পুরাকাল| সাল তারিখ সময় ঘেঁটে গেছে| রয়ে গেছে “ওয়ান্স আপন এ টাইম” দিয়ে শুরু হওয়া মুখে মুখে ফেরা মানুষের গল্প, যাদের আমরা বলি, কিংবদন্তি| কিংবদন্তি – এই শব্দটা আমার ছোটবেলা থেকেই খুব ভালো লাগে| এই শব্দটার মধ্যেই কেমন যেন হাজার হাজার বছর ধরে মানুষের ভালবাসার খারাপবাসার কাহিনীগুলো মিলেমিশে যায়| লেপাক্ষী মন্দির নিয়েও এরকম অনেক কিংবদন্তি রয়েছে| স্কন্দপুরাণ, অগস্ত্য সংহিতা এবং শিবপুরাণে এই জায়গার উল্লেখ আছে| অর্থাত এই জায়গাটা নিয়ে গল্পকথা অনেকদিনের| এখুনি হয় তো কেউ বলে উঠবেন, “পুরাণে আছে যখন, তা আবার গপ্পকথা হলো নাকি? সেডা তো নির্ভেজাল সইত্য”| হে জনমেজয়, কান খুলে শুনে নাও, পুরাণ হলো আসমুদ্রহিমাচল ভারতবর্ষের শত-সহস্র জনগোষ্ঠির সঞ্চয় করে রাখা লক্ষ লক্ষ কিংবদন্তির সংকলন| পুরাণ শব্দের মানে হলো প্রাচীন| পুরাকালের ঘটনা| আমরা কথায় কথায় বেদ-পুরাণ পেড়ে আনি| যুক্তিতে না কুলালেই তেড়ে দুটো গালাগাল দিয়ে বলি “এসব ব্যাদে আর পুরাণে আছে”| যেহেতু দুই পক্ষের কেউই কোনদিন বেদ বা পুরাণ চোখে দেখেনি, তর্কটা এখানেই থেমে যায়| বেদে কিংবা পুরাণে আছে যখন! বেদ আর পুরাণ কিন্তু টেকনিক্যালি একদম আলাদা| বেদ হলো শ্রুতি| আর পুরাণ হলো স্মৃতি| শ্রুতি, অর্থাত যা শুনেছ| সেটা শুনে কী ভেবছ, কী বুঝেছো তার থেকেও বড় কথা কী বলেছো, বা ফেসবুকে পোস্ট দিয়েছো.. এগুলো গুরুত্বপূর্ণ নয়| জাস্ট যা শুনেছ তাই| অর্থাত এখানে নিজের বুদ্ধি, কল্পনা, আবেগ এসব লাগাতে যেও না, যা শুনেছ পরের জনকে পাস করে দাও| আর অন্যদিকে পুরাণ হলো স্মৃতি| আমাদের স্মৃতি আমাদের কল্পনা, আবেগ, ভালবাসা, অনুভূতিগুলোকে ছুঁয়ে থাকে| আমাদের জীবনের সব ঘটনা স্মৃতি হয়ে থেকে যায় না| কতো কিছু ঘটনা ঘটে| তারপর আমাদের পক্ষপাতিত্ব, কল্পনা, অনুভূতি- সেই ঘটনায় প্রলেপ লাগায়| কত ঘটনা স্মৃতিতে বদলে যায় বা বিস্মৃতির আড়ালে হারিয়ে যায়| আবার একই ঘটনা এক একজনের স্মৃতিতে এক একরকমভাবে থাকে| পুরাণ আসলে তাই| পুরাণ নিয়ে লিখতে বসলে এখন অনেক কথা চলে আসবে, ছন্দোগ্য উপনিষদ থেকে হরনাথ শাস্ত্রী — সেসব লিখতে লিখতে একটা গোটা মহাভারত হয়ে যাবে| ও, হ্যা, মহাভারতও আসলে একটা পুরাণ, এর আর এক নাম ইতিহাসপুরাণ বা জয়া| পৌরানিক গল্পগুলো বিভিন্ন পুরাণে বিভিন্নভাবে ফিরে ফিরে আসে| ছোটবেলাথেকেই শুনে আসছি, পুরাণ লিখেছেন ব্যাসদেব| মানে আমাদের চিরপরিচিত মহাভারতের রচয়িতা ব্যাসদেব| তখন থেকেই ভাবতাম, ব্যাসদেব বেচারা একা মানুষ, কত কিছু লিখবেন! না হয়, হাতে ব্যথা হবে বলে, গনেশের হেল্প নিয়েছিলেন| তাই বলে, আঠেরো পর্বের মহাভারত লেখার পর আঠারোটা মহাপুরাণ আর, গুচ্ছখানেক উপপুরাণও লিখবেন? তারপরে আবার চারখানা বেদ লিখে তিনি বেদব্যাস| তখনো ছাপাখানা আবিস্কার হয়নি বলে যা খুশি তাই! পরে জেনেছি, ব্যাসদেব কোনো একজন মানুষ নয়| ব্যাস কথাটার মানে হলো সঙ্কলক বা কম্পাইলার| যিনিই এই পুরাণ বা বেদ সংকলন করতেন, তিনিই ব্যাসদেব| ঋষি কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বিভিন্ন জায়গা থেকে পাওয়া গল্পগুলোকে জোড়া লাগিয়ে জয়া বা ইতিহাসপুরাণ লিখেছিলেন| সেটার সঙ্গে আরো অনেক অনেক গল্প যোগ করে তাঁরই শিষ্য বৈশ্যম্পায়ন “মহাভারত” সংকলন করেন| এঁরা সবাই এক একজন ব্যাস| তা, যেটা বলছিলাম| স্কন্দপুরাণ আর শিবপুরাণে লেপাক্ষীর উল্লেখ| সেই যে সেই দক্ষযজ্ঞ লেগেছিলো পুরাকালে! মেয়ের বর হিসেবে চালচুলাহীন গাঁজাখোর শিবঠাকুর মোটেও দক্ষরাজার ফার্স্ট চয়েস ছিলেন না| তিনি মেয়ের বিয়ে দেবেন সফিস্টিকেটেড রাজা-মহারাজার সঙ্গে, অথবা স্কলার ব্রাহ্মণ কিংবা ডাক্তার, নিদেন পক্ষে অনসাইট ফেরত সফ্টওয়ার ইঞ্জিনিয়ার হলেও কথা ছিল| তা বলে ব্যোমভোলে শিব! কিন্তু অবাধ্য মেয়ে সতী শিবঠাকুরকেই বরমাল্য দিয়ে বসলো| সেইসব গল্প সবার জানা| সতী অনাহুত হয়েই গিয়েছিলেন বাপের বাড়ি| দক্ষ তখন বিরাট এক যজ্ঞ আয়োজন করেছেন| শিব ছাড়া সব দেবতা সেখানে নিমন্ত্রিত| সতী দক্ষরাজের যজ্ঞ থেকে আর ফেরেননি| দক্ষরাজের গঞ্জনায় আগুনে আত্মাহুতি দেন তিনি| সেই অনার কিলিং-এর ভয়াবহ খবরটা গেলো শিবের কানে| রাগে, শোকে শিব পাগল হয়ে উঠলেন| তাঁর সেই রুদ্ররূপ থেকে জন্ম নিলেন বীরভদ্র| তিনি শিবেরই আর এক অবতার| বায়ুপুরাণের বর্ণনায়, বীরভদ্রের মুখ ছিল অতি ভয়ংকর, শরীর অগ্নিশিখায় ব্যাপ্ত, প্রকাণ্ড উদর ও দীর্ঘ দন্ত। পোশাক ছিল ব্যাঘ্রচর্ম। এর হাতে ছিল বহু অস্ত্রশস্ত্র । মানে সহজ কথায় যেরকম দেখতে হলে সবাই ভয়-টয় পাবে আর কি| বীরভদ্র শিবের অনুচর নন্দীকে নিয়ে চললেন প্রতিশোধ নিতে| তাঁর ক্রোধের সামনে কেউ দাঁড়াতেই সাহস পেল না| স্বর্গ-মর্ত্য-পাতাল কেঁপে উঠলো| পুরো যজ্ঞক্ষেত্র বীরভদ্র একাই ভেঙ্গেচুরে ছারখার করে দিলেন| অন্য সব দেবতাদের দাঁড়িয়ে দেখা ছাড়া কিছুই করার ছিল না| ডাইরেক্টরের সামনে জুনিয়র সফটওয়ার ইঞ্জিনিয়াররা যেরকম করে দাঁড়ায় আর কি| বীরভদ্র শিব ঠাকুরের অবতার, মানে তিনি দেবতাদের বোর্ড অফ ডিরেক্টরসে ভেটো মেম্বার| চুন্নু-মুন্নু দেবতারা তাঁর সামনে খড়কুটোর মতো ভেসে গেলেন| সূর্যদেবের দাঁত ভেঙে দিলেন, ভগদেবের চোখ গেলে দিলেন| টিম লিডার ইন্দ্র কিছু বলতে গেছিলেন, বীরভদ্র পাতি তাঁকে তুলে আছাড় মেরে দিলেন| অতএব, বোর্ডের বাকি দুজন পাওয়ারফুল মেম্বার ফিল্ডে নামলেন| বিষ্ণু তুলনামূলক ইয়ং ডিরেক্টর| তার ওপর দক্ষরাজ বিষ্ণুর পরম ভক্ত| দক্ষকে বাঁচাতে সরাসরি ডুয়েল লড়ার চ্যালেঞ্জ দিয়ে বসলেন বীরভদ্রকে| তারপর শুরু হলো হরি-হরের যুদ্ধ… ভয়ানক সে যুদ্ধ| পৃথিবীতে অন্ধকার নেমে এলো|স্বর্গ-মর্ত্য-পাতাল কেম্পে উঠলো| সৃষ্টি বোধয় ধ্বংস হয় হয়| কিন্তু হরি-হরের যুদ্ধ থামে না| কেউ কারুর থেকে কম যান না| ইনি ওনাকে একটা দৈবঅস্ত্র ঝাড়েন, তো উনি দশটা| এভাবেই চলতে থাকে| ব্রহ্মা, বুড়ো মানুষ, মানে ইয়ে দেবতা, দুজনকেই বুঝিয়ে সুঝিয়ে শান্ত করার চেষ্টা করেন| কিন্তু কে শোনে কার কথা| শেষে বিষ্ণু যখন কোনভাবে বীরভদ্রকে হারাতে পারলেন না, তখন ছাড়লেন তাঁর চরমতম অস্ত্র – সুদর্শন চক্র| কিন্তু বীরভদ্র তাতেও কাবু হবার পাত্র নন| খপাত করে সুদর্শন চক্রটাকেই গিলে ফেললেন| বিষ্ণু পড়লেন বিপাকে| বুঝলেন বীরভদ্রকে হারানো তাঁর কাজ নয়| ওদিকে বীরভদ্রও বুঝলেন, বিষ্ণুকে যুদ্ধে হারানো সম্ভব নয়| তাই যুদ্ধের মধ্যেই, সুযোগ পেয়ে দক্ষের ধড় থেকে মুন্ডুটি আলাদা করে দিলেন| হরি-হরের যুদ্ধের কোনো মীমাংসা হলো না| তবে যাকে নিয়ে যুদ্ধ সেই যখন থাকলো না আর যুদ্ধ করে হবেটা কী? হাসতে হাসতে বললাম বটে গল্পখানা, পৌরানিক কাহিনীগুলোতে অনেক সময় অনেক বড় দার্শনিক ভাবনা লুকিয়ে থাকে| লৌকিক গল্পগুলোর মধ্যে ঘুমিয়ে থাকে অনেককিছুই| পৌরানিক মতে, সৃষ্টির শুরু থেকেই শিব এবং বিষ্ণু – এক জন অন্যজনকে ছাড়া সম্পূর্ণ নন, অথচ শিব আর বিষ্ণুর মধ্যে অনেকবার যুদ্ধ হয়েছে| আসলে প্রতিনিয়ত সেই হরি-হরের যুদ্ধ চলে| সংস্কৃতভাষা দিয়ে তাত্পর্য বিচার করে দেখলে, হরি কথাটার মানে সৃষ্টি| হর কথার মানে ধ্বংস| বিষ্ণু, কথাটা এসেছে ‘বিষ’ ধাতু থেকে, যার অর্থ হলো ব্যাপ্ত করা বা পূর্ণ করা (বিষল্যত্ ব্যাপ্তৌ ইতি: বিষ্ণু
| আর শিব? শব্দটা এসেছে “শ্বি” ধাতু থেকে, যার অর্থ শূন্য বা খালি| শিব আর বিষ শব্দে, অক্ষরগুলোর উচ্চারণ বা ফোনেটিক্সগুলো উল্টো করে সাজানো (shiv-vish)| আসলে এরা কেউই কাউকে ছাড়া পূর্ণ নয়| তাই শিব আর বিষের মধ্যে এই লড়াইচিরন্তন — ভেতরে এবং বাইরে| নাল সেট আর ইউনিভার্সাল সেটের মধ্যে ভাব এবং আড়ি — এ ফিলোসফি আপনারাই বুঝে নিন| আমি বরং অন্য একটা তথ্য দিই| বীরভদ্র আর বিষ্ণুর মধ্যে যুদ্ধ চলাকালীন বীরভদ্র কিছুক্ষণ জিরিয়ে নিয়েছিলেন এক কুর্মশৈলর(কচ্ছপের মতো দেখতে পাহাড়)ওপরে| সেই কুর্মশৈলর ওপরে তিনি নিজেই শিবলিঙ্গ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন| সেই কুর্মশৈলের অবস্থান? আজকের লেপাক্ষী|