#হরিদ্বারে

ঘুম ভাঙতে বেশ দেরী হয়ে গেল,প্রায় সাতটা বাজে,আমাদের সাইট সিইং এর জন্য গাড়ি চলে আসবে আটটার মধ্যে।তাই তাড়াতাড়ি স্নান করে রেডি হয়ে নিই।পৌনে আটটা নাগাদ রেডি হয়ে চলে এলাম হোটেলের বাইরে,আমাদের গাড়ি চলে এসেছে,কিন্তু সেই ফ্যামিলি যাদের সাথে আমাদের ঘুরতে যাওয়ার কথা,তারা এখনও এসে পৌঁছননি।এদিকে খিদে পেয়েছে খুব,পাশে একটা সাউথ ইন্ডিয়ান রেস্টুরেন্ট এ ঢুকে পড়ি।খাওয়া দাওয়া শেষ করে এসে দেখি সেই ফ্যামিলি চলে এসেছে,ফ্যামিলি বলতে এক ষাটোর্ধ ভদ্রলোক আর ভদ্রমহিলা।

যাই হোক,গাড়িতে সবাই উঠে বসি,গাড়ি চলতে শুরু করে।বেশ খানিকটা দেরি হয়ে গেল।গাড়িতে আলাপ হলো ভদ্রলোক ও ভদ্রমহিলার সাথে।ভদ্রলোক রিটায়ার্ড করে এখন ঘরেই থাকেন,মাঝে মাঝেই বেরিয়ে পড়েন তীর্থের উদ্দেশ্যে নানা স্থানে। ওনাদের এক ছেলে,কলকাতায় নামকরা এক কোম্পানিতে চাকরি করেন।
দেখতে দেখতে গাড়ি চলে আসে আমাদের প্রথম গন্তব্যস্থানে,পাবন ধাম মন্দির।গাড়িতেই জুতো খুলে নেমে আসি,না হলে আবার জুতো জমা রাখার জন্য পয়সা দিতে হবে।বিশাল বড়ো মন্দির,প্রধান গেটের ভিতর দিয়ে আসি মন্দির চত্বরে।মন্দিরটি কাঁচের তৈরি,তাই এটি কাঁচের মন্দির নামেও পরিচিত।পুরো মন্দিরটাই কাঁচের ছোট ছোট টুকরো লাগিয়ে তৈরি করা হয়েছে,মন্দিরের বাইরের দেওয়াল,ভিতরে,সিলিঙ সবই কাঁচের তৈরি।

এখানে মূল মন্দির বা গর্ভগৃহ বলতে কিছু নেই।খোপ খোপ করা ছোট ছোট ঘরের মতো করা,তার ভিতরে বিগ্রহ,সারি সারি দিয়ে,অনেকটা প্রদর্শনী হলের মতো।একে একে দর্শন করি দুর্গা,কালি,লক্ষ্মী, সরস্বতী, রাধাকৃষ্ণ, গোপাল,সন্তোষী মা,শিব,গনেশ, রাম লক্ষন সীতা হনুমান সবাই রয়েছে।সবকটি বিগ্রহই অপূর্ব,শ্বেতপাথরে নির্মিত। মন্দিরের ভিতরের দেওয়ালে কাঁচের টুকরো বসিয়ে পুরানের বিভিন্ন কাহিনী যেমন কালীয়দমন, গোবর্ধন ধারন,গঙ্গাবতরন ইত্যাদি তুলে ধরা হয়েছে।এছাড়াও রয়েছে কাঁচের তৈরি অর্জুনের রথের থ্রিডি মডেল।সত্যি অপূর্ব, এখানকার কাঁচের অসামান্য কারুকার্য মনকে মুগ্ধ করে দেয়।সকল দেবদেবীর উদ্দেশ্যে প্রনাম নিবেদন করে বেরিয়ে আসি মন্দির থেকে,বলা বাহুল্য এখানে কোন পান্ডার উৎপাত নেই।

গাড়িতে উঠে বসতেই গাড়ি এগিয়ে চলল পরবর্তী গন্তব্যের উদ্দেশ্যে।কিছুক্ষন চলার পরে গাড়ি থেমে যাই,গাড়ি থেকে নেমে এগিয়ে চলি আর এক মন্দিরের দিকে, ভুমা নিকেতন।এটি একটি কৃত্রিম ভাবে নির্মিত আধুনিক মন্দির,মানে এখানে পাহাড়, গুহা,ঝরনা সবই আছে,তবে কৃত্রিম ভাবে নির্মিত,অনেকটা পুজোর প্যান্ডেলের মতো।আমাদের ড্রাইভার জানালো এরকম ধরনের মন্দির হরিদ্বারে বেশ কয়েকটা আছে,সবই আধুনিক কালে নির্মিত, এগুলির কোন স্থানমাহাত্ম্য নেই,সবই তীর্থযাত্রীদের মনোরঞ্জনের জন্য তৈরি করা হয়েছে।এই মন্দিরগুলিতে যেমন ভুমা নিকেতন,ইন্ডিয়া টেম্পল ইত্যাদি প্রবেশের জন্য প্রবেশমূল্য দিতে হয়,অনেকটা মিউজিয়াম টাইপের।ড্রাইভারের কথা অনুযায়ী এই মন্দির টি নাকি অন্য গুলির থেকে ভালো তাই আমাদের শুধু এই মন্দিরটি দেখেই সন্তুষ্ট থাকতে হবে।

যাই হোক, প্রবেশ করি মন্দির চত্বরে।সামনেই রয়েছে জলের উপর অনন্তশয্যায় শায়িত বিষ্ণু,সামনে বিশাল ফোয়ারা।জলাশয়ের চারপাশে রয়েছে কৃত্রিম পাহাড়,পাহাড়ের চুড়ায় রয়েছে গঙ্গাবতরনের মডেল,একপাশে দেবি মহিষাসুরমর্দ্দিনী আর সতী কাঁধে মহাদেব।এখানে ছবি তুলতে হলে দিতে হয় ডোনেশন,২১ টাকার ডোনেশন দিয়ে পাওয়া গেল ছবি তোলার ছাড়পত্র।যাই হোক ছবি তুলতে তুলতে সরু গুহাপথ দিয়ে প্রবেশ করি ভিতরে,ভিতরে রয়েছে দেবি ষোড়শীর ছোট মন্দির,সামনে কূর্ম, উপরে শ্রীযন্ত্রম।এগিয়ে চলি গুহাপথ দিয়ে,এখানে পান্ডারা বসে আছে,তীর্থযাত্রীদের টিকা পরিয়ে দক্ষিণা চাইছে,ভালোই ব্যাবসা!দেওয়ালের একপাশে রয়েছে দশমহাবিদ্যার মূর্তি।মনে মনে ভাবি দশমহাবিদ্যার কথা,তন্ত্রে দশমহাবিদ্যার উৎপত্তি সম্পর্কে যে কাহিনী বর্ণিত আছে তা অনেকটা এরকম- একবার প্রচন্ড শিববিদ্বেষী প্রজাপতি দক্ষ আয়োজন করেন এক শিবহীন যজ্ঞের,সেই যজ্ঞে সকল দেব দেবী, মুনি ঋষি দের আমন্ত্রণ করলেও আমন্ত্রণ করেননি নিজ কনিষ্ঠা কন্যা সতী ও জামাতা দেবাদিদেব মহাদেবকে,এদিকে সেই যজ্ঞের কথা নারদের মুখে জানতে পারেন সতী,অত্যন্ত দুঃখিত ও ক্রুদ্ধ সতী সেই যজ্ঞে যাবার সিদ্ধান্ত নেন,কিন্তু বাধা দেন মহাদেব।অমঙ্গলের আশংকায় শিব অনেক চেষ্টা করেন দেবীকে বোঝাতে,কিন্তু সে সবই বৃথা। দেবী সতী মহাদেব কে নিজের আপন স্বরূপ স্মরণ করাতে একে একে ধারন করেন দশটি রূপ, সেই রূপ দেখে শিব হলেন ভিত,শিব যেদিকেই পালাতে যান সেদিকেই দেবীর এক একটি রূপ দেখতে পান।দেবীর সেই দশটি রূপ দশদিক জুড়ে অবস্থান করছিল,এই রূপগুলির মধ্যে কোন রূপ অত্যন্ত ভয়ংকর, আবার কোন রূপ শান্ত, সৌম্য,এই রূপগুলিই দশমহাবিদ্যা নামে পরিচিত, এরা হলেন যথাক্রমে কালী, তারা,ষোড়শী, ভুবনেশ্বরী, ভৈরবী, ছিন্নমস্তা, ধূমাবতী, বগলা, মাতঙ্গী, কমলা।বলা হয় এনাদের মধ্যে কালী ও তারাই প্রধান মহাবিদ্যা,বাকি দেবীরা এনাদের থেকেই সৃষ্ট, আর বগলা হলেন সিদ্ধবিদ্যা। নারদ পঞ্চরাত্র গ্রন্থে এই দেবীদের সম্পর্কে বিস্তারিত বর্ণনা আছে।
ভাবতে ভাবতে এসে পড়ি একটি হলঘরের মতো যায়গায়,এখানে ইলেকট্রিক পাপেট শো এর মাধ্যমে পুরানের নানা কাহিনি দেখানো হচ্ছে,যেমন কৃষ্ণের মাটি খাওয়া,পুতনা বধ,বিশ্বরূপ দর্শন, রামের হরধনু ভঙ্গ, গজেন্দ্রমোক্ষন লীলা ইত্যাদি।টিকিট কেটে এসব দর্শন করে বেরিয়ে আসি গুহাপথ ধরে,গুহাপথের দুপাশে রয়েছে নানা দেবদেবীর ছোট ছোট মন্দির।সব দর্শন করে, মন ভরে ছবি তুলে এগিয়ে চলি পরবর্তী গন্তব্যের দিকে।