নতুনপথে কেদারনাথ
-- শ্রীধর বন্দ্যোপাধ্যায়
(২০১৩ সালের ১৭ই জুন সকালে এক প্রলয়ঙ্কর বন্যায় বিধ্বস্ত হয় কেদারনাথ উপত্যকা, শুধু মন্দির বাদে প্রায় সবকিছুই ভেসে যায় মন্দাকিনীর জলে। ধুয়ে মুছে সাফ হয়ে যায় কেদারনাথ পৌঁছানোর প্রাচীন পায়ে চলা পথটাও। উত্তরাখণ্ড সরকার, ভারত সরকার, নেহেরু ইন্সটিটিউট অফ মাউন্টেনিয়ারিং এবং ইণ্ডিয়ান আর্মির অক্লান্ত পরিশ্রমে ২০১৪ সালেই তৈরি করা শুরু হয় কেদারনাথের নতুনপথ। সেই নির্মীয়মান নতুনপথেই আমরা ঘুরে এলাম কেদারনাথ, ২০১৫র অক্টোবরে। কেমন সেই পথ, প্রলয়ের পর কেমনই বা আছে কেদারনাথ উপত্যকা ও তার অধিবাসীরা? সেইসব অভিজ্ঞতাই ভাগ করে নেব ‘যথা ইচ্ছা তথা যা’র সদস্যদের সাথে বেশ কয়েকটি পর্বে। আজ রইল প্রথম পর্ব)
প্রথম পর্ব
১৯শে অক্টোবর ২০১৫, ভোর সাড়ে পাঁচটা। দুন এক্সপ্রেস এই কিছুক্ষণ হল আমাদের নামিয়েছে হরিদ্বার স্টেশনে। হরিদ্বার এই নিয়ে আমার তৃতীয় বার। প্রথম এসেছিলাম তখন ২০০৬ সাল, সদ্য মাধ্যমিক দিয়েছি; সঙ্গে জেঠু ছাড়াও বাবা, মা ও দিদি ছিল। সেবারও এসেছিলাম এই দুন এক্সপ্রেসেই। কাজেই এবছর জুলাই মাসে জেঠু যখন বলল যে উপাসনায় টিকিট পাওয়া যায়নি, দুনেই যেতে হবে, তখন মন্দ লাগেনি। ন’বছর আগের দুন এক্সপ্রেসে যাত্রার অনেক স্মৃতি মনে ভিড় করছিল।
এবছর আমরা চারজন। জেঠু, আমি আর আমার দুই বন্ধু অতনু ও শ্রীকৃষ্ণ। কৃষ্ণ মুর্শিদাবাদের ছেলে, আমার কলেজের বন্ধু। আমার ছিল কেমিস্ট্রি আর ওর সংস্কৃত। সাবজেক্ট আলাদা হলেও আমাদের বন্ধুত্ব ছিল গলায় গলায়, তাই যখন কৃষ্ণকে বললাম পুজোয় কেদারনাথ যাচ্ছি ও আসবার জন্যে এক পায়ে খাড়া। অতনু হাওড়ার বাসিন্দা। ওর সাথে আলাপ বেড়ানোর সুত্রে, দুবছর আগে এই হরিদ্বারেই। ও পলিটেকনিকের ছাত্র। আমার কলেজ বিদ্যামন্দির, আর অতনুর কলেজ শিল্পমন্দির। বেলুড়মঠের দোরগোড়ায় আমাদের দুজনের কলেজ ছিল একদম পাশাপাশি। যদিও কলেজে পড়ার সময় কেউ কাউকে চিনতাম না। আরেক বন্ধু, রামকৃষ্ণ, ওরও আসার কথা ছিল, কিন্তু শেষমুহুর্তে বাড়ির কিছু সমস্যায় পড়ে গিয়ে তার আর আসা হয়নি। ট্রেন ছাড়ার পর থেকেই রামকৃষ্ণের ফোন আসছিল, সশরীরে না আসতে পারলেও ওর মন পড়ে ছিল আমাদের সাথেই।
দুন এক্সপ্রেসের যাত্রার শুরুর দিকটা মন্দ হয়নি। ভোর হতে না হতেই গয়া, সকাল দশটায় বারাণসী। গঙ্গার উপর রেলের ব্রীজ পার হতে হতে মনে পড়ে যাচ্ছিল নবছর আগে প্রথমবার বারাণসী দেখে মুগ্ধ হওয়ার কথা। একে একে পেরিয়ে গেল অযোধ্যা, ফৈজাবাদ। দুন বেশ ভালোই ছুটছে, প্রায় রাইট টাইম। সমস্যাটা প্রথম দেখা দিল লক্ষ্ণৌয়ে। ট্রেন স্টেশনে ঢুকতে না ঢুকতেই অন্তত জনা পঞ্চাশেক যুবক উঠে পড়ল আমাদের সংরক্ষিত কামরায়। তাদের সে কি দাপট। অতনুকে তো নিজের জায়গা থেকেই তুলে দিল। গোটা কামরায় চরম বিশৃঙ্খলা, চিৎকার চেঁচামেচি। আমি খানিকটা ধাক্কাধাক্কি করেই আমার আর জেঠুর জায়গাটা দখলমুক্ত রাখলাম। কোথায় টিটি আর কোথায়ই বা জি আর পি?
ঘণ্টা খানেক বাদে টিটি এলো, যার কাছ থেকে যেমন পারল টাকা নিল, তারপর চলে গেল। খুব ইচ্ছা করছিল টিটিকে ঘা কতক দিই, কিন্তু লক্ষ্ণৌয়ের যুবকদের সংখ্যা আর চেহারা দেখে মনের রাগ মনে মনেই হজম করে নিলাম। বাকি রাতটা আমার আপার বার্থে আমি আর অতনু বসে রইলাম। সারারাত ধরে ভেবেছি হরিদ্বারে নেমেই স্টেশন মাষ্টারের কাছে টিটির নামে অভিযোগ জানাবো। কিন্তু হরিদ্বারে নেমে ভোরের ঠাণ্ডা হাওয়ায় শরীরের সাথে মনটাও যেন জুড়িয়ে গেল, অভিযোগ করতে আর ইচ্ছা হলনা। হয়ত দেবভূমির প্রভাব, অথবা আমার তামসিকতা।
হরিদ্বারে সকাল।
সূর্য উঠতে এখনও দেরি আছে, চারিদিক বেশ অন্ধকার। দূরে পাহাড়ের মাথায়, বেশ খানিকটা উঁচুতে, দেখা যাচ্ছে মনসা দেবীর মন্দির। আলোয় আলোয় উদ্ভাসিত। এখন নবরাত্রি চলছে, আজ দুর্গাষষ্ঠী, তাই হয়ত এত আলোর সাজ। স্টেশনের বাইরে থেকে অটোয় চাপলাম, গন্তব্য বিষ্ণুঘাটের রাজস্থান গেস্ট হাউস। হরিদ্বার শহরকে জেঠুর সেকেন্ড হোম বলা চলে। প্রায় চল্লিশ বছর ধরে প্রতি বছর আসছে, কোনও কোনও বছর একাধিকবার। আগে উঠত ভোলাগিরির ধর্মশালায়, এখন ওঠে রাজস্থান গেস্ট হাউস অথবা কালীবাড়ি গেস্ট হাউসে। দুটো গেস্ট হাউসের নাম আলাদা হলেও আসলে একটিই বাড়ির দুটো ভাগ, রিসেপশানও একজায়গাতেই। চেনা পরিচিতি থাকায় আগে থেকে ফোন করে বুকিং করা হয়নি, একেবারে গিয়ে হাজির হওয়া যাবে। রাস্তাঘাট ফাঁকা, হরিদ্বার শহর এখনো ঘুম থেকে ওঠেনি; তাই দেখতে দেখতে চলে এলাম বিষ্ণুঘাট। রাজস্থান গেস্ট হাউস ভরতি, কাজেই ঠাই হল কালীবাড়িতে। হাতমুখ ধুয়ে, জামা কাপড় পালটে, চলে এলাম গঙ্গার ঘাটে। সেই অতি পরিচিত বিষ্ণুঘাট, প্রবল স্রোতে উচ্ছলা গঙ্গা, হিমশীতল জল আর কুল কুল শব্দ। তখন সদ্য সূর্যোদয় হচ্ছে, লাল আলোয় ঝলমল করছে গঙ্গা। ওপাড়ে মাইল দুয়েক দূরে দেখা যাচ্ছে নীলপর্বত, যার মাথায় দেবী চণ্ডীর মন্দির।
আগের দুবারই চণ্ডী মন্দির দর্শনে গিয়েছি, প্রথমবার উড়ন খাটোলা অর্থাৎ রোপ ওয়েতে, দ্বিতীয়বারে পায়ে হেঁটে। এবারে সময় কম, তাই আর যাওয়া হবে না চণ্ডীপাহাড়ে। সেজন্য দূর থেকেই প্রণাম জানালাম মা চণ্ডীকে। কাল সকালেই রওনা দেব কেদারনাথের উদ্দেশ্যে। পথে ষোল কিলোমিটার চড়াই ভাঙ্গতে হবে। বাড়িতে থাকতে শারীরিক পরিশ্রমের কাজ তেমন একটা করা হয় না, তাই ঠিক করা হল চা খেয়েই ঘুরে আসব শহরের পাশেই, মনসা পাহাড়ে। মনসা দেবীর দর্শনও হবে আবার একটু ওয়ার্ম আপও হবে। মাইল খানেক পথে ছশো ফুট চড়াই উঠতে হবে, কেদারনাথের চড়াইয়ের কাছে এ কিছুই নয়, তবুও পাহাড়ের পথে হাঁটলেই মনে সাহস আসে, উতসাহ বাড়ে।
মনসা পাহাড়ের উপর থেকে শ্যেনদৃষ্টিতে হরিদ্বার শহর। অনেকদূরে দেখা যাচ্ছে নীলপর্বত (চণ্ডীপাহাড়)।
বিষ্ণুঘাটের পাশেই সবজিমণ্ডী, অর্থাৎ বাজার। সবজিমণ্ডীর পশ্চিমপ্রান্ত থেকে মনসা পাহাড়ে ওঠার পায়ে চলা পথ। শুরুতে খানিকটা সিঁড়ি ভেঙ্গে তারপর পিচঢালা সুন্দর রাস্তা, মাঝে মধ্যেই পাশ দিয়ে হুস করে বেড়িয়ে যাচ্ছে স্কুটি, বাইক। রাস্তার ধারে ধারে বসে আছে অজস্র বাঁদর। অত্যন্ত ভালোমানুষের মত চাহনি, কিন্তু সুযোগ পেলেই প্রসাদের প্যাকেট ছিনিয়ে নিতে এরা অত্যন্ত নিপুন। আধঘন্টা একটানা হেঁটে পৌঁছে গেলাম পাহাড়ের মাথায়, মনসা মন্দিরে। নীচে কুয়াশা ঘেরা হরিদ্বার শহর, অদ্ভুত সুন্দর দৃশ্য। ভক্তের মনস্কামনা পুর্ণ করেন দেবী, নাম তাই মনসা। পুজো দিয়ে আমরাও আমাদের মনস্কামনা জানালাম। নির্বিঘ্নে কেদারনাথ পৌঁছানই তখন আমাদের সবচেয়ে বড় প্রার্থনা। পরে বুঝেছিলাম তিনি আমাদের সে প্রার্থনা শুনেছেন।
এবার নামার পালা। ফিরতি পথে একটানা উতরাই। শ্রম নেই, কোনও তাড়াও নেই। ধীরে সুস্থে নামছি, আর মাঝে মাঝে দাঁড়িয়ে মুগ্ধ হয়ে দেখছি সকালের নরম রোদে ভেজা শিবালিক পর্বতকে, ধাপে ধাপে উত্তরদিকে উঠে চলেছে একটানা। সকালে আকাশ পরিষ্কার থাকলে অনেক দূরের চূড়া দেখা যায়, বেলা বাড়লে কুয়াশা আর ধুলোকণার জন্য আর দেখা যায় না। রাস্তার ধারে বিক্রি হচ্ছে জড়িবুটি, আদা, বিভিন্ন ধরণের রঙ্গিন পাথর, কন্দমূল। কন্দমূল পাওয়া যাচ্ছে দশ টাকায় চার ফালি। রামচন্দ্র বনবাসের সময় নাকি এই কন্দমূল খেয়েই জীবনধারণ করতেন।
কন্দমূল খেতে খুব সুস্বাদু নয়, তবে একফালি খেলেই বেশ খানিকক্ষণের জন্য জল পিপাসার হাত থেকে ছুটি।
#কেদারনাথ #হরিদ্বার #হিমালয় #বরফ #শৃঙ্গ #মহাদেব #কৃষ্ণ #পঞ্চপান্ডব #ভীমশিলা
#রাম #সীতা #চড়াই #উতরাই #মনসা #দেবী
#Kedarnath #Haridwar#Himalaya #BRAF #ice #peak #mahadev #shib #Krishna #panchapandava #pandava #Bhima #bhimrock #RAM #Sita #chatai #utrai #manasa #গঙ্গা #Ganga #nilparbat #নীল #পর্বত #bluehill#blue #Hill
Last edited by Admin on Sat Mar 17, 2018 2:31 pm; edited 1 time in total