#বিশাখাপত্তনম –> আরাকু –> জগদলপুর -> কোরাপুট –(৭)
কোরাপুট পর্ব
২৭-০২-২০ – আজ আমরা জগদলপুর ছেড়ে যাব কোরাপুট, যা কিনা আমাদের এই ট্রিপের অন্তিম গন্তব্যস্থল। এই পুরো ট্রিপটার সবচেয়ে অনিশ্চিত, কিন্তু সম্ভাবনাপূর্ন একটি জায়গায় যাচ্ছি, যে এলাকা আমাদের কাছে প্রকৃতির এক অকৃত্রিম সৌন্দর্যের দ্বার খুলে দেবে বলে আশা রাখছি। আর “অনিশ্চিত” বলছি এই কারনে যে (১) এই যাত্রায় এই প্রথম আমাদের জগদলপুর থেকে কোরাপুট যাবার কোন অগ্রিম টিকিট বুকিং করা নেই। এমন কি আমরা কি ভাবে কোরাপুট যাব তাও আমাদের ঠিক করাও নেই; এবং (২) কোরাপুটে আমাদের কোনও হোটেল পর্যন্ত বুকিং করা নেই। এই তথাকথিত “হটকারী” সিন্ধান্ত নেওয়ার পেছনে কিছু যুক্তিও আছে, যেমন, প্রথমতঃ (ক) জগদলপুর থেকে কোরাপুটের দূরত্ব খুব বেশী নয়; দ্বিতীয়তঃ (খ) এই জার্নিটা হবে পুরো দিনের বেলায়; এবং সর্বপরি (গ) এই দুই জায়গার মধ্যে ট্রেন, বাস ও ট্যাক্সি – সমস্ত রকম যোগাযোগই আছে, ইত্যাদি। সুতরাং আমাদের অপশন অনেক। এছাড়া, আমরা যখন যাচ্ছি তখন সেটা কোনও ট্যুরিস্ট সিজন নয়, তাই হোটেলের অগ্রিম বুকিং করার কোনও প্রয়োজনও নেই। যাইহোক, আগের দিন রাত্রে ডিনার করার পর জগদলপুর হোটেলে বসে স্থির হল ট্রেনেই যাওয়া যাক। হোটেলের লোকেরাও বলল যে এই রুটে একেবারেই ভীড় হয় না, তাই সকালের দিকে একটা প্যাসেঞ্জার ট্রেন আছে, সকাল ১০.০০ নাগাত, এই ট্রেনে সাধারন সেকেন্ড ক্লাসের টিকিট কেটে নিলেই হবে। এই কথামত আমরা সকাল বেলায় রেডি হয়ে আমরা যাকে বলি, “সস্তায় পুষ্টকর খাদ্য” অর্থাৎ দোসা, ইডলি ইত্যাদি দিয়ে প্রাতরাশ সেরে একটি অটোরিক্সা নিয়ে চলে এলাম জগদলপুর স্টেশনে। এবং রেলওয়ে কাউন্টার থেকে পাঁচটি আনরিজার্ভড সেকেন্ড ক্লাসের টিকিট কেটে নিলাম। তার পরে কোন ট্রেন, কখন, কোন প্লাটফর্ম থেকে ছাড়বে ইত্যাদি খোঁজ করতে গিয়ে আবিস্কার করলাম যে এ সেই একই ট্রেন, যেটাতে করে আমরা আরাকু থেকে জগদলপুর এসেছিলাম। শুধু ট্রেনের এখন রিটার্ন জার্নি। অর্থাৎ এটা হল কিরন্দুল-ভাইজাগ প্যাসেঞ্জার, যেটা জগদলপুর ছাড়ার নির্ধারিত সময় হল বেলা ১০.০০টা; এবং কোরাপুট পৌঁছনোর সময় হল দুপুর ০১-১৫ মি। যাইহোক, শেষ পর্যন্ত ট্রেন এল ঝাড়া ১ ঘন্টা লেট করে (এটা নাকি এখানকার দস্তুর, এবং প্রায় রোজই হয়ে থাকে।)
পথিমধ্যে কিছু ছোটখাট নাটকীয় ঘটনা ঘটে গেল। আমরা ভাবলাম যখন সময় পাওয়াই গেছে তাহলে ফোন করে কোরাপুটের কিছু হোটেলের খোঁজ খবর নেওয়া যাক। প্রথমে ফোন করা হল “হোটেল আলিশান” বলে একটি হোটেলকে, যার রিভিউ বেশ ভাল ছিল। কিন্তু জায়গা নেই। তারপর ফোন করা হল “হোটেল রাজ রেসিডেন্সী” নামে অন্য আর একটি হোটেলকে। এটার রিভিউও বেশ ভাল। কিন্তু এখানেও জায়গা নেই; এখানকার রিসেপশন আমাদের জানালেন যে যদিও এই সময় ঠিক ট্যুরিস্ট সিজন নয়, কিন্তু এখন এখানে “বিয়ের সিজন” চলছে, তাই প্রায় সব হোটেলই বুকড হয়ে রয়েছে। যাঃ বাবা, এটা তো আমাদের হিসাবের বাইরে ছিল। যাইহোক, ভালই শিক্ষা হল, ভবিষ্যতে এই ধরনের পরিস্থিতিতে আমাদের বিয়ের সিজনকেও হিসাবের মধ্যে রাখতে হবে। যাইহোক, এর পর “অতিথি ভবন” নামক একটি হোটেলকে ফোন করা হল। এই হোটেল সম্পর্কে ইতিপূর্বে আমার পোস্ট-করা “প্লানিং” পর্বে বিস্তারিত লিখেছি, তাই আর পুনারক্তি করছি না। শুধু এইটুকুই জানাচ্ছি যে এই হোটেলটিও পুরো বুকড ছিল, কিন্তু এখানকার একজন কর্মচারীর সৌজন্যে আমরা শেষ পর্যন্ত এদেরই sister hotel (শান্তি নিবাস)-এ আমরা ঠাঁই পেয়েছিলাম। এবং আমাদের অভিজ্ঞতা এখানে খুবই ভাল ছিল। যাইহোক, এবার back to train journey! সিংগল লাইনের কল্যানে এবং অন্য ট্রেনগুলিকে ছেড়ে দিতে দিতে আমাদের ট্রেনের লেট প্রায় দু ঘন্টায় পৌঁছল। শেষকালে আমরা কোরাপুট পৌঁছালাম অপরাহ্ন সাড়ে তিনটা নাগাত। ইতিমধ্যে আমাদের থাকার জায়গা “শান্তি নিবাসে” টেলিফোনের মাধ্যমে confirmed হয়ে গেছে, তাই সোজা একটা অটোরিক্সা নিয়ে (একটা অটোতেই সকলকে ধরে গেল) সোজা গেলাম হোটেল “শান্তি নিবাস”, স্টেশন থেকে দূরত্ব প্রায় ৪/৫ কিমি, ভাড়া পড়ল ১০০.০০ টাকা। স্টেশন থেকে অটো করে আমাদের হোটেলে যাবার সময় দেখলাম কোরাপুট একটি পাহাড়ী জায়গা, উঁচু-নিচু রাস্তা ঘাট, আবহাওয়াও আদৌ গরম নয়। পরে নেটে দেখলাম সমুদ্রপৃষ্ট থেকে কোরাপুটের উচ্চতা হল ২,৮৫০ ফিট।
হোটেলে আমাদের চেক ইন ইত্যাদি অত্যন্ত সুশৃঙ্খলভাবেই হয়ে গেল, এখানকার স্টাফেরা যথেষ্ট হেল্পফুল ও বিনয়ী ছিল। কিন্তু আমাদের হোটেলে কিচেন নেই, খাবার জন্য পাশেই এদের সহযোগী “হোটেল অতিথি ভবন”-এ আছে কিচেন ও ডাইনিং হল এবং ওখানে সুলভ মূল্যে খাবার পাওয়া যায়। অতএব আমরা তাড়াতাড়ি ফ্রেশ হয়ে নিয়ে দ্রুত চললাম খাবারের উদ্দেশ্যে। যেহেতু এই সংস্থা একটি ধর্মীয় সংগঠনের দ্বারা পরিচালিত, এখানে শুধু নিরামিষ খাবারই পাওয়া যায়, এমনকি এখানে রান্নায় পিঁয়াজ, রসুন ইত্যাদিও ব্যবহার করা হয় না। যাইহোক, তখন আমাদের প্রচন্ড ক্ষিধে পেয়েছে, তাই এসব তুচ্ছ ব্যাপারকে আমরা তত গুরুত্ব দিলাম না। খাবারের মূল্য খুবই পকেট ফ্রেন্ডলি, যেমন, অর্ডিনারী থালির মূল্য হচ্ছে ৪০.০০ টাকা মাত্র।
কোরাপুটে ঘোরার একটা বিশেষ্যত্ব হল এখানকার দ্রষ্টব্য স্থানগুলি বেশ দূরে দূরে অবস্থিত, এবং কিছু স্পট বেশ উঁচু পাহাড়ের উপরে, সেখানকার রাস্তা খুব একটা ভাল নয়। তাই ঘোরার জন্য গাড়ী তো আবশ্যকই, এবং সে গাড়ী SUV শ্রেনীর হলেই ভাল। তাই আমাদের প্রথম লক্ষ্য ছিল একটা গাড়ীর বন্দোবস্ত করা। এ ব্যাপারেও আমাদের কোনও পূর্ব হোমওয়ার্ক করা ছিল না। সেজন্য প্রথমেই আমরা এখানকার রিসেপশনের সংগে বেড়ানোর জন্য গাড়ীর কি বন্দোবস্ত হতে পারে, তার খোঁজ খবর নিলাম। জানা গেল এই হোটেলের নিজস্ব কোনও ট্রাভেল বিভাগ নেই, তবে এঁদের সংগে দু’
একটি ক্যাব অপারেটরের সংগে যোগাযোগ আছে, আমরা চাইলে ওঁরা সেই অপারেটরদের সাথে আমাদের যোগযোগ করিয়ে দেবেন। আমরা তাতে রাজী হয়ে গেলাম। ঠিক হল সন্ধ্যা ৮টা নাগাত আমরা যখন ডিনার করতে আসব, তখন কোন একটি অপারেটরের সংগে আমাদের কথা বলিয়ে দেবেন। এর পরে আমরা হোটেল থেকে বেরিয়ে আমাদের হোটেলে না গিয়ে স্থানীয় বাজারের দিকে গেলাম, যা কিনা এখান থেকে পায়ে হাঁটা দূরত্বে। আমরা এখানে বাজারের মধ্যে ট্যাক্সি স্টান্ড খুঁজে বার করে একাধিক ড্রাইভারের সংগে কথা বললাম, আমরা কোথায় কোথায় ঘুরতে চাই, তা জানালাম, ক’দিন ধরে ঘুরব তাও বললাম এবং এর পরে তাদের কাছ থেকে তাদের চার্জ কি রকম পড়বে তাও জেনে নিলাম। ওদের বললাম আমরা নিজেদের মধ্যে কথাবার্তা বলে আজ রাত্রি নটার মধ্যেই ওদের ফোন করে আমাদের সিন্ধান্ত জানিয়ে দেব। উদ্দেশ্য হল আমাদের হোটেলের পাঠানো ড্রাইভারের সংগে কথা বলার পরই এই ইস্যুটা ফাইনাল করা।
আমাদের তথ্য অনুযায়ী কোরাপুটকে কেন্দ্র করে মোটামুটি এই স্পটগুলি ঘোরা হয়ে থাকে – (১) ডুমুরিপেট রাম মন্দির; (২) সুনাবেদা শ্রী হনুমান মন্দির; (৩) নালকো টাউনশিপের সিরডি সাঁইবাবা মন্দির; (৪) কাঁটা বাউনিসিয়ানি দেবী মন্দির; (৫) দেওমালী হিলটপ; (৬) কোরাপুট (৭) রানী দুদুমা ফলস; (৮) সুলারপেট ড্যাম; (৯) দুদুমা ফলস; (১০) গুপ্তেশ্বর গুহা-তথা-মন্দির; (১১) বত্রিশ সিংহাসন ইত্যাদি। এই স্পট গুলির মধ্যে দুএকটি স্থান আমরা প্লানিং পর্বেই বাদ দিয়েছিলাম, যেমন, গুপ্তেশ্বর গুহা; এখানে যেতে হলে যে ধরনের শারীরিক সক্ষমতার দরকার, তা আমাদের নেই। তাই বন্ধুদের পরামর্শ ও আমাদের নির্বাচিত ড্রাইভারের মতামত মেনে আমরা এই স্পটটি আমরা প্রথম থেকেই বাদ দিয়েছিলাম। আর শেষকালে বত্রিশ সিংহাসন এবং কোরাপুট ট্রাইবাল মিউজিয়ম(আমাদের হোটেলের খুব কাছে হওয়া সত্ত্বেও) বাদ পড়ে গেছে সময়ের অভাবে।
যাইহোক, ঠিক রাত আটটা নাগাত আমরা আবার “হোটেল অতিথি ভবন”-এর রিসেপশনে এসে হাজির হলাম। রিসেপশনের স্টাফেরা আমাদের সংগে ওদের মনোনীত ক্যাব অপারেটরের সংগে আমাদের আলাপ করিয়ে দিল। ক্যাব অপারেটর বয়সে তরুন, সদা হাস্যমুখ, বিনয়ী, তাই প্রথম দর্শনেই আমাদের ভাল লেগে গেল। যাইহোক, একটু দরাদরি পর, যে অফার আমরা পেলাম সেটা হল উনি আমাদের একটি ৭ সিটের SUV দু’দিনের জন্য দেবেন; আমাদের উল্লেখিত সব স্পট ঘুরিয়ে দেখাবেন (গুপ্তেশ্বর বাদে) এবং এর জন্য দিন প্রতি ২,৫০০.০০ করে দুদিনের জন্য ৫,০০০.০০ টাকা নেবেন। এর আগে আমরা বাজার থেকে যে রেট পেয়েছিলাম তা এর থেকে কিঞ্চিত বেশি। তার উপরে এই ক্যাব অপারেটর আমাদের হোটেলের দ্বারা মনোনীত, কিছু অসুবিধা বা বিতর্ক হলে আমাদের হোটেলের মধ্যস্থতা পাওয়া যাবে, এই সব কারনে আমরা এই ক্যাব অপারেটরের অফার গ্রহন করার সিন্ধান্ত নিলাম। সেই অনুযায়ী কথাবার্তা পাকা করে, আগামী কাল সকাল ৯টার সময় আমাদের হোটেলে গাড়ী এসে রিপোর্ট করবে এই কথা দিয়ে আমাদের নির্বাচিত ক্যাব অপারেটর বিদায় নিলেন। আমরা এই সংগে বাজারের অন্য যে সব ড্রাইভারদের সংগে কথা বলে এসেছিলাম, তাদের জানিয়ে দিলাম যে আমরা তাদের সার্ভিস নিতে পারছি না। আগের কথা এখনই বলে নিই। আমাদের এই ক্যাব অপারেটর নির্বাচনের সিদ্ধান্ত পরবর্তীকালে অত্যন্ত সঠিক বলে প্রমানিত হয়েছিল। এই অপারেটর ভদ্রলোকের নাম হল
শ্রী বাবুলা, ফোন নং – ৯৯৩৭৯২৬৪৯৯ এবং ৯৪৩৯২৮৪৭৪০
এই প্রসংগে বলে নেওয়া ভাল হবে যে এই ক্যাব অপারেটরের সংগে আমাদের কোনও ব্যবসায়িক সম্বন্ধ নেই; শুধু যে সব বন্ধুরা আগামী দিনে কোরাপুট বেড়াতে যাবেন, তাঁদের সুবিধার্থে এই রেফারেন্স দিয়ে দেওয়া হল। আর একটা কথা, আমাদের মনে হল এই অপারেটরের সংগে “অতিথি ভবন” ও “শান্তি নিবাস” কর্তৃপক্ষের সংগে ভাল যোগাযোগ রয়েছে। আমি একবার মজাচ্ছলে বাবুলাবাবু কে বলেছিলাম যে আপনার তো এদের সংগে ভাল সম্পর্ক আছে, তাহলে ভবিষ্যতে যদি এই হোটেল বুক করার প্রয়োজন হয়, তাহলে নিশ্চয়ই আপনার সাহায্য পাওয়া যাবে! এর জবাবে ঐ ভদ্রলোক কোনও সোজা উত্তর না দিয়ে বলেছিলেন যে সে তখন দেখা যাবে (“...তব দেখা যায়েগা”) । মানে, উনি সরাসরি স্বীকার করেন নি, আবার অস্বীকারও করেন নি। কিন্তু আমি অবশ্যই বলব যে ওনার সার্ভিস বেশ ভাল ছিল, যা যা কথা হয়েছিল, তা তো উনি পুরোপুরি রেখেছেনই, তা ছাড়া আমরা যখন একটু এক্সট্রা কিছু অনুরোধ করেছি, উনি সেটাও accommodate করার চেষ্টা করেছেন। আর একটা বড় কথা যে উনি আমাদের কাছে কোনও আগাম অর্থ দাবী করেন নি, এমন কি প্রথম দিনের শেষে যখন আমরা এক দিনের ভাড়া দেবার কথা বললাম, উনি দ্বিতীয় দিনের পর পুরো টাকাটা একসংগে নেবেন বলে আমাদের জানালেন। অর্থাৎ উনি আমাদের উপর পুরোপুরি বিশ্বাস করে সার্ভিস দিয়েছেন। এই ব্যাপারটাও আমাদের ভাল লেগেছে।
যাইহোক, এবার আমাদের বেড়ানোর গল্পে ফেরা যাক। আমাদের কোরাপুট ভ্রমনের প্রথম দিন সকালে আমরা যখন প্রস্তুত হয় হোটেলের সামনে রাস্তায় দাঁড়িয়ে গাড়ীর জন্য অপেক্ষা করছি, তখন দেখা গেল যে আমাদের হোটেলের মূল গেটের বিপরীত দিকে রাস্তার উপরে একটি ছোট্ট দোকানে দক্ষিনী প্রাতরাশ বিক্রি হচ্ছে এবং বেশ কিছু পথ চলতি লোক ওখানে দাঁড়িয়ে সেই প্রাতরাশ গ্রহন করছে। দেখে মনে হল বেশ জনপ্রিয় ধাবা। আমাদের তো তখনও প্রাতরাশ নেওয়া হয় নি, হাতে কিছু সময়ও ছিল, তাই আমরা ঠিক করলাম এখান থেকে কিছু খেয়ে নেওয়া যাক। দোসা, ইডলি, বড়া ইত্যাদি নেওয়া হল, সংগে গরমাগরম চা। স্বাদ যথেষ্ট ভাল ছিল, এবং বলা বাহুল্য, এটাও ছিল “সস্তায় পুষ্টকর খাদ্য”! এর পরে পরেই আমাদের নির্দিষ্ট গাড়ী এসে হাজির হল, এটাও একটা জাইলো, 7 সিটের SUV গাড়ী। ড্রাইভার বাবুলা বাবু নন, অন্য একজন; তার নাম ঠিক মনে পড়ছে না।
এইবার শুরু হল আমাদের কোরাপুট ভ্রমন। আমরা প্রথমে গেলাম কোরাপুটের কাছেই সুনাবেদা নামে এক জনপদের কাছে “ডুমুরিপুট” নামে এক গ্রামে, যা কিনা এন এইচ-২৬ এর পাশেই অবস্থিত। এখানে রয়েছে এক প্রাচীন শ্রীরাম মন্দির। এখানের এক বৈশিষ্ট হল মন্দিরে ঠিক সামনে শ্রীরাম ভক্ত হনুমানজীর হাঁঠু ভেংগে প্রনত হয়ে বসে থাকার এক বিশাল মূর্তি। বলা হয়ে থাকে এই মূর্তিটি নাকি highest kneeling Hanuman Statue in Odisha! মন্দিরটিও বেশ সুন্দর, কিন্তু মন্দিরের ভিতরের শ্রীরাম, সীতা ও লক্ষন-এর মূর্তিগুলি বাইরের হাঁটু-ভেংগে-বসা শ্রী হনুমানজীর মূর্তির তুলনায় নিতান্তই ছোট।
আমাদের এর পরের গন্তব্য হল দামনজোড়ি নামে এক ইন্ড্রাষ্টিয়াল টাউনশিপ, এটা ভারত সরকারে সংস্থা নালকোর কর্মচারীদের জন্য প্রতিষ্টিত এক সাজানো গোছানো ছিমছাম টাউনশিপ। এই উপনগরী শুরু হবার মুখেই আমাদের নিয়ে যাওয়া হল একটি বিচিত্র ধরনের মন্দিরে, যদিও একে মন্দির বলব, না অন্য কিছু, ঠিক বুঝে উঠতে পারছি না। এখানকার বৈশিষ্ট হল যে এখানে কোনও মূর্তি বা কোনও স্ট্রাকচারও নেই, দেখে যা মনে হল এটি একটি প্রাচীন বিশাল বাঁশ বাগানের অংশ; এবং এই বাঁশ গাছকেই দেবীজ্ঞানে স্থানীয়রা পুজো করেন। আমরা দেখতে পেলাম যে খোলা আকাশের নীচে এই বাঁশ বাগানের মধ্যে এখানকার স্থানীয় আদিবাসীরা তাঁদের ছেলে মেয়েদের বিয়ে দিতে এসেছেন, কেউ বা এনেছেন ছাগশিশু, সম্ভবতঃ বলি দেবার জন্য। প্রচুর ধুপকাটি জ্বালনো হয়েছে; এবং আশপাশের বাঁশ গাছের নিন্মভাগ লাল কাপড়ে মুড়ে দেওয়া হয়েছে। আর একটা জিনিষ আমাদের অবাক করল, সেটা হচ্ছে এখানে কোন পুরোহিত নজরে পড়ল না। এই ধরনের বিচিত্র মন্দিরের কথা এর আগে আমরা শুনি নি, দেখা তো দূরের কথা। ড্রাইভারের সাথে কথা বলে, এবং পরবর্তিকালে নেট সার্চ করে যা তথ্য পেলাম, তা হল এই দেবীস্থান হল “কাঁটা বাউন্সিয়ানী দেবী”র স্থান। স্থানীয় অধিবাসীরা এই দেবীকে দেবী দূর্গারই এক রূপ বলে মেনে থাকেন।
এর পরে আমরা মূল নালকো টাউনশিপের মধ্যে প্রবেশ করলাম। এই সাজানো গোছানো টাউনশিপ আমাদের পরিচিত যেকোনও ইন্ড্রাষ্টিয়াল টাউনশিপের মত করেই গড়ে তোলা হয়েছে। এই সংগে এখানকার কর্তৃপক্ষ এঁদের কর্মচারী ও তাঁদের পরিবারের জন্য গড়ে দিয়েছেন দুটি সুন্দর মন্দির – (ক) শিরডি সাই বাবা মন্দির; এবং (খ) হনুমানজী মন্দির। দুটি মন্দিরই পাশাপাশি অবস্থিত; এবং এই মন্দিরদ্বয়ের সংগে গড়ে তোলা হয়েছে একটি সুসজ্জিত উদ্যান। খুবই সুন্দর করে সাজানো এবং দেখে মনে হল নিয়মিত পুজা ও পার্কের দেখভাল করা হয়ে থাকে। এখানকার একটি বৈশিষ্টের কথা উল্লেখ করতেই হবে। এখানে শ্রী হনুমানজীর মূর্তিটি সত্যিই বিশালাকৃতি, মাটি থেকে ১০৮ ফিট উঁচু। এই মূর্তি নাকি এশিয়ার মধ্যে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ হনুমানজীর মুর্তি। কিন্তু একটা কথা এখানে বলা প্রয়োজন, শ্রী হনুমানজীর মূর্তির বিভিন্ন অংশে মৌমাছিরা চাক বেঁধেছে, যা নিচে থেকেই পরিস্কার বোঝা যাচ্ছে। অথচ এই ব্যাপারটাতে কর্তৃপক্ষ বা পূজারী কারও কোন ভ্রুক্ষেপ আছে বলে মনে হল না।
এর পরে আমরা গেলাম “দেওমালী হিল টপ”-এ। আমার কাছে এই স্থানটির বিশেষ এক আকর্ষন ছিল। বহুদিন আগে, আমার এক পরিচিত ব্যক্তি, বেশ কিছু পাহাড়ী রাস্তা ট্রেক করে (তখন পাকা রাস্তা ছিল না) এই জায়গায় এসে পৌঁচেছিলেন; এবং তাঁর কাছ থেকে এই স্বর্গীয় স্থানের বিবরন শুনে তখন থেকেই এই জায়গায় আসার ইচ্ছে মনের মধ্যে লালন করছিলাম। আজ তা পুরন হতে চলেছে। স্বাভাবিক ভাবেই আমি রোমাঞ্চিত ও কিঞ্চিত উত্তেজিতও বটে। এই দেওমালী হিল টপ কোরাপুট থেকে মোটামুটি ৭০ কিমি দূরে অবস্থিত পূর্বঘাট পর্বতমালার চন্দ্রগিরি-পট্টাংগি সাব-রেঞ্জের অংশ ; এটিকে ওডিশার সর্বোচ্চ শৃংগ বলে মানা হয়ে থাকে, এর উচ্চতা সমুদ্রপৃষ্ট থেকে ৫৪৮৬ ফিট। বর্তমানে এই স্পটে পৌঁছানোর জন্য একটি সুন্দর পাহাড়ী রাস্তা তৈরী করা হয়েছে, এর ফলে আমাদের SUV সহজেই হিলটপের উপরে পৌঁছে গেল।
যেখানে এসে আমাদের গাড়ী থেমে গেল; এবং ড্রাইভার আমাদের নামতে বলল, সেখানে সন্তর্পনে পা রাখতেই আমার সমস্ত দেহ রোমাঞ্চিত হয়ে উঠল।আমরা দাঁড়িয়ে আছি, আক্ষরিক অর্থে্ এক দিকশূন্যপুরে। একটা ন্যাড়া পাহাড়ের উপরে এক ফালি ফ্লাট জায়গা, আশ পাশে কোন গাছপালা, কোনও স্ট্রাকচার, কোন পাহাড়ের শৃংগ – কিছুই দৃশ্যমান নয়; শুধু দেখতে পাচ্ছি আমাদের উপরে আকাশের ঘেরাটোপ, যেন মশারীর মত আমাদের ঘিরে ধরেছে। শন শন করে হাওয়া বইছে বেশ বেগেই। আচ্ছা, আপনারা কেউ কি বাতাসের “শন, শন” শব্দের আওয়াজ শুনেছেন? বোধহয় না, কিন্তু আমি যেন এখানে এই আওয়াজ স্পষ্ট শুনতে পেলাম। চারিদিকে কিচ্ছু নেই, আশে পাশে চোখ মেলে কেবল দেখতে পাচ্ছি উপরে নীলাকাশ, আর নিচে, অনেক নিচে, অসংখ্য ছোট ছোট পর্বত শৃংগের বিন্যাস। যেন এক প্রার্থনারত রুক্ষ সন্যাসীর জটাজালে আটকে পড়ে গেছি। একটা সরু রাস্তা আরও অল্প কিছু উঁচুতে চলে গিয়েছে, এই পথ যেন আমাদের ডাকছে, কোথায়? জানি না। আর একটু এগিয়ে দেখি একটা নিঃসংগ দ্বিতল সমান উঁচু আধ-ভাংগা ওয়াচ টাওয়ার গোছের স্ট্রাকচার, সেখানে সিঁড়িও রয়েছে, কিছুটা উপরে ওঠাও যায়। এখান থেকে নিচে গিরিখাত হঠাৎ যেন ঝাঁপ মেরে পড়েছে, আশে পাশে অসংখ্য গিরি শৃংগ যেন দেওমালীর এই গিরিশৃংগকে অভিবাদন করছে। হিমালয়ের সামনে দাঁড়ালে আমার কেমন যেন নিজেকে অকিঞ্চিতকর বলে মনে হয়; আর এই দেওমালীতে পৌঁছে আমার সেই একই অনুভূতি হল, সংগে কিছু আশংকা, কিছু ভীতি। কেন? কিসের জন্য? আমার জানা নেই। হঠাৎ করে নিজেকে যেন একাকী, এক নিঃসংগ পথিক বলে মনে হতে থাকল। যাইহোক, এই প্রাথমিক বিহ্বলতা কাটিয়ে চারিদিকে আবার নজর দিতে লক্ষ্য করলাম, এই রুক্ষ পাহাড়ের পাথর ভেদ করে জেগে উঠেছে জীবন, ছোট ছোট নাম-না-জানা ফুল ফুটেছে আশপাশে। সব মিলিয়ে প্রকৃতি যেন কোন বিশেষ অতিথির জন্য শয্যা সাজিয়ে রেখেছে। এই অসামান্য স্পটটি কিন্তু কিছুটা অবহেলা, অযত্নে বিষন্ন হয়ে রয়েছে। তাই এবার কিছু ছোট খাট ”নেই” জগতের হিসাব খুঁজে দেখলাম। যেমন, নেই কোনও টয়লেটের ব্যবস্থা, ফলে বিনা বাধায় প্রকৃতি দূষন চলছে। আর সবচেয়ে বড় কথা, আশে পাশে কোথাও নেই কোন পানীয় জলের ব্যবস্থা। ওয়াচ টাওয়ারটার ভগ্নদশা সারানোর কোন উদ্যোগও আমাদের চোখে পড়ল না। এই ছোটখাট কয়েকটি জিনিষ যদি ওড়িশা ট্যুরিজিম নজর দেয়, তবে আমার মনে হয়, এই স্পটটি দর্শনার্থীদের কাছে এক জনপ্রিয় অবশ্য-দ্রষ্টব্য জায়গা হয়ে উঠবে। এখানে বলে রাখি, আমরা এই স্পটে প্রায় ঘন্টাখানেক কাটিয়েছিলাম; এবং এমন একটি অসামান্য জায়গায়, এই এক ঘন্টার মধ্যে, অন্য কোনও দ্বিতীয় প্রানীকে আসতে দেখি নি। এখান থেকে ফিরতে ফিরতে মনে হচ্ছিল যে এই জায়গা দেখতে আসা আমার ট্রাভেলার জীবনের এক পরম প্রাপ্তি। কেমন একটা ভালোলাগার পরিতৃপ্তি নিয়ে এখান থেকে ফিরে এলাম। এই ভাল লাগার রেশ এখনও আমার মনে লেগে রয়েছে। এই প্রসংগে একটা কথা বলে নেওয়া ভাল যে এখানে যে কথাগুলি লিখেছি, সেগুলি একান্তই আমার ব্যক্তিগত বোধ/চিন্তা থেকে লিখেছি। যাঁদের এগুলি অর্থহীন বকবকানী বলে মনে হবে, তাহলে আমার অনুরোধ, এই প্যারাগ্রাফটিকে যেন ignore করে এড়িয়েই যান।
আমাদের পরের গন্তব্য, যা কিনা আমাদের আজকের শেষ গন্তব্য স্থল, হল “রানী দুদুমা জলপ্রপাত”। অকৃত্রিম প্রাকৃতিক পরিবেশের মধ্যে লুকিয়ে থাকা এই জলপ্রপাত টি কোরাপুট থেকে প্রায় ৪০-৪৫ কিমি দূরত্বে আর সেমালিগুডা শহর থেকে প্রায় ২০ কিমি দূরে অবস্থিত। এই জলপ্রপাতটির নিকটস্থ গ্রামের নাম নন্দপুর। এখানে বলে নেওয়া উচিত হবে যে এই “রানী দুদুমা জলপ্রপাত” আর “দুদুমা জলপ্রপাত” কিন্তু এক নয়। দুটি জলপ্রপাত মধ্যে দূরত্ব যথেষ্ট, আকারে, প্রকারে, চেহারায় দুটির মধ্যে কোনও মিলই নেই, তবু দুটি নামের মধ্যে কেন এমন মিল তা আমি চেষ্টা করেও বার করতে পারি নি। স্থানীয় লোকেরাও এ ব্যাপারে আমাদের খুব একটা সাহায্য করতে পারে নি। যাই হোক, এই ফলস টি প্রকৃতপক্ষে ওডিশা ও অন্ধ্র প্রদেশে সীমান্তে অবস্থিত। শুনেছি এই জলপ্রপাতের মোট তিনটি ধারা আছে, আমরা অবশ্য দুটি ধারা ই দেখতে পেরেছিলাম, হয়ত বর্ষাকালে সব ক’টি ধারাই দৃশ্যমান হয়। এই তিনটি ধারার মধ্যে দুটি ধারা নাকি ওডিশার মধ্যে পড়েছে, আর অন্যটি পড়েছে অন্ধ্র প্রদেশে। এই জলপ্রপাতের কাছে যেতে হলে কিন্তু ১ কিমি-র মতো হাঁটতে হয়; এবং এই হাঁটা প্রায় ট্রেকিং-এর মতোই, আমাদের মত বৃদ্ধদের কাছে বেশ কষ্টসাধ্য। আগে সঠিক খবর থাকলে হয়ত আমি চেষ্টাই করতাম না, কিন্তু এক্ষেত্রে আমি বলব, এই প্রকৃত খবর না-থাকাটা একদিক থেকে আমার পক্ষে সাপে বর হয়েছে। আমাদের গাড়ী একটা নির্দিষ্ট পয়েন্ট পর্য্যন্ত গিয়ে পার্কিং লটে থেমে গেল। সেখানে আমাদের ৫০.০০ পার্কিং ফি দিতে হল আমাদের গাড় পার্ক করার জন্য। যে যুবকেরা এই পার্কিং ফি আদায় করছিল, তাদের যখন জিজ্ঞাসা করলাম কতদূর যেতে হবে এই ফলস দেখতে, তখন তার বলল এই তো খুব কাছেই, দশ মিনিটের মত লাগবে। আমার স্ত্রী ও কন্যা কিছুটা গিয়েই তাদের যাত্রার ক্ষান্তি দিল এবং পথিমধ্যে যাত্রীদের বসার যে বেঞ্চ করে দেওয়া আছে, সেখানে বসে পড়ল। আমার ভ্রাতা ও তার স্ত্রী তর তর করে এগিয়ে গেল উপরের দিকে। আমি আস্তে আস্তে, দম নিয়ে নিয়ে, ধীরে ধীরে এগুতে লাগলাম, পথের মাঝে দেখলাম এই যাত্রাপথের সংস্কার ও সৌন্দর্যায়ন হচ্ছে। অনেক মহিলা ও পুরুষ কারিগররা কাজ করে চলেছেন। সবাই মনে হল বাংগালী, কেননা তারা নিজেদের মধ্যে বাংলায় কথাবার্তা বলছে। অবশ্যই আলাপ করলাম, জানা গেল যে এই কাজের বরাত পেয়েছে এক কোলকাতার ঠিকেদার এবং স্বাভাবিকভাবি এখানে কর্মরত কারিগর ও তাদের সহকারীরা সবাই বাংগালী। আমি বিশেষ করে খুশী হলাম এই শুনে যে এই কর্মচারীরা সবাই আমার এলাকা বেহালা-ঠাকুরপুকুর অঞ্চলের বাসিন্দা। এরা সবাই তাদের পরিবার নিয়েই এখানে এসেছে, এবং স্বামী-স্ত্রী উভয়েই কাজ করছে। কাছেই নন্দপুর নামে এক গ্রামে বাড়ী ভাড়া করে বসবাস করছে। যাইহোক, কিছুক্ষন গল্প করে আবার এগোলাম। এখানেও, আমার দেশের লোক হওয়া সত্ত্বে্ও, এরা আমাকে জলপ্রপাতের দূরত্ব সম্পর্কে ভূল তথ্য দিল। ফেরার পথে এই সম্পর্কে অনুযোগ করলে ওরা হাসতে হাসতে বলল, “কাকু, ঠিক দূরত্ব বললে আপনি তো আর এগোতেনই না, আপনার জায়গাটা আর দেখা হত না। তাই আপনাকে উৎসাহ দেবার জন্য দূরত্ব কমিয়ে বলেছি। দেখুন, আপনি তো ঠিকঠাকই দেখে এখন ফিরে আসছেন”। ভেবে দেখলাম, একদিক থেকে ঠিকই তো। যাই হোক, এখানে বলে নিই, এই ১ কিমি মতো যাত্রা পথ আমাদের মত বৃদ্ধদের পক্ষে যথেষ্ট কষ্টসাধ্য জার্নি, কিন্তু একটু কষ্ট করে পৌঁছতে পারলে কথা দিতে পারি ঠকবেন না। অসম্ভব সুন্দর প্রাকৃতিক পরিবেশের মধ্যে লুক্কায়িত এই ঝর্নাটির চারিপাশে গভীর জংগল, একটু দূর থেকেই জলের আওয়াজ শুনতে পাওয়া যায়, তারপরে হঠাৎই প্রকাশিত হয় এর রূপ, আমরা এর দুটি ধারা, একটি বড়, অন্যটি ছোট ও শীর্ন, দেখতে পেয়েছি। আমরা ছাড়া আর অন্য কোন প্রানীকে এই ফলসের কাছে দেখতে পাই নি। এই প্রপাতের একটি বিশেষত্ব হল যে এখানে একদম জল প্রপাতের নিচে পৌঁছে যাওয়া যায়, স্নান করাও যায়। আমার ভাই ও ভ্রাতৃবধু তো আগেই এখানে পৌঁছে গিয়েছিল, তারপর আমি ওখানে গিয়ে ওদের সংগে যোগ দিই। ওখানে পৌঁছানোর পর প্রারম্ভিক মনোভাব হল এই যে, আমি পেরেছি! এখানে আধ ঘন্টার মত কাটিয়ে, খুব একটা পরিতৃপ্তির শান্তি নিয়ে ফিরে পথ ধরলাম। ফিরতি পথে আবার আমার দেশওয়ালী লোকদের সংগে দেখা হল, তাদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে ফিরে চললাম আমাদের আস্তানায় দিকে।
এ দিনের শেষ গন্তব্য হল কোরাপুট মূল শহরের মধ্যে অবস্থিত “শবর শ্রীক্ষেত্রের জগন্নাথ মন্দির”, যা কিনা, আমাদের হোটেলের ঠিক উপরে এক টিলার ঊপরে অবস্থিত। আমাদের গাড়ী, আমাদের বিশেষ অনুরোধে (এই স্পটটি আমাদের নির্দ্দিষ্ট ভ্রমনসূচির মধ্যে ছিল না্ এই মন্দির চত্তরেই নামিয়ে দিয়ে আমাদের থেকে আজকের মত বিদায় নিল। এই মন্দিরের নাম “শবর শ্রীক্ষেত্র জগন্নাথ মন্দির”। আমরা যা শুনলাম যে এই নামকরনের পিছনে একটি ইতিহাস আছে, বলা হয়ে থাকে যে দ্বাদশ শতাব্দীতে স্থানীয় জাতিগোষ্টীর (যাঁদের “শবর” বলে ডাকা হয়) শাষকেরা এই মন্দির তৈরী করেছিল। তাই এই মন্দিরটি “শবর শ্রীক্ষেত্র” বলে পরিচিতি লাভ করেছে। এই ধর্মস্থান বর্তমানে পুরীর মন্দিরের পরেই ওডিশার অন্যতম মূখ্য জগন্নাথ মন্দির বলে মানা হয়ে থাকে। কোরাপুটের সর্বোচ্চ টিলার উপর এই মন্দির প্রকৃতপক্ষে একাধিক মন্দিরের সমন্বয়ে গঠিত হয়েছে। পরিস্কার পরিচ্ছন্ন মন্দির, মন্দির প্রাংগন থেকে কোরাপুটের দৃশ্য আমাদের ভালই লাগল। এই মন্দিরটি প্রদক্ষিন করার পর আমরা পায়ে হেটে আমাদের হোটেলে নেমে এলাম।
২৮-০২-২০ – আজ আমাদের এই জগদলপুর-কোরাপুট অফবিট সার্কিট ভ্রমনের অন্তিম দিন। যথারীতি গত কালের মতই আমরা বেরিয়ে পড়লাম আমাদের আজকের গন্তব্যের উদ্দেশ্যে। আজ আমাদের জন্য বরাদ্দ দু’তিনটি স্পট, কিন্তু স্পটগুলি বেশ দূরে দূরে অবস্থিত। আজকের দ্রষ্টব্যের মধ্যে রয়েছে “ডুডুমা জলপ্রপাত”, যার নাম আমাদের ছোট বেলা থেকেই শুনে আসছি। ফলে এই নামটার সংগে একটা নস্টালজিক-তথা-রোমান্টিক আমাদের সব বাংগালী হৃদয়ের সঙ্গেই জড়িয়ে আছে, আমরাও এর ব্যতিক্রম নই। যাইহোক, এদিনের আমাদের প্রথম গন্তব্য ছিল জোলাপুট ড্যাম ও তার সংগে একটি পার্ক। এই ড্যাম সম্পর্কে বিশেষ কিছু বলার নেই, দেশের অন্যান্য ড্যামের মতই একটি সাধারন ড্যাম; শুধু এটা বলা যেতে পারে যে এই ড্যামের অবস্থান এক পাহড়ী রুক্ষ পরিবেশের মধ্যে, ফলে ড্যাম টির পরিবেশ বেশ দৃষ্টিনন্দন।
এর পরে আমরা গেলাম আজকের Star attraction ডুডুমা জলপ্রপাতের কাছে। এই জল প্রপাতটি সম্ভবতঃ ভারতবর্ষের সর্বোচ্চ জলপ্রপাত, এর উচ্চতা প্রায় ৫৭৫ ফিট, মাছকুন্ড নামে এক নদীর অববাহিকায় এর সৃষ্টি। এই এলাকাটি স্থানীয় “বোন্ডা” উপজাতি অধ্যুষিত, এবং নিকটস্থ গ্রামের নাম হল “বাডিগঢ়া”। কোরাপুট থেকে এর দূরত্ব প্রায় ৯০ কিমি মতো। যে বিশাল জলস্রোত এই জলপ্রপাত বহন করে সগর্জনে নিচে গিরিখাতে পড়ছে, তার (এই অফ সিজিনেও) পরিমান এত বেশী যে এর থেকে উদ্ভূত জলকনা দ্বারা সৃষ্ট ধোঁওয়া দর্শকদের দৃষ্টি আচ্ছন্ন করে দেয়। এই জলপ্রপাতের ভৌগলিক অবস্থান ওডিশায় হলেও এর জল যে গিরিখাত দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে, সেটি অন্ধ্রপ্রদেশ ও ওডিশার মধ্যে সীমানা নির্ধারন করে দিয়েছে। ডুডুমার মূল প্রবাহ একটিই, কিন্তু এর সহযোগী আরও দুটি প্রপাত আমাদের নজরে এল, দুটিই অপেক্ষাকৃত অনেক ছোট, তার একটি ওডিশার মধ্যে, অন্যটি অন্ধ্রপ্রদেশের দিকে। শোনা গেল এই প্রপাতে নীচে নামার জন্য সিঁড়ি করা আছে, যার সংখ্যা হল প্রায় আটশোর মত। বলা বাহুল্য, আমরা নীচে নামার দুঃশ্চেষ্টা করি নি। আমরা উপরের থেকে যা দেখলাম, তাতেই আমাদের মন ভরে গেল। এর নিছক বিশালত্বের কাছে কেমন যেন একটা অসহায় ভীতি, এক অনিশ্চিতের আশংকা আমাদের মনে এল। কথায় বলে না, “ভয়ংকর সুন্দর”, এই জলপ্রপাত হল সেই ভয়ংকর সুন্দরের এক প্রকৃষ্ট উদাহরন। এই প্রপাতের কাছে আমরা কাটালাম বেশ কিছুক্ষন, আমাদের এই ভ্রমনের শেষ প্রান্তে এসে মনে হল আমাদের এই অফবিট ভ্রমনের পূর্ন পরিনিতি পেল গতকালের “দেওমালী হিলটপ” আর আজকের “ডুডুমা জলপ্রপাত” – এই দুটি দ্রষ্টব্য অন্ততঃ আমার ট্রাভেলার জীবনের হাইলাইটস হয়ে থাকবে।
এর পরে আমরা আজকের ঘোরার শেষ স্পট, “জোলাপুট ড্যাম” ও “মাছকুন্ড হাইডেল পাওয়ার প্রজেক্ট” বাইরে থেকে ঘুরে দেখে নিলাম। প্রজেক্টের ভিতরেও ঢোকা যায়, তবে তার জন্য বিশেষ অনুমতির প্রয়োজন পড়ে। আমাদের তার জন্য সময় বা ইচ্ছা কোনটাই ছিল না। ফেরার পথে এক গ্রাম্য বাজারের মধ্যে একটি সাধারন খাবারের দোকানে কিছু খেয়ে ক্ষুন্নিবৃত্তি নিবারন করলাম। আমরা আমাদের সারা দিনের কষ্টসাধ্য, কিন্তু মন-ভালো-করে-দেওয়া এক পরিতৃপ্তি নিয়ে আমাদের আস্তানায় এসে আমাদের ভালোলাগা স্মৃতি গুলি নিয়ে কিছু নাড়াচাড়া করার পর হোটেলের পাওনা গন্ডা মিটিয়ে, খাওয়া দাওয়া সেরে তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়লাম, কেননা কাল সকালেই আমাদের ফেরার ট্রেন। আমাদের ফেরার ট্রেন হল সম্বলেশ্বরী এক্সপ্রেস, যা কিনা কোরাপুট থেকে ছাড়ে সকাল ০৭.১০ মি। আমাদের হোটেলের স্টাফেরা বলল যে আমাদের স্টেশনে যাবার জন্য কোনও গাড়ী অগ্রিম বুকিং-এর প্রয়োজন নেই, কেননা ভোর বেলা থেকেই হোটেলের সামনে থেকেই প্রচুর অটো পাওয়া যাবে; আমরা ওদের কথামত আর কোন গাড়ী বুকিং করি নি। আরও একটা জিনিষ জানা গেল যে আমাদের ট্রেনে সম্বলপুর পর্যন্ত কিন্তু কোনও পান্ট্রি কার থাকবে না, তাই রাস্তায় খাওয়া দাওয়ার বন্দোবস্ত আমাদেরই করে নিতে হবে, অন্ততঃ সম্বলপুর পর্যন্ত। তাই আমরা কিছু শুকনো খাবার, যেমন, মুড়ি, চানাচুর, কেক, ডিম সেদ্ধ, পাকা কলা, ইত্যাদি সংগ্রহ করে রাখলাম, যাতে অন্ততঃপক্ষে আমাদের লাঞ্চ পর্যন্ত কাজ চলে যায়।
২৯-০২-২০ – আজ ভোর বেলায় প্রস্তুত হয়ে ল্যাগেজ নিয়ে বাইরে আসতেই আমরা পেয়ে গেলাম এক অটো, ভাড়া সেই একই, ১০০.০০ টাকা – হোটেল থেকে স্টেশন। ১৫ মি মধ্যে পৌঁছে গেলাম কোরাপুট স্টেশনে। কিছুক্ষন বাদেই ট্রেন এল, আমাদের টিকিট ছিল এ সি থ্রি টায়ারে, একেবারে ফাঁকা কামরা, আমরা মাত্র কয়েকজন যাত্রি, এমন কি কোনও টিকিট কালেক্টরেরও দেখা মিলল না। এই রকম চলল সম্বলপুর পর্যন্ত। তারপরে কিছু ভীড় হল, কিন্তু তাও শুধু বৈধ যাত্রিদেরই, অন্য রুটের মত অবৈধ যাত্রীদের দৌরাত্ম্য আমাদের এই যাত্রায় ভোগ করতে হয় নি – এটাও এই রুটের এক বৈশিষ্ট্য বলে আমাদের মনে হল। আমাদের ফিরতি যাত্রা ছিল ঘটনাবিহীন, নিরুপদ্রব।
১-০৩-২০ – নতুন মাসের প্রথম দিনের সকালে ঘুম ভাংগল তখন আমরা পশ্চিমবংগে ঢুকে পড়েছি। ট্রেন মোটামুটি সঠিক সময়েই চলছে। ঠিক ০৬-১৫ মি আমাদের ট্রেন হাওড়া স্টেশনে পৌছালাম; বাইরে বেরিয়ে প্রিপেড ট্যাক্সি লাইনে বিশেষ ভীড় ছিল না, ১৫ মি মধ্যেই পেয়ে গেলাম আমাদের ট্যাক্সি; সকাল আটটার মধ্যেই পৌঁছে গেলাম আমাদের বেহালার বাড়ীতে। এই ভাবে শেষ হল আমাদের এক অবিস্মরনীয় অফবিট ভ্রমন।
বন্ধুদের যদি কোনও প্রশ্ন থাকে, আমি সানন্দে সাধ্যমত তার উত্তর দিতে তৈরি রইলাম। তবে একটা অনুরোধ, প্রশ্ন করার আগে একবার আমার পোস্ট করা সব ক’টি পর্ব একবার ভাল করে পড়ে নিয়ে তারপর আপনাদের প্রশ্ন করবেন। ধন্যবাদ ও নমস্কার।