#পুরোনো_ও_পৌরাণিক : সতীপীঠ
: কনখল :
তিনদিন ধরে বেনারসের গলি গলি ঘুরে দুধ জিলাবি রাবড়ি পান প্যাড়া গণ্ডেপিণ্ডে গিলে ছেলে ট্যাঁকে গুঁজে চারদিন ধরে লক্ষ্নৌ ঘুরে টুরে চললাম সেবারের শেষ গন্তব্য সতীর বাপের বাড়ি।
নামটা হরদ্বার না হরিদ্বার তা নিয়ে বিষম গোল। জায়গাটা আরও উত্তরে যাওয়ার "দ্বার" এ বিষয়ে সবাই একমত ; কিন্তু কেদারেশ্বর শিবের কাছে যাওয়ার দরজা, না বদ্রীনাথ বিষ্ণুর কাছে ....এ নিয়ে শৈব আর বৈষ্ণবদের মতভেদ চিরকালীন।
পীঠস্থান ভিন্ন অন্য কোন গল্প এই সিরিজে আমার লেখার বিষয় নয়। তাই সোজাসুজি পৌঁছে যাই সতীর পিত্রালয় পীঠস্থানের কারণভূমি দক্ষগৃহে।
কনখল যেতে হয় হরিদ্বার থেকে। এখানেই ছিল যজুর্বেদীয় মহাজ্ঞানী রাজা দক্ষের বাড়ি। দুর্গা-উপাসক দক্ষ তাঁর জ্ঞান ও পূজার দ্বারা সতীরূপী মায়াদেবী দুর্গার জনক হবার সৌভাগ্য লাভ করেন। ছোট্ট থেকেই সতী শিবপূজারিণী তথা শিবাকাঙ্ক্ষিণী। দক্ষপুরীর অদূরেই যে বেলগাছের বনে তিনি শিবার্চনা করতেন, সেখানে এখনও বিল্বকেশ্বরের মন্দিরে রয়েছেন লিঙ্গেশ্বর মহাদেব।
নিজের স্বয়ম্বরে মহাদেবকে অনুপস্থিত দেখে তাঁর উদ্দেশ্যে সতী আকাশে বরমাল্য নিক্ষেপ করলে সে ফুলহার গলায় পরিহিত হয়ে ভস্মাবৃত বাঘছালশোভিত জটাধারী শম্ভু স্বয়ম্বরসভায় আবির্ভূত হলেন এবং ঘোর অনিচ্ছা সত্ত্বেও কন্যাদায়গ্রস্ত পিতা দক্ষ সতীর জেদের কাছে পরাভূত হয়ে তাঁকে শ্মশানচারীর হাতে সম্প্রদান করলেন। ঋগ্বেদীয় অলৌকিক দেবত্ব আর যজুর্বেদীয় আপন ভাগ্য আপন কর্মে তৈরী করার আত্মাভিমানের সিম্বলস্বরূপ শ্বশুর জামাতার সম্পর্কের মধ্যে সূক্ষ্ম ফাটল চিরস্থায়ী হল।
শিব ব্যতীত অনুষ্ঠিত যজ্ঞে অনাহূত সতী দশমহাবিদ্যার ছলে, লাস্যে, বিভঙ্গে, ভয়াবহতায়, বিভীষিকায়, অভিমানে, অপরূপতায়, বিদ্যায়, অবিদ্যায় মহাদেবের সম্মতি আদায় করতে না পেরে অবশেষে নিরুপায়তার রূপ দরিদ্র অশক্ত বৃদ্ধা ধূমাবতীতে শিবকে পর্যদুস্ত করে ষণ্ডারোহন করে পিতৃগৃহ কনখলে উপস্থিত হলেন।
বিবাহিতা মহিলাদের এ এক বিষম সমস্যা, না পারে পিতাকে ভুলতে, না পারে পতিকে অগ্রাহ্য করতে। আমাদের দেশে মেয়েরা আপনগৃহে বড়ো হয় অন্য পরিবারের গচ্ছিত সম্পদ হিসেবে, অথচ পরবর্তীকালে আপন অধিকারে সেই অন্য পরিবারে গিয়ে সেখানেও সে বহুলাংশেই আপদ হিসেবে পরিগণিত হয়। মেয়েরা না পারে দুই পরিবারেরই আপন হতে, না পারে কোন পরিবারকেই পর করতে। এই দ্বিধান্বিত বিপদে সে শ্বাস নিয়ে চললেও আসলে অনেক আগেই সংসারাগ্নিতে আত্মাহুতি দিয়ে ফেলে।
মানবকন্যা দেবী সতীরও একই দশা হল। প্রাণাধিক প্রিয় পতির আপত্তি অগ্রাহ্য করে পরম ভালোবাসা আর বিশ্বাস নিয়ে পিতৃগৃহে এসে পিতারই মুখে পতির নিন্দা শুনে পিতৃদত্ত পার্থিব শরীর অন্তরস্থ শোকাগ্নিতে আহুতি দিলেন।
দুঃসংবাদ পেয়ে ক্রুদ্ধ মহাদেব দৌড়ে এসে শ্বশুরের মুন্ডচ্ছেদন করে যজ্ঞকুণ্ডে নিক্ষেপ করলেন এবং মৃতা স্ত্রীর দেহ কাঁধে তুলে প্রবল তান্ডবনৃত্য শুরু করলেন। প্রলয়ঙ্করী সেই নৃত্য থামাতে বিষ্ণু সুদর্শনচক্র নিক্ষেপ করে সতীদেহ একান্ন টুকরো করলেন।
সতীর দেহের নানা অঙ্গ অবিভক্ত ভারতের নানা স্থানে ছড়িয়ে পড়ল। কেবল যে অঙ্গটি শিবের কাঁধ স্পর্শ করে ছিল, সতীর সেই দেহাবশেষ জঠর (মতান্তরে নাভি ) পড়ে রইল কনখলের যজ্ঞস্থলেই। তৈরী হল গঙ্গার ক্ষীণস্রোত এক পবিত্র জলাধার ; সতীকুণ্ড।
আর পত্নীবিয়োগের ক্রোধের সঙ্গে প্রিয়া হারানোর যে হাহাকার মিশে রয়েছিল, তা অশ্রুবিন্দু হয়ে রুদ্রের অক্ষি থেকে ভূমিতে ঝরে পড়ল ; সেই সব স্থানে জন্ম নিল পুরুষের প্রেমের অপূর্ব প্রতীক রুদ্রাক্ষ ফল সমৃদ্ধ পুণ্যবৃক্ষ।
এদিকে যজ্ঞ সম্পূর্ণ করার জন্য শিবকে সবাই অনুরোধ করলেন দক্ষকে পুনরুজ্জীবিত করতে। শিবের মাথা ততক্ষণে একটু ঠান্ডা হয়েছে। ভেবে দেখলেন বউয়ের বাবার মাথা কাটায় বউ তো মরেও শান্তি পাবেনা। কিন্তু দক্ষের মাথা ততক্ষণে যজ্ঞাগ্নিতে পুড়ে ছাই।
অগত্যা বলির জন্য আনা ছাগলের মুণ্ডু কেটে স্বর্গের ডাক্তারভ্রাতা অশ্বিনীকুমারদ্বয় দক্ষের ঘাড়ের ওপর প্লাস্টিক সার্জারি করে সেট করে দিলেন। ব্রহ্মা মন্ত্র পড়ে লাইফ সাপোর্ট সিস্টেমে রাখা দক্ষের প্রাণ ফিরিয়ে দিলেন। ছাগমুণ্ড দক্ষ দম্ভ বিসর্জন দিয়ে জামাতারূপী মঙ্গলময় শিবের আরাধনা করলেন। তাই এখানে মহাদেব দক্ষেশ্বর নামে অভিহিত।
যজ্ঞ সম্পূর্ণ হলে জামাতা শিব পত্নীর বাকি অঙ্গ প্রত্যঙ্গ গয়নাগাঁটি খুঁজতে অখন্ড ভারতের কোণা কোণা দৌড়োতে লাগলেন। সব খুঁটিয়ে পেলে ডাক্তারভ্রাতারা শিবপত্নীরও প্লাস্টিক সার্জারি করতে পারেন। শ্বশুরশাশুড়ির দেখভালের জন্য পোষা নন্দীকে রেখে গেলেন।
নন্দী এখানে ভক্তদের সব আব্দার রাখেন। আমার চার বছরের ছেলে নন্দীর কানে কানে ফিসফিস করে সশব্দে হটহুইলস ট্রিকট্র্যাকের লেটেস্ট সেটটা চেয়েছিল। ফিরে আসার পর নন্দীর মাহাত্ম্যের মান রাখতে সেটা তাকে কিনে দেওয়া হয়েছিল বৈকি !
মনে রাখতে হবে এই স্থানে সতী জন্মেছেন, বড় হয়েছেন। এখানেই অগ্নিসাক্ষী করে সতী ও শিবের বিবাহ হয়েছে। পতিপ্রেমের আবেগে এখানেই সতীর মৃত্যু। আবার সতীপতি শম্ভুর পত্নীপ্রেমের চূড়ান্ত প্রকাশ তান্ডব এই কনখলের মাটিতেই। তাই এখানে পতিপত্নী সতী মায়াদেবী ও ভৈরব দক্ষেশ্বর সমগুরুত্বে সমান জনপ্রিয়।
: কনখল :
তিনদিন ধরে বেনারসের গলি গলি ঘুরে দুধ জিলাবি রাবড়ি পান প্যাড়া গণ্ডেপিণ্ডে গিলে ছেলে ট্যাঁকে গুঁজে চারদিন ধরে লক্ষ্নৌ ঘুরে টুরে চললাম সেবারের শেষ গন্তব্য সতীর বাপের বাড়ি।
নামটা হরদ্বার না হরিদ্বার তা নিয়ে বিষম গোল। জায়গাটা আরও উত্তরে যাওয়ার "দ্বার" এ বিষয়ে সবাই একমত ; কিন্তু কেদারেশ্বর শিবের কাছে যাওয়ার দরজা, না বদ্রীনাথ বিষ্ণুর কাছে ....এ নিয়ে শৈব আর বৈষ্ণবদের মতভেদ চিরকালীন।
পীঠস্থান ভিন্ন অন্য কোন গল্প এই সিরিজে আমার লেখার বিষয় নয়। তাই সোজাসুজি পৌঁছে যাই সতীর পিত্রালয় পীঠস্থানের কারণভূমি দক্ষগৃহে।
কনখল যেতে হয় হরিদ্বার থেকে। এখানেই ছিল যজুর্বেদীয় মহাজ্ঞানী রাজা দক্ষের বাড়ি। দুর্গা-উপাসক দক্ষ তাঁর জ্ঞান ও পূজার দ্বারা সতীরূপী মায়াদেবী দুর্গার জনক হবার সৌভাগ্য লাভ করেন। ছোট্ট থেকেই সতী শিবপূজারিণী তথা শিবাকাঙ্ক্ষিণী। দক্ষপুরীর অদূরেই যে বেলগাছের বনে তিনি শিবার্চনা করতেন, সেখানে এখনও বিল্বকেশ্বরের মন্দিরে রয়েছেন লিঙ্গেশ্বর মহাদেব।
নিজের স্বয়ম্বরে মহাদেবকে অনুপস্থিত দেখে তাঁর উদ্দেশ্যে সতী আকাশে বরমাল্য নিক্ষেপ করলে সে ফুলহার গলায় পরিহিত হয়ে ভস্মাবৃত বাঘছালশোভিত জটাধারী শম্ভু স্বয়ম্বরসভায় আবির্ভূত হলেন এবং ঘোর অনিচ্ছা সত্ত্বেও কন্যাদায়গ্রস্ত পিতা দক্ষ সতীর জেদের কাছে পরাভূত হয়ে তাঁকে শ্মশানচারীর হাতে সম্প্রদান করলেন। ঋগ্বেদীয় অলৌকিক দেবত্ব আর যজুর্বেদীয় আপন ভাগ্য আপন কর্মে তৈরী করার আত্মাভিমানের সিম্বলস্বরূপ শ্বশুর জামাতার সম্পর্কের মধ্যে সূক্ষ্ম ফাটল চিরস্থায়ী হল।
শিব ব্যতীত অনুষ্ঠিত যজ্ঞে অনাহূত সতী দশমহাবিদ্যার ছলে, লাস্যে, বিভঙ্গে, ভয়াবহতায়, বিভীষিকায়, অভিমানে, অপরূপতায়, বিদ্যায়, অবিদ্যায় মহাদেবের সম্মতি আদায় করতে না পেরে অবশেষে নিরুপায়তার রূপ দরিদ্র অশক্ত বৃদ্ধা ধূমাবতীতে শিবকে পর্যদুস্ত করে ষণ্ডারোহন করে পিতৃগৃহ কনখলে উপস্থিত হলেন।
বিবাহিতা মহিলাদের এ এক বিষম সমস্যা, না পারে পিতাকে ভুলতে, না পারে পতিকে অগ্রাহ্য করতে। আমাদের দেশে মেয়েরা আপনগৃহে বড়ো হয় অন্য পরিবারের গচ্ছিত সম্পদ হিসেবে, অথচ পরবর্তীকালে আপন অধিকারে সেই অন্য পরিবারে গিয়ে সেখানেও সে বহুলাংশেই আপদ হিসেবে পরিগণিত হয়। মেয়েরা না পারে দুই পরিবারেরই আপন হতে, না পারে কোন পরিবারকেই পর করতে। এই দ্বিধান্বিত বিপদে সে শ্বাস নিয়ে চললেও আসলে অনেক আগেই সংসারাগ্নিতে আত্মাহুতি দিয়ে ফেলে।
মানবকন্যা দেবী সতীরও একই দশা হল। প্রাণাধিক প্রিয় পতির আপত্তি অগ্রাহ্য করে পরম ভালোবাসা আর বিশ্বাস নিয়ে পিতৃগৃহে এসে পিতারই মুখে পতির নিন্দা শুনে পিতৃদত্ত পার্থিব শরীর অন্তরস্থ শোকাগ্নিতে আহুতি দিলেন।
দুঃসংবাদ পেয়ে ক্রুদ্ধ মহাদেব দৌড়ে এসে শ্বশুরের মুন্ডচ্ছেদন করে যজ্ঞকুণ্ডে নিক্ষেপ করলেন এবং মৃতা স্ত্রীর দেহ কাঁধে তুলে প্রবল তান্ডবনৃত্য শুরু করলেন। প্রলয়ঙ্করী সেই নৃত্য থামাতে বিষ্ণু সুদর্শনচক্র নিক্ষেপ করে সতীদেহ একান্ন টুকরো করলেন।
সতীর দেহের নানা অঙ্গ অবিভক্ত ভারতের নানা স্থানে ছড়িয়ে পড়ল। কেবল যে অঙ্গটি শিবের কাঁধ স্পর্শ করে ছিল, সতীর সেই দেহাবশেষ জঠর (মতান্তরে নাভি ) পড়ে রইল কনখলের যজ্ঞস্থলেই। তৈরী হল গঙ্গার ক্ষীণস্রোত এক পবিত্র জলাধার ; সতীকুণ্ড।
আর পত্নীবিয়োগের ক্রোধের সঙ্গে প্রিয়া হারানোর যে হাহাকার মিশে রয়েছিল, তা অশ্রুবিন্দু হয়ে রুদ্রের অক্ষি থেকে ভূমিতে ঝরে পড়ল ; সেই সব স্থানে জন্ম নিল পুরুষের প্রেমের অপূর্ব প্রতীক রুদ্রাক্ষ ফল সমৃদ্ধ পুণ্যবৃক্ষ।
এদিকে যজ্ঞ সম্পূর্ণ করার জন্য শিবকে সবাই অনুরোধ করলেন দক্ষকে পুনরুজ্জীবিত করতে। শিবের মাথা ততক্ষণে একটু ঠান্ডা হয়েছে। ভেবে দেখলেন বউয়ের বাবার মাথা কাটায় বউ তো মরেও শান্তি পাবেনা। কিন্তু দক্ষের মাথা ততক্ষণে যজ্ঞাগ্নিতে পুড়ে ছাই।
অগত্যা বলির জন্য আনা ছাগলের মুণ্ডু কেটে স্বর্গের ডাক্তারভ্রাতা অশ্বিনীকুমারদ্বয় দক্ষের ঘাড়ের ওপর প্লাস্টিক সার্জারি করে সেট করে দিলেন। ব্রহ্মা মন্ত্র পড়ে লাইফ সাপোর্ট সিস্টেমে রাখা দক্ষের প্রাণ ফিরিয়ে দিলেন। ছাগমুণ্ড দক্ষ দম্ভ বিসর্জন দিয়ে জামাতারূপী মঙ্গলময় শিবের আরাধনা করলেন। তাই এখানে মহাদেব দক্ষেশ্বর নামে অভিহিত।
যজ্ঞ সম্পূর্ণ হলে জামাতা শিব পত্নীর বাকি অঙ্গ প্রত্যঙ্গ গয়নাগাঁটি খুঁজতে অখন্ড ভারতের কোণা কোণা দৌড়োতে লাগলেন। সব খুঁটিয়ে পেলে ডাক্তারভ্রাতারা শিবপত্নীরও প্লাস্টিক সার্জারি করতে পারেন। শ্বশুরশাশুড়ির দেখভালের জন্য পোষা নন্দীকে রেখে গেলেন।
নন্দী এখানে ভক্তদের সব আব্দার রাখেন। আমার চার বছরের ছেলে নন্দীর কানে কানে ফিসফিস করে সশব্দে হটহুইলস ট্রিকট্র্যাকের লেটেস্ট সেটটা চেয়েছিল। ফিরে আসার পর নন্দীর মাহাত্ম্যের মান রাখতে সেটা তাকে কিনে দেওয়া হয়েছিল বৈকি !
মনে রাখতে হবে এই স্থানে সতী জন্মেছেন, বড় হয়েছেন। এখানেই অগ্নিসাক্ষী করে সতী ও শিবের বিবাহ হয়েছে। পতিপ্রেমের আবেগে এখানেই সতীর মৃত্যু। আবার সতীপতি শম্ভুর পত্নীপ্রেমের চূড়ান্ত প্রকাশ তান্ডব এই কনখলের মাটিতেই। তাই এখানে পতিপত্নী সতী মায়াদেবী ও ভৈরব দক্ষেশ্বর সমগুরুত্বে সমান জনপ্রিয়।