জৈবিক আবহবিকার ও মাটির উৎপত্তি
►জৈবিক আবহবিকার [Organic Weathering]:- জৈবিক আবহবিকার হল যান্ত্রিক আবহবিকার [Mechanical Weathering] -এর একটি বিশেষ রূপ । গাছপালার শিকড় শিলাস্তরের মধ্যে ঢুকে ফাটল ধরিয়ে যান্ত্রিক আবহবিকার [Mechanical Weathering] ঘটায় । যান্ত্রিক ও রাসায়নিক আবহবিকার ছাড়াও উদ্ভিদ ও প্রাণীরা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে শিলাখন্ডকে চূর্ণ বিচুর্ণ করে থাকে । ইঁদুর, খরগোশ, প্রেইরি কুকুর, পিঁপড়ে, কেঁচো, উই প্রভৃতি মৃৎভেদী প্রাণীরা মাটিতে গর্ত খুঁড়ে ভেতরের শিলাচূর্ণ, মাটি ইত্যাদি উপরের পৃষ্ঠে নিয়ে আসে । এভাবে উদ্ভিদ এবং প্রাণীজগৎ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে শিলাখন্ডকে চূর্ণবিচূর্ণ করে থাকে । এরকম আবহবিকার [Weathering] কে জৈবিক আবহবিকার [Organic Weathering]বলে ।
জৈবিক আবহবিকার [Organic Weathering] এর সংঘটন:- জৈবিক বিচূর্ণীভবন বিভিন্ন উদ্ভিদ এবং প্রাণীর সাহায্যে হতে পারে ।
উদ্ভিদের সাহায্যে বিচূর্ণীভবন:-
১) উদ্ভিদ, লতাপাতা প্রভৃতি জলে পচে যে জৈব অম্লের সৃষ্টি হয় তার সংস্পর্শে এলে শিলাগঠিত খনিজে রাসায়নিক বিক্রিয়া ঘটে, ফলে কালক্রমে খনিজ বিয়োজিত হয়ে শিলা ক্ষয়িত হয়;
২) এছাড়াও শিলার ফাটল দিয়ে উদ্ভিদের শিকড় শিলার অভ্যন্তরে প্রবেশ করে বিস্তার লাভ করে এবং শিলাকে চূর্ণবিচূর্ণ হতে সাহায্য করে ।
প্রাণীর সাহায্যে বিচূর্ণীভবন:-
১) প্রেইরি কুকুর, খরগোশ, ছুঁচো, ইঁদুর, কেঁচো প্রভৃতি মৃৎভেদী প্রাণী ভূপৃষ্ঠে গর্ত করে বাসস্থান নির্মান করতে গিয়ে মৃত্তিকার দৃঢ়তা নষ্ট করে একে ক্ষয়প্রাপ্ত হতে সাহায্য করে ।
২) বিভিন্ন ধরনের কীট, জীবাণু এবং ব্যাকটিরিয়ার দেহ-নিঃসৃত রসের মাধ্যমে শিলায় আবহবিকার [Weathering] হয় ।
►মাটির সৃষ্টি [Formation of Soil]:- ভূত্বকের উপরিভাগের ক্ষয়ে যাওয়া শিলাচূর্ণের সঙ্গে বিভিন্ন ধরনের জৈব্য ও অজৈব বস্তুর সংমিশ্রণে গঠিত যে নরম ও অসমসত্ত্ব আবরণ স্তরে গাছপালা জন্মায়, তাকেই মাটি [ Soil ]বলে।
মাটির উৎপত্তি :- ভূ-তত্ত্ববিদদের মতে , সূর্য থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার পর পৃথিবী প্রথমে গ্যাসীয় বা বায়বীয় অবস্থায় ছিল । পরে তাপ বিকিরণের ফলে পৃথিবী তরল অবস্থায় আসে এবং ক্রমাগত তাপ বিকিরণের ফলে ঠান্ডা হয়ে শক্ত পিণ্ডে পরিণত হয় । এই শক্ত পিণ্ডকে শিলা বলে। কঠিন শিলা প্রাকৃতিক, রাসায়নিক ও জৈবিক বিক্রিয়ায় চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে অবশেষে মাটিতে পরিণত হয় । আসলে চূর্ণবিচূর্ণ হওয়া শিলার সঙ্গে জৈব পদার্থ মিশ্রিত হয়েই প্রকৃত মাটি সৃষ্টি হয় । ভূ-পৃষ্ঠে মাটি সৃষ্টির পদ্ধতিগুলিকে প্রধানত দু’ভাগে ভাগ করা যেতে পারে, যথা- ১) প্রাকৃতিক প্রক্রিয়া ২) জৈব প্রক্রিয়া (উদ্ভিদ ও প্রাণীর দ্বারা) ।
১) প্রাকৃতিক প্রক্রিয়া:-যেসব প্রাকৃতিক প্রক্রিয়ায় মাটি সৃষ্টি হয় সেগুলি হল-(ক) আবহবিকার, (খ) ক্ষয়ীভবন, (গ) নগ্নীভবন, (ঘ) অপসারণ এবং (ঙ) অবক্ষেপন ।
ক) আবহবিকার: শীতের প্রচন্ড শৈত্য, গ্রীষ্মের উত্তাপ এবং দিন ও রাতের উষ্ণতার পার্থক্যের জন্য ভূপৃষ্ঠের শিলার ক্রমাগত সংকোচন ও প্রসারণ হয় । সাধারণ ভাবে একে আবহবিকার বলে । আর এই আবহবিকারের ফলে শিলাত্বকে ফাটল ধরে এবং শিলার ওপরের অংশ ক্রমশ চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে পড়ে । কালক্রমে বিভিন্ন ধরনের জৈবিক [Organic], রাসায়নিক [Chemical] এবং জৈব রাসায়নিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে চূর্ণবিচূর্ণ উপাদানগুলি বিশ্লিষ্ট ও স্তরীভূত হয়ে মাটির সৃষ্টি করে ।
খ) ক্ষয়ীভবন:- বৃষ্টিপাত, বায়ুপ্রবাহ, জলস্রোত, হিমবাহ ইত্যাদি প্রাকৃতিক শক্তির প্রভাবে কিংবা আবহবিকারের জন্য ভূত্বকের উপরিভাগ ক্রমশ ক্ষয় পেয়ে মাটির সৃষ্টি করে । এই প্রক্রিয়াকে ক্ষয়ীভবন বলে ।
গ) নগ্নিভবন:- বিভিন্ন প্রাকৃতিক শক্তি দ্বারা ভূত্বকের উপরিভাগ চূর্ণবিচূর্ণ ও ক্ষয়প্রাপ্ত হলে শিলার ওপরের অংশ আলগা হয়ে যাওয়ায় ঠিক তার নীচের স্তরটি উন্মুক্ত বা নগ্ন হয়ে পড়ে, এই প্রক্রিয়াকে নগ্নীভবন বলে।
ঘ) অপসারণ:- এই প্রক্রিয়ায় ভূত্বকের উপরিভাগের চূর্ণবিচূর্ণ এবং ক্ষয়প্রাপ্ত অংশগুলি প্রাকৃতিক বাহক, যথা- জলস্রোত, বায়ুপ্রবাহ, হিমবাহ ইত্যাদির দ্বারা একস্থান থেকে অন্য স্থানে পরিবাহিত হয় এবং কালক্রমে সঞ্চিত হয়ে বিভিন্ন ধরনের জৈবিক [Organic], রাসায়নিক [Chemical] এবং জৈব রাসায়নিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে চূর্ণবিচূর্ণ উপাদানগুলি বিশ্লিষ্ট ও স্তরীভূত হয়ে মাটির সৃষ্টি করে ।
ঙ) অবক্ষেপণ: এই প্রক্রিয়ায় ভূত্বকের উপরিভাগের চূর্ণবিচূর্ণ এবং ক্ষয়প্রাপ্ত অংশগুলি পরিবাহিত হয়ে অন্য কোনও স্থানে সঞ্চিত হয়ে মাটির সৃষ্টি করে।
২) জৈবিক প্রক্রিয়া:- উদ্ভিদ ও প্রাণীর দ্বারা মাটির উৎপত্তি প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে খনিজ পদার্থের রূপান্তর ঘটিয়ে মাটি সৃষ্টি করে ।
ক) ছোটো বড়ো উদ্ভিদ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ভাবে খনিজ পদার্থের রূপান্তর ঘটিয়ে মাটি সৃষ্টি করে ।
খ) উদ্ভিদ, লতাপাতা প্রভৃতি জলে পচে যে জৈব অম্লের সৃষ্টি হয় তার সংস্পর্শে এলে শিলাগঠিত খনিজে রাসায়নিক বিক্রিয়া ঘটে, ফলে কালক্রমে খনিজ পদার্থের রূপান্তর ঘটিয়ে মাটি সৃষ্টি করে ।
গ) শিলার ফাটলের মধ্যে উদ্ভিদের মূল প্রবেশ করলে ফাটলের আয়তন বাড়ে এবং উদ্ভিদের মূলের বৃদ্ধির ফলে শিলা ভেঙে চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে যায় ।
ঘ) শিলার ওপর শৈবাল, ছত্রাক ইত্যদি জন্মালে শিলা নরম ও আলগা হয়ে মাটিতে পরিণত হয় ।
ঙ) মাটিতে থাকা বিভিন্ন জীবাণু, মৃত উদ্ভিদ ও প্রাণীদেহকে পচিয়ে জৈব পদার্থে পরিণত করে এবং পরোক্ষভাবে মাটি সৃষ্টিতে সাহায্য করে ।
চ) মাটিতে বসবাসকারী কেঁচো, উঁই, পিঁপড়ে, ইঁদুর প্রভৃতি প্রাণীরা মাটিকে ওলটপালট করে দিয়ে রাসায়নিক উপাদানের সঙ্গে জৈব উপাদানের মিশ্রণ ঘটিয়ে মাটি সৃষ্টিতে সাহায্য করে ।
রেগোলিথ [Regolith]:-
রেগোলিথ হল মৃত্তিকাময় এক ধরনের শিথিল শিলাচূর্ণ । মাটি সৃষ্টির প্রাথমিক অবস্থাকে রেগোলিথক বলা যেতে পারে । আবহবিকারের [Weathering] ফলে ভূপৃষ্ঠের শিলাস্তর ক্রমাগত চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে অবশেষে ছোট ছোট সূক্ষ্ম কণায় পরিণত হয় এবং ভূত্বকের উপর রেগোলিথ নামে এক ধরনের শিলাচূর্ণের আবরণ পড়ে । কালক্রমে বিভিন্ন ধরনের জৈবিক [Organic], রাসায়নিক [Chemical] এবং জৈব রাসায়নিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে রেগোলিথের প্রাথমিক উপাদান গুলি বিশ্লিষ্ট ও স্তরীভূত হয়ে মাটির সৃষ্টি করে । সাধারণত গ্রানাইট শিলায় আবহবিকারের ফলে ক্রান্তীয় ও উপক্রান্তীয় উষ্ণ ও আদ্র জলবায়ু অঞ্চলে শিলা চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে সুড়কির মতো এক ধরনের মৃত্তিকাময় ও লাল রঙের শিথিল শিলাচূর্ণ রেগোলিথ সৃষ্টি করে ।
মাটির শ্রেণিবিভাগ:-
উৎপত্তি অনুসারে মাটি দু’ধরনের হয়, যেমন- ১) স্থানীয় মাটি, ২) অপসৃত মাটি ।
১) স্থানীয় মাটি:- প্রাকৃতিক পরিবর্তনের ফলে মাতৃশিলা থেকে উৎপন্ন মাটি উৎপত্তিস্থলেই স্থিতিলাভ করে তখন তাকে স্থানীয় মাটি বা স্থিতিশীল মাটি বলে । এই ধরনের মাটির ওপরের স্তরএর কণাগুলো সূক্ষ্ম হয় কিন্তু নীচের স্তরগুলিতে মাটির কণাগুলো ক্রমশ মোটা হতে শুরু করলেও মাটির বিভিন্ন স্তরের মূল উপয়াদান একই থাকে ।
২) অপসৃত মাটি:- যেসব মাটি বায়ুপ্রবাহ, তুষারপাত, জলপ্রবাহ, বৃষ্টিপাত প্রভৃতি প্রাকৃতিক শক্তির দ্বারা পরিবাহিত হয়ে তাদের উৎস থেকে দূরবর্তী স্থানে সঞ্চিত হয়, তাদের পরিবাহিত বা অপসৃত মাটি বলে । অপসৃত মাটি সাধারণত উর্বর হয় এবং দূরবর্তী স্থান থেকে আসার জন্য অপসৃত মাটির মূল ভৌত ও রাসায়নিক ধর্ম তাদের নীচে থাকা শিলাস্তর থেকে সম্পূর্ণ আলাদা হয় ।
মাটির প্রকারভেদ: অপসৃত মাটি নানা ধরনের হতে পারে, যেমন- কোনো স্থানের মাটি বায়ুপ্রবাহ দ্বারা পরিবাহিত হয়ে দূরবর্তী স্থানে সঞ্চিত হলে তাকে লোয়েস মাটি এবং জলপ্রবাহ দ্বারা সঞ্চিত হলে তাকে পলিমাটি বলে ।
গঠন অনুসারে মাটির শ্রেণিবিভাগ:- গঠন অনুসারে মাটিকে নুড়ি, বালি, পলি এবং কাদা- এই চারটি ভাগে ভাগ করা যায়। যথা:-
১) দোঁয়াশ মাটি, (এই মাটিতে বালি ও কাদা প্রায় সমপরিমাণে থাকে),
২) এঁটেল মাটি (এই মাটিতে কাদার ভাগ বেশি)
৩) বেলে মাটি ( এইমাটিতে বালির ভাগ বেশি)।