিশাল চিনার, ঝাউ আর সাইপ্রাস। হেমন্তের শেষ বিকেলে লাল হয়ে যাওয়া চিনারের পাতা ঝরে পড়ে বাগানের হাঁটাপথে।
সে এক অবর্ণনীয় সৌন্দর্য্য!
শালিমার বাগও মখমলি সবুজ ঘাস, শাহি ফোয়ারা, জাফরির কাজ সমৃদ্ধ খিলান, নানারঙের ফুল আর উচ্চকায় সব চিনার গাছে সজ্জিত। ১৬১৯ খ্রীস্টাব্দে মুঘল সম্রাট জাহাঙ্গীর এটি নির্মান করেন তাঁর প্রিয়তমা নূরজাহানের জন্য।
এছাড়াও আমরা দেখলাম হজরতবাল মসজিদ (হজরত মহম্মদের দাড়ির একটি চুল এখানে সযত্নে সংরক্ষিত রয়েছে), প্রতাপ সিংহ মিউজিয়াম আর পড়ন্ত বিকেলে ডালের জলে শিকারাবিহার করতে করতে হলুদ সূর্যাস্ত।
ফিরান জড়ানো বিকেলে এখন শীতের হাতছানি। সাঁঝ আরেকটু গাঢ় হলে আগুনসেঁকা কাংড়ি ঘিরে জমে ওঠে কাওয়া-বিলাস।
রাতের বেলা ডিনারের খোঁজে বেরিয়ে আরেক অভিজ্ঞতা। লালচক থেকে খয়ামচকের রাস্তায় রাতে কাবাবের খুশবু ওড়ে। কাশ্মীরি খাদ্যের প্রচুর সুখ্যাতি শুনেছিলাম কিন্তু বুলেভার্ড রোডের শামিয়ানা আর মুঘল দরবারের সুস্বাদু খাবার সমস্ত উপমার উর্ধ্বে। এখানকার ওয়াজয়ান প্ল্যাটারে থাকে ইয়াকনি, রিশতা, গোশতবা, তবক মছলি ইত্যাদির এক আকর্ষণীয় সম্ভার। এখানকার বিভিন্ন বেকারিতে পাওয়া যায় বাখরখানি, কাশ্মীরি নান, শোচভারু ইত্যাদি। ঘোরাঘুরির ফাকে এইসব সুখাদ্যের স্বাদ নেওয়াটাও অত্যন্ত জরুরি।
শ্রীনগর থেকে পরদিন আমাদের যাত্রা শুরু হল সোনামার্গের উদ্দেশ্য। এপথে সঙ্গী হয় সিন্ধনালা (অর্থাৎ সিন্ধুনদ) আর পাইনের সারি। এ পথেই আরও এগোলে দুর্গম গিরিখাত পেরিয়ে জোজিলা পাস, দ্রাস, কাগিল হয়ে পৌঁছে যাওয়া যায় লে অবধি।
পাহাড়ের ঢাল ঘেঁসে, সুন্দর ছিমছাম এক রেস্তোরাঁ। আলুগোবি, আলু পরাঠা আর গরম কফি সহযোগে প্রাতরাশ সারা হল সিন্ধুর বয়ে চলা দেখতে দেখতে।
ক্রমশ এগিয়ে চলেছি সোনামার্গের পথে। গতরাতে বৃষ্টি হয়ে গেলেও এখন মেঘ সরিয়ে আলতো আলোর আভাস।
আকাশচুম্বী তুষারাবৃত পর্বতচূড়া, সবুজ বুগিয়াল, পাইন আর চিনারের বন-- এই নিয়ে সোনামার্গ। আর আছে থাজিবাস গ্লেসিয়ার, যেখান থেকে নেমেছে সিন্ধুর একটি ধারা। দূরত্ব প্রায় ৪ কিমি। ঘোড়ার পিঠে চেপে ঘুরে আসা যায় সেখান থেকে। যদিও আমাদের সাথে বয়স্ক বাবা-মা থাকাতে আমাদের সেরকম কিছু ভাবনা প্রথমে ছিল না। কিন্তু গাড়ি থেকে নেমে একটু এগোতেই ঘোড়াওয়ালারা প্রায় ঘিরে ধরল আমাদের। বক্তব্য একটাই-- আমরা যেন ওদের থেকে ঘোড়া নিয়ে একটু ঘুরে আসি ওদিক থেকে। বন্যার জন্য এই মরসুমে প্রচুর লোকসান হয়েছে।
সত্যিই তো! খেয়াল করে দেখলাম, আমরা ছাড়া আর মাত্র দুটি পরিবার এসেছে এখানে। ওদের কথা শুনে বড্ড মন খারাপ হয়ে গেল।
উৎসাহের বশে তাই নিজেরা তো বটেই, বাবা-মা দেরও দিলাম ঘোড়ায় চাপিয়ে! অবশ্য ওরাই অভয় দিয়েছিল, " পিতাজী আর মাম্মীলোগোকো কোঈ দিক্কত নহি হোনে দেংগে। জান কবুল!"
ঘোড়ার পিঠে চেপে সবুজ মাখা সোনামার্গের চলতে চলতে চারপাশে চেয়ে এক অদ্ভুত ভাললাগায় মনটা খুশিয়াল হয়ে উঠল। এ পথে না এলে সত্যিই বড় ভুল হয়ে যেত।
প্রকৃতির বুক চিরে পাথুরে পায়ে চলা পথ মিশেছে দিগন্তরেখায়। পথের দুধারে আকাশছোঁয়া পাইন গাছের ফাঁক দিয়ে নরম আলো আর গাছের ছায়ারা লুকোচুরি খেলছে।পাতার ফাঁকে নানান শৃঙ্গের উঁকিঝু্ঁকি। মাঝে মাঝেই সবুজ বুগিয়াল। এদিক- ওদিক ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছবির মত ঘর-বাড়ি। একদল ভেড়া মহানন্দে ঘাস খাচ্ছে। হিমেল হাওয়া চোখে, ঠোঁটে, গালে ছুঁয়ে দিয়ে যায় শিহরণ জাগিয়ে।
সূর্যোদয় আর সূর্যাস্তের সময় এ পাহাড়ের মাথায় লাগে সোনারঙের ছটা। তাই এই উপত্যকার নাম সোনামার্গ।
হিমবাহের খানিক আগে পুলের এপারে ঘোড়া ঘোড়া ছেড়ে হাঁটা শুরু করলাম। হিমবাহ পর্যন্ত পথ সামান্যই। আমরা এগিয়ে চললাম না থেমে।
"যে পথ চল হয়নি--আমি হাঁটি, থমকে দাঁড়াই--
দূর থেকে দেখি মিটমিট অালো-- মনে হয় ঐতো অার বেশিদূর নয়
আমি একা নই, আমার চলার পথে তুমিও হও সাথী.......
তোমার হাত ছুঁতে গেলেই অামি হয়ে যাই একা,
সেই ভালো, হারানোর চেয়ে...
ছায়ার সাথে থাকা।"
ক্রমশ..........
কীভাবে যাবেন--
জম্মু-তাওয়াই এক্সপ্রেসে চড়ে চলে আসুন জম্মু। সেখান থেকে গাড়িতে কিংবা বাসে আসতে হবে শ্রীনগর। দূরত্ব ৩০০ কিমি।
বিমানে গেলে দিল্লি থেকে শ্রীনগর এয়ারপোর্টে নামতে হবে।
শ্রীনগরে কোথায় থাকবেন--
ডালের পাড়ে বুলেভার্ড রোডের ডানদিকে রাত্রিবাসের জন্য রয়েছে অসংখ্য হোটেল। জম্মু-কাশ্মীর ট্যুরিজমেরই চারটি হোটেল রয়েছে। হোটেল হিমল, লালারুখ, কাশ্মীর।রেসিডেন্সি, হোটেল কংগপোস।
এছাড়াও প্রাইভেট হোটেলগুলোর মধ্যে হোটেল হামজা, ডাল ভিউ, নুরা প্যালেস ইত্যাদির সুনাম রয়েছে।
ছবিঃ Supratim Mandal
#Jammu & #Kashmir #Tourism
#জম্মু #কাশ্মীর #ভ্রমন #ডাল-লেক
...................................................
আর্টিকেল ৩৭০ উইথড্রল নিয়ে সারাভারত উদ্বেলিত। কাশ্মীর আবার সংবাদ শিরোনামে। আর এই সব সময়ে আমার খুব 'কাশ্মীর' পাচ্ছে। আপাতত যখন সেরম কোনও প্ল্যান নেই, তখন মনের সিন্দুক থেকে নামিয়ে মহামূল্যবান স্মৃতির অলংকারগুলোই আরেকবার দেখেশুনে, মুছে-টুছে তুলে রাখা যাক!
......................................
দিল্লী বিমানবন্দরের রানওয়েতে আমাদের বিমানটি গতি নিতেই বুকভরে শ্বাস নিলাম। যাক্, আর মাত্র ঘন্টা দেড়েক পরেই পৌঁছে যাবো আমার আশৈশব স্বপ্নের ভূস্বর্গে। সকলের বারণ অমান্য করে, প্রত্যেকের সাবধানবানী অগ্রাহ্য করে কাশ্মীর যাত্রায় অনড় থেকে গেছি।
অফিসের বাকি সহকর্মীরা যখন এবারকার মত তাদের কাশ্মীর যাত্রা স্থগিত রেখে পুজোয় বেছে নিচ্ছেন অন্য গন্তব্য, আমি তখনও আশা-নিরাশার দোলাচলে দুলতে দুলতে দুবেলা চোখ রাখছি সংবাদপত্রে আর টিভি চ্যানেলে।
২০১৪, অক্টোবরের মাঝামাঝি যাত্রা শুরুর আগে ভরসা বলতে দূরভাষে বলা হাউসবোটের ম্যানেজার আব্দুল ভাইয়ের কথাগুলো,
"বাঢ় তো আয়েগী, যায়েগী! পর, জিন্দেগী নহি রুকেগী, ওহ তো বহতি রয়েগি অপনি খুদ কী লয় মে"!
জীবনের কী অমোঘ সত্য সেদিন তথাকথিত সেই অশিক্ষিত মানুষটির থেকে শিখলাম, তা বুঝতে আরেকটু সময় লেগেছিল।
শ্রীনগর এয়ারপোর্টের বাইরে বেরিয়ে প্রথমেই চোখে পড়ল, বিশাল মিলিটারি ক্যান্টনমেন্ট, রাইফেল হাতে অতন্দ্র পাহারায় সেনা-জওয়ান অার অবিশ্বাস্য রকম শুনশান, জনহীন রাস্তাঘাট। এই মারাত্মক বন্যা শ্রীনগরের শ্রী কে নষ্ট করে ফেলেছে অনেকটাই। রাস্তার দুপাশের হোটেল এবং বাড়িগুলোর দোতলার গায়ে অবধি জলের দাগ এখনও সুষ্পষ্ট। আমাদের হোটেলটি ডালগেটের একদম কাছেই। এখান থেকেই শুরু ডাল বুলেভার্ড রোড আর বাঁদিকে বিখ্যাত ডাল লেক। লেকের জল বন্যার পরে বেশ অপরিষ্কার। হৃদের জলে ভাসমান দারুন সুন্দর কারুকার্য করা হাউস বোটগুলোরও ক্ষতি হয়েছে বিপুলভাবে। বেশিরভাগ হোটেল এবং দোকানপাট বন্ধ। মরসুমের এইসময় যখন বাঙালি পর্যটকের ভিড়ে ডাল রোডে হাঁটা আর বড়বাজারে হাঁটা প্রায় এক হওয়া উচিৎ ছিল, সেখানে এই মুহূর্তে হাতে গোনা কিছু পর্যটক।
অথচ এত কিছুর মাঝেই সেবার উপত্যকার যে অন্য রূপটি আমাদের চোখে পড়েছিল তা সত্যিই ভোলার নয়।
গরীব কাশ্মীরি শাল বিক্রেতা থেকে অতিথি বৎসল হোটেল মালিক,শিকারা চালক, প্রত্যেকের আন্তরিকতা আর অফুরান প্রাণশক্তিতে জীবনের উপর বিশ্বাসটাই ফিরে আসে বারে বারে।
প্রকৃতির ভ্রূকুটি উপেক্ষা করে লক্ষ লক্ষ টাকার ব্যবসা নষ্ট হবার পরেও এই মানুষগুলো যেভাবে আবার স্বাভাবিক জীবনের ছন্দে ফেরার চেষ্টা করে চলেছিল, সবকিছু আবার আগের মত করে গড়ে তোলার লড়াই করে চলেছিল তাকে কুর্নিশ জানাতেই হয়।
আমাদের অতি সামান্য অসুবিধেতেই যেভাবে তারা হাতজোড় করে ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছিলেন, তাতে কুন্ঠিত হচ্ছিলাম আমরাই।
বাড়ি ফিরে এসে অনেক নিরালা মুহূর্তে অনাত্মীয় সেই মানুষগুলোর আন্তরিকতা চোখে এনে দিয়েছিল অশ্রু। বিশেষত, বিদায় নেবার আগে আমাদের ট্রিপের ড্রাইভার মজিদ ভাইয়ের শেষবারের মত বলা কথাগুলো, "অগলি বার তুম অকেলি আ জানা। তুমহারা ভাই হ্যায় না ইধার। ডর কী কোঈ বাত হি নহি।"
এত জায়গায় গেছি, কিন্তু মজিদভাইয়ার মত বিনম্র, শান্ত, সুভদ্র ড্রাইভার আর কোথাও, কখনো পাই নি।
এই মানুষগুলোর সহযোগিতাতেই বন্যাবিধ্বস্ত শ্রীনগরে থেকেছি এবং শ্রীনগরকে
কেন্দ্র করেই নির্ঝঞ্ঝাট ঘুরেওছি। বিশেষত ভিড় কম হওয়ায় কাশ্মীরের ভেতরে অন্য কাশ্মীরের রূপটাও চোখে পড়েছে সহজেই।
প্রথম দিনে শ্রীনগর সাইটসিইং এ আমাদের প্রথম দ্রষ্টব্য হল তখত-এ-সুলেমান পাহাড়ের মাথায় শংকরাচার্যের মন্দির। শোনা যায় খ্রীস্টপূর্ব ২০০ সালে সম্রাট অশোকের পুত্র এই মন্দির তৈরি করেন। কাশ্মীর ভ্রমণকালে জ্ঞানতপস্বী শংকরাচার্য দীর্ঘ দিন ধ্যান করেন এই মন্দিরে। ২৪২ টি সিঁড়ি ভেঙে উঠতে হয় মন্দির প্রাংগনে। সেখান থেকে দেখা যায় ঝিলম ও ডাল লেক সহ সমগ্র শ্রীনগরের শহরটিকে।
মন্দির থেকে নেমে ডাল লেককে বাঁপাশে রেখে আমরা ছুটে চললাম রাজকীয় মুঘল গার্ডেন গুলির উদ্দেশ্যে।
পথের প্রথমেই পড়লো 'চশমেশাহি'। সম্রাট শাহজাহানের অামলে এই অপূর্ব উদ্যানটি তৈরি হয়েছে এক প্রাকৃতিক প্রস্রবনকে কেন্দ্র করে। এর কাছেই রয়েছে আরও একটি ছয়মহলা উদ্যান। শাহজাদা দারার প্রিয় 'পরিমহল'। দারাশুকো জ্যোতিষচর্চাকেন্দ্র ও সুফি সাধকদের বাসস্থান হিসেবে এটি নির্মান করান। পরিমহল থেকে দেখা যায় ডাললেক আর দূরের সবজে-নীল পাহাড়।
মুঘল বাদশাহ দের অতিপ্রিয় গ্রীষ্মাবাস শ্রীনগরে রয়েছে আরও দুটি বিখ্যাত প্রমোদকানন--
'নিশাতবাগ' আর 'শালিমার বাগ'।
মুঘল গার্ডেনগুলির মধ্যে সবচেয়ে বড় 'নিশাতবাগ' নির্মান করেন নুরজাহানের ভ্রাতা আসফ খান। পাহাড়ের ঢালে ১২ টি ধাপে তৈরি এই বাগানের মাঝখানে বয়ে চলেছে পাহাড়ি জলধারা আর উদ্যানের ফোয়ারাগুলো তৈরি হয়েছে সেই জলে। দুপাশে বাঁধানো রাস্তা দিয়ে উঠতেই চোখ জুড়ালো রং-বেরঙের অজস্র ফুলের সমারোহে। বাগান জুড়ে রয়েছে বিশাল বিশাল চিনার, ঝাউ আর সাইপ্রাস। হেমন্তের শেষ বিকেলে লাল হয়ে যাওয়া চিনারের পাতা ঝরে পড়ে বাগানের হাঁটাপথে।
সে এক অবর্ণনীয় সৌন্দর্য্য!
শালিমার বাগও মখমলি সবুজ ঘাস, শাহি ফোয়ারা, জাফরির কাজ সমৃদ্ধ খিলান, নানারঙের ফুল আর উচ্চকায় সব চিনার গাছে সজ্জিত। ১৬১৯ খ্রীস্টাব্দে মুঘল সম্রাট জাহাঙ্গীর এটি নির্মান করেন তাঁর প্রিয়তমা নূরজাহানের জন্য।
এছাড়াও আমরা দেখলাম হজরতবাল মসজিদ (হজরত মহম্মদের দাড়ির একটি চুল এখানে সযত্নে সংরক্ষিত রয়েছে), প্রতাপ সিংহ মিউজিয়াম আর পড়ন্ত বিকেলে ডালের জলে শিকারাবিহার করতে করতে হলুদ সূর্যাস্ত।
ফিরান জড়ানো বিকেলে এখন শীতের হাতছানি। সাঁঝ আরেকটু গাঢ় হলে আগুনসেঁকা কাংড়ি ঘিরে জমে ওঠে কাওয়া-বিলাস।
রাতের বেলা ডিনারের খোঁজে বেরিয়ে আরেক অভিজ্ঞতা। লালচক থেকে খয়ামচকের রাস্তায় রাতে কাবাবের খুশবু ওড়ে। কাশ্মীরি খাদ্যের প্রচুর সুখ্যাতি শুনেছিলাম কিন্তু বুলেভার্ড রোডের শামিয়ানা আর মুঘল দরবারের সুস্বাদু খাবার সমস্ত উপমার উর্ধ্বে। এখানকার ওয়াজয়ান প্ল্যাটারে থাকে ইয়াকনি, রিশতা, গোশতবা, তবক মছলি ইত্যাদির এক আকর্ষণীয় সম্ভার। এখানকার বিভিন্ন বেকারিতে পাওয়া যায় বাখরখানি, কাশ্মীরি নান, শোচভারু ইত্যাদি। ঘোরাঘুরির ফাকে এইসব সুখাদ্যের স্বাদ নেওয়াটাও অত্যন্ত জরুরি।
শ্রীনগর থেকে পরদিন আমাদের যাত্রা শুরু হল সোনামার্গের উদ্দেশ্য। এপথে সঙ্গী হয় সিন্ধনালা (অর্থাৎ সিন্ধুনদ) আর পাইনের সারি। এ পথেই আরও এগোলে দুর্গম গিরিখাত পেরিয়ে জোজিলা পাস, দ্রাস, কাগিল হয়ে পৌঁছে যাওয়া যায় লে অবধি।
পাহাড়ের ঢাল ঘেঁসে, সুন্দর ছিমছাম এক রেস্তোরাঁ। আলুগোবি, আলু পরাঠা আর গরম কফি সহযোগে প্রাতরাশ সারা হল সিন্ধুর বয়ে চলা দেখতে দেখতে।
ক্রমশ এগিয়ে চলেছি সোনামার্গের পথে। গতরাতে বৃষ্টি হয়ে গেলেও এখন মেঘ সরিয়ে আলতো আলোর আভাস।
আকাশচুম্বী তুষারাবৃত পর্বতচূড়া, সবুজ বুগিয়াল, পাইন আর চিনারের বন-- এই নিয়ে সোনামার্গ। আর আছে থাজিবাস গ্লেসিয়ার, যেখান থেকে নেমেছে সিন্ধুর একটি ধারা। দূরত্ব প্রায় ৪ কিমি। ঘোড়ার পিঠে চেপে ঘুরে আসা যায় সেখান থেকে। যদিও আমাদের সাথে বয়স্ক বাবা-মা থাকাতে আমাদের সেরকম কিছু ভাবনা প্রথমে ছিল না। কিন্তু গাড়ি থেকে নেমে একটু এগোতেই ঘোড়াওয়ালারা প্রায় ঘিরে ধরল আমাদের। বক্তব্য একটাই-- আমরা যেন ওদের থেকে ঘোড়া নিয়ে একটু ঘুরে আসি ওদিক থেকে। বন্যার জন্য এই মরসুমে প্রচুর লোকসান হয়েছে।
সত্যিই তো! খেয়াল করে দেখলাম, আমরা ছাড়া আর মাত্র দুটি পরিবার এসেছে এখানে। ওদের কথা শুনে বড্ড মন খারাপ হয়ে গেল।
উৎসাহের বশে তাই নিজেরা তো বটেই, বাবা-মা দেরও দিলাম ঘোড়ায় চাপিয়ে! অবশ্য ওরাই অভয় দিয়েছিল, " পিতাজী আর মাম্মীলোগোকো কোঈ দিক্কত নহি হোনে দেংগে। জান কবুল!"
ঘোড়ার পিঠে চেপে সবুজ মাখা সোনামার্গের চলতে চলতে চারপাশে চেয়ে এক অদ্ভুত ভাললাগায় মনটা খুশিয়াল হয়ে উঠল। এ পথে না এলে সত্যিই বড় ভুল হয়ে যেত।
প্রকৃতির বুক চিরে পাথুরে পায়ে চলা পথ মিশেছে দিগন্তরেখায়। পথের দুধারে আকাশছোঁয়া পাইন গাছের ফাঁক দিয়ে নরম আলো আর গাছের ছায়ারা লুকোচুরি খেলছে।পাতার ফাঁকে নানান শৃঙ্গের উঁকিঝু্ঁকি। মাঝে মাঝেই সবুজ বুগিয়াল। এদিক- ওদিক ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছবির মত ঘর-বাড়ি। একদল ভেড়া মহানন্দে ঘাস খাচ্ছে। হিমেল হাওয়া চোখে, ঠোঁটে, গালে ছুঁয়ে দিয়ে যায় শিহরণ জাগিয়ে।
সূর্যোদয় আর সূর্যাস্তের সময় এ পাহাড়ের মাথায় লাগে সোনারঙের ছটা। তাই এই উপত্যকার নাম সোনামার্গ।
হিমবাহের খানিক আগে পুলের এপারে ঘোড়া ঘোড়া ছেড়ে হাঁটা শুরু করলাম। হিমবাহ পর্যন্ত পথ সামান্যই। আমরা এগিয়ে চললাম না থেমে।
"যে পথ চল হয়নি--আমি হাঁটি, থমকে দাঁড়াই--
দূর থেকে দেখি মিটমিট অালো-- মনে হয় ঐতো অার বেশিদূর নয়
আমি একা নই, আমার চলার পথে তুমিও হও সাথী.......
তোমার হাত ছুঁতে গেলেই অামি হয়ে যাই একা,
সেই ভালো, হারানোর চেয়ে...
ছায়ার সাথে থাকা।"
ক্রমশ..........
কীভাবে যাবেন--
জম্মু-তাওয়াই এক্সপ্রেসে চড়ে চলে আসুন জম্মু। সেখান থেকে গাড়িতে কিংবা বাসে আসতে হবে শ্রীনগর। দূরত্ব ৩০০ কিমি।
বিমানে গেলে দিল্লি থেকে শ্রীনগর এয়ারপোর্টে নামতে হবে।
শ্রীনগরে কোথায় থাকবেন--
ডালের পাড়ে বুলেভার্ড রোডের ডানদিকে রাত্রিবাসের জন্য রয়েছে অসংখ্য হোটেল। জম্মু-কাশ্মীর ট্যুরিজমেরই চারটি হোটেল রয়েছে। হোটেল হিমল, লালারুখ, কাশ্মীর।রেসিডেন্সি, হোটেল কংগপোস।
এছাড়াও প্রাইভেট হোটেলগুলোর মধ্যে হোটেল হামজা, ডাল ভিউ, নুরা প্যালেস ইত্যাদির সুনাম রয়েছে।
ছবিঃ Supratim Mandal
#Jammu & #Kashmir #Tourism
#জম্মু #কাশ্মীর #ভ্রমন #ডাল-লেক