Churn : Universal Friendship
Welcome to the CHURN!

To take full advantage of everything offered by our forum,
Please log in if you are already a member,
or
Join our community if you've not yet.


Churn : Universal Friendship
Welcome to the CHURN!

To take full advantage of everything offered by our forum,
Please log in if you are already a member,
or
Join our community if you've not yet.

Churn : Universal Friendship
Would you like to react to this message? Create an account in a few clicks or log in to continue.

Churn : Universal Friendship Log in

PEACE , LOVE and UNITY


নতুন পথে কেদারনাথ Kedarnath trekking

power_settings_newLogin to reply

descriptionনতুন পথে কেদারনাথ Kedarnath trekking - Page 2 Emptyনতুন পথে কেদারনাথ Kedarnath trekking

more_horiz
First topic message reminder :

নতুনপথে কেদারনাথ

নতুন পথে কেদারনাথ Kedarnath trekking - Page 2 13603710
নতুন পথে কেদারনাথ Kedarnath trekking - Page 2 13131410

-- শ্রীধর বন্দ্যোপাধ্যায়
(২০১৩ সালের ১৭ই জুন সকালে এক প্রলয়ঙ্কর বন্যায় বিধ্বস্ত হয় কেদারনাথ উপত্যকা, শুধু মন্দির বাদে প্রায় সবকিছুই ভেসে যায় মন্দাকিনীর জলে। ধুয়ে মুছে সাফ হয়ে যায় কেদারনাথ পৌঁছানোর প্রাচীন পায়ে চলা পথটাও। উত্তরাখণ্ড সরকার, ভারত সরকার, নেহেরু ইন্সটিটিউট অফ মাউন্টেনিয়ারিং এবং ইণ্ডিয়ান আর্মির অক্লান্ত পরিশ্রমে ২০১৪ সালেই তৈরি করা শুরু হয় কেদারনাথের নতুনপথ। সেই নির্মীয়মান নতুনপথেই আমরা ঘুরে এলাম কেদারনাথ, ২০১৫র অক্টোবরে। কেমন সেই পথ, প্রলয়ের পর কেমনই বা আছে কেদারনাথ উপত্যকা ও তার অধিবাসীরা? সেইসব অভিজ্ঞতাই ভাগ করে নেব ‘যথা ইচ্ছা তথা যা’র সদস্যদের সাথে বেশ কয়েকটি পর্বে। আজ রইল প্রথম পর্ব)

প্রথম পর্ব

১৯শে অক্টোবর ২০১৫, ভোর সাড়ে পাঁচটা। দুন এক্সপ্রেস এই কিছুক্ষণ হল আমাদের নামিয়েছে হরিদ্বার স্টেশনে। হরিদ্বার এই নিয়ে আমার তৃতীয় বার। প্রথম এসেছিলাম তখন ২০০৬ সাল, সদ্য মাধ্যমিক দিয়েছি; সঙ্গে জেঠু ছাড়াও বাবা, মা ও দিদি ছিল। সেবারও এসেছিলাম এই দুন এক্সপ্রেসেই। কাজেই এবছর জুলাই মাসে জেঠু যখন বলল যে উপাসনায় টিকিট পাওয়া যায়নি, দুনেই যেতে হবে, তখন মন্দ লাগেনি। ন’বছর আগের দুন এক্সপ্রেসে যাত্রার অনেক স্মৃতি মনে ভিড় করছিল।


এবছর আমরা চারজন। জেঠু, আমি আর আমার দুই বন্ধু অতনু ও শ্রীকৃষ্ণ। কৃষ্ণ মুর্শিদাবাদের ছেলে, আমার কলেজের বন্ধু। আমার ছিল কেমিস্ট্রি আর ওর সংস্কৃত। সাবজেক্ট আলাদা হলেও আমাদের বন্ধুত্ব ছিল গলায় গলায়, তাই যখন কৃষ্ণকে বললাম পুজোয় কেদারনাথ যাচ্ছি ও আসবার জন্যে এক পায়ে খাড়া। অতনু হাওড়ার বাসিন্দা। ওর সাথে আলাপ বেড়ানোর সুত্রে, দুবছর আগে এই হরিদ্বারেই। ও পলিটেকনিকের ছাত্র। আমার কলেজ বিদ্যামন্দির, আর অতনুর কলেজ শিল্পমন্দির। বেলুড়মঠের দোরগোড়ায় আমাদের দুজনের কলেজ ছিল একদম পাশাপাশি। যদিও কলেজে পড়ার সময় কেউ কাউকে চিনতাম না। আরেক বন্ধু, রামকৃষ্ণ, ওরও আসার কথা ছিল, কিন্তু শেষমুহুর্তে বাড়ির কিছু সমস্যায় পড়ে গিয়ে তার আর আসা হয়নি। ট্রেন ছাড়ার পর থেকেই রামকৃষ্ণের ফোন আসছিল, সশরীরে না আসতে পারলেও ওর মন পড়ে ছিল আমাদের সাথেই।

দুন এক্সপ্রেসের যাত্রার শুরুর দিকটা মন্দ হয়নি। ভোর হতে না হতেই গয়া, সকাল দশটায় বারাণসী। গঙ্গার উপর রেলের ব্রীজ পার হতে হতে মনে পড়ে যাচ্ছিল নবছর আগে প্রথমবার বারাণসী দেখে মুগ্ধ হওয়ার কথা। একে একে পেরিয়ে গেল অযোধ্যা, ফৈজাবাদ। দুন বেশ ভালোই ছুটছে, প্রায় রাইট টাইম। সমস্যাটা প্রথম দেখা দিল লক্ষ্ণৌয়ে। ট্রেন স্টেশনে ঢুকতে না ঢুকতেই অন্তত জনা পঞ্চাশেক যুবক উঠে পড়ল আমাদের সংরক্ষিত কামরায়। তাদের সে কি দাপট। অতনুকে তো নিজের জায়গা থেকেই তুলে দিল। গোটা কামরায় চরম বিশৃঙ্খলা, চিৎকার চেঁচামেচি। আমি খানিকটা ধাক্কাধাক্কি করেই আমার আর জেঠুর জায়গাটা দখলমুক্ত রাখলাম। কোথায় টিটি আর কোথায়ই বা জি আর পি?

ঘণ্টা খানেক বাদে টিটি এলো, যার কাছ থেকে যেমন পারল টাকা নিল, তারপর চলে গেল। খুব ইচ্ছা করছিল টিটিকে ঘা কতক দিই, কিন্তু লক্ষ্ণৌয়ের যুবকদের সংখ্যা আর চেহারা দেখে মনের রাগ মনে মনেই হজম করে নিলাম। বাকি রাতটা আমার আপার বার্থে আমি আর অতনু বসে রইলাম। সারারাত ধরে ভেবেছি হরিদ্বারে নেমেই স্টেশন মাষ্টারের কাছে টিটির নামে অভিযোগ জানাবো। কিন্তু হরিদ্বারে নেমে ভোরের ঠাণ্ডা হাওয়ায় শরীরের সাথে মনটাও যেন জুড়িয়ে গেল, অভিযোগ করতে আর ইচ্ছা হলনা। হয়ত দেবভূমির প্রভাব, অথবা আমার তামসিকতা।
হরিদ্বারে সকাল।

সূর্য উঠতে এখনও দেরি আছে, চারিদিক বেশ অন্ধকার। দূরে পাহাড়ের মাথায়, বেশ খানিকটা উঁচুতে, দেখা যাচ্ছে মনসা দেবীর মন্দির। আলোয় আলোয় উদ্ভাসিত। এখন নবরাত্রি চলছে, আজ দুর্গাষষ্ঠী, তাই হয়ত এত আলোর সাজ। স্টেশনের বাইরে থেকে অটোয় চাপলাম, গন্তব্য বিষ্ণুঘাটের রাজস্থান গেস্ট হাউস। হরিদ্বার শহরকে জেঠুর সেকেন্ড হোম বলা চলে। প্রায় চল্লিশ বছর ধরে প্রতি বছর আসছে, কোনও কোনও বছর একাধিকবার। আগে উঠত ভোলাগিরির ধর্মশালায়, এখন ওঠে রাজস্থান গেস্ট হাউস অথবা কালীবাড়ি গেস্ট হাউসে। দুটো গেস্ট হাউসের নাম আলাদা হলেও আসলে একটিই বাড়ির দুটো ভাগ, রিসেপশানও একজায়গাতেই। চেনা পরিচিতি থাকায় আগে থেকে ফোন করে বুকিং করা হয়নি, একেবারে গিয়ে হাজির হওয়া যাবে। রাস্তাঘাট ফাঁকা, হরিদ্বার শহর এখনো ঘুম থেকে ওঠেনি; তাই দেখতে দেখতে চলে এলাম বিষ্ণুঘাট। রাজস্থান গেস্ট হাউস ভরতি, কাজেই ঠাই হল কালীবাড়িতে। হাতমুখ ধুয়ে, জামা কাপড় পালটে, চলে এলাম গঙ্গার ঘাটে। সেই অতি পরিচিত বিষ্ণুঘাট, প্রবল স্রোতে উচ্ছলা গঙ্গা, হিমশীতল জল আর কুল কুল শব্দ। তখন সদ্য সূর্যোদয় হচ্ছে, লাল আলোয় ঝলমল করছে গঙ্গা। ওপাড়ে মাইল দুয়েক দূরে দেখা যাচ্ছে নীলপর্বত, যার মাথায় দেবী চণ্ডীর মন্দির।

আগের দুবারই চণ্ডী মন্দির দর্শনে গিয়েছি, প্রথমবার উড়ন খাটোলা অর্থাৎ রোপ ওয়েতে, দ্বিতীয়বারে পায়ে হেঁটে। এবারে সময় কম, তাই আর যাওয়া হবে না চণ্ডীপাহাড়ে। সেজন্য দূর থেকেই প্রণাম জানালাম মা চণ্ডীকে। কাল সকালেই রওনা দেব কেদারনাথের উদ্দেশ্যে। পথে ষোল কিলোমিটার চড়াই ভাঙ্গতে হবে। বাড়িতে থাকতে শারীরিক পরিশ্রমের কাজ তেমন একটা করা হয় না, তাই ঠিক করা হল চা খেয়েই ঘুরে আসব শহরের পাশেই, মনসা পাহাড়ে। মনসা দেবীর দর্শনও হবে আবার একটু ওয়ার্ম আপও হবে। মাইল খানেক পথে ছশো ফুট চড়াই উঠতে হবে, কেদারনাথের চড়াইয়ের কাছে এ কিছুই নয়, তবুও পাহাড়ের পথে হাঁটলেই মনে সাহস আসে, উতসাহ বাড়ে।
মনসা পাহাড়ের উপর থেকে শ্যেনদৃষ্টিতে হরিদ্বার শহর। অনেকদূরে দেখা যাচ্ছে নীলপর্বত (চণ্ডীপাহাড়)।

বিষ্ণুঘাটের পাশেই সবজিমণ্ডী, অর্থাৎ বাজার। সবজিমণ্ডীর পশ্চিমপ্রান্ত থেকে মনসা পাহাড়ে ওঠার পায়ে চলা পথ। শুরুতে খানিকটা সিঁড়ি ভেঙ্গে তারপর পিচঢালা সুন্দর রাস্তা, মাঝে মধ্যেই পাশ দিয়ে হুস করে বেড়িয়ে যাচ্ছে স্কুটি, বাইক। রাস্তার ধারে ধারে বসে আছে অজস্র বাঁদর। অত্যন্ত ভালোমানুষের মত চাহনি, কিন্তু সুযোগ পেলেই প্রসাদের প্যাকেট ছিনিয়ে নিতে এরা অত্যন্ত নিপুন। আধঘন্টা একটানা হেঁটে পৌঁছে গেলাম পাহাড়ের মাথায়, মনসা মন্দিরে। নীচে কুয়াশা ঘেরা হরিদ্বার শহর, অদ্ভুত সুন্দর দৃশ্য। ভক্তের মনস্কামনা পুর্ণ করেন দেবী, নাম তাই মনসা। পুজো দিয়ে আমরাও আমাদের মনস্কামনা জানালাম। নির্বিঘ্নে কেদারনাথ পৌঁছানই তখন আমাদের সবচেয়ে বড় প্রার্থনা। পরে বুঝেছিলাম তিনি আমাদের সে প্রার্থনা শুনেছেন।

এবার নামার পালা। ফিরতি পথে একটানা উতরাই। শ্রম নেই, কোনও তাড়াও নেই। ধীরে সুস্থে নামছি, আর মাঝে মাঝে দাঁড়িয়ে মুগ্ধ হয়ে দেখছি সকালের নরম রোদে ভেজা শিবালিক পর্বতকে, ধাপে ধাপে উত্তরদিকে উঠে চলেছে একটানা। সকালে আকাশ পরিষ্কার থাকলে অনেক দূরের চূড়া দেখা যায়, বেলা বাড়লে কুয়াশা আর ধুলোকণার জন্য আর দেখা যায় না। রাস্তার ধারে বিক্রি হচ্ছে জড়িবুটি, আদা, বিভিন্ন ধরণের রঙ্গিন পাথর, কন্দমূল। কন্দমূল পাওয়া যাচ্ছে দশ টাকায় চার ফালি। রামচন্দ্র বনবাসের সময় নাকি এই কন্দমূল খেয়েই জীবনধারণ করতেন।

কন্দমূল খেতে খুব সুস্বাদু নয়, তবে একফালি খেলেই বেশ খানিকক্ষণের জন্য জল পিপাসার হাত থেকে ছুটি।

#কেদারনাথ #হরিদ্বার #হিমালয় #বরফ #শৃঙ্গ #মহাদেব #কৃষ্ণ #পঞ্চপান্ডব #ভীমশিলা
#রাম #সীতা #চড়াই #উতরাই #মনসা #দেবী
#Kedarnath #Haridwar#Himalaya #BRAF #ice #peak #mahadev #shib #Krishna #panchapandava #pandava #Bhima #bhimrock #RAM #Sita #chatai #utrai #manasa #গঙ্গা #Ganga #nilparbat #নীল #পর্বত #bluehill#blue #Hill

Last edited by Admin on Sat Mar 17, 2018 2:31 pm; edited 1 time in total

descriptionনতুন পথে কেদারনাথ Kedarnath trekking - Page 2 EmptyRe: নতুন পথে কেদারনাথ Kedarnath trekking

more_horiz

দ্বাদশ পর্ব

নতুন পথে কেদারনাথ Kedarnath trekking - Page 2 13731810
নতুন পথে কেদারনাথ Kedarnath trekking - Page 2 13735010
নতুন পথে কেদারনাথ Kedarnath trekking - Page 2 13730810
নতুন পথে কেদারনাথ Kedarnath trekking - Page 2 13724810
নতুন পথে কেদারনাথ Kedarnath trekking - Page 2 13698210
নতুন পথে কেদারনাথ Kedarnath trekking - Page 2 13723810


আমরা আবার নামতে শুরু করি। আকাশের রঙ যে এত গাঢ় নীল হতে পারে, তা নিজের চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা কঠিন। পিছন ফিরে তাকালে এখনও রুদ্রাপয়েন্টের লালরঙের মেডিকেল ক্যাম্পটা দেখা যাচ্ছে, ওর ঠিক পিছনেই কেদার উপত্যকা, যার মাথায় ছাতা ধরে আছে শ্বেতশুভ্র কেদার ও কেদারডোমের যমজ শৃঙ্গদুটি। বেলা বাড়তেই পেঁজা তুলোর মতন সাদা সাদা মেঘের টুকরো এসে ভিড় করেছে তাদের চুড়ার কাছে, আর ঘণ্টাখানেক বাদেই হয়ত ঢেকে দেবে পুরোটাই।
বিজয়া দশমীর চাঁদ। আকাশ এখানে এত নীল!

নামার সময় আমরা সুযোগ পেলেই পাকদণ্ডী ব্যবহার করছি, সেগুলোতে খাড়াই অনেক বেশি, কাজেই খুব সাবধানে পা ফেলতে হচ্ছে। কিন্তু ঘুরপথের চেয়ে অনেক তাড়াতাড়ি নেমে যাচ্ছি আমরা। আপার লিঞ্চোলি থেকে লোয়ার লিঞ্চোলি নেমে এলাম মাত্র ৪৫ মিনিটে। লোয়ার লিঞ্চোলি থেকে রামবাড়ার সেতুটা দেখা যাচ্ছিল। আমরা ঠিক করলাম তাড়াতাড়ি নেমে গিয়ে রামবাড়ার সেতুর পাশে খানিক বসব, তারপর পথে আর কোথাও না দাঁড়িয়ে একটানা নেমে যাব।

লিঞ্চোলি ছাড়িয়ে দেখি একজন ভদ্রলোক উঠে আসছেন চড়াই বেয়ে, বয়স বছর পঞ্চাশেক। হাতের ব্যাগটিতে বাংলা লেখা দেখে বুঝলাম ভদ্রলোক বঙ্গজ। তিনি কিন্তু বুঝতে পারেননি যে আমরাও একগোত্রীয়। ভাঙা ভাঙা হিন্দিতে জিজ্ঞাসা করলেন যে কেদারনাথ আর কতদুর। হেসে বললাম, আপনি বাঙলায় কথা বলতে পারেন আমাদের সাথে। কেদারের পথে বাঙালি পেয়ে খুব খুশি ভদ্রলোক। জমিয়ে গল্প শুরু করলেন।

ওনার নাম গোপাল, পেশায় স্কুল মাস্টার, স্কুলের নাম শুনে বুঝলাম তিনি আমার মামার সহকর্মী। সেকথা বলতেই তিনি একেবারে আহ্লাদে আটখানা, পারলে এখনি আমায় ভাগ্নে বলে ডাকতে শুরু করেন। গোপালবাবুর সঙ্গে তাঁর স্ত্রী, ও শ্যালিকা চলেছেন কেদারনাথে। চড়াই ভাঙতে ভাঙতে তাঁরা পিছিয়ে পরেছিলেন, কাজেই প্রথমে তাঁদের দেখতে পাইনি। এখন তাঁরাও এসে গল্প জুড়লেন, কি নাম, কোথায় থাকি, কি করি, এইসব।



পথশ্রমে তিনজনেই ক্লান্ত, কিন্তু গোপালবাবুর শ্যালিকার অবস্থা সবচেয়ে খারাপ। এঁদের কেউই লাঠি নেন নি গৌরীকুণ্ড থেকে, ভেবেছিলেন লাঠি আর কি কাজে লাগবে। লাঠির মাহাত্ত্য যখন বুঝলেন তখন আর লাঠি কেনার উপায় নেই। কৃষ্ণর কাছে দুটো লাঠি ছিল, তার একটা দেওয়া হল ওঁদেরকে। গোপালবাবুকে বললাম, কেদারনাথ এখনও প্রায় পাঁচ কিলোমিটার, কিন্তু তার মধ্যে চার কিলোমিটারই বুকফাটা চড়াই, কাজেই সময় নষ্ট না করে এগিয়ে যান। গোপালবাবুরা উঠতে লাগলেন, আমরা লাগলাম নামতে।
লোয়ার লিঞ্চোলির বসত।

মাঝে মাঝে খাড়াই এত বেশি যে দেখে শিউরে উঠছি, এই চড়াই কাল আমরা উঠেছিলাম কিভাবে! রামবাড়া এসে পৌছালাম বেলা আড়াইটের সময়। মন্দাকিনীর সেতুর উপর বেশকিছুক্ষন সময় কাটালাম। মন্দাকিনীর প্রবল স্রোত, ততোধিক গর্জন। কৃষ্ণ ফটাফট ছবি নিয়ে চলেছে ক্যামেরায়। অতনু বসে আছে একটা পাথরের উপরে, আর আমি চেয়ে আছি ফেলে আসা পথের দিকে। ওই যে দূরে দেখা যাচ্ছে লোয়ার লিঞ্চোলির বাড়িঘর। মন বলছে আবার ফিরে আসব এ পথে, নিশ্চয় আসব।

সন্ধ্যার আগেই গৌরীকুণ্ড ফিরতে হবে, নাহলে সোনপ্রয়াগ যাওয়ার শেয়ারের জীপ পেতে অসুবিধা হবে। কাজেই আবার চলা শুরু করলাম। যেমনটা ভেবেছিলাম, ভীমবলিতে আর দাঁড়ালাম না। এখন পা চালিয়ে নামতে হবে। নামছি, নামছি, আর নামছি। আজ পুরো পথটাই প্রায় নামা। মনে হয় নামতে বুঝি তেমন কষ্ট নেই। কিন্তু উৎরাই পথে হাঁপিয়ে যাওয়া, বা শ্বাসকষ্টের সমস্যা না হলেও একটানা নামারও পরিশ্রম আছে। আমরা সেটা এখন টের পাচ্ছি ভালই। কাজেই পথে আর কোথাও বসব না ভাবলেও জঙ্গলচটিতে এসে আমাদের খানিক বসতেই হল।

একজায়গায় নিম্বুপানি পাওয়া যাচ্ছিল। একগ্লাস করে নিম্বুপানি খেলাম আমরা। মনে পড়ে যাচ্ছিল ওঠার সময়ে জঙ্গলচটিতে কোল্ড ড্রিঙ্কস খাওয়া, এবং তারপরে ভীমবলি পর্যন্ত আমার শোচনীয় অবস্থার কথা। নিম্বুপানি খেয়ে আবার নামা শুরু।
জঙ্গল চটি।

জঙ্গলচটি থেকে গৌরীকুণ্ড পর্যন্ত রাস্তাটা পুরোটাই বনভূমির মধ্যে দিয়ে। দুপাশের পাহাড়েই অসংখ্য গাছপালা। নামতে নামতে অতনুর সাথে আলোচনা করছিলাম যে সত্যিই এপথে পদযাত্রীর সংখ্যা এখন খুব কম। ওঠা নামা এই দুদিন মিলিয়ে খুব বেশি হলে জনা তিরিশেক মানুষকে দেখেছি হেঁটে যেতে। ঘোড়ায় চড়া যাত্রীর সংখ্যা তারচেয়ে অনেক বেশি ঠিকই, কিন্তু তাও পুরনো পথের বর্ণনা যা শুনেছি, বইয়ে পড়েছি, বা ভিডিওয় দেখেছি তার তুলনায় এ কিছুই নয়। কেদারের পথে যাত্রী সত্যিই অনেক অনেক কমে গেছে, বিপর্যয়ের পর।

হনুমানচটি পেরিয়ে গেলাম, আমরা এখন গৌরীকুণ্ডের একদম কাছে এসে পড়েছি। আমাদের বাঁদিকে পাহাড়ের মাথায় চাঁদ উঠেছে, বিজয়া দশমীর চাঁদ। আমরা নিঃশব্দে হেঁটে চলেছি। একটানা প্রায় ষোল কিলোমিটার উৎরাই পথে নেমে আমরা এখন খুব ক্লান্ত। পথ ফুরোলেই বাঁচি। অবশেষে সাড়ে পাঁচটার সময় সেই অর্ধচন্দ্রাকৃতি বাঁকে এসে পৌছালাম, ওই যে দেখা যাচ্ছে গৌরীকুণ্ডের দোকানপাট।

গৌরীকুণ্ডে এসে প্রথমেই গেলাম গৌরীমায়ের মন্দিরে। আমরা পেরেছি মা, তোমার কৃপায় কেদারনাথ দর্শন করে এসেছি। নাটমন্দিরে ঢুকে আভূমি প্রণিপাত জানালাম মাকে। বিজয়া দশমীর দিনে পশ্চিমবাংলা থেকে কয়েক হাজার কিলোমিটার দূরে পাহাড়ের গহন কোলের মধ্যে আমরা হিমালয়-দুহিতা উমারূপী-দুর্গার দর্শন পেয়ে ধন্য হলাম।

মায়ের দর্শন সেরে আমরা চললাম জীপস্ট্যাণ্ডে। কিন্তু তার আগেই একবিপত্তি। গৌরীকুণ্ডে এসে অবধি একবারের জন্যও ফোনে নেটওয়ার্ক পাচ্ছি না। এদিকে রাজুদাকে বলতে হবে যে আমরা এসে গেছি, সোনপ্রয়াগে গাড়ি নিয়ে আসতে। কিছুতেই নেটওয়ার্ক পাই না। ফোন দুয়েকবার রিস্টার্ট করলাম, তাতেও লাভ হলনা। ফোন না করতে পারলে, সোনপ্রয়াগ থেকে রামপুর পর্যন্ত ৪ কিলোমিটার পথ হেঁটে ফেরা ছাড়া গতি নেই। অথচ হাঁটার কথা ভাবলেই এখন দেহমন অবশ হয়ে আসছে। কি আর করি, যা আছে কপালে বলে জীপস্ট্যান্ডের দিকে পা বাড়ালাম।
হিমবাহের ভেঙে পড়া বরফের চাঁই।

স্ট্যান্ডে এসে দেখি জীপ রয়েছে একটাই, যাত্রী ভর্তি হলে তবে ছাড়বে। অগত্যা বসে বসে অপেক্ষা করা ছাড়া উপায় নেই। অদ্ভুত ক্লান্তিতে আচ্ছন্ন দেহ, আচ্ছন্ন মনও। তবে মনের একদম গভীরতম প্রদেশে একটা প্রচ্ছন্ন আনন্দও যেন কাজ করছে। জীপের পিছনের সিটে বসে বসে সন্ধ্যা নামা দেখছিলাম। পাহাড়ের মাথায় মাথায় রোদের লেশটুকু লেগে আছে এখনও, কিন্তু নীচের এই উপত্যকা এখন আলোআঁধারির রহস্যময়তায় ডুবে গেছে। অনেকদূরে দেখা যাচ্ছে কেদারনাথ যাওয়ার পথ, তাতে দুয়েকটা গাধা মালপত্র নিয়ে হেঁটে যাচ্ছে মাঝে মধ্যে, তাদের গলার ঘণ্টি টুংটাং শব্দ করতে করতে আস্তে আস্তে মিলিয়ে যাচ্ছে জমাট নৈশব্দে।

আধঘণ্টা বসার পরে কয়েকজন যাত্রী এলেন। এবার জীপ ছাড়বে। জীপ ছাড়ার ঠিক আগে হঠাৎ দেখি মোবাইলে সিগনাল এসেছে। সঙ্গে সঙ্গে ফোন লাগালাম রাজুদাকে। যাক এবার নিশ্চিন্ত, আর অন্তত হাঁটতে হবে না আজকে। সোনপ্রয়াগ এসে পৌছালাম যখন তখন অন্ধকার নেমে এসেছে। জীপস্ট্যাণ্ড থেকে বেরিয়েই দেখি জেঠু দাঁড়িয়ে আছে, তার চোখমুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে আনন্দে। আমরা গিয়ে প্রণাম করতেই আমাদের বুকে জড়িয়ে ধরল জেঠু, ‘যাক, তোমরা পেরেছ’।

রাজুদা আসেনি আমাদের নিতে, অন্য আরেকজন ড্রাইভারের সাথে জেঠুকে পাঠিয়ে দিয়েছে। যাইহোক, আমরা তার গাড়িতে চেপে আধঘণ্টার মধ্যে চলে এলাম রামপুরে, ‘নিউ শিবশক্তি লজে’। লজে এসে পৌঁছাতেই দেখলাম রাজুদা, অঙ্কুশ, অর্জুন, লজের মালিক সবাই সিঁড়ি বেয়ে রাস্তায় উঠে এসেছে আমাদের অভিনন্দন জানাতে। প্রত্যেকে আমাদের সঙ্গে আলিঙ্গন করল, আমাদের চেয়ে ওদের আনন্দও যেন কোন অংশেই কম নয়।

রাজুদা একটু আড়ালে ডেকে নিয়ে গিয়ে বলল, এমনিতে ও মদটদ একেবারেই খায় না তবে নেহাত আজ দশেরা, তাই একটু ‘দারু’ পান করে ফেলেছে, সেজন্যই নিজে আমাদের আনতে যেতে পারেনি। তার এই অক্ষমতার জন্য ক্ষমাটমা চেয়ে একশেষ। রাজুদা এমনিতেই বকবক করতে ওস্তাদ, তার উপর আজ আবার পেটে দুপাত্তর পড়েছে, কাজেই আজ একেবারে ফুলঝুরি ছুটছে। ইতিমধ্যে এক রাউন্ড চা দিয়ে গেছে অঙ্কুশ। কত কথাই না হল, কিছু কথার অর্থ বুঝলাম, কিছুর অর্থ বোঝার চেষ্টাও করলাম না। শেষকালে আমায় বলল আয়নায় গিয়ে নিজের চেহারাটা একবার দেখতে। আমার নাকটা নাকি ‘লিচির’ মতন লাল হয়ে গেছে। রুমে এসে আয়নায় দেখি সত্যিই নাকটা ঠান্ডায় পুড়ে গিয়েছে, রঙ হয়েছে টকটকে লাল।

রুমে ঢুকতেই টের পেলাম যে তুলতুলে গদি আর গরম কম্বল এখন আমাদের চুম্বকের মতন টানছে। জামাকাপড় ছেড়ে কোনরকমে হাতমুখ ধুয়েই কম্বলের তলায়। আধশোয়া হয়েই গল্প। আজ আবার বিজয়ে দশমী, কাজেই বাড়িতে ফোন করে বিজয়ার প্রণাম জানালাম। তারপর জেঠুর সাথে জমিয়ে গল্প। এই দুদিনের সমস্ত অভিজ্ঞতা যেন ঠেলে বেড়িয়ে আসতে চাইছে মুখ থেকে। গল্প আর ফুরোয় না।

আটটার সময় অঙ্কুশ এসে ডেকে নিয়ে গেল, খাবার রেডি। সেই মোটা মোটা রুটি, চাপ চাপ ডাল, আর ঝালঝাল সবজি; সেই অপূর্ব স্বাদ। খেতে খেতেই বুঝতে পারছিলাম শরীর আর বইছে না, সুতরাং খেয়েদেয়ে ঘরে এসেই শুয়ে পড়লাম আমরা। আজ আর গল্প নয়। দুদিন ধরে প্রচুর পরিশ্রম হয়েছে, এখন নিঝুম ঘুম দরকার।

এবারের মতন কেদারনাথ পর্ব এখানেই শেষ। কাল সকালেই রওনা দেব উখিমঠের দিকে, সেখান থেকে চোপ্তাভ্যালী দেখে ফেরার পথে রাত্রিবাস করব দেবপ্রয়াগে। পরেরদিন সেখান থেকে হরিদ্বারে। তারপর ঘরে ফেরা। যা পেতে এসেছিলাম কেদারনাথে, ফিরে যাচ্ছি তারচেয়ে অনেক অনেক বেশিকিছু নিয়ে।

আমার জীবনের সবচেয়ে আনন্দময় কিছু মুহূর্ত রেখে যাচ্ছি এখানে। কিন্ত হে হিমালয়, তুমিও বাঁধা পড়েছ আমার চেতনায়। আমার চেতনা জেগে থাকবে তোমার বুকে, আমি থাকি বা না থাকি। মন্দাকিনীর তীরের এই নির্জন লজে সে রাত্রিবাস করবে, রামবাড়ার সেতুর উপর বসে বসে চেয়ে থাকবে তোমার দিকে। তার সজাগ চোখের সামনেই কেদারনাথ উপত্যকায় জমবে শিশিরের কণা। তারাভরা আকাশ, আর জ্যোৎস্নায় স্নাত তুষারচুড়ার পানে চেয়ে চেয়ে বিনিদ্র রাত্রি যাপন করবে অনন্তকাল ধরে।

ফিরে আসব বারবার তোমার কাছে, আরও ঋদ্ধ হব তোমার সান্নিধ্যে, আরও গভীর হবে তোমার সাথে আমার ভালোবাসা। আপাতত বিদায়, হে প্রিয়সখা, বিদায়!

সমাপ্ত
privacy_tip Permissions in this forum:
You cannot reply to topics in this forum
power_settings_newLogin to reply