#ওরছা(ভারতের মিউজিয়াম নগরী)
---------
ওরছাতে আমার লজ্ টা ছিল রামরাজা মন্দিরের পিছনে। লজ্ থেকে বেরিয়ে ওরছার দূর্গপ্রাসাদ পরিদর্শন করাই আজ বিকেলে আমার পরিকল্পনা। প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য যে ওরছার দ্রষ্টব্য স্থান সমূহ ঘুরে দেখার জন্য নিজের পদযুগলের উপর ভরসা রাখা উচিত।ছোট শহর ওরছাতে এগুলো স্বল্পপরিসরের মধ্যে অবস্থিত,তাই গাড়ি ভাড়া করার কোনো প্রয়োজন পড়ে না। রাজারাম মন্দিরের প্রাঙ্গণের বাজারটি অতিক্রম করে একটা বড় রাস্তার চৌমাথার মোড়ে এসে পড়লাম। এখানে কয়েকটি হোটেল, লজ্, ডাকঘর ও ব্যাঙ্ক রয়েছে। এখানেই অটোরিকশার স্ট্যান্ড। চৌমাথাটা অতিক্রম করে সোজা এগিয়ে পূর্বদিকে দিকে গিয়ে একটা সেতুর মতো রাস্তা দেখতে পেলাম, যেটি একটি নিম্ন ভূমির উপর দিয়ে ওরছার দূর্গপ্রাসাদের সঙ্গে ওরছার মূল শহরের সংযোগ রক্ষা করেছে।এই সেতু দিয়ে এগিয়ে গেলে রাজা মহলের প্রধান ফটকের সামনে এসে পৌছে যাওয়া যায়।ওরছার দূর্গপ্রাসাদ দর্শন করতে হলে প্রথমে রাজা মহলে থেকে শুরু করতে হয়।
রাজা মহল :------ রাজা মহলের ফটকটিতে দেখলাম বড় বড় ছুঁচলো মোটা মোটা গজাল গাঁথা আছে যাতে হাতি দিয়ে এই ফটকটি না ভাঙা যায়।রাজামহল প্রাসাদটি একটি বর্গাকার জমির উপরে নির্মিত। জমিটি আবার দুটি প্রাঙ্গণে বিভক্ত।প্রধান ফটক দিয়ে ঢুকেই যে প্রাঙ্গণে প্রবেশ করলাম সেখানে টিকিট কাউন্টার রয়েছে এবং এখান থেকে টিকিট সংগ্রহ করা বাধ্যতামূলক।ভারতীয়দের জন্য প্রবেশমূল্য দশ্ টাকা ও ক্যামেরার চার্জ পঁচিশ টাকা। এই টিকিট সংরক্ষণ করতে হবে,কারণ এই টিকিটে ওরছার আরও কিছু স্থাপত্য ও মন্দির দেখা যাবে।বিদেশিদের জন্য প্রবেশমূল্য আড়াইশো টাকা।ভিডিও ক্যামেরার জন্য দুশো টাকা।এখানে লাইট অ্যাণ্ড সাউণ্ড শোয়ের জন্য দর্শনী একশো টাকা।
লাইট অ্যাণ্ড সাউণ্ড শোয়ের সময়:----
7-30 PM (English); 8-45 PM (Hindi)
এই প্রাসাদের বৈশিষ্ট্য হলো এর বিস্ময়কর স্থাপত্য এবং রাজকীয় বিলাসবহুল রাজাদের বসবাসের কক্ষসমূহ, সুউচ্চ ব্যালকনি ও পরস্পর সংযোগরক্ষাকারী করিডোর। মনোরম পাথরের জাফরির কাজ ,প্রবেশপথগুলির আঁকা বাঁকা খিলান,মিনার, প্রাসাদশীর্ষদেশের গম্বুজযুক্ত প্যাভিলিয়ন একে দর্শনীয় করে তুলছে।
রাজা মহলের ভিতরের প্রাঙ্গণদুটি রাণীদের দ্বারা ব্যবহৃত হতো।প্রধান প্রাঙ্গণটি চারিদিকে প্রসাদ দিয়ে ঘেরা।এর একটি দিকে চারতলা মহল রয়েছে, অন্য তিন দিক পাঁচতলা
মহল দ্বারা পরিবেষ্টিত।এই মহলটি হিন্দু ও মুঘল স্থাপত্য শৈলীর মিশ্রণে নির্মিত।
মুঘলদের অনুকরণে নির্মিত দেওয়ান-ই-আম এই মহলের উত্তর দিকের কোণে অবস্থিত।এখানে রাজা আম জনতার সঙ্গে মিলিত হতেন,তাদের অভাব অভিযোগ শুনতেন এবং বিচার করতেন।রাজার সিংহাসন স্থাপনের স্থানটি উঁচু বেদির মত এবং একপাশে রয়েছে দেখা গেল। এইরূপ অবস্থানের কারণ হিসাবে জানা গেল যে বিচার করার সময়ে রাজা বিচারপ্রার্থীর মুখদর্শন করতেন না,পাছে বিচারপ্রার্থীর মুখদর্শন করে কোন পক্ষপাতিত্ব তিনি না করে ফেলেন। রাজসভায় সকল শ্রেণীর মানুষের উপস্থিতিতে বিচার চলত।রাজার একদম পাশে থাকতেন তাঁর আত্মীয়স্বজন,তারপর মন্ত্রীগণ,তারপর অন্যান্য সভাসদগণ,ব্রাহ্মণগণ ও তারপর সাধারণ মানুষ। সাধারণ মানুষ ব্রাহ্মণগণ মারফত রাজার কাছে বিচারের আর্জি পেশ করতে পারতেন।দেখলাম পর্যটকরা এর দেওয়ালে চক্, কয়লা বা লোহা দিয়ে নিজেদের নাম ও কিছু অশ্লীল কথাবার্তা লিখে রেখেছেন। হায় ভগবান! ভাবলাম কবে যে আমাদের দেশের লোকের একটু শুভবুদ্ধির উদয় হবে?
পূর্বদিকের প্রবেশদ্বার দিয়ে ঢুকে বাঁদিকে দেওয়ান-ই-খাস্।এখানে বসে রাজা তাঁর মন্ত্রী ও পাত্র মিত্রদের সঙ্গে একান্তে শলাপরামর্শ করতেন।এখান থেকে একটি গুপ্তসুরঙ্গ আছে জঙ্গলে পালিয়ে যাওয়ার জন্য।এর দেওয়ালে ও সিলিং এ এখনও মলিন হয়ে যাওয়া পার্সীয়ান কার্পেটের মতো মোটিফের কাজ দেখতে পাওয়া যায়।জানলার পাথরের ফ্রেমের কারুকার্যগুলি খুবই সূক্ষ্ম ও মনোমুগ্ধকর। দেওয়ান-ই-খাসের বিপরীতে একটি মঞ্চ আছে যেখানে নর্তকীরা তাদের নৃত্যকলা প্রদর্শন করতেন। আমি দেখলাম কয়েকটি মেয়ে বেড়াতে এসে আনন্দে মঞ্চের উপরে নৃত্য করছে।
দুর্গপ্রাসাদ থেকে এইবার আমি প্রাসাদের ভিতরের প্রাঙ্গণে চলে এলাম।এই প্রাঙ্গণের ধারে রাজা ও রাণীদের বাসগৃহগুলি অবস্থিত।একতলার ডানদিকে অর্থাৎ যে দিক দিয়ে আমি ঢুকেছিলাম সেই ঘর রাজা মধুকর শাহের রাণীর জন্য।এই ঘরের সিলিং ও দেওয়াল অপূর্ব রাজপুত ঘরাণার ফ্রেস্কোর কাজের চিত্রাবলী দ্বারা শোভিত। ফ্রেস্কো পেন্টিং হলো দেওয়াল ও ছাদ জুড়ে স্থায়ীভাবে চিত্রাঙ্কনের বহু পুরনো একটি পদ্ধতি। দেওয়াল ভিজে থাকা অবস্থায় জলরঙে চিত্রাঙ্কন করা হতো।পলস্তারা শুকিয়ে গেলে চিত্রটি স্থায়ীভাবে দেওয়ালের শোভাবর্ধন করত। ব্যবহৃত রং ভেষজ এবং ধাতব উপাদান থেকে সংগ্রহ করা হতো। রেনেশাঁ বা নবজাগরণের সময়ে ইটালিতে ফ্রেস্কো পেন্টিং এর সূচনা হয়। রাজামহল প্রাসাদের বৈশিষ্ট্য হলো বাইরে থেকে দেখতে সাধারণ, কিন্তু এর খিলানাকৃতি দরওয়াজা ও রঙিন ফ্রেস্কোর চিত্রাবলী দর্শকের মন হরণ করে নেয়। নানান বিষয় যেমন রামায়ণ, মহাভারত,নানান দেবদেবী,বিষ্ণুর দশ অবতার, পৌরাণিক কাহিনী, রাজকীয় নানা ঘটনা, অন্দরমহলের সখী পরিবৃত রাণীদের জীবনযাত্রা, নানান উৎসব অনুষ্ঠানের বা যুদ্ধের দৃশ্য.......... বিভিন্ন রঙের সমাহারে অপূর্ব সুন্দর করে চিত্রিত আছে কক্ষের দেওয়ালে ও ছাদে.......এমনকি কুলুঙ্গিতেও। তন্ময় হয়ে দেখছিলাম........হঠাৎ বিদেশী একসেন্টে!
"ওয়াও,লাভলি"
শুনে ফিরে তাকিয়ে দেখি এক সোনালী চুলের নীলনয়না সুন্দরী বিদেশিনী মুগ্ধ হয়ে চিত্রকলা দেখছে,ফটো তুলছে আর নিজের অভিব্যক্তি প্রকাশ করছে। প্রাসাদের জানলাগুলি এমনভাবে স্থাপিত যে উপর থেকে জানলা খুললেই চতুর্ভুজ মন্দির পরিষ্কার দেখা যায়।
রাজা মধুকর শাহের ছয়জন রাণী ছিলেন। প্রাঙ্গণের উভয় পাশে তিনটি তিনটি করে ঘরে তাঁরা বসবাস করতেন। মধুকর শাহের প্রধান মহিষী গণেশ কুয়ারী দেবী ছিলেন ভগবান শ্রীরামচন্দ্রের একনিষ্ঠ ভক্ত। তাঁর ব্যবহৃত কক্ষে রামায়ণের চিত্রাবলীর প্রাধান্য দেখা যায়।
রাজা মধুকর শাহের কক্ষটি রাণীদের ঘরের মাঝখানে।তাঁর কক্ষের একপার্শ্বে তিনজন রাণীর কক্ষ এবং অপর পার্শ্বে আরও তিন জন রাণীর কক্ষ। রাজার কক্ষের সঙ্গে সবকটি রাণীদের কক্ষের যোগাযোগ রয়েছে।রাজা মধুকর শাহ্ ছিলেন ভগবান শ্রীকৃষ্ণের পরম ভক্ত। তাঁর কক্ষে কৃষ্ণলীলার বিভিন্ন চিত্রাবলী দেখা যায়।
প্রাঙ্গণের অপর দিকে রয়েছে স্নানাগার।বেতোয়া নদী থেকে জলবাহকদের দিয়ে জল এখানে নিয়ে আসা হতো।শীতকালে জল গরম করার জন্য স্নানাগারের মাঝখানে আগুন জ্বালানোর ব্যবস্থা ছিল।স্নানাগারের ভিতরে একটি স্থানে চন্দন ও অন্যান্য সুগন্ধি দ্রব্য রাখার ব্যবস্থা ছিল।
ওরছার দূর্গপ্রাসাদ ঘুরে দেখার জন্য একজন গাইড নেওয়া উচিত যিনি বন্ধ ঘর ও লুকোনো দরওয়াজা দিয়ে ঢুকিয়ে পুরনো জাঁকজমক দেখাতে পারবেন।
1530 খ্রিস্টাব্দে রাজা রুদ্রপ্রতাপ সিং এই প্রাসাদ নির্মাণ করেন। কিন্তু তিনি এর নির্মাণকাজ সম্পূর্ণ করতে পারেন নি কারণ 1531 খ্রিস্টাব্দে তাঁর অকালমৃত্যু ঘটে। তাঁর মৃত্যুর পরে প্রাসাদ নির্মাণের কাজ বন্ধ হয়ে যায়। তাঁর পুত্র ভারতী চাঁদ সম্মুখভাগ ও প্রধান অংশের নির্মাণ সম্পূর্ণ করতে চেষ্টা করেন,কিন্তু কোন এক অজ্ঞাত কারণে নির্মাণকাজ বন্ধ হয়ে যায়।তারপর নির্মাণের দায়িত্ব এসে পড়ে রাজা মধুকর শাহের উপরে।তিনি এই প্রাসাদের নির্মাণ কাজ সমাপ্ত করেন।এই প্রাসাদ রাজপুত ও মোগল ঘরাণার স্থাপত্য শৈলীর মিশ্রণে তৈরি।বূন্দেলখণ্ডের প্রবল গরমের মোকাবিলা করার জন্য এই প্রাসাদের নির্মাণে এমন পাথর ব্যবহার করা হয়েছিল যা বেশী উত্তপ্ত হয়ে ওঠে না। তাছাড়া পাথরের জাফরির ভিতর দিয়ে যখন বাইরে থেকে বায়ুপ্রবাহ হতো তখন Venturi effect এর জন্য ভিতরটা ঠাণ্ডা রাখতো।এই প্রাসাদের অবস্থান,গঠন,জানলার অবস্থান ও খিলানযুক্ত করিডোর এমন ভাবে বিন্যস্ত যে দিনের বিভিন্ন সময়ে সূর্যালোক ও ছায়া বিভিন্ন মুডে খেলা করে থাকে।1783 খ্রিস্টাব্দে রাজামহল পরিত্যক্ত হওয়ার আগে পর্যন্ত ওরছার রাজারা এখানেই বসবাস করতেন।প্রাসাদের নিচে রয়েছে তোপখানা।
রাজা মহল দেখে কিছুক্ষণ সময় অতিবাহিত করে রাজামহলের পূর্ব দিকে অপর একটি অনুপম স্থাপত্য জাহাঙ্গীর মহল দেখতে এলাম।জাহাঙ্গীর মহলের প্রধান প্রবেশপথটি পূর্ব দিকে, কিন্তু এখানে প্রবেশ করার জন্য রাজা মহল থেকে একটি সর্টকাট রাস্তা আছে।রাজামহল প্রাসাদ থেকে কয়েক ধাপ সিঁড়ি উঠে একটি প্রাঙ্গণ অতিক্রম করে এখানে পৌছে যাওয়া যায়।এই প্রাঙ্গণের বাঁদিকে শীষমহল প্রাসাদ দেখা যায়।
জাহাঙ্গীর মহলে:---এই সুন্দর প্রাসাদটি মুঘল ও রাজপুত স্থাপত্যশৈলীর মিশ্রণে নির্মিত।সেইজন্য এটিতে দুটি ঘরাণার স্থাপত্য শৈলীর প্রভাব সুস্পষ্ট।যেমন মুঘলদের প্রতীক ময়ূর,আবার বুন্দেলাদের প্রতীক হাতি;মুঘলদের স্থাপত্য গম্বুজ, আবার বুন্দেলাদের স্থাপত্য ছত্রী;মুঘলদের পছন্দ সবুজ রঙ,আবার বুন্দেলাদের সেটি নীলরঙ-এই প্রাসাদে দুরকম স্থাপত্যশৈলীর সকল বৈশিষ্ট্যসমূহ প্রবলভাবে বিদ্যমান। তাই বলা হয় মোগল ও বুন্দেলাদের সম্প্রীতি রক্ষার প্রতীক হলো এই প্রাসাদের নির্মাণ। রাজামহল নির্মাণের প্রায় ষাট বছর পরে এই মহল নির্মিত হয়। দূর্গপ্রাসাদ কমপ্লেক্সের ভিতরের দিকের প্রাঙ্গণে একটি সুষম বর্গাকার জমির উপরে এই মহল অবস্থিত। এই প্রাসাদের প্রতিটি কোণায় একটি করে গোলাকৃতি মিনার শোভাবর্ধন করছে এবং মিনারগুলির শীর্ষ দেশ গম্বুজাকার।দুই সারি মনোরম ঝুলন বারান্দা কারুকার্য সম্বলিত ব্রাকেটের উপর স্থাপিত এবং তা মাঝের তলাটির সীমানা নির্দেশ করছে।প্রাসাদের শীর্ষদেশটি আটটি বৃহদাকার গম্বুজ দ্বারা শোভিত। তাদের মাঝখানে মাঝখানে ছোট ছোট গম্বুজ আছে।গম্বুজগুলো সব কারুকার্য খচিত রেলিং শোভিত।এই প্রাসাদে প্রত্নতত্ত্ব দফতরের মিউজিয়াম বসেছে।
সপ্তদশ শতাব্দীর প্রথম দিকে 1618 খ্রিস্টাব্দে রাজা বীর সিং দেও তাঁর মিত্র মুঘল সম্রাট জাহাঙ্গীরকে ওরছাতে স্বাগত জানাতে এই প্রাসাদ নির্মাণ করেন। জাহাঙ্গীর ওরছায় একরাত্রি অবস্থান করেছিলেন, তবে এই প্রাসাদেই অবস্থান করেছিলেন কিনা সঠিক জানা যায় না।
আকবর ওরছা জয় করার জন্য যুবরাজ সেলিম,আবদুল হাসান,আসফ খান এবং আবুল ফজলকে পাঠিয়েছিলেন। যুবরাজ সেলিমের সঙ্গে বারো হাজার সৈন্য পাঠানো হয়েছিল। রাজা বীর সিং দেও যুদ্ধে পরাজিত হয়ে সন্ধি করতে বাধ্য হলেন। তিনি অঙ্গীকার করেন যে আকবরের সঙ্গে জোট কখনো ভাঙবেন না।তাঁকে পাঁচ হাজার পদাতিক ও এক হাজার অশ্বারোহী সৈন্যের উপর প্রভুত্ব ছেড়ে দিতে হয়েছিল।এই ঘটনার তিন বছর পর যুবরাজ সেলিম আকবরের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে ওরছা পালিয়ে আসেন এবং রাজা বীর সিং দেও তাঁকে আশ্রয় প্রদান করেন ও সকল প্রকার সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দেন। আকবর বিদ্রোহ দমন করতে ও যুবরাজ সেলিমকে হত্যা করার জন্য সৈন্য সামন্ত সহ আবুল ফজলকে ওরছা পাঠিয়েছিলেন। কিন্তু রাজা বীর সিং দেও আবুল ফজলকে হত্যা করে তাঁর ছিন্ন মুণ্ড সেলিমকে উপহার দিয়েছিলেন।এর ফলে যুবরাজ সেলিম ও রাজা বীর সিং দেও এর মধ্যে এক মিত্রতার সম্পর্ক তৈরি হয়।সেলিম পরবর্তী কালে জাহাঙ্গীর নাম নিয়ে দিল্লির সিংহাসনে আরোহণ করলে রাজা বীর সিং দেও বন্ধু জাহাঙ্গীরকে ওরছায় আমন্ত্রণ জানান এবং জাহাঙ্গীরের ওরছা আগমনকে স্মরণীয় করে রাখতে রাজা বীর সিং দেও এই প্রাসাদ নির্মাণ করেন।
আর একটি ঐতিহাসিক ঘটনা এই প্রাসাদের সঙ্গে জড়িয়ে আছে। 1635 খ্রিস্টাব্দের 4th October ষোল বছর বয়সে ঔরঙ্গজেব সম্রাট শাহজাহানের প্রতিনিধি হিসেবে বুন্দেলাদের সঙ্গে যুদ্ধে জয়লাভ করে জাহাঙ্গীর মহলের শীর্ষে মোগল পতাকা উত্তোলন করেছিলেন।তখন দেবী সিং কে ওরছার সিংহাসনে বসানো হয়েছিল। বিদ্রোহী রাজা জুঝাড় সিং কে হত্যা করে শাহজাহান ওরছার সম্রাট হিসেবে নিজেকে ঘোষণা করেন।
এই তিনতলা প্রাসাদটির বৈশিষ্ট্য হলো এর অপূর্ব ভাস্কর্য,ঝুলন্ত ব্যালকনি,সূক্ষ্ম কারুকার্য সম্বলিত বিম,ছত্রীসমূহ,গম্বুজাকার শিখর, কতগুলি প্রাঙ্গণ এবং অসংখ্য বিলাসবহুল কক্ষ। একশোটির বেশি ঘর আছে এই প্রাসাদে। অনেকগুলি ঘর ভূগর্ভস্থ। বর্তমানে ভূগর্ভস্থ ঘরগুলো বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে, কাউকে প্রবেশ করতে দেওয়া হয় না। তিন তলার উপর থেকে একদিকে বেতোয়া নদী এবং অপর দিকে চতুর্ভুজ মন্দির দেখতে পাওয়া যায়।
ছাদের উপর অনুচ্চ হেলান প্যরাপিট যা শিখরে অবধি উঠে গিয়েছে তা ফটোগ্রাফির জন্য আদর্শ। শিখরগুলিতে সব শকুনের বাসা। আগেই বলা হয়েছে যে ছাদের উপর আটটি গম্বুজাকার শিখর রয়েছে।
এই মহলের প্রধান প্রবেশ পথটি যে পূর্বদিকে তা আগেই বলা হয়েছে।প্রবেশপথটিতে টার্কিস্ টালির কাজ দেখতে পাওয়া যায়।প্রবেশদ্বারের দুপাশে হাতির মূর্তি আছে,যা ঘন্টা নিয়ে আগন্তুককে স্বাগত জানায়।সবুজ ও নীল-এই দুই রকম রঙের টালি এখানে ব্যবহার করা হয়েছে।
এরপর যে স্থাপত্যটি দেখলাম তা হোল শীষমহল প্রাসাদ।
শীষমহল:---রাজামহল ও জাহাঙ্গীর মহলের মাঝখানে এটি অবস্থিত।শীষমহলের বাঁয়ে রাজামহল ও ডানদিকে জাহাঙ্গীর মহল।এই মহলটিতে মধ্যযুগে ভারতের সমৃদ্ধশালী ঐতিহ্য,পরম্পরা ও উন্নত স্থাপত্যশৈলীর ঝলকানি দেখা যায়।এটি একটি সুন্দর স্থাপত্য এবং বর্তমানে মধ্যপ্রদেশ ট্যুরিজম ডেভলপমেন্ট করপোরেশনের (MPTDC) অধীন একটি বিলাসবহুল হোটেলে পরিণত হয়েছে।ওরছার মহারাজা উদিত সিং এর বসবাসের জন্য 1554 খ্রিস্টাব্দ থেকে 1592 খ্রিস্টাব্দের মধ্যে রাজা মধুকর শাহ্ এই মহল নির্মাণ করেছিলেন।রাজা সুইট ও রাণী সুইট ছাড়া আরও চারটি বিলাসবহুল কক্ষ এখানে আছে।এই মহলের ডাইনিং হলটি অতুলনীয়।এই মহলের শীর্ষদেশ থেকে সমগ্র ওরছা নগরীর সুন্দর দৃশ্য খুব সহজেই প্রতীয়মান হয়।
জাহাঙ্গীর মহলের সুদৃশ্য পূর্বদিকের তোরণদ্বার থেকে উটখানা,বেতোয়া নদী,রাই পারভীন মহল ও সঙ্গে আনন্দবাগ এবং নদীর তীরের কিছু স্থাপত্যের ধ্বংসাবশেষ দেখা যায়।জাহাঙ্গীর মহলে কিছু ফটোগ্রাফি করার পরে আমি পূর্বদিকের তোরণদ্বার দিয়ে রাস্তাতে নেমে এলাম।এই রাস্তার সন্নিকটে কয়েকটি ধ্বংসপ্রাপ্ত স্থাপত্য আছে যেগুলো হলো শ্যমদুয়া কোঠি,রসালদার কোঠি এবং রাই পারভীন মহল।
উটখানা:--(উটের থাকার জায়গা)
দুর্গপ্রাসাদের ঠিক পরেই এর অবস্থান।এটি একটি অবশ্য দ্রষ্টব্য স্থান।এর ছাদের উপর উঠে ওরছা শহরের সামগ্রিক দৃশ্য দেখা বড়ই মনোরম অভিজ্ঞতা।দুর্গপ্রাসাদের পিছনে ভগ্নাবশেষের সৌন্দর্য বিশেষ উল্লেখের দাবি রাখে। এখানে অনেক সামরিক পদাধিকারীর বাসস্থান,মন্ত্রী ও আমলাদের বাসগৃহ,রাস্তা ও বারুদের কারখানা ইত্যাদির ভগ্নাবশেষ রয়েছে।
শ্যামদুয়া কোঠি:--এটি ছিল প্রধান সেনাপতির
আবাসস্থল।শ্যামদুয়া ছিলেন রাইমান দুয়ার পৌত্র। রাইমান দুয়া ছিলেন রাজা বীর সিং দেও এর সভাসদ। রাইমান দুয়ার পরিবার কোন এক অজ্ঞাত কারণে আগুনে পুড়ে আত্মহত্যা করেন।শোকাহত রাজা বীর সিং দেও রাইমান দুয়ার পুত্রবধূকে ওরছাতে ডেকে পাঠান এবং তাঁর বসবাসের জন্য একটি মহল নির্মাণ করে দেন।এই মহলের নাম হয় শ্যমদুয়া কোঠি।এই মহলটি দ্বিতল এবং এতে একটি বিশালাকার প্রাঙ্গণ ও সেচ সুবিধা যুক্ত দুটি মনোরম উদ্যান দেখা যায়। ভিতরে একটি কূপও রয়েছে। তবে এগুলো সব ঘিরে রাখা আছে। মুঘলরা শ্যামদুয়াকে হত্যা করে,কারণ তিনি মুসলমান ধর্ম গ্রহণ করতে অস্বীকার করেছিলেন।
শ্যমদুয়া কোঠির পাশে একটি ধ্বংসপ্রাপ্ত মহল দেখা যায় যার নাম রাইসালদার কোঠি। এটি ছিল অশ্বারোহী সৈন্যবাহিনীর প্রধানের আবাসস্থল।
রাই পারভিন মহল:---এরপর আমি রাই
পারভীন মহলের দিকে এগিয়ে গেলাম। এই মহলটি ওরছার এক বিখ্যাত ও বিস্ময়কর স্থাপত্য যেটি সত্যিকারের একটি নীরব ও জীবন্ত দলিল।অসীম সাহসীনি,উচ্চ প্রশংসনীয় নৃত্য,সঙ্গীত ও কবিপ্রতিভার অধিকারিনী এবং অসাধারণ প্রতিভাবান ও সুন্দরী নর্তকী রাই পরভিনের স্মারক। তিনি ছিলেন রাজা ইন্দ্রজিতের রাজসভার নর্তকী ও তাঁর প্রেমিকা।তাঁর সৌন্দর্য ও নৃত্যগীতে পারদর্শীতার জন্য অনেকের হৃদয় জয় করেছিলেন।বিখ্যাত কবি কেশবদাস তাঁর সম্মানে 'কবিপ্রিয়া' কাব্যগ্রন্থ রচনা করেছিলেন। সেখানে তিনি তাঁর সৌন্দর্যকে রূপমতি ও মৃগনয়নীর সঙ্গে তুলনা করেছেন। তাঁর সৌন্দর্য ও গুণাবলীর সুখ্যাতি দিল্লিতে আকবর বাদশার কানে গিয়ে পৌছলে তিনি রাই পারভিনকে তাঁর দরবারে ডেকে পাঠালেন। উদ্দেশ্য একটাই,রাই পারভিনকে তাঁর হারেমে বন্দী করা। প্রবল পরাক্রমশালী সম্রাট আকবরের হুকুম অমান্য করার ক্ষমতা রাই পারভিন বা রাজা ইন্দ্রজিতের ছিল না।তিনি আকবরের হুকুম মোতাবেক 1602 খ্রিস্টাব্দে দিল্লি যেতে বাধ্য হলেন। আকবরের রাজসভায় নৃত্যগীত পরিবেশনের পর আকবরের কাছে কিছু বক্তব্য রাখার আবেদন করলেন এবং কবিতা ছন্দে বললেন- "Vinit Rai Praveen ki,suniye Sah Sujan,
Juthi patar bhaka hain,bari,bayas,swan."
অর্থাৎ রাই পরভিনের বিনীত নিবেদন এই যে নিচু জাতের লোক,কাক ও নাপিত ছাড়া কেউ উচ্ছিষ্ট গ্রহণ করে না। জাঁহাপনা এদের মধ্যে কোন শ্রেণীভুক্ত?
বুদ্ধিমান সম্রাট আকবর এই কথার অর্থ বুঝলেন। কারণ তিনি জানতেন যে রাই পরভিন রাজা ইন্দ্রজিতের প্রেমিকা ও তাঁকেই হৃদয় দিয়ে বসে আছেন।গুণীর কদর গুণীরাই করেন।তাই রাই পরভিনের বুদ্ধিমত্তা ও কবিত্বশক্তির পরিচয় পেয়ে সম্রাট সসম্মানে তাঁকে মুক্তি দিলেন এবং অনেক ইনাম ও সুরক্ষা দিয়ে ওরছায় প্রেরণ করলেন।
রাই পরভিন মহলটি রাজা ইন্দ্রজিৎ 1618 খ্রিস্টাব্দে রাই পরভিনের বসবাসের জন্য নির্মাণ করেছিলেন। ওরছাতে প্রথম দর্শনে এটি চোখে পড়ে না। এখানে আসতে হলে জাহাঙ্গীর মহলের পিছনে কয়েকধাপ সিঁড়ি নেমে উটখানার মধ্যে দিয়ে যেতে হবে। মহলটি দ্বিতল,দ্বিতলে একটি বড় হলঘর আছে এবং হলঘরের দেওয়ালে রাই প্রভীনের নাচের বিভিন্ন মুদ্রার ছবি আঁকা আছে।মহলটিতে অনেকগুলো ঘর রয়েছে এবং তাতে বড় বড় জানলা আছে। মহলটির সঙ্গে একটি উদ্যান আছে যেটি দুটি ভাগে বিভক্ত।উদ্যানটির নাম 'আনন্দমণ্ডল বাগ'। বর্তমানে উদ্যানটি আগাছা ও শুকনো ঝোপঝাড়ে পরিপূর্ণ।পুরুষসঙ্গী বা অন্যান্য পর্যটকদের সঙ্গ ছাড়া এখানে কোন একা মেয়ের যাওয়া উচিত নয়। গাইডরাও এগুলো দেখাতে চায় না। এই মহলটির অপর নাম হলো "রাই পরভিন মণিকা ভবন" ও "তোপখানা।" কারণ এটি পরবর্তী কালে গোলাবারুদ রাখতে ব্যবহার করা হতো।
রাই পরভিন মহল থেকে কয়েক পা এগিয়ে শাহী দরওয়াজা চোখে পড়ল। এই তোরণদ্বার নির্মিত হয়েছিল সম্রাট জাহাঙ্গিরকে ওরছায় স্বাগত জানাতে।এর উপরের তলার ঘরগুলো সাধারণের জন্য বন্ধ করা আছে। ডানদিকে উটখানা দেখতে পাওয়া যায়।আমি এই তোরণের ভিতর দিয়ে হেঁটে চলে গেলাম এবং বাঁ দিকে ঘুরে কয়েকটি প্রাচীন সৌধের ধ্বংসাবশেষ দেখতে পেলাম। সবুজের সমারোহের মধ্যে দিয়ে এবড়োখেবড়ো বালুকাময় রুক্ষ রাস্তা ধরে এগিয়ে গিয়ে শিবমন্দির,তিন দেশীয় কা মহল,পঞ্চমুখী মহাদেব মন্দির,রাধিকা বিহারী মন্দির ও বনবাসী মন্দির দেখতে পেলাম। এরপর আর বিশেষ এগোনোর জায়গা নেই। স্থাপত্যশৈলীর দিক দিয়ে দেখলে এগুলির বিশেষ কোন বৈশিষ্ট্য নেই।তবে অফবিট লোকেশন এদের আকর্ষণ বাড়িয়ে দিয়েছে।এগুলি সব ASI দ্বারা সংরক্ষিত। তবু স্থানীয় লোকজন এর চৌহিদ্দির মধ্যে ঢুকে পড়ে চাষাবাদ শুরু করে দিয়েছে।এদিকে আসাটা বেশ বিপজ্জনক, কারণ এখানে কুকুরে তাড়া করে। সেইজন্য হাতে লাঠি রাখা উচিত।
আমার এই পদযাত্রার প্রথম গন্তব্যস্থল ছিল সপ্তদশ শতাব্দীতে নির্মিত একটি ছোট শিবমন্দির।এখানে একটি বড় মন্দিরের চৌহিদ্দির ভিতরে দুটি ছোট ছোট স্থাপত্য আছে। মূল মন্দিরের শিখরটি অষ্টকোণবিশিষ্ট ও এর একটি অর্ধমণ্ডপও রয়েছে।মন্দিরে একটি শিবের মূর্তি ও শিবলিঙ্গ ছিল যা বর্তমানে রামরাজা মন্দিরে স্থানান্তরিত হয়েছে।
কুকুরের হাত থেকে পালিয়ে আমি এসে পৌছোলাম পঞ্চমুখী মহাদেব মন্দিরগুচ্ছের চত্বরে। রাজা বীর সিং দেও এই মন্দির নির্মাণ করেছিলেন।বর্তমানে এই মন্দির স্থানীয় চাষীদের দ্বারা অধিকৃত এবং দেখলাম বাচ্চারা এখানে ক্রিকেট খেলছে। এই মন্দিরগুচ্ছে তিনটি মন্দির তিনটি বিভিন্ন দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে আছে। এককালে এই মন্দিরে অনেক হিন্দু দেবদেবী ও ভগবান বিষ্ণুর দশ অবতারের চিত্রাবলী আঁকা ছিল।এই মন্দিরের গঠনশৈলীর সঙ্গে খাজুরাহোর মন্দিরগুচ্ছের গঠনশৈলীর মিল আছে।
এরপর আমি আরও এগিয়ে একটি সীমানা প্রাচীর বিহীন,পরিত্যক্ত ও বিধ্বস্ত মন্দিরে এসে পৌছোলাম।মন্দিরটি সুন্দর এবং রাজা বীর সিং দেও এটি নির্মাণ করেন। এই মন্দিরের নাম রাধিকা বিহারী মন্দির,যেটি বুন্দেলা স্থাপত্যশৈলীর এক অপূর্ব নিদর্শন।মন্দিরের গর্ভগৃহটি মনোরম এবং গর্ভগৃহে গণেশের ও দ্বারপালের ভাস্কর্য দেখা যায়।
তারপর দেখলাম বনবাসী মন্দির। এটিও রাজা বীর সিং দেও নির্মাণ করেন এবং এটি একটি রামমন্দির।বর্তমানে মন্দিরটি খালি এবং বিগ্রহটি রামরাজা মন্দিরে স্থানান্তরিত হয়েছে।মন্দিরের চারিদিকে কেবল লম্বা লম্বা ঘাস।এখানে এসে বেতোয়া নদীর কলধ্বনি কানে এল।নদীতে গিয়ে এক আঁজলা জল নিয়ে মাথায় দিলাম ও পা ধুয়ে নিলাম।
নদীর ধারে কিছুক্ষণ বসে তাড়াতাড়ি প্রাসাদদূর্গের প্রবেশপথে চলে এলাম।সেখান থেকে তাড়াতাড়ি লজে ফিরে এলাম কারণ অন্ধকার নেমে এসেছে। আজ আর কোথাও ঘোরা সম্ভব ছিল না। তবে সন্ধ্যাবেলা রামরাজা মন্দিরের আরতি ও রাজামহলের লাইট অ্যাণ্ড সাউণ্ড শো দেখলাম। আগামীকাল সকালে আবার বের হয়ে বাঁকি দ্রষ্টব্য গুলো দেখতে হবে।