আজ থেকে প্রায় আড়াইশো বছর আগেকার কথা। সালটা আনুমানিক ১৭৪০ । অবিভক্ত বাংলার মসনদে দোর্দণ্ডপ্রতাপ নবাব আলিবর্দি খাঁ। তাঁর যেমন দাপট, তেমনই দূরদর্শিতা। বাঘে গরুতে নাকি একঘাটে জল খায়।

তখনও সোনার বাংলা দুর্ধর্ষ বর্গী আক্রমণে ছারখার হতে শুরু করেনি। ইংরেজরাও তখন সামান্য বেনিয়ামাত্র। আলিবর্দি খাঁ তাঁর রত্নচক পরগণার ইজারাদার করে পাঠালেন কর্মচারী বিদ্যানন্দ ঘোষালকে।

রত্নচক পরগণাটি কংসাবতী নদীর তীরে একটি আণুবীক্ষণিক গ্রাম। সবুজ শ্যামল গাছে ছাওয়া গ্রামটিতে কয়েকঘর প্রজা বাস করে, তবে অঞ্চলটি বহু প্রাচীন। গুপ্ত যুগে যখন তাম্রলিপ্ত বন্দরের রমরমা ছিল, তখন এই গ্রাম এই বন্দরের প্রবেশপথ হিসেবে কাজ করত। সেইসময়ের বৌদ্ধ স্থাপত্যের কিছু নিদর্শন এখনো ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে।

তা থাকুক। বিদ্যানন্দ ঘোষাল ধর্মপ্রাণ হিন্দু, রত্নচকে সপরিবারে থিতু হয়ে ঠিক করলেন সেখানে মন্দির বানাবেন। যেমন ভাবা তেমন কাজ। একের পর এক মন্দির বানিয়ে যেতে লাগলেন তিনি। শিবমন্দির, রাসমঞ্চ, দশমহাবিদ্যা থেকে শুরু করে ধর্মঠাকুরের মন্দির, নানান দেবদেবীর উপাসনালয়ে ভরে উঠল রত্নচক গ্রাম।

বিদ্যানন্দ ঘোষাল তখনও থামলেন না। প্রায় দুশোর কাছাকাছি মন্দির বানানো হয়ে গিয়েছে, তার মধ্যে ছিয়াশিটিই শিব মন্দির। আর মাত্র চোদ্দটি। তাহলেই তাঁর সাধের গ্রাম কাশীধামের মত তীর্থক্ষেত্র হয়ে উঠবে। আহ। কি আনন্দ! শান্তিতে চোখ বুজতে পারবেন তিনি।

কিন্তু তাঁর সেই স্বপ্ন পূরণ হওয়ার আগেই এসে গেল এক ভীষণ বিপদ। আলিবর্দি খাঁয়ের কানে কে কে যেন কথা তুলে দিল, তহবিলের পয়সায় বিদ্যানন্দ একের পর এক মন্দির বানিয়ে চলেছে। নবাব রাগে অগ্নিশর্মা হয়ে হুকুম দিলেন, বিদ্যানন্দকে হাতির পায়ের তলায় থেঁতলে মেরে ফেলা হোক।

হাতি এল। সিপাই শান্ত্রী এল। সবই হল। কিন্তু মন্দির প্রাঙ্গণে যতবারই হাতির গতিপথে ফেলে দেওয়া হয় বিদ্যানন্দকে, গজরাজ পা সরিয়ে নিয়ে চলে যান। একবার, দুবার, বারবার। নবাবের লোকলস্কর স্তম্ভিত। বিদ্যানন্দ হাতির পা থেকে উৎরে গেলেন। ‘পা উৎরে’ থেকে গাঁয়ের নামই পাল্টে হয়ে গেল ‘পাতরা’। কালের অপভ্রংশে পাথরা।

মেদিনীপুর শহরে এক বিশেষ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে আমন্ত্রণ রক্ষা করতে এসে খোঁজ পেলাম সেই গ্রামের।

মাত্র নয় দশ কিলোমিটার দূরের সেই পাথরা গ্রামেই আজ কুয়াশামাখা শীতের ভোরে চলে গিয়েছিলাম ইতিহাসকে খুঁজতে। ইতিহাস তো পেলামই, সঙ্গে সংস্পর্শে আসার সৌভাগ্য হল এমন এক মানুষের, যিনি দেশের বর্তমান প্রেক্ষাপটে এক আলোকবর্তিকাস্বরূপ।

তাঁর নাম ইয়াসিন পাঠান। বাড়ি পাথরার পার্শ্ববর্তী হাতিহলকা গ্রামে।

আজ থেকে পঞ্চাশ বছর আগে ইয়াসিন যখন মাত্র সতেরো বছরের তরুণ, সে নিজের খেয়ালে ঘুরে বেড়াত অরণ্যে ঢেকে যাওয়া এই মন্দিরের ধ্বংসাবশেষগুলোর মাঝে। মন্দিরগুলোর একেই জরাজীর্ণ ভগ্নদশা, কেউ পারতপক্ষে আসে না, তার ওপর একটি একটি করে মন্দির প্রতিবছরই কাঁসাই নদীর গর্ভে ডুবে যাচ্ছে। বর্ষায় নদীর ঢেউ এসে গিলে খাচ্ছে একটি একটি করে স্তূপকে।

কারা বানিয়েছে এই মন্দির? এমন মামুলি একটি গ্রামে এত এত মন্দির কোথা থেকে এল? কাঁসাই নদীর তীরে ঘুরে বেড়াতে বেড়াতে ইয়াসিনের মনে ঘুরপাক খেত সেইসব প্রশ্ন।

“আচ্ছা, এই যে একটা একটা করে মন্দির নদীতে ডুবে যাচ্ছে, আমরা কিছু করতে পারিনা?” ইয়াসিন প্রশ্ন করে গ্রামবাসীদের।

রাম খরচোখে তাকায়, “মন্দির ভাঙছে আমরা বুঝব, তোর তাতে কী? মোল্লা মোল্লার মত থাক।”

রহিম ভ্রূ কুঁচকোয়, “তাতে আমাদের কী! ওরা বুঝবে। তুই তো আজব।”

সত্যিই হয়ত ইয়াসিন আজব। সে নিরস্ত হয়না। একদিন বিষ্ণুপুর ঘুরতে গিয়ে এক সাহেবের সঙ্গে পরিচয় হল। তাঁর নাম ডেভিড ম্যাককুশন। বাংলার টেরাকোটার ওপর গবেষণা করছেন। তাঁর কাছ থেকে ইয়াসিন জানল, কিভাবে এইসব পুরাতত্ত্বের নিদর্শন সংরক্ষণ করতে হয়।  

১৯৭১ সালে স্থানীয় একটি বিদ্যালয়ের পিওন পদে সামান্য একটি চাকরি জুটতেই সে আর দেরি করল না। নিজের মাইনের টাকা দিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল এক অদ্ভুত কর্মকাণ্ডে। পাথরা গ্রামের সব মন্দিরগুলোকে বাঁচাতে হবে। বাঁচাতেই হবে। নদীর পেটে সে আর একটা মন্দিরকেও যেতে দেবে না।

গ্রামবাসীরা প্রথমে এই পাগলকে পাত্তা দিল না। তারপর যখন দেখল সে সত্যিই গাঁটের কড়ি খরচ করে একে একে মন্দিরের আশপাশ সাফাই করছে, নদীর আক্রমণ থেকে বাঁচাতে তুলছে প্রাচীর, তারা হাঁ হয়ে গেল।

এতদিন তারা জানত, বাড়িতে কোন প্রয়োজনে ইট কম পড়লে ওইসব ভগ্নস্তূপ থেকে ভেঙে ইট নিয়ে আসতে হয়।

কিন্তু এসব আবার কি?

ইয়াসিন একদিন খুব মার খেল। হিন্দুদের হাতে। নাক গলানোর অপরাধে। তার কিছুদিন পর মুসলমানরা চড়াও হল। ‘কাফের’ দের মন্দির বানিয়ে ইসলামকে অপমান করার অপরাধে।

আর বাড়িতে বাবা-মা, স্ত্রীপরিবারের গঞ্জনা তো কাঁসাই নদীর স্রোতের মতই সদাপ্রবহমান। বদ্ধ পাগল না হলে কেউ নিজের টাকা দিয়ে এইসব অনাছিস্টি কাজ করে?
ইয়াসিন কাউকে পাত্তাই দিল না। একনিষ্ঠভাবে উদ্ধার করতে লাগল একটির পর একটি মন্দির। একার চেষ্টায় তৈরি করল Pathra Archaeological Preservation Committee. হিন্দু মুসলমান নির্বিশেষে গ্রামের কিছু শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষকে নিয়ে।

নিজের গ্রামের এই দুর্লভ সম্পদের কথা জেলা, রাজ্য, জাতীয়স্তরে প্রাণপণ চেষ্টা করতে লাগল পৌঁছনোর।
অবশেষে টনক নড়ল। Archaeological Survey of India ২০০৩ সালে গ্রামের আঠাশটি মন্দির সংস্কারের দায়িত্ব নিলেন। ক্রমে এগিয়ে এল রাজ্যসরকারও।

পাথরায় এখন চৌত্রিশটি মন্দির নতুন প্রাণ পেয়ে সগর্বে দাঁড়িয়ে রয়েছে। একে একে সংস্কার হচ্ছে আরো কিছু। পুজোও শুরু হয়েছে কয়েকটিতে।

ভোলানাথ শিব তাঁর এই অবহেলিত যবন সন্তানটিকে প্রাণভরে আশীর্বাদ করছেন। ইয়াসিন সম্মানীত হয়েছেন ভারতের রাষ্ট্রপতি প্রদত্ত কবীর পুরষ্কারে।  

আমার অশেষ সৌভাগ্য ইয়াসিন পাঠানের সঙ্গে আজ সকালটি কাটাতে পেরে। তিনি এখন ষাটোর্ধ, অত্যন্ত অসুস্থ। তবু তিনি ছুটছেন দিল্লী থেকে কলকাতা সর্বত্র। তাঁর নতুন লড়াই যে কৃষকরা ASI কে ক্ষতিপূরণের প্রতিশ্রুতিতে মন্দিরসমেত নিজেদের জমি দান করেছে, তাদের প্রাপ্য আদায়ের জন্য।

আজকের অশান্ত ভারতবর্ষে ধর্মের ভেদাভেদকে হাতিয়ার করে যখন বিষ নিঃশ্বাস ফেলছে রাজনৈতিক দলগুলো, তখন মন্দির বাঁচানোর জন্য ইয়াসিন পাঠানের এই আজীবন একক সংগ্রাম আমাকে নতুন করে বোঝাল,

যত যাই হোক, এ-ই আমার ভারতবর্ষ। যত যাই হোক, এখানে মানুষ এখনো আছেন। এখানে যিনি বিদ্যানন্দ, তিনিই ইয়াসিন। পরিচয়? আমরা ভারতবাসী।

এ-ই আমার দেশ!

এর জন্যই আমি গর্বিত। ইয়াসিন পাঠান, আপনাকে প্রণাম। আরো আরো মানুষের আপনাকে জানা উচিৎ। চেনা উচিৎ।

কলমে -- দেবারতি_মুখোপাধ্যায়