Churn : Universal Friendship
Welcome to the CHURN!

To take full advantage of everything offered by our forum,
Please log in if you are already a member,
or
Join our community if you've not yet.


Churn : Universal Friendship
Welcome to the CHURN!

To take full advantage of everything offered by our forum,
Please log in if you are already a member,
or
Join our community if you've not yet.

Churn : Universal Friendship
Would you like to react to this message? Create an account in a few clicks or log in to continue.

Churn : Universal Friendship Log in

PEACE , LOVE and UNITY


descriptionবিশাখাপত্তনম আরাকু জগদলপুর কোরাপুট Emptyবিশাখাপত্তনম আরাকু জগদলপুর কোরাপুট

more_horiz

#বিশাখাপত্তনম –> আরাকু –> জগদলপুর -> কোরাপুট –(১)



প্রাক-কথন (প্লানিং পর্ব)



“কলকাতা – বিশাখাপত্তনম – আরাকু – জগদলপুর – কোরাপুট – কলকাতা”।
যাত্রা শুরুর দিন ঠিক হল ২০ শে ফেব্রুয়ারী(বৃহস্পতিবার); আর কলকাতায় ফেরার দিন হল ২রা মার্চ, ২০২০।
অনেক ঝাড়াই বাছাইএর পর শেষ পর্যন্ত আমাদের দিন ভিত্তিক ভ্রমনসূচী ঠিক হল এই ভাবে –
২০শে ফেব্রুয়ারী, ২০২০ হাওড়া থেকে যাত্রা শুরু, ১২৮৪১ করমন্ডল এক্সপ্রেসে, হাওড়া থেকে ছাড়ছে দুপুর ০২.৫০ মিঃ
২১শে ফেব্রুয়ারী, ২০২০ পৌঁছানো বিশাখাপত্তনমে, ভোর বেলা ০৪.০০টার সময়।
২১শে ও ২২শে ফেব্রুয়ারী, ২০২০ – রাত্রিবাস বিশাখাপত্তনমে (২ রাত্রি)।
২৩শে ফেব্রুয়ারী, ২০২০, বিশাখাপত্তনম থেকে আরাকু, ৫৮৫০১ বিশাখাপত্তনম-কিরন্ডুল প্যাঃ, ছাড়বে সকাল ০৬.৫০ মিঃ (আমরা কিন্তু সোজা আরাকু পর্যন্ত যাবো না, আরাকুর দুটি স্টেশন আগেই নেমে পড়ব “বোরোগুহালু” স্টেশনে। সেখান থেকে বোরোগুহা দেখে একটা গাড়ী ভাড়া করে সড়কপথে রওয়ানা দেব আরাকুর উদ্দেশ্যে, এই ফিরতি পথে যত গুলি দ্রষ্টব্য পড়বে, সেগুলি একে একে দেখে নেব)
ঐ দিনেই পৌঁছব “বোরোগুহালু” স্টেশনে, সকাল ০৯.৪২ মিঃ
২৩শে ও ২৪ ফেব্রুয়ারী, ২০২০ – রাত্রিবাস আরাকু (২ রাত্রি)।
২৫শে ফেব্রুয়ারী, ২০২০, আরাকু থেকে জগদলপুর, ৫৮৫০১ বিশাখাপত্তনম-কিরন্ডুল প্যাঃ, আরাকু ছাড়বে সকাল ১১.০০ মিঃ
ঐ একই দিনে (২৫শে ফেব্রুয়ারী) পৌঁছব জগদলপুর বিকাল ০৪.৩০ মিঃ
২৫শে ও ২৫শে ফেব্রুয়ারী, ২০২০ – রাত্রিবাস জগদলপুর (২ রাত্রি)।
২৭শে ফেব্রুয়ারী,২০২০,জগদলপুর থেকে কোরাপুট, ৮৫০২ কিরন্ডুল-বিশাখাপত্তনম প্যাঃ,জগদলপুর ছাড়বে সকাল ১০.০০মিঃ
২৭শে, ২৮শে ও ২৯শে ফেব্রুয়ারী, ২০২০ – রাত্রিবাস কোরাপুট (৩ রাত্রি)।
১লা মার্চ, ২০২০, জগদলপুর থেকে হাওড়া, ১৮০০৬ কোরাপুট-হাওড়া এক্সপ্রেস, ছাড়বে সকাল ০৭.১০ মিঃ
২রা মার্চ, ২০২০, পৌছব হাওড়া, সকাল ০৬.১৫ মিঃ

এই হল আমাদের বেড়ানো সলতে পাকানোর পর্ব, অর্থাৎ কিনা প্লানিং-এর গল্প। এর পরে একে একে আসবে রেল বুকিং পর্ব, তারপরে হোটেল বুকিং পর্ব এবং সবশেষে আসবে বেড়ানোর আখ্যান।

Last edited by Admin on Thu Apr 23, 2020 9:44 am; edited 1 time in total

descriptionবিশাখাপত্তনম আরাকু জগদলপুর কোরাপুট EmptyRe: বিশাখাপত্তনম আরাকু জগদলপুর কোরাপুট

more_horiz

#বিশাখাপত্তনম–>আরাকু–>জগদলপুর->কোরাপুট –(২)
রেল টিকিট বুকিং


হাতের কাছে নেটের সহজ-ল্ভ্যতা এখন রেল টিকিট বুকিং করার সেই আগেকার দিনের লাইন দিয়ে টিকিট কাটার দুঃস্বপ্নের অবসান ঘটিয়েছে। তা ছাড়া হোটেল বুকিং-এর অনিশ্চয়তাও এখন আর নেই। তাই যাত্রার দিন ও যাত্রাসংগীরা যখন ঠিক হয়েই গেছে, তখন আর দেরী কীসের? বসে পড়া গেল PC -এর সামনে, আঙ্গুল রইল কি-বোর্ডের উপর। প্রথমেই ঢোকা হল IRCTC সাইটে। এখানে বলে নেওয়া ভাল যে আমরা টিকিট কাটতে বসেছি আমাদের যাত্রা শুরুর ৪৫ দিন আগে, অর্থাৎ অগ্রিম টিকিট বুকিং শুরু হবার(৯০ দিন) বেশ কিছুদিন পরেই। তাই আমাদের সবচেয়ে চিন্তা ছিল কনফার্মড টিকিটের প্রাপ্যতা নিয়ে। বিশেষ করে আমাদের প্রথম বুকিং ছিল হাওড়া থেকে বিশাখাপত্তনম পর্যন্ত এবং করমন্ডল এক্সপ্রেসের মত জনপ্রিয় ও ব্যস্ত ট্রেনে, এসি – থ্রি টায়ার ক্লাসে। যাইহোক, আমাদের চিন্তার অবসান ঘটিয়ে আমরা পেয়ে গেলাম কনফার্মড টিকিট, সবারই। কিন্তু একটা কাঁটা রয়ে গেল, আমরা পাঁচ জনের মধ্যে চার জন বরিষ্ট নাগরিক হওয়া সত্ত্বেও এবং সবারই লোয়ার বার্থের অপশন দেওয়া হলেও, আমাদের পাঁচ জনেরই টিকিট মিলল মিডল ও আপার বার্থে, একটিও লোয়ার বার্থ হল না। এই রুটের AC-3 Class-এর ভাড়া (রিসার্ভেশন চার্জ সহ) আমাদের যা দিতে হল, তা হচ্ছে নিন্মরূপঃ
Adult – 1255.00
Sr. Female – 670.00
Sr. Male – 790.00
এর পরের বুকিং ছিল বিশাখাপত্তনম থেকে বড়াগুহালু পর্যন্ত। ট্রেন - ৫৮৫০১ বিশাখাপত্তনম কিরন্ডুল পাসেঞ্জার, মোটামুটি ৩ ঘন্টার মত অল্প সময়ের যাত্রা, তাও আবার দিনের বেলায়, তাই আমরা ঠিক করলাম যে আমরা যাব নন-এসি সেকেন্ড ক্লাস সিটিং শ্রেনীতে। আমাদের মনে হয়েছিল যে যেহেতু এই রুটে খুব একটা ভীড় হয় না বলে শুনেছি এবং পাহাড়ী পরিবেশে আবহাওয়াও মনোরম থাকবে, তাই এই জার্নিটা বিশেষ কষ্টদায়ক হবে না; আর সবচেয়ে বড় কথা এর ফলে বেশ কিছু খরচও বাঁচানো যাবে। প্রত্যাশিত মত আমরা আমাদের পছন্দ মত কনফার্মড টিকিটও পেয়ে গেলাম, এমনকি দুটি জানলা ধারের সিটও পাওয়া গেল। এই রুটের II Class Seating-এর ভাড়া (রিসার্ভেশন চার্জ সহ) দিতে হল নিন্মরূপ হারেঃ
Adult – 40.00
Sr. Female – 30.00
Sr. Male – 30.00
এর পরের টিকিট ছিল আরাকু থেকে জগদলপুর পর্যন্ত। এই যাত্রাও সেই একই ৫৮৫০১ বিশাখাপত্তনম কিরন্ডুল পাসেঞ্জার ট্রেনে এবং পুরোটাই হবে সাড়ে পাঁচ ঘন্টার ডে জার্নি। তাই একই যুক্তিতে আমরা কাটলাম সেকেন্ড ক্লাস স্লিপারের টিকিট। সিটিং টিকিটের বদলে স্লিপার টিকিট কাটার যুক্তি হল যেহেতু এই অংশে অপেক্ষাকৃত বেশী সময়ের জার্নি, তাই দিনের জার্নি হলেও, প্রয়োজন পড়লে একটু হাত-পা ছড়িয়ে শুয়ে নেওয়ার অপশন থাকবে। সবার জন্যই কনফার্মড টিকিট মিলে গেল। এখানে একটা কথা বলে নিই। আমরা আমাদের বন্ধুদের (যাঁরা এই রুটে এর আগেই যাতায়াত করেছেন) কাছ থেকে শুনেছিলাম যে আরাকুতে এই ট্রেন একেবারেই খালি হয়ে যায়, এত খালি থাকে যে হাতে-গোনা যে কজন যাত্রী থাকেন, তাঁদের রীতিমত ভয়ের পরিবেশে যাত্রা করতে হয়। টিকিট কাটতে গিয়ে কিন্তু আমাদের অভিজ্ঞতা হল অন্য রকম। যেমন, আমরা সকলেরই কনফার্মড টিকিট পেলাম বটে, কিন্তু কারোরই লোয়ার বার্থ হল না।এই ঘটনায় আমরা একটু অবাকই হলাম, কেননা আমাদের খবর অনুযায়ী ট্রেন তো খালি যাওয়ারই কথা। তাহলে সিনিয়র সিটিজেন হওয়া সত্ত্বেও আমরা কেউই লোয়ার বার্থ পেলাম না কেন? মজার কথা হল যখন পরবর্তী সময়ে আমরা এই রুটে যাত্রা শুরু করলাম, তখন ট্রেন কিন্তু আক্ষরিক অর্থে খালিই রইল, অর্থাৎ আমাদের বন্ধুদের ফিডব্যাক সঠিকই ছিল। কিন্তু আমরা বুঝতে পারলাম না, তাহলে IRCTC কোন যুক্তিতে এইভাবে seat allotment করল, আর এতগুলি লোয়ার বার্থ তাহলে কি unalloted রয়ে গেল, আর তা না হলে সেগুলি গেলই বা কোথায়!! একজন যাত্রীকেও তো লোয়ার বার্থে দেখা গেল না। রেলওয়ের(IRCTC) এই বার্থ allotment-এর স্ব-বিরোধিতা সম্বন্ধে যদি কোনও অভিজ্ঞ বন্ধু কিছু আলোকপাত করতে পারেন, তবে খুশী হতাম। এই রুটের II Class Sleeper-এর ভাড়া (রিসার্ভেশন চার্জ সহ) হচ্ছে নিন্মরূপঃ
Adult – 100.00
Sr. Female – 60.00
Sr. Male – 70.00
এর পরের যাত্রা নির্দিষ্ট ছিল জগদলপুর থেকে কোরাপুট পর্যন্ত। ট্রেনের টাইম টেবলে দেখা গেল এই দুই জায়গার দূরত্ব মাত্র ১০০ কিমি-র মতো। এই রাস্তায় একাধিক ট্রেন তো আছেই, তা ছাড়া বাস, শেয়ার ট্যাক্সীও পাওয়া যায় বলে শোনা গেল। তাই আমরা ঠিক করলাম যে এই অংশের জন্য আমরা কোনও অগ্রিম টিকিট কাটবো না। এতে আমাদের কিছুটা flexibility থাকবে এবং টাইম মানেজমেন্টও ভাল করে করা যাবে। প্রয়োজন বোধে আমরা ট্রেন, বাস বা ট্যাক্সী – যে কোনও মাধ্যম ব্যাবহার করে কোরাপুট পৌঁছে যেতে পারব। যাইহোক, এখানে বলে নিই যে আমরা শেষ পর্যন্ত ট্রেন(৫৮৫০২ কিরন্ডুল-বিশাখাপত্তনম প্যাসেঞ্জার) ধরেই কোরাপুট গিয়েছিলাম। সকাল ১০ টা নাগাত প্যাসেঞ্জার ট্রেন ধরে বেলা ১ টা নাগাত পৌছে যাই কোরাপুটে। আমরা II Class-এ গিয়েছিলাম, একদম খালিই ছিল কামরা। আর ভাড়া পড়েছিল এইরকম –
Adult – 40.00
Sr. Female – 30.00
Sr. Male – 30.00
আমাদের ট্রিপের অন্তিম পর্ব ছিল কোরাপুট থেকে কলকাতা ফেরা। এই পথে একমাত্র ট্রেন হল ১৮০০৬ কোরাপুট-হাওড়া সমলেশ্বরী এক্সপ্রেস। এই ট্রেন টি কোরাপুট থেকে ছাড়ে সকাল ০৭.১৫ মিঃ, আর হাওড়া পৌঁছায় পরদিন সকাল ০৬.১৫ মিঃ।বলা বাহুল্য, এই পর্বে্র যাত্রার জন্য অগ্রিম রিজার্ভেশন তো must. আমাদের ভাগ্য ভাল যে এবারও সমস্ত টিকিট গুলিই confirmed পাওয়া গেল। শুধু তাই নয় এবার কিন্তু আমরা ৫ টি টিকিটের মধ্যে তিনটিই পেলাম লোয়ার বার্থ, যা কিনা আমাদের এই ২৪ ঘন্টাব্যাপী ক্লান্তিকর যাত্রাপথকে কিছুটা সহনীয় করতে সাহায্য করেছিল। এবারের ভাড়া পড়ল এই রকম-
Adult – 1355.00
Sr. Female – 700.00
Sr. Male – 830.00
এই হল আমাদের ট্রেন বুকিং-এর উপাখ্যান। আমরা একই দিনে single seating-এ এই বুকিংগুলি করেছি, যা আর কোনও দিন করেছি বলে মনে পড়ে না। সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য কথা হল সব পর্বের টিকিটই ছিল confirmed টিকিট, যদিও birth selection সবসময়ে মনোমত হয় নি।

এর পরের পর্বে থাকবে আমরা এই ট্রিপে যে যে হোটেলগুলিতে ছিলাম তার একটা রুপরেখা এবং তার সংগে থাকবে সেই সব হোটেল বুকিং-এর উপাখ্যান।

descriptionবিশাখাপত্তনম আরাকু জগদলপুর কোরাপুট EmptyRe: বিশাখাপত্তনম আরাকু জগদলপুর কোরাপুট

more_horiz

#বিশাখাপত্তনম –> আরাকু –> জগদলপুর -> কোরাপুট –(৩)
হোটেল ও হোটেল বুকিং


প্রথমেই বলে নিই যে এই হোটেল নির্বাচনের ব্যাপারে আমি সবচেয়ে বেশী নির্ভর করেছি আমার ফেসবুক বন্ধুদের ফিডব্যাকের বন্ধুদের ফিডব্যাক উপর নির্ভরতা আমাদের ক্ষেত্রে চমৎকার কাজ করেছে। তাই আমি ধন্যবাদ জানাতে চাই সেই সব বন্ধুদের যাঁরা আমার নিরন্তর প্রশ্নের জবাব ধৈর্য্য ধরে, বিরক্ত না হয়ে দিয়ে গিয়েছেন। আমরা মূলতঃ এই ফিডব্যাকের উপর ভিত্তি করে প্রথমে প্রতিটি স্থান(যেখানে আমাদের রাত্রিবাস করার কথা আছে)-এর জন্য কয়েকটি সম্ভাব্য হোটেলের নাম short listed করেছি। Short Listing করার সময় যে পয়েন্টগুলি নজরে রেখেছি, সেগুলি হল – ১) লোকেশন, ২) ট্যারিফ, ৩) ফিডব্যাক, ৪) চেক ইন/চেক আউটের নিয়ম, ৫) ঘর সংলগ্ন Western Type toilet আছে কিনা, ইত্যাদি ইত্যাদি। এইবার এই short listed hotel গুলির স্ট্যাটাস দু একটি অন-লাইন রিজার্ভেশন সিস্টেমের (যেমন, মেক মাই ট্রিপ, গো আইবিবো, ইত্যাদি) রিভিউ পেজে গিয়ে Cross-Check করেছি। এ ছাড়া, কোনও কোনও ক্ষেত্রে সোজাসুজি নির্দিষ্ট হোটেলের সাথেও কথা বলেছি। এত কিছু করার পরেও যখন কোনও কিছুই ঠিক করে উঠতে পারি নি, সে সব ক্ষেত্রে “গিয়ে-তো-হাজির-হই-তারপর–দেখা-যাবে” গোছের মনোভাব নিয়েছিলাম। এখানে বলে নিচ্ছি এই ট্রিপে হোটেল নিয়ে খুব একটা অসুবিধার মধ্যে পড়ি নি কোথাও। যে হোটেলগুলিতে আমরা উঠেছিলাম, সেগুলির নাম, তার সম্বন্ধে কিছু মন্তব্য, ট্যারিফ, ফোন নং ইত্যাদি এখন আপনাদের সংগে শেয়ার করছি।
বিশাখাপত্তনম – প্রথমে আমি চেষ্টা করেছিলাম রামকৃষ্ণ বিচের উপর বাংগালী মালিকাধীন হোটেল, “হোটেল সোনার বাংলা” বুক করতে। এটি কোনও অন লাইন রিজার্ভেশন সংস্থার সাথে যুক্ত নয় বলে মনে হল। তাই সোজাসুজি ফোনই করলাম, উত্তবে জনৈক ব্যক্তি আমাকে পত্রপাঠ জানিয়ে দিলেন যে ওঁরা অন্ততঃ তিনদিন বা তার বেশী সময়ের জন্য হলেই বুকিং দেন, অন্যথায় নয়। আমার যেহেতু দু দিনের বুকিং দরকার, তাই তাঁরা আর কথা না বাড়িয়ে ফোন কেটে দিলেন। আমার মনে হয়েছে, অত্যন্ত unprofessional approach এবং যে কোনও hospitality service provider-এর পক্ষে অযোগ্য ব্যাবহার।
এখানে আমাদের দ্বিতীয় short listed হোটেল ছিল “হোটেল রামচন্দ্র এ সি”, যেটি কিনা বিশাখাপত্তনম স্টেশনের কাছেই। এই হোটেলটি অন লাইনে “মেক মাই ট্রিপ” সংস্থার মাধ্যমে বুক করলাম খুব সহজেই। ভাড়াও তুলনামূলক ভাবে যথাযথ বলে আমার মনে হল। এর অনলাইন ও আমার ফেসবুক বন্ধুদের ফিডব্যাক ঠিকঠাকই ছিল।
অবস্থান - রামচন্দ্র সার্কেল, রেলওয়ে লো ব্রিজ, রেলওয়ে স্টেশন রোড, বিশাখাপত্তনম। ফোন – ০৮৯১ ৬৬৬৮৬১২/৬৬৬৮৬১১। নন-এ সি ডাবল বেডরুমের ভাড়া পড়েছিল – ৬৮৫.০০। এ হোটেলটি বুক করা হয়েছিল “মেক মাই ট্রিপ”-এর মাধ্যমে। আমাদের ঘরে তিন জন থাকার জন্য দিন প্রতি আরও ২০০.০০ করে সোজাসুজি হোটেলকে দিতে হয়েছিল। এই শেষের চার্জ আমাদের কাছ থেকে জনৈক রিসেপশনের কর্মী আদায় করেছিলেন, কিন্তু এ জন্য আমাদের কোনও রিসিপ্ট দেওয়া হয় নি। ডাবল বেডরুমে তিন জন থাকার জন্যও দিন প্রতি অতিরিক্ত ২০০.০০ টাকা করে আদায় করা হয়েছিল, এবং এই অর্থেরও কোনো রিসিপ্ট দেওয়া হয় নি। অতিরিক্ত এক জনের জন্য একটি করে বালিশ ও কম্বল অবশ্য সরবরাহ করেছিল।
হোটেল টি সম্পর্কে আমাদের মন্তব্য – ঘরগুলি ছোট কিন্তু পরিস্কার পরিচ্ছন্ন, কাজ চলে যায় মোটামুটি। এ্যাটাচড বাথ, রানিং গরম জল, কমোড, টি ভি ছিল। পানীয় জল পরিশোধনের জন্য মেশিন আছে, ফলে পানীয় জল কেনার দরকার পড়ে নি। এই হোটেলে কোনও ইন-হাউস রেস্তাঁরা নেই। তবে সবচেয়ে সুবিধার ব্যাপার হল(বিশেষ করে বংগ-সন্তানদের জন্য) এই যে এই হোটেলের ঠিক পাশেই বিশাখাপত্তনমের বিখ্যাত বাংগালী খাবার রেস্তাঁরা – “নিমন্ত্রন” অবস্থিত। ফলে প্রাতরাশ থেকে রাত্রিকালীন বাংগালী ধাঁচের আহার একেবারে হাতের মুঠোয় ছিল। হোটেলটির অবস্থান স্টেশনের কাছে হওয়ায় পায়ে হেঁটেই যাওয়া যেত। আর নিকটতম সমুদ্র সৈকত, আর কে বীচ, অটোতে ৫০.০০ টাকা করে নিত (মোট ৫ জন ধরে যেত)। দু একটি ব্যাপার আমাদের ভাল লাগে নি। যেমন, আমাদের ট্রেন ভোর ৪টা নাগাত বিশাখাপত্তনমে পৌঁছে গিয়েছিল, তাই আমাদের প্রয়োজন ছিল Early Check In করার। আমরা MMT-র মাধ্যমে Early Check In করার অনুরোধও পাঠিয়েছিলাম। হোটেল কর্তৃপক্ষ আমাদের ভোর ৪টা থেকে ৭টা পর্যন্ত ঠায় বসিয়ে রাখে, রুম খালি নেই এই অজুহাতে। কিন্তু আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস যে রুম খালিই ছিল, শুধু আমাদের কাছ থেকে কিছু অতিরিক্ত টাকা (এক্ষেত্রে রুম প্রতি ২০০.০০) আদায় করার জন্যই এই কৌশল অবলম্বন করা হয়েছিল। এই তথাকথিত Early Check In charges-এর জন্যও আমাদের কোনো রিসিপ্ট ইস্যু করা হয় নি। এই প্রসংগে আর একটি কথা বলে নিই। আমাদের এই হোটেল টির একটি সহযোগী হোটেল আছে, নাম – “হোটেল রামচন্দ্র গ্রান্ড”, দুটি হোটেলই একই ঠিকানায় পাশাপাশি অবস্থিত। কিন্তু দুটি হোটেলের রিসেপশন একটিই; এবং সেই রিসেপশনের মাথায় কিন্তু শুধু “হোটেল রামচন্দ্র গ্রান্ড” নামটিই উল্লেখিত। আমাদের ড্রাইভার প্রথমে তো আমাদের নির্দ্দিষ্ট “হোটেল রামচন্দ্র এ সি” খুঁজেই পাচ্ছিল না, পরে গাড়ী থেকে নেমে জিজ্ঞাসা করে জানতে পারে যে “হোটেল রামচন্দ্র গ্রান্ড”-এর রিসেপশন আর “হোটেল রামচন্দ্র এ সি”-র রিসেপশন একই ও অভিন্ন।
আরাকু – মূলতঃ বন্ধুদের ফিডব্যাকের উপর ভিত্তি করেই আমরা স্থির করি যে আরাকুতে আমরা থাকব “হোটেল রাজধানী”তে। এই হোটেলটিও কোন অন-লাইন রিজার্ভেশন সিস্টেমের সংগে যুক্ত বলে মনে হল না। তাই বন্ধুদের দেওয়া ফোন নং-এ (Hotel Rajdhani Ph. No.08936-249745/ 249111/ 249580) যোগাযোগ করে হোটেল কর্তৃপক্ষ থেকে জানা গেল যে ১) ভাড়া পড়বে ৯০০.০০ নন-এসি রুম প্রতি (রেট negotiate করতে রাজী হয় নি); ২) ১ দিনের ভাড়ার সমমূল্যের অর্থ ওই হোটেলের Account-এ অগ্রিম হিসাবে পাঠাতে হবে; ৩) টাকা পাঠানোর পর confirmatory message-এর screenshot Whatsapp করতে হবে; এবং ৪) এর পরে হোটেল কর্তৃপক্ষ Whatsapp করে আমাদের booking confirmation পাঠিয়ে দেবেন। বাকি অর্থ/ভাড়া check out-এর সময় দিতে হবে।
আমরা সাথে সাথেই GooglePay App-এর মাধ্যমে দুটি রুমের জন্য দুদিনের ভাড়া (৯০০.০০x২) = ১৮০০.০০ পাঠিয়ে দিই। এর পরে একটি ছোটখাট নাটকীয় পরিস্থিতি তৈরী হয়। টাকা পাঠানোর পর ১-২ দিন কেটে গেলেও কোন মেসেজ বা কনর্ফামেশন আসে না, একই নাম্বারে ফোন করলে শুনতে পাই যে “insufficient balance”-জন্য incoming এবং outgoing call সাময়িক ভাবে বন্ধ আছে। হোটেলের অপর একটি নাম্বারে (নেট থেকে পাওয়া) ফোন করলে বলে যে হোটেলের বুকিং রেজিস্টারে আমাদের নাম নেই; আর যার Account-এ আমরা টাকা পাঠিয়েছি, তিনি এখন ছুটিতে রয়েছেন বলে আমাদের জানানো হয়। যখন আমি এই পরিস্থিতির কথা তৃতীয় একটি ফোনে হোটেলকে জানাই, তখন আমাদের শুধু বলা হয় যে আমাদের কোনও চিন্তা নেই, ঊক্ত ভদ্রলোক(পরে জানতে পারি উনিই ম্যানেজার) এলেই আমরা বুকিং কনর্ফামেশন পেয়ে যাব। স্বাভাবিক ভাবেই এই স্তোক বাক্যে আমাদের চিন্তা বিন্দুমাত্রও কমে নি। এই অবস্থার কথা আমি এই ফোরামে শেয়ারও করেছিলাম। তখনও কোন কোনও বন্ধু বলেছিলেন তাঁরা এই হোটেলে থেকেছেন এবং তাঁদের মতে হোটেল টি ভালই। যাই হোক, কিছুদিন বাদে ঐ ফোন নং টি আবার চালু হয়, তখন আমার সংগে অপর প্রান্তের ব্যক্তির সংগে কিছু তর্ক-বিতর্কও হয় এবং উনি এও বলে বসেন যে তাদের এই বুকিং-এর দরকার নেই; এবং তিনি টাকা ফেরত দিয়ে দেবেন।যাইহোক, শেষ পর্যন্ত টাকা আর ফেরত আসে নি, বদলে আমি Whatsapp-এর মাধ্যমে আমাদের প্রতীক্ষিত confirmationও পেয়ে যাই।
হোটেল টি সম্পর্কে আমাদের মন্তব্য – লোকেশন হচ্ছে আরাকু স্টেশনের এবং পদ্মাচেন গার্ডেনের কাছেই। চমৎকার প্রপার্টি, খুব বড় ঘর, রানিং গরম জল, attached western type toilet, TV, complimentary toiletries etc. ইন-হাউস মাল্টি কুউজিন রেস্তাঁরাও আছে। কিন্তু প্রাত্যহিক maintenance ভাল নয়। ম্যানেজমেন্ট নতুন আর একটি হোটেল বানাচ্ছেন, তাই সম্ভবতঃ এই প্রপার্টি সম্বন্ধে কিঞ্চিত উদাসীন। তবে আমি আমার বন্ধুদের জন্য এই হোটেলটিকে recommendই করব। আর হ্যাঁ, আর দু’একটি কথা বলে নেওয়া ভাল। বুকিং নিয়ে আমাদের সংগে যে তিক্ত ফোনালাপ হয়েছিল, তার রেশ/বা কোনো effect কিন্তু এঁদের ব্যাবহারে আমরা পাই নি।দ্বিতীয়তঃ, আমাদের ঘরে আমরা দুইজনের বদলে তিন জন ছিলাম, এর জন্য কোনও extra পয়সা নেয় নি।তৃতীয়তঃ, রিসেপশনে দেখলাম যে আমাদের ধরনের রুমের ভাড়া ৯৯৯.০০ লিখিত ভাবে দেখান আছে, কিন্তু ওঁরা আমাদের চার্জ করেছেন ৯০০.০০ টাকা করে।
জগদলপুর – এখানে পুরোপুরি আমার বন্ধুদের ফিডব্যাকের ভিত্তি করে আমরা দুটি হোটেলকে short listed করি – (১) হোটেল রিখা; এবং (২) হোটেল অতিথি (Hotel Atithi Ph. No. 07782-225275/224294) এই দুটি হোটেলের কোনটিই কোন অনলাইন বুকিং সিস্টেম সংস্থার তালিকাভূক্ত নয় বলেই আমার মনে হল।তাই কোনও অনলাইন রিভিউ আমরা পাই নি। এক্ষেত্রে সোজাসুজি হোটেলকেই ফোন মারফৎ যোগাযোগ করা ছাড়া আর কোনও উপায় ছিল না। আমরা কলকাতা থেকেই এই দুটি হোটেলের সংগে ফোনে কথাবার্তা বলি, দুটি হোটেল থেকেই আমাদের জানানো হয় যে তারা এত আগে অগ্রিম বুকিং নেন না। ওঁরা আমাদের আশ্বস্ত করেন যে আমাদের চাহিদা মত দিনগুলি “অফ সিজন” সময়ে পড়ছে, তাই বুকিং পেতে কোনও অসুবিধা হবে না। ওঁরা আমাদের বলেন যে আমরা যখন বিশাখাপত্তনমে পৌঁছব, অর্থাৎ জগদলপুর পৌঁছানোর ৩/৪ দিন আগে, তখন যেন আমরা ওঁদের যোগাযোগ করি। আমি ওদের কথায় আশ্বস্ত হয়ে ঠিক করি আমরা বিশাখাপত্তনমে পৌঁছনোর পরই ফোন করে যোগাযোগ করব। কিন্তু বিশাখাপত্তনমে এসে যখন প্রথমে “হোটেল রিখা”র সাথে যোগাযোগ করি, তখন হঠাৎ হোটেল ম্যানেজারের সুর পু্রোপুরি বদলে যায়; এবং উনি আমাদের জানান যে উনি দুঃখিত যে আমাদের কোনও রুম দিতে পারছেন না, কেননা একটা ম্যা্রেজ পার্টি পুরো হোটেলটিকেই বুক করে রেখেছে। আমি যখন ওনার পূর্ব প্রতিশ্রুতি স্মরন করিয়ে দিলাম, উনি তাতে শুধু “দুঃখিত” ছাড়া আর কিছু বলতে পারলেন না। এতে আমার তো panic button press হয়ে গেছে।এটা যদি ঐ এলাকার বিয়ের সিজনই হয়ে থাকে, তাহলে তো অপর short listed হোটেল – হোটেল অতিথিরও একই দশা হবে। যাই হোক দুরু দুরু বক্ষে করলাম ফোন হোটেল অতিথি-কে। এখানেও বিয়ের বুকিং রয়েছে, কিন্তু ঘর খালি আছে, তবে সেটা 2nd floor-এ(লিফট নেই)। Ground floor & First Floor সব ঘরই বুকড। উপায় না দেখে, আমাদের পক্ষে অসুবিধাজনক হওয়া সত্ত্বেও, আমাদের জন্য দুটি রুম ঐ 2nd Floorএই রেখে দিতে বললাম। ওঁরা রাজী হলেন; এবং কোনও advance payment করার দরকার নেই বলে জানালেন।এখানে আমি আপনাদের বলে রাখি যে আমরা এত প্যানিকড হয়ে গিয়েছিলাম যে মাঝের তিনটি দিনই রোজ একবার করে হোটেল অতিথি-কে ফোন করে গেছি আর আমাদের arrival re-confirm করে গেছি।
এবার হোটেলটি (হোটেল অতিথি) সম্পর্কে আমাদের মন্তব্য – হোটেলের ট্যারিফ হচ্ছে দিন প্রতি ৮০০.০০(নন এ সি ডাবল রুম) আর লোকেশন হচ্ছে স্টেশনের খুব কাছে, প্রকৃত পক্ষে রেলওয়ে এলাকার ঠিক বাইরেই এই হোটেলের অবস্থান। অটোতে ৫০.০০ টাকা নেয়, মাল পত্র সহ ৫ জন যাত্রী ধরে যায়। মাল পত্র না থাকলে হেঁটেই আসা-যাওয়া করা যায়। হোটেলটি বেশ বড় এবং সম্ভবতঃ এটি এই শহরের প্রথম হোটেল। বর্তমানে এটির সংস্কারকার্য চলছে। আশে পাশে তার চিহ্ন ছড়িয়ে রয়েছে দেখা গেল। আমাদের রুম দুটির অবশ্য সংস্কার হয়ে গেছে। একেবারে ঝাঁ চকচকে বিশাল রুম, ফার্নিশিংও বেশ রুচিসম্মত। Western Type Toilet, রানিং গরম জল, complimentary toiletaries ইত্যাদি। এখানেও আমরা আমাদের রুমে ৩ জন ছিলাম, কোন অতিরিক্ত চার্জ দিতে হয় নি। চেক ইন প্রক্রিয়া বেশ সহজ-সরল। ইন-হাউস রেস্তাঁরা আছে। হোটেল স্টাফ দের ব্যবহারও বেশ ভাল। মোটকথা, এই accommodation নিয়ে আমাদের কোনও অভিযোগ নেই, শুধু ঐ 2nd floor ওঠা-নামা করতে এই বয়সে আমাদের একটু কষ্টই হচ্ছিল, কিন্তু কি আর করা যাবে? বন্ধুদের জন্য আমরা এই প্রপার্টিকে recommendই করব।
কোরাপুট – এখানে আমরা তিনটি প্রপার্টি short listed করেছিলাম। (১) হোটেল আলিশান; (২) রাজ রেসিডেন্সী; ও (৩) অতিথি ভবন । এই লিস্টের প্রথম দুটি প্রপার্টি হল কমার্শিয়াল প্রপার্টি আর তৃতীয়টি হল কোরাপুট “সবর শ্রীক্ষেত্র জগন্নাথ মন্দির ট্রাস্ট”-পরিচালিত ভক্তদের জন্য থাকার জায়গা। প্রথম দুটি হোটেলই অন লাইন রিজার্ভেশন সিস্টেমের সংগে যুক্ত, এবং উভয়ের ক্ষেত্রেই ফিডব্যাক ভাল। তবে আমরা যখন বুক করতে চাইছিলাম তখন অন লাইন ট্যারিফ একটু বেশীই দেখাচ্ছিল, যা কিনা আমাদের বাজেটের পক্ষে একটু বেশী ছিল। তাই আমরা ঠিক করি অতিথি ভবনেই (ফোন নং ০৬৮৫২-২৫১৫১২/২৫২৫১২) থাকার চেষ্টা করব। ওঁদের ফোন করা হল; এবং প্রত্যাশিত ভাবেই আমাদের জানান হল এত আগে কোনও অগ্রিম বুকিং দেওয়া যাবে না; আমাদের যাবার দিন দশেক আগে যেন আমরা যোগাযোগ করি। এখানে বলে নিই এই প্রপার্টি সম্পর্কে বন্ধুদের কাছ থেকে mixed reaction পাওয়া গেল; তবে জানা গেল মোটামুটি ভাবে এ সি রুম গুলি বেশ ভালই। ভাড়াও (মাত্র ৭০০.০০ টাকা এ সি ডাবল বেড) আয়ত্বের মধ্যে। কিন্তু যখন আমাদের কোরাপুট পৌঁছাবার দিন দশেক আগে আবার যোগাযোগ করলাম, তখন ফোনের অপর প্রান্ত থেকে আমাদের জানানো হল যে সমস্ত ধরনের রুমই বুক হয়ে গেছে। আমদের তখন একেবারে অসহায় অবস্থা, শেষকালে এসে আটকে যাব! যাইহোক, যিনি ফোন ধরেছিলেন তাঁকে আমরা আমাদের অসহয়তার কথা জানিয়ে কিছু একটা করার অনুরোধ জানালাম। তখন তিনি বললেন এই ট্রাস্টের পরিচালিত আরও কিছু ভবন আছে, যদিও সেগুলি এ সি নয়। কিন্তু attached bath, running hot water, TV ইত্যাদি সব সুযোগ সুবিধাও আছে। এই ভবনটির নাম “শান্তি নিবাস”। (এই পরিস্থিতিতে আমার হঠাৎ মনে পড়ে গেল আমাদের এই ফোরামেই কোন একজন দিদি তাঁর কোরাপুট ভ্রমন কাহিনীতে এই থাকার জায়গাটির কথা আলোচনা করেছিলেন। আমার মনে পড়ল, তিনি এই accommodationএর প্রভূত প্রশংসাও করেছিলেন।) “অতিথি ভবনের” ভদ্রলোক আমাকে জানালেন যে এখানে যদি আপনারা থাকতে চান, তবে উনি একটি ফোন নং দিচ্ছেন; এই ফোন নাম্বারটি জনৈক অজয়বাবুর।এখানে ফোন করলে আমরা “শান্তি নিবাসে” accommodation পেয়ে যাব। তখন আমাদের ডুবন্ত অবস্থা, ঐ ফোন নাম্বারটিই খড়কুটোর মত আঁকড়ে ধরলাম। And to make the story short, আমরা “শান্তি নিবাসে” দুটি রুমএর বুকিং পেয়ে গেলাম, ভাড়া মাত্র ৪০০.০০ টাকা (তিন জন থাকার জন্য ১০০.০০ টাকা অতিরিক্ত)।
হোটেল টির অবস্থান একেবারে শহরের কেন্দ্রস্থলে, যে পাহাড়ের শীর্ষে শ্রী জগন্নাথ দেব অবস্থান করছেন, তার ঠিক নিচেই এই ভবনের অবস্থান, অটোতে স্টেশন থেকে ১০০.০০ টাকা ভাড়া, আমরা ৫ জনই মাল পত্র নিয়ে অনায়াসেই এসেছিলাম। ভাল রিপোর্ট থাকা সত্ত্বেও আমাদের কিঞ্চিত দ্বিধা তো ছিলই, কিন্তু হোটেলে পৌঁছাবার পর we are simply amazed! রাস্তার ঠিক উপরেই, ওঠা নামা করতে হয় না, পরিস্কার পরিচ্ছন্ন রিসেপশন, স্টাফদের চমৎকার ব্যাবহার, আর সবচেয়ে অবাক করল রুমগুলি। দুটি পৃথক খাট, একসংগে করে নিলে (আমরা তাই করেছিলাম) তিনজন অনায়াসেই থাকা যায়। Colored TV, attached western type bath, running hot water ইত্যাদি। সত্যি বলতে, আর কি চাই! একেবারে যাকে বলে, সস্তায় পুস্টিকর খাদ্য। একটাই অসুবিধা, সেটা হল ইন-হাউস রেস্তাঁরা নেই, এঁদের মূল ভবন “অতিথি ভবন”-এ, যা কিনা পাঁয়ে-হাটা দূরত্বে অবস্থিত, রয়েছে এঁদের কিচেন। এখানে অত্যন্ত সূলভ মূল্যে খাবার দাবার পাওয়া যায়, তবে তা সবই নিরামিশ। এই ভবনের ঠিক সামনেই রাস্তার অপর পারে দুটি দোকান আছে, সেখানে চা, প্রাতরাশ ও Evening snacks পাওয়া যায়।
যাঁরা ভবিষ্যতে কোরাপুট যাবেন, এবং যাঁরা বাজেট শ্রেনীর হোটেল/বাসস্থান খোঁজেন, তাঁদের ultimate destination হওয়া উচিত এইখানে। এই ট্রাস্ট মোট তিনটি ভবন পরিচালনা করেন – (১) অতিথি ভবন (উচ্চ শ্রেনী); (২) শান্তি ভবন (মধ্য শ্রেনী); ও (৩) যাত্রি নিবাস (সবচেয়ে কম খরচের জায়গা, ভাড়া মাত্র ২০০.০০ ঘর প্রতি)। এখানে একটাই অসুবিধা, সেটা হল অগ্রিম বুকিং-এর বন্দোবস্ত কেবলমাত্র অতিথি ভবনেই আছে; এবং কেবল মাত্র এখানেই আছে একটি টেলিফোন সংযোগ। অন্য কোথাও টেলিফোনও নেই, নেই কোন অগ্রিম বুকিং-এর ব্যবস্থা। তবে আগ্রহী বন্ধুরা অতিথি ভবনের ফোন নং (নং আগে দিয়ে দিয়েছি) –এ ফোন করে চেষ্টা করে দেখতে পারেন (আমরা যেভাবে করেছিলাম)।
এই সংগে শেষ হল আমাদের হোটেল নির্বাচন ও হোটেলের ভাল-মন্দের আখ্যান।

descriptionবিশাখাপত্তনম আরাকু জগদলপুর কোরাপুট EmptyRe: বিশাখাপত্তনম আরাকু জগদলপুর কোরাপুট

more_horiz

#বিশাখাপত্তনম –> আরাকু –> জগদলপুর -> কোরাপুট –(৪)



আমরা আমাদের যাত্রা শুরু করি ২০শে ফেব্রুয়ারী, বৃহস্পতিবার এবং আমাদের ট্রেন ছিল করমন্ডল এক্সপ্রেস, যার ছাড়ার সময় ছিল হাওড়া স্টেশন থেকে বেলা ২-৫০ মিঃ। আমরা আমাদের বাড়ী বেহালা শকুন্তলা পার্ক থেকে “ওলা” ক্যাবের সৌজন্যে আগে ভাগেই পৌঁছে গেলাম হাওড়া স্টেশনে, আমার ভাই ও তার স্ত্রী পৌঁছল একটু দেরীতে। একদম সঠিক সময়েই আমাদের ট্রেন ছাড়ল; এবং আমার প্রথম কাজ ছিল আমাদের জন্য নির্ধারিত আপার বার্থগুলি যথাসম্ভব লোয়ার বার্থে পরিবর্তিত করে নেওয়া। প্রথমে চেষ্টা করলাম টিকিট কালেক্টরের মাধ্যমে, কিন্তু তিনি প্রথমেই “কোনও বার্থ খালি নেই” বলে তাঁর অপারগতার কথা জানিয়ে দিলেন। এর পরে বাকি রইল সহযাত্রীদের অনুরোধ করা, যদি কেউ তাঁদের নিচের বার্থ আমাদের জন্য ছেড়ে দিয়ে উপরের বার্থ নিতে রাজী থাকেন। কিন্তু এই প্রচেষ্টাও কাজে এল না, কেননা আমাদের নিচের বার্থের সহযাত্রীরা সবাই আমাদের মতই সিনিয়র সিটিজেন, অতএব তাঁদের অনুরোধ করাই অর্থহীন। তাই শেষ পর্যন্ত আমাদের পূর্ব-নির্দিষ্ট মিডল ও আপার বার্থ নিয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হল। মনকে সান্তনা দেওয়া গেল এই বলে যে একটা রাত্রি তো মাত্র, কোন মতে কাটিয়ে দিলেই হল, কাল ভোরেই তো পৌঁছে যাচ্ছি ভাইজাগে। যাইহোক, বয়স-জনিত শারিরীক বাধ্যবাধকতার জন্য রাত্রিকালে বার্থ থেকে ওঠা-নামা ইত্যাদি করতে করতে ঘুম আর তেমন হল না, রাত্রি সাড়ে তিনটা থেকে উঠে বাক্সপেটরা গুছিয়ে নিয়ে নিচে গুটিসুটি মেরে বসে রইলাম; ট্রেন পৌঁছে গেল সময়ের কিছুটা আগেই, ভোর চারটার আগেভাগে। বিশাখাপত্তনম স্টেশনে ট্রেন অনেক সময় দাড়ায়, সম্ভবতঃ ইঞ্জিন, স্টাফ ইত্যাদি পরিবর্তন হয় এই স্টেশনেই। তাই আমাদের ধীরে সুস্থে ট্রেন থেকে নামতে কোনও অসুবিধা হল না।তখনও অন্ধকার রয়েছে পুরোমাত্রায়, শেষ শীতে আমেজে বাতাসে একটু ঠান্ডার ছোঁওয়া। স্টেশন চত্তর অবশ্য আলোয় আলোয় ঝলমল করছে, পরিস্কার পরিচ্ছন্ন প্লাটফর্ম, খুব একটা বেশী ভীড় লক্ষ্য করা গেল না। অনেক বসার জায়গা, চা-কফিও পাওয়া যাচ্ছে কাছেপিঠে। আমরা যে জায়গাটা বেছে নিয়ে বসলাম, সেখানে বসে-থাকা অন্য একটি বাংগালী গ্রুপের সংগে পরিচয় হল। এঁরাও আমাদের সংগে একই ট্রেনে এসেছেন, আজই বিশাখা-কিরন্ডুল প্যাসেঞ্জার ধরে সোজা আরাকু যাবেন, তাই এঁরা স্টেশনেই বসে রইলেন, ওঁদের ট্রেন (যে ট্রেনে আমরাও দুদিন পরেই আরাকু যাব) এই স্টেশন থেকেই কয়েক ঘন্টা পরে (সকাল ০৬-৫০ মিঃ) ছাড়বে। যাঁরা শুধু বিশাখাপত্তনম ও আরাকু ঘুরতে চান, তাঁদের জন্য এই ভাবে রুট প্লানিং করা যেতে পারে। কলকাতা থেকে সোজা আরাকু, পরে আরাকু থেকে বিশাখাপত্তনম, আবার এখান থেকেই সোজা কলকাতা ফেরা। প্রথম বার যখন আমরা এখানে এসেছিলাম, আমরা এই ভাবেই রুট প্লানিং করেছিলাম।
আমাদের ট্রেন ১নং প্লাটফর্মে দাঁড়িয়াছিল এবং এই প্লাটফর্মে যাত্রীদের জন্য দু ধরনের ওয়েটিং রুম ছিল। দেখা গেল, আপার ক্লাস যাত্রীদের জন্য পৃথক ওয়েটিং রুম রয়েছে; আমাদের মহিলা সহযাত্রীরা কিন্তু প্লাটফর্মের বেঞ্চিতেই সন্তুষ্ট রইলেন। যাইহোক, গুছিয়ে বসে এক কাপ করে গরমাগরম কফি পান করা হল। এবার আমাদের পরের task-এর দিকে নজর দেওয়া হল। প্রথমেই ফোন করে হল আমাদের হোটেলে; এবং আমাদের early check-in-এর অনুরোধ করা হল। জবাব পেলাম যে এখনও খালি রুমের তথ্য তাদের হাতে আসে নি, তাই আমাদের আরও কিছুক্ষন অপেক্ষা করতে বলা হল। হোটেলে পৌঁছে পরে আমরা বুঝতে পেরেছিলাম যে এই তথাকথিত “খালি রুমে”র তত্ত্ব-টি পুরোপুরি fake; এটা কেবল মাত্র আমাদের কাছ থেকে কিছু extra পয়সা আদায় করার ফন্দি মাত্র। যাইহোক, আমরা ঠিক করলাম যে আমরা সকাল ৫টা নাগাত হোটেলকে না-জানিয়েই সোজা হোটেলে গিয়ে হাজির হব, তারপরে দেখা যাক কি হয়। এখন তাহলে দেখতে হয় স্টেশন থেকে কি করে হোটেলে পৌঁছানো যায়। আগেও জানা ছিল যে স্টেশন চত্ত্বর থেকে আমাদের নির্বাচিত হোটেল বেশি দূর নয়; এবং পাঁয়ে হেটেই পৌঁছে যাওয়া যায়, কিন্তু যেহেতু সময়টা একেবারে ভোর বেলা, তা ছাড়া সংগে রয়েছে বেশ কিছু ল্যাগেজ এবং আমাদের পক্ষে জায়গাটা নতুন, তাই ঠিক হল যে আমরা একটা গাড়ী ভাড়া করেই হোটেলে যাব। এখানে বলে নিই যে আমরা যখন ট্রেন থেকে নেমে প্লাটফর্মে দাঁডিয়েছিলাম, তখন বেশ কিছু লোক “আপনাদের গাড়ী লাগলে বলবেন” বলে বেশ কয়েকটি কার্ড ধরিয়ে দিয়েছিল। এই কার্ডগুলির মধ্যে একটি কার্ড বেছে নিয়ে(just random বেছে নিয়েছিলাম) ফোন করা হল। যিনি ধরলেন, তিনি বললেন যে তিনি এখনও স্টেশন চত্ত্বরেই রয়েছেন; এবং তাঁর সংগে এই মুহূর্তে একটি SUV গাড়ীও রয়েছে। আমরা তখন স্টেশনের বাইরে গিয়ে এই ভদ্রলোকের দেখা করলাম। জানা গেল যে ভদ্রলোক নিজে একজন ড্রাইভার ও সেই সংগে তিনি একজন ক্যাব অপারেটরও বটে। তাঁর কাছে বড়, মাঝারি এবং ছোট – সব রকমের গাড়ীই পাওয়া যাবে। যে কারনেই হোক, আমাদের ভদ্রলোককে ঠিকঠাক মনে হল (gut feelings মাত্র) এবং এর সংগেই আমাদের ডিল পাকা করা হল। ঠিক হল যে উনি আমাদের এখনই একটি SUV গাড়ী দেবেন, যেটি করে আমরা এখন আমাদের হোটেলে যাব; আর পরের দিন উনি দেবেন একটি SUV গাড়ী(সারা দিনের জন্য), যেটি করে আমরা বিশাখাপত্তনমের বিভিন্ন জায়গায় ঘুরব।গাড়ী ভাড়াও ঠিক হয়ে গেল, যেমন, আজ হোটেলে পৌঁছাবার জন্য লাগবে ২০০.০০ টাকা মাত্র; আর তার পরের দিন সারা দিনের জন্য (নির্দিষ্ট ভ্রমনসূচি অনুযায়ী) লাগবে ২৫০০.০০। এই ডিলের জন্য উনি কোনও আগাম অর্থ দাবী করলেন না, এবং কথা দিলেন যে আগামী কাল ঠিক সকাল ৯টার সময় গাড়ী হোটেলের সামনে হাজির হয়ে যাবে। ঐ মুহূর্তে এই dealটা কে একটু risky বলে মনে হচ্ছিল কেননা আমি এমন একজনের সংগে ডিল পাকা করে ফেললাম, যার সম্বন্ধে আমরা কোন কিছুই জানি না। সাধারনত আমি এই ধরনের gut feeling–এর উপর ভিত্তি করে কোনও সিন্ধান্ত নিই না, কিন্তু সেদিন কেন জানি না, এই রকম একটা স্বভাবরিরুদ্ধ একটা কাজ করেই ফেললাম। যাইহোক, এখন আগে ভাগেই বলে নিচ্ছি যে, আমাদের gut feelings একদম সঠিক প্রমানিত হয়েছিল, ঐ ভদ্রলোকের সংগে deal সব ঠিকঠাকই ছিল। কোনও কথার নড়চড় হয় নি। ভদ্রলোক যে ক্যাব সেন্টারটি চালান, তার নাম ও ফোন নং নিচে দিয়ে দিলাম – (এই প্রসংগে আমি আগেই জানিয়ে রাখি যে এই ব্যাপারে আমার কোনও ব্যবসায়িক interest নেই; ভবিষ্যতের যাত্রীদের সুবিধা হতে পারে মনে করে এই তথ্যগুলি আমি শেয়ার করছি মাত্র। যাঁদের প্রয়োজন নেই, তাঁরা এইসব তথ্যগুলি ignore করতে পারেন)
Mr. D Chinna Reddy, Chinni Cab Centre,
Phone No. 9440330734/9640784208
২১-০২-২০ – আমাদের বেড়ানোর প্রথম দিন, বিশাখাপত্তনম –
এখানে বলে নিই যে বিশাখাপত্তনম ট্রাডিশনাল ভাবে ঘুরতে সময় লাগে দুদিনের মত। ভাইজাগ ঘোরার রুট প্লানিং এই ভাবে করা যায়, যেমন – এক দিন লাগবে – (১) সিংহাচলম মন্দির; (২) লাইট হাউস; (৩) ডলফিনস নোজ লাইট হাউস; (৪) ইয়ারডা বিচ; এবং (৫) ফিশিং হারবার। এইসব স্পটগুলি পড়ে একদিকে। বাকি স্পটগুলি পড়ে অন্য দিকে। এই স্থানগুলি দ্বিতীয় দিনে ঘুরে নেওয়া যেতে পারে – (১) ভিমলি বীচ; (২) তোতলাকোন্ডা; (৩) রুশিকোন্ডা বীচ; (৪) কৈলাশ গিরি; (৫) ভুদা পার্ক (VUDA Park); (৬) সাবমেরিন মিউজিয়াম; (৭) রামকৃষ্ণ বীচ, (৮) রামানাইডু স্টুডিও, (৯) বিশাখা মিউজিয়াম, ইত্যাদি।
আমি আগেই বলেছি, আমি ও আমার পরিবারের পক্ষে বিশাখাপত্তনম ও আরাকু আগেই একাধিক বার ঘোরা হয়ে গেছে। তাই আমরা আমাদের ভ্রমনের প্রথম দিন বিশেষ কোনও প্রোগ্রাম রাখলাম না। এই প্রসংগে আমাদের বয়স এবং প্রায় নির্ঘুম রাত্রি কাটানোর কথাও মনে রাখতে হবে। অবশ্য, আমার ভাই ও তার স্ত্রী পক্ষে এটি ছিল তাদের প্রথম ভাইজাগ ভ্রমন। যেহেতু ওরা শুধু সিমহাচলমই যাবে, তাই শুধু একটি গন্তব্যস্থলের জন্য একটি আলাদা গাড়ী ভাড়া করলে খরচ একটু বেশীই পড়ে যাবে। তখন খোঁজ লাগালাম আর কি কি alternative mode of travel আছে। যা জানা গেল, তাতে দেখা গেল পাবলিক বাসই হবে সবচেয়ে উত্তম উপায়, বাস স্টান্ড স্টেশন লাগোয়া, আমাদের হোটেল থেকে বেশী দূর নয়, হেঁটেই চলে যাওয়া যায়; সেখান থেকে ডাইরেক্ট বাস আছে, যেটি কিনা একেবারে সোজাসুজি সিমহাচলম পর্যন্ত যাতায়াত করে। সময়ও লাগে মাত্র ঘন্টা খানেক। হিসাব করে দেখা গেল যাতায়াত আর মন্দির ঘোরা নিয়ে ঘন্টা চারেকের ব্যাপার। সিন্ধান্ত নেওয়া হল যে ওরা এইভাবেই সিমহাচলম যাবে। তাই আমরা একসংগেই প্রাতরাশ সারলাম এবং তার পর ওরা রেলস্টেশন বাস স্ট্যান্ড থেকে পাবলিক বাস ধরে সিমহাচলম চলে গেল। ভাড়া পড়ল মাথাপিছু মাত্র ৩০.০০ টাকা মাত্র(এক পিঠের জন্য)।যাঁরা শুধু সিমহাচলম যেতে চান, তাঁরা এইভাবে পাবলিক বাস ধরে গেলে খুব কম খরচে এই ঘোরাটা সম্পন্ন করতে পারবেন, আমার মতে শুধু এই ট্রিপের জন্য আলাদা করে গাড়ী ভাড়া করার প্রয়োজন নেই। যাইহোক, এই সুযোগে আমি আশে পাশে একটু ঘুরে নিলাম; এবং এই সময়েই আবিস্কার করলাম আমাদের পাশেই রয়েছে একটি বাংগালী রেস্তারাঁ (যার কথা আমি আগেই জানিয়েছি)। আমার ভ্রাতারা লাঞ্চ-এর আগেই সিমহাচলম থেকে ফিরে এল। আমরা একসংগেই বাংগালি খানা খেয়ে লাঞ্চ সারলাম। বিকাল চারটা নাগাত আমরা পুরো টিম একসংগে বেরিয়ে একটা অটো ভাড়া করে (এখানকার অটো আমাদের অটোর চাইতে অনেক বড়, আমাদের ৫ জনের টিম ভাল ভাবেই ধরে গেল) সোজা চলে গেলাম ভাইজাগের সবচেয়ে কাছের(শহরের মধ্যেই বলা যেতে পারে) এবং সবচেয়ে জনপ্রিয় বীচ – রামকৃষ্ণ বীচে। এই বীচ এলাকা এখানকার সবচেয়ে happending area বলে মানা হয়ে থাকে। লোকজন, দোকান, বাজার, খেলাধূলার আয়োজন – সব মিলিয়ে একেবারে জমজমাট পরিবেশ। বিশেষ করে উল্লেখ্য যে আমরা যেদিন গিয়েছিলাম, সেদিন ছিল শিবরাত্রি – বীচে চলছিল এক বিশাল ফাংশন, এই ফাংশানের লাইভ টেলিকাস্ট চলছিল বীচের নানা প্রান্তে। আমরাও কিছুক্ষন দাঁডিয়ে দেখে নিলাম শিবরাত্রির সেই অনুষ্টান। সন্ধ্যের মুখে আমরা গেলাম বীচে উপর অবস্থিত কালী মন্দির; এবং তার পাশেই রাম কৃষ্ণ মিশনের মঠ, সেখানেও চলছে কীর্তন ও শিবরাত্রির পূজা।
পরের দিন, অর্থাৎ আমাদের ভাইজাগ ভ্রমনের দ্বিতীয় দিনে তাড়াতাড়ি প্রস্তুত হয়ে নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম, হোটেলের সামনে রাস্তায় উপরে প্রচুর স্ট্রীট ফুডের অস্থায়ী স্টল, সাউথ ইন্ডিয়ান প্রাতরাশ, পুরি-সব্জী, চা, কফি, জিলাবী ইত্যাদি মুখরোচক খাবার দাবার পাওয়া যাচ্ছে। আমরা এইসব খেয়ে আমাদের প্রাতরাশ সেরে নিলাম, একেবারে যাকে বলে, সস্তায় পুষ্টিকর খাদ্য। আমাদের খাওয়া শেষ হবার মুখেই, একেবারে ঘড়ির কাঁটা মিলিয়ে, মিঃ রেড্ডীর পাঠানো SUV এসে হাজির। আমরাও চটপট উঠে পড়লাম সেই গাড়ীতে। গাড়ীটা ৯ সিটের ছিল, ফলে আমরা বসার পরেও যথেষ্ট জায়গা খালি থাকল। এইবার আমরা পর পর দেখে নিলাম – (১) কৈলাস গিরি; (২) রামানাউডু স্টুডিও(এখন প্রায় পরিত্যক্তই বলা যায়, কোন নিয়মিত সুটিং এখন আর হয় না); (৩) ভিমলি বীচ; (৪) তোতলাকোন্ডা Ruins; (৫) রুশিকোন্ডা বীচ; এবং (৬) ড্রাইভার রাস্তার ধারেই একটা পাহাড়ী জায়গা দেখিয়ে আমাদের বলল, এটা নাকি Red Hills! ব্যাপারটা কিন্তু কিছুই না, Red soil-এ তৈরী এক মাটির স্তুপ বিশেষ, যা আমাদের রাঢ় বাংলায় আকছার দেখা মেলে। এইবার হল ফেরার পালা, ফেরার পথে আমরা দেখলাম (৭) VUDA Park, নাতিউচ্চ টিলার উপর একটি সাজানোগোজান পার্ক, নিচে দেখা যাচ্ছে নীল সমুদ্র, মিস্টি হাওয়া দিচ্ছিল, আমরা কিছুক্ষন বসে একটু বিশ্রাম নিয়ে নিলাম; খুবই শান্তি লাগছিল।(৮) আই এন এস কুরুশিরা সাবমেরিন মিউজিয়াম, (৯) বিশাখা মিউজিয়ম – খুব একটা আকর্ষনীয় লাগল না, আর খুব ক্লান্তও ছিলাম; এবং সবশেষে আমাদের নিয়ে যাওয়া হল (১০) বিশাখাপত্তনমের তথাকথিত ফিশিং হারবার-এ। আমরা এই ফিশিং হারবার দেখে বিন্দুমাত্র impressed হই নি, কিছু ফিশিং ট্রলার ও সামান্য কিছু সামুদ্রিক মাছের খুচরো কেনাকাটা করার একটা বাজার মাত্র। আমাদের দীঘার মোহনা অঞ্চলের ফিশিং হারবার এর থেকে অনেক বড়, অনেক ধরনের মাছের আড়ত। এগুলির মধ্যে সাবমেরিন মিউজিয়াম বেশ কৌতুহলদ্দীপক স্পট। ভারতীয় নৌবাহিনীতে ব্যবহৃত একটি (বর্তমানে পরিত্যক্ত) সাবমেরিন (আই এন এস কুরুশিরা) কে ব্যবহার করে এই মিউজিয়ামটকে গড়ে তোলা হয়েছে। মিউজিয়ামের জন্য এন্ট্রি ফি (মাথাপিছু ২৫.০০) লাগে; এবং জনপ্রিয় লোকেশন হওয়ার দৌলতে এটি ঢুকতে বেশ লম্বা লাইনে দাঁড়াতে হয়। প্রকৃতপক্ষে একটি actual Susbmarine হওয়ার কারনে এর ভিতরটি বেশ জটিল টেকনিকাল ব্যাপার বলে মনে হয়েছে। নৌবাহিনীর পক্ষ থেকে গাইড অবশ্য ছিল, কিন্তু আমি বলতে বাধ্য হচ্ছি, আমাদের সময়ে যিনি গাইড ছিলেন, তিনি খুব একটা helpful ছিলেন না। কিন্তু এটি একটি প্রকৃত সাবমেরিন(কোনও মডেল নয়); এবং জানা গেল যে, এই সাবমেরিনটি বেশ কয়েকটি অপারেশনেও অংশগ্রহল করেছে, এই তথ্যটিই দর্শকদের শিহরন জাগানোর পক্ষে যথেষ্ট!
বিশাখাপত্তনম পর্ব শেষ করার আগে এখানে বলে নিই যে আমরা এবার যে দুটি গুরুত্বপূর্ন স্পট দেখে উঠতে পারি নি, সে দুটি জায়গা হল – (১) ইয়ারদা বীচ; ও (২) ডলফিনস নোজ লাইট হাউস। বিশাখাপত্তনমে আমাদের প্রথম দিনে আমাদের হাতে যথেষ্ট সময়ও ছিল; কিন্তু ক্লান্তির জন্য আমরা সঠিক ভাবে সময়ের সদ্বব্যবহার করে উঠতে পারি নি। এটা একটা দুঃখ রয়ে গেছে। এখানকার অনান্য দ্রষ্টব্যস্থানগুলি সম্বন্ধে বিশেষ করে আর কিছু বললাম না, কেননা এগুলি বহু চর্চিত জায়গা, বহুবার বহু ট্রাভেলার এই স্পট গুলি সম্পর্কে বিস্তারিত ভাবে লিখেছেন, তাই আর পুনরক্তিদোষ এড়াতে আমি আর নতুন কিছু বললাম না। তবে এটা বলা বিশেষ ভাবে উচিত হবে যে বিশাখাপত্তনমের বীচগুলি (যেগুলি আমরা দেখেছি), সব গুলিই বংগপসাগরের উপর অবস্থিত, কিন্তু অবস্থান বৈচিত্রে সব গুলি বীচই অনন্য, একটির সংগে অন্যটির কোনও তুলনাই চলে না। কৈলাশ গিরির অবস্থানও চমৎকার, নাতি উচ্চ পাহাড়ের উপর থেকে একদিকে সমুদ্রের নীল জলরাশি ও অপর দিকে বিশাখাপত্তনম শহরের স্কাইলাইনের সহ-অবস্থান খুবই উপভোগ্য। আমাদের কাছে অবশ্য সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য লেগেছে তোতলাকোন্ডার ধংসাবশেষ। কেন জানি না, আমরা এই স্পটটি আমাদের পূর্বের ভ্রমনের সময়ে বাদ পড়ে গিয়েছিল। এটি নিয়ে কিছু খোঁজখবর নিয়েছি, ইচ্ছা আছে, এই অবহেলিত প্রায় বিলুপ্ত বৌদ্ধ বিহার সম্পর্কে কিছু আলোচনা করার।
পরের পর্বে থাকবে আমাদের আরাকু ও সন্নিহিত অঞ্চলের ভ্রমন আখ্যান; আগামী কাল (২২-০২-২০) সকাল ০৬-৫০ মিঃ আমাদের ট্রেন ছাড়বে বিশাখাপত্তনম স্টেশন থেকে, আমরা নেমে যাব বোরাগুহালু স্টেশনে।

descriptionবিশাখাপত্তনম আরাকু জগদলপুর কোরাপুট EmptyRe: বিশাখাপত্তনম আরাকু জগদলপুর কোরাপুট

more_horiz
#বিশাখাপত্তনম –> আরাকু –> জগদলপুর -> কোরাপুট –(৫)
আরাকু পর্ব
২৩-০২-২০২০ – আজ আমদের ভাইজাগ ছেড়ে আরাকুর উদ্দেশ্যে যাত্রা করার কথা। বন্ধুরা বোধহয় জানেন যে ভাইজাগ থেকে আরাকু যাওয়ার দুটি উপায় আছে – (১) ট্রেনে করে; অথবা (২) বাই রোড। আমরা যাব ট্রেনে, অবশ্যই। “অবশ্যই” কেন? আগে দু’বার এই রুটে যাত্রা করার অভিজ্ঞতা রয়েছে ... অসম্ভব সুন্দর প্রাকৃতিক দৃশ্য, পাহাড়, সবুজ প্রকৃতি, পাহাড়ের মধ্যে অসংখ্য টানেল, মাঝে মাঝে দু একটা ঝর্না ... আর কি চাই। এ সবই পাওয়া যাবে একমাত্র ট্রেন যাত্রা কালীন, কিন্তু বাই রোড গেলে এই সব অভিজ্ঞতা থেকে বেশিরভাগই বঞ্চিত হতে হবে; আর হ্যাঁ, অবশ্যই ট্রেনে যাওয়া নিশ্চিত ভাবেই পকেট ফ্রেন্ডলি অপশন। অবশ্য গাড়ী করে গেলেও কিছু সুবিধা আছে, যেমন – (১) তাড়াতাড়ি যাওয়া যায়; এবং (২) পথিমধ্যে যে সব দেখার স্পট গুলি পড়ে(বেশ কয়েকটি স্পট আছে) সেগুলি যাওয়ার পথেই দেখে নেওয়া যায়। তবু বলব এই রুটে ট্রেন যাত্রা এক অনন্য অভিজ্ঞতা। যাইহোক, আমরা যে দু’বার এই রুটে ট্রেন যাত্রা করেছি, আমাদের অভিজ্ঞতা হল যে ট্রেনে খুব একটা বিশেষ ভীড় হয় না। কিন্তু কিছু সাম্প্রতিক অভিজ্ঞতার বিবরন পড়ে মনে হল, অবস্থাটা এখন বেশ পালটে গেছে। ভীড় এখন ভাল মতই হচ্ছে, তাই আগে ভাগেই টিকিট বুক করে রেখেছিলাম। এখানেই দুএকটি প্রাসংগিক কথা বলে নেওয়া যাকঃ
(১) আমরা “সেকেন্ড ক্লাস সিটিং” শ্রেনীর টিকিট বুক করেছিলাম। উচ্চ শ্রেনী বা এই রুটের সেই বিখ্যাত “ভিস্টাডোমে”র টিকিট বুক করি নি। আমাদের মনে হয়েছে, সেকেন্ড ক্লাস সিটের খরচ অপেক্ষাকৃত অনেকটাই পকেট ফ্রেন্ডলি, আর তা ছাড়া, ভিস্টাডোমে বসে যে সব দৃশ্য যাত্রীরা দেখতে পান, সেকেন্ড ক্লাস সিটে বসে হয়ত ততটা ভালভাবে দেখা যায় না, কিন্তু খুব একটা যে মিস করে যাব এমনটা আমাদের মনে হয় নি। তবে দেখুন, বন্ধুরা, এই ব্যাপারটা খুবই ব্যক্তিগত পছন্দ-অপছন্দের ব্যাপার, তাই এই ইস্যুতে আমি বলব ভবিষ্যতের যাত্রীরা তাঁদের পছন্দ ও ক্ষমতার কথা চিন্তা করে যথাযথ সিন্ধান্ত নেবেন। আমরা যা করেছিলাম, তাই আপনাদের সংগে শেয়ার করলাম।
(২) আরাকু ভ্রমনের জন্য যাত্রীরা সাধারনতঃ প্রথমে আরাকু পৌঁছে তারপর গাড়ী ভাড়া করে আশেপাশের দ্রষ্টব্যগুলি দেখতে যান। কিন্তু আরাকুর আশে পাশের যে সব স্পটগুলি সাধারনতঃ দেখা হয়ে থাকে, তার সিংহভাগই আরাকু পৌঁছনোর আগেই পড়ে। যেমন ধরুন, বোরা কেভ বা অনন্তগিরি ফলস, বা অনন্তগিরি কফি প্লান্টেশন, কিংবা Gailkonda View Point, অথবা তেলেগু ফিল্ম shooting spots, ইত্যাদি সবই আরাকু পৌঁছানোর আগেই পড়ে। তাই আমরা ঠিক করলাম যে আমরা আরাকু স্টেশনের দুটি স্টেশন আগে “বোরা গুহালু” স্টেশনে (বিখ্যাত বোরা গুহা এই স্টেশনের খুব নিকটেই) আমরা নেমে যাব, আরাকু পর্যন্ত যাব না। উদ্দেশ্য হল, স্টেশন থেকে হেঁটে গুহায় চলে যাব (আমাদের লাগেজ খুবই কম ছিল), ওখানে বোরা গুহা দেখে একটা গাড়ী ভাড়া করে আরাকুর উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেব, এবং পথিমধ্যে যে দ্রষ্টব্যস্থানগুলি পড়বে সেগুলি সব আমরা একেবারে দেখেই আরাকুতে আমাদের পূর্ব থেকে বুক করা হোটেলে চেক ইন করব। পরের দিন আবার একটা গাড়ী বা অটো করে (এখানকার অটোগুলি বেশ বড়ো, পাঁচ জন প্যাসেঞ্জার অনায়াসেই ধরে যায়) বাকি জায়গাগুলি (যা কিনা সবই মূল আরাকু শহরের মধ্যেই অবস্থিত) ধীরে সুস্থে দেখে নেব। আমাদের মনে হয়েছিল এতে আমাদের খরচও কম হবে; আর সেই সংগে সময়ও কম লাগবে।
এইবার বলি আমাদের যাত্রা শুরুর কথা। আমাদের ট্রেনের ছাড়ার সময় ছিল সকাল ০৬.৫০ মিঃ; তাই আগের দিন রাত্রিতেই Alarm দিয়ে রেখেছিলাম ভোর চারটের সময় ওঠার জন্য। ঠিক সময়েই alarm বাজল; এবং আমরাও প্রাতকৃত্য সেরে চটপট তৈরী হয়ে নিলাম। হোটেল চেক আউট করলাম সকাল ০৫.৪৫ মিঃ নাগাত(আগের দিন রাত্রিতেই আমরা সমস্ত পেমেন্ট করে বিল ইত্যাদি নিয়ে রেখেছিলাম)। আগাম কোনও গাড়ী বুক করি নি, কেননা স্টেশনের কাছে আমাদের হোটেলের অবস্থান হওয়ায় এখানে সবসময়েই কোন না কোন গাড়ী বা অটো পাওয়া যায়। আমাদের যাত্রার দিনেও তার কোনও অন্যথা হল না। একটা অটো নিয়ে নিলাম, ভাড়া পড়ল মাত্র ১০০.০০ টাকা। দশ মিনিটের মধ্যেই পৌঁছে গেলাম স্টেশনে। জানা গেল যে আমাদের ট্রেন ছাড়বে ৫ নং প্লাটফর্ম থেকে, আর আমরা স্টেশনে ঢুকেছি ১ নং প্লাটফর্মের দিক থেকে; ফলে আমাদের মালপত্র বয়ে খাঁড়া সিড়ি বেয়ে ওঠানামা করতে হল। অত ভোরবেলায় ঐ ধরনের পরিশ্রম, বলা বাহুল্য, খুব একটা উপাদেয় লাগল না। একটা এস্কালেটরের কথা বিজ্ঞাপিত রয়েছে দেখলাম, কিন্তু তার অস্তিত্ব আমাদের চোখে পড়ে নি।
অত সকালে খুব সম্ভবতঃ বেশী ট্রেন নেই, তাই ভাইজাগ স্টেশন ভীড় যথেষ্টই কম, কেমন যেন ঘুমন্ত স্টেশন। ফলে ট্রেন ছাড়ার নির্ধারিত সময়ের আধ ঘন্টা আগে যখন ট্রেন প্লাটফর্মে এল, তখন নিরুপদ্রবেই আমাদের নির্দিষ্ট কোচে উঠতে পারলাম। নিজ নিজ সিটে আরাম করে বসার পর কামরার ভাল করে নজর দিতেই, কি আর্শ্চয্য, কামরা তো প্রায় খালি, কোথায় ভীড়! যদিও রিজার্ভড কামরা, কিন্তু কামরা তো সেকেন্ড ক্লাস সিটিং ক্লাসের, তাই আশংকা ছিল (এবং ছিল কিছু যাত্রীদের পূর্ব অভিজ্ঞতা) যে প্রচুর ভীড় হবে; এবং আমি অত্যন্ত দুঃখের সংগে স্বীকার করে নিচ্ছি যে এই প্রায় তিন ঘন্টা ব্যাপী মনোরম যাত্রাপথের সৌন্দর্য উপভোগ করার বদলে আমি দ্রুত ঘুমিয়ে পড়ি, ঘুম ভাংগে সেই বড় গুহালু স্টেশন আসার পূর্ব মুহূর্তে, তাও সহ যাত্রীদের চিৎকার চেঁচামেতিতে।এই অমার্জনীয় অপরাধের কারনে এই যাত্রাপথের কোনও ছবি তোলা সম্ভব হয় নি।
যাইহোক, বড় গুহালু স্টেশনে ট্রেন তো প্রায় খালিই হয়ে গেল, আমরাও পড়লাম নেমে। মাল পত্র নিয়ে নিরিবিলি এই ছোট্ট, কিন্তু ছিমছাম স্টেশনের বাইরে আসতেই অসংখ্য ক্যাব ড্রাইভার, অপারেটর, গাইড ইত্যাদি আমাদের উপর প্রায় ঝাঁপিয়ে পড়ল। মনে হল যাত্রীদের তুলনায় এই সব তথাকথিত Service Providerদের সংখ্যা বেশি। কেউ গাড়ী ভাড়া দিতে চায়, কেউ প্যাকেজ ট্যুর করাতে চায়, আর কেউ বা গাইড হিসাবে আমাদের সব জায়গা ঘুরিয়ে দেখাতে চায়। আমাদের উদ্দেশ্য ছিল দুটি – (১) স্টেশন থেকে পায়ে হেটে গুহামুখে পৌঁছনো; এবং (২) একটি SUV type-এর গাড়ী ভাড়া করা। এই গাড়ী আমাদের বড় গুহালু থেকে, পথিমধ্যে বিভিন্ন স্পট দেখিয়ে, আরাকুতে আমাদের নির্বাচিত হোটেলে পৌঁছে দেবে। তাই আমরা ভীড়ের মধ্যে সমস্ত চেঁচামেচিকে উপেক্ষা করে গুহা মুখের উদ্দেশ্যে এগিয়ে চললাম। এখানে বলে নিই যে একটিই মাত্র রাস্তা, সুতরাং পথ ভূল হবার কোনও সম্ভাবনা নেই, এই রাস্তাটাই আমদের সোজা পৌঁছে দিল একদম সরাসরি গুহা মুখে। আমাদের সাথে ট্রলি লাগানো মাঝারি মাপের স্যুটকেশ ছিল; এবং সেটি নিয়ে এই পাঁচ-সাত মিনিটের পদযাত্রায় আমাদের বিন্দুমাত্র অসুবিধা হয় নি। পথিমধ্যে অনেক গাড়ীর ড্রাইভারদের সংগে মোলাকাত হল, এখানে লক্ষ্য করলাম যে ক্যাব ড্রাইভাররা যেন কেমন একটা অঘোষিত সিন্ডিকেট গোছের সংস্থা গঠন করে রেখেছে। যদি কোনও ড্রাইভার আমাদের সংগে একবার কথা বলেছে, তখন অন্য কেউ আমাদের সংগে আর কথা বলতে চাইছে না, বললেও একই দাম চাইছে। এটা একবার নয়, বার বার এই রকম ঘটতে লাগল। মনে হচ্ছিল কেউ যেন আমাদের উপর নজর রাখছিল। এটা যখন আমদের বোধগম্য হল, তারপর আমরা আর পথিমধ্যে কোনও কথা বলার চেষ্ট করিনি। এইভাবে কিছুক্ষনের মধ্যেই বড়গুহালুর গুহামুখে পৌছে গেলাম। আমরা আগেই স্থির করে রেখেছিলাম যে যেহেতু আমি ও আমার ফ্যামিলি এর আগে দুবার এই গুহা ঘুরে নিয়েছি, তাই এবার আমরা আর গুহাতে ঢুকবো না। আমার ভাই ও তার স্ত্রী গুহার ভিতরে যাবে, আর আমরা গুহা মুখে অপেক্ষা করব। তাই করাও হল, বাইরে অনেক অপেক্ষা করার জায়গা আছে, কোনো অসুবিধা নেই। ভাবলাম, এখন যখন (মনে হচ্ছে) আমরা ক্যাব ড্রাইভারদের surveillance এর বাইরে চলে এসেছি, এই সুযোগে একটা গাড়ীও বুক করে ফেলা যাক। এইবার একজন অল্পবয়সী ড্রাইভার দেখে একটি গাড়ীর জন্য কথাবার্তা চালাতে শুরু করলাম; সেই একই দাম, এখান থেকে সব কিছু ঘুরিয়ে আমাদের হোটেলে পৌঁছে দেবে এবং ভাড়া নেবে ৩৫০০.০০ টাকা। সত্যি বলতে কি এটা আমাদের বাজেটের একেবারেই বাইরে ছিল, তাই তাকে পত্রপাঠ বিদায় করলাম। কিছুক্ষন অপেক্ষা, ভাবছি এবার কি করব, হঠাৎ সেই ছেলেটির আবার আবির্ভাব, এবার তার রেট একটু কমে দাড়িয়েছে ৩০০০.০০ টাকায়। আমিও একটু নমনীয় হয়ে বললাম, দেখো ভাই, আমাদের বাজেট হল ২০০০.০০ টাকা; এতে যদি হয়, তাহলে চল। এটা শুনে সে দ্রুত ভীড়ের মধ্যে হারিয়ে গেল। সত্যি বলতে কি, তখন আমি একটু প্যানিকড হয়ে পড়েছি। তাহলে কি হবে, কি করব, ইত্যাদি হাবিজাবি ভাবছি, এর মধ্যে আবার সেই ড্রাইভারের পুনরাগমন। এবার তার অফার (এবং তার ভাষায় এটাই তার লাস্ট অফার) হচ্ছে ২৫০০.০০ টাকা। আমার তখন মনে হল আর বোধহয় এই ব্যাপারটা আর বাড়তে দেওয়া উচিত হবে না, তাই এই রেটেই রাজী হয়ে গেলাম। এবং আমাদের এই নির্বাচিত ড্রাইভারের সংগে কথা বলে সে কি কি স্পট আমাদের দেখাবে তার একটা লিস্ট তৈরী করে ফেললাম। ইতিমধ্যে আমার ভাই এবং ভ্রাতৃবধু গুহা দেখা শেষ করে ফিরে এসেছে। ওদের সময় লেগেছে প্রায় ঘন্টা দেড়েকের মতো।
এই খানে বলে নিই যে আমরা এই ট্রিপ টা ঘুরে যখন আরাকুতে আমাদের হোটেলে পৌঁছালাম, তখন আমরা বুঝতে পারলাম যে ৪ থেকে ৫ ঘন্টা ব্যাপী এই ট্রিপটার ভাড়া কিছুতেই ৩৫০০-৩০০০.০০ টাকা হতে পারে না, এমনকি আমরা যে ভাড়া শেষ পর্য্যন্ত দিয়েছি (২৫০০.০০), সেটাও যথেষ্ট বেশী বলে আমাদের মনে হয়েছে। আমাদের যে ড্রাইভার যে ছিল সেও খুব একটা হেল্পফুল ছিল না। এই ইস্যুটি এত বিস্তারিত ভাবে লেখার উদ্দেশ্য হল যে ভবিষ্যতের যাত্রীরা যেন এই গাড়ী ভাড়ার ব্যাপারটা একটু খেয়াল রাখেন। হ্যাঁ, আর একটি কথা, আমি শুনলাম যে এই ট্রিপটা নাকি অটোতেও করা যায়, সময় একটু বেশী লাগে, তবে খরচ যথেষ্ট কম পড়বে। যেহেতু আমরা আমাদের ভাড়া করা ড্রাইভার সম্বন্ধে সন্তুষ্ট নই, তাই আমরা একে recommend করতে পারছি না, এবং সেই জন্য তার নাম ও কন্ট্যাক্ট নং আর শেয়ার করলাম না।
এই ট্রিপে আমরা যে স্পটগুলি দেখলাম, সেগুলি হল –
(১) অনন্তগিরি জলপ্রপাত। এই জল প্রপাতের একটা স্থানীয় নাম আছে, সেটা একটু খটোমটো, ঠিক মনে নেই। আগে অনেক বন্ধুরা জানিয়েছেন যে জলপ্রপাতের কাছে যেতে হলে গাড়ি ছেড়ে দিয়ে কিছুটা পথ অটো করে যেতে হবে। আমরা কিন্তু পুরো পথটাই বড় SUV গাড়ীতে গেলাম। অবশ্য স্থানীয় লোকদের ৩০.০০ টাকা তথাকথিত এন্ট্রি ফি প্রদান করতে হল। এই ফলসটির আশপাশের সৌন্দর্য্য অপূর্ব, কিন্তু বর্ষার সময় না হওয়ার জন্য, জল বেশ কম। চমৎকার সিঁড়ি করে দেওয়া আছে। একেবারে নিচে নেমে যাওয়া যায়, দেখা গেল স্থানীয় অনেকেই নিচে নেমে গেছেন।কিন্তু আমরা সে দূঃশ্চেষ্টা করি নি। স্থানীয় লোকদের কাছে এটা একটা জনপ্রিয় পিকনিক স্পট বলে মনে হল।
(২) অনন্তগিরি কফি প্ল্যান্টেশন। এটি একটি সরকার-নিয়ন্ত্রিত কফি চাষের বাগান, সংগে প্রচুর গোল মরিচের চাষও হচ্ছে দেখা গেল। এই বাগানের নিচে, রাস্তার ধারে বেশ কয়েকটি দোকান বসে গেছে মশলা বিক্রি করতে। সেখানে কফি ছাড়াও গোলমরিচ, দারচিনি, এলাচ ও স্টার অ্যানিস ইত্যাদি মহার্ঘ মশলাপাতি যথেষ্ট কম দামে বিক্রি হচ্ছে।
(৩) Gailkonda ভিউ পয়েন্ট। এখানে আমরা বাম্বু চিকেন ও বার বি কিউ চিকেন টেস্ট করলাম। স্বাদ মোটামুটি, তেমন আহামরি বলে আমাদের মনে হয় নি। পাহাড়ের উপর থেকে নিচের দৃশ্য ভালই লাগল। তবে অসাধারন কিছু নয়।
(৪) তেলেগু ফিল্মের shooting spots। এই স্পট টি তে আমাদের ড্রাইভার আমাদের নিয়ে যায় নি। দূর থেকে দেখিয়ে যা বলল, তাতে মনে হল মরশুমে এই ভ্যালিতে প্রচুর সূর্যমুখী ফুলের চাষ হয়। তখন পুরো ভ্যালি অত্যন্ত মনোরম হয়ে ওঠে, এবং সেই সময় এখানে অনেক তেলেগু ফিল্মের শুটিং হয়ে থাকে। আমরা যখন গেলাম, তখন কিন্তু আমরা কোনও সূর্যমুখী ফুলের চিহ্নমাত্র দেখি নি; এবং ভ্যালি টিকে অত্যন্ত সাধারন স্থান বলে মনে হয়েছে। এটি অনায়াসে বাদ দেওয়া যেতে পারে।)
(৫) এবার আমরা আরাকু মূল শহরে পৌঁছে গেলাম। প্রথমে দেখে নিলাম ট্রাইবাল মিউজিয়াম। এখানে মডেলে সাহায্য এখানকার স্থানীয় ট্রাইবালদের সংস্কৃতি, এদের ইতিহাস সবকিছু বর্ননা করা হয়েছে। মিউজিয়াম এর ডিসপ্লে বেশ আকর্ষনীয়, কিন্তু নিয়মিত দেখভাল করা হয় বলে মনে হল না। এখানে এন্ট্রি ফি দিতে হল। সম্ভবতঃ ৫.০০ মাথা পিছু।
(৬) এদিন সবশেষে দেখা হল পদ্মপুরম বোটানিকাল গার্ডেন; এটিও আরাকু শহরের প্রান্তেই অবস্থিত, আমাদের হোটেলের খুব কাছেই। ২৬ একরের উপর প্রতিষ্টিত এই বাগান টি স্থানীয় গাছপালা, ফুল, অর্কিড ইত্যাদি নিয়ে চমৎকার ভাবে সাজানো এক গার্ডেন। আগেরবার যখন এসেছিলাম, তখনও এটা ছিল, কিন্তু অবস্থা ছিল খুব করুন। এখন একদম ভোল পাল্টে গেছে। এখন একটি টয় ট্রেন হয়েছে, সেটায় চেপে পুরো বাগানটিকে ঘুরে নেওয়া যায়। এ ছাড়া হয়েছে একটি আকর্ষনীয় ট্রি হাউস এবং একটি নার্সারী। বেশ কিছু সময় কাটানোর সুন্দর একটি জায়গা। আমার কাছে এটিকে বোটানিকাল গার্ডেন থেকে একটি সুন্দর সাজানো গোজানো পার্ক বলে মনে হয়েছে। এখানকার মাথাপিছু এন্ট্রি ফি হল ৪০.০০ টাকা।
এইসব জায়গা গুলি দেখে আমাদের হোটেলে পৌঁছতে প্রায় বিকেল হয়ে গেল। আজ আমরা কোনও প্রথামাফিক লাঞ্চ করতে পারি নি। যাইহোক, হোটেলে পৌঁছে প্রথমেই গরম জলে স্নান করে এক কাপ চা, তারপর সোজা বিছানায়, একটি ঘটনা বহুল, ক্লান্ত দিনের অবসান। রাত্রে হোটেলের রেস্তারাঁতে জমিয়ে ডিনার করা হল। চমৎকার খাবারের মান, দামও আয়ত্বের মধ্যে। আমাদের হোটেল সম্পর্কে রিভিউ তো আগেই পোস্ট করেছি। তাই আজকের কহানী এখানেই শেষ করছি।
২৪-০২-২০ – এদিন ছিল আমাদের আরাকুর দ্বিতীয় দিন। আমাদের হাতে পুরো দিন, দেখা বাকি আছে দু একটি স্পট মাত্র। আর সেগুলি সবই শহরের মধ্যেই। তাই কোনও তাড়াহুড়ো নেই, ধীরেসুস্থে উঠে বাইরের একটা ছোট দোকান থেকে স্বল্প দামে ধোসা, ইডলি, কফি ইত্যাদি সহযোগে চমৎকার দক্ষিনী ব্রেকফাস্ট সারলাম। তারপরে স্নান করে একটা অটো করে সোজা চলে গেলাম আরাকু শহরের মূল কেন্দ্রে। এখানে দেখে নিলাম –
(১) কফি মিউজিয়াম – এই মিউজিয়ামের theme টি আমার কাছে অনবদ্য মনে হয়েছে। এখানে মডেল ও বিভিন্ন ডিস্প্লের সাহায্যে আন্তর্জাতিক স্তরে কফি চাষের ইতিহাস; সবচেয়ে ইন্টারেস্টিং হল ভারতবর্ষে কিভাবে কফি চাষের উৎপত্তি হল তার বিস্তৃত বিবরন এই মিউজিয়মে দেখানো হয়েছে। আমরা এই মিউজিয়মটি খুব আগ্রহ সহকারে ঘুরে দেখলাম; এখানে কফি কে ভিত্তি করে অনেক কিছুই বিক্রি করা হচ্ছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল Coffe-based Chocolates, বিভিন্ন ধরনের, বিভিন্ন মানের।দামও আয়ত্বের মধ্যে। আমরাও কিছু চকোলেট কিনলাম। পরে আমরা গেলাম এই মিউজিয়মের মধ্যেই অবস্থিত কফি পার্লারে। আহা, কত রকমের যে কফি হতে পারে, তার কোন ধারনাই ছিল না। তার নাম, ধরন, রং সবই আমাদের অপরিচিত। তাই এক হাস্যমুখী কর্মীর সাহায্য নিয়ে এক কাপ করে এক খটোমটো নামের কফি নিয়ে বসে পড়লাম এই কফি কর্নারে। আঃ, কি শান্তি!!
(২) হারিথা ট্যুরিস্ট লজ ও বাস স্টান্ড – এই দুটি জায়গা প্রথামাফিক কোন বেড়ানোর জায়গা নয়। কিন্তু আমরা একবার পুরোন স্মৃতি ঝালিয়ে নেওয়ার জন্য এই জায়গা দুটি ঘুরে নিলাম। আমাদের এর আগের দুবার আরাকু ভ্রমনের সময় আরাকুতে খুব কমই হোটেল ছিল। এর মধ্যে সেরা থাকার জায়গা ছিল “ময়ূরী লজ”, যা কিনা পরিচালিত হত অন্ধ্র প্রদেশ ট্রাইবাল ডেভেলপমেন্ট করপোরশনের দ্বারা। আমরা তখন এখানেই ছিলাম। এখন সেই “ময়ূরী লজ” হাত বদল হয়ে হয়েছে “হারিথা রিসর্ট”, পরিচালিত হচ্ছে অন্ধ্র প্রদেশ ট্যুরিজিম ডেভেলপমেন্ট করপোরেশনের দ্বারা। এই নতুন করে ঢেলে সাজানো প্রপার্টির কাছে গিয়ে দেখলাম আমাদের সেই “ময়ূরী লজ”-এর খোল নলচে পুরো পাল্টে গেছে। চেনাই যাচ্ছে না। যাহোক, কিছু পুরোনো স্মৃতি রোমন্থন করলাম এর প্রাংগনে দাড়িয়ে। এর পরে গেলাম বাস স্টান্ডে; এই বাস স্টান্ডে প্রথম বার এক ঝুড়ি গাছ-পাকা আতা ফল কিনেছিলাম মাত্র ২০ টাকায়, এক ট্রাইবাল রমনীর কাছ থেকে; এবং সেই ঝুড়ি ভর্তি আতা আমি ও আমার পুত্র শেষ করেছিলাম এই নির্জন বাস স্টান্ডের এক বেঞ্চিতে বসে। বাস স্টান্ডের বিশেষ কিছু পরিবর্তন হয় নি, সেই বেঞ্চিটাও খুঁজে পেলাম, কিন্তু সেই নির্জনতাও নেই আজ, আর এখন পেলাম না সেই স্বর্গীয় আতাফলের কোনও খোঁজ। যাই হোক, স্মৃতি তো সততই সুখের!
ইতিমধ্যে আমাদের দুপুরের খাবার সময় হয়ে গেছে। আমার মনে পড়ল সেই প্রথম বার আমাদের আরাকু বেড়ানোর কথা; তখন আরাকু বাজারে একটা হোটেল খুঁজে পেয়েছিলাম, যেটা তে পেয়েছিলাম বাংগালী খাবার। এই হোটেলটির পরিচালক আমাদের সংগে পরিস্কার বাংলায় জানিয়েছিলেন যে তিনি আদতে ওড়িসাবাসী, কিন্তু কলকাতায় অনেকদিনে ছিলেন; এবং সেখানে তিনি রান্নার কাজ করতেন। তাই তাঁর এখানকার হোটেলে বাংলা খাবারও পাওয়া যায়; বাংগালীরা যাঁরা এখানে বেড়াতে আসেন, তাঁরা সবাই ওনার হোটেলে খাবার খেয়ে থাকেন। এখন সেই আরাকু বাজার পুরোপুরি পালটে গেছে, অনেক খোঁজাখুজি করলাম, কিন্তু সেই হোটেল খুজে বের করতে পারলাম না। সেই হোটেলের অস্তিত্ব আজও আছে কিনা, কে জানে! যাই হোক, বিফল হয়ে শেষ কালে এক মাড়ওয়ারী হোটেল থেকে পুরো নিরামিশ খাবার খেয়ে হোটেলে ফিরলাম। বিকেলে আরও একবার বেরোন হল। এবার পায়ে হেঁটেই গেলাম আমরা আরাকু স্টেশনের দিকে, আগের বার আরাকু স্টেশন চত্তর ছিল একেবার নির্জন, কোনো লোকালয় ছিল না। এখন স্টেশনের আশপাশে প্রচুর বাড়ীঘর, দোকান, হোটেল, ইত্যাদি হয়েছে। এই সুযোগে একবার স্টেশন প্লাটফর্মও ঘুরে নিলাম। কোনও লোকজন নেই, পরিস্কার, পরিচ্ছন্ন প্লাটফর্ম, প্রচুর বসার জায়গা। প্লাটফর্মে ঘুরতে ঘুরতে একটা তথ্য নজরে এল। আরাকু স্টেশনেও রয়েছে Retiring Room এবং সেগুলি অন লাইন বুকিংও হয়ে থাকে। ঘর পিছু ভাড়া মাত্র ১৬৫.০০ টাকা (১২ ঘন্টার জন্য)। যাঁরা একদিনের জন্য আরাকুতে থাকতে চান; এবং থাকার জন্য বাজেট অপশন ঘুঁজছেন, তাঁদের জন্য এটা একটা বেশ ভাল সুযোগ বলে আমাদের মনে হল। স্টেশন চত্তরে এবার দেখলাম রেলওয়ে কর্মীরা ফেলে দেওয়া লোহালক্কর দিয়ে তৈরী করেছেন এক শিল্পকর্ম এবং সেই সৃষ্টিটিকে সুন্দর ভাবে সাজিয়ে রাখা রয়েছে। আরাকু স্টেশন থেকে বাইরে আসা মাত্রই যাত্রীদের এই শিল্পকর্মটিই প্রথমে নজরে পড়বে। ফেরার পথে একজায়গায় দেখলাম স্থানীয় এক আদিবাসী পরিবার “বাম্বু চিকেন” বানাচ্ছেন; আমাদের অনুরোধে তাঁরা আমাদের জন্য প্যাকিং করে দিলেন। এক একটি বাঁশের ফাঁপা অংশের মধ্যে মশলা-মাখানো চিকেনের দাম পড়ল ১০০.০০ টাকা করে; এতে প্রায় দুশো গ্রাম ঝলসানো চিকেন থাকে। স্বাদ, আবার বলছি, আমার কাছে খুব একটা আকর্ষনীয় লাগে নি। আরাকুতে আজই আমাদের শেষ রাত্রি। কাল আমরা রওয়ানা দেব জগদলপুরের উদ্দেশ্যে। যাব সেই একই ট্রে্নে, যেটা করে আমরা গত পরশুদিন বড় গুহালু স্টেশনে এসে নেমেছিলাম। এবার আমরা সেই একই ট্রেন ধরব আরাকু স্টেশন থেকে। এর পরের গল্প (জগদলপুর পর্ব) আসবে পরবর্তী পর্বে।

descriptionবিশাখাপত্তনম আরাকু জগদলপুর কোরাপুট EmptyRe: বিশাখাপত্তনম আরাকু জগদলপুর কোরাপুট

more_horiz
#বিশাখাপত্তনম –> আরাকু –> জগদলপুর -> কোরাপুট –(৬)
জগদলপুর পর্ব
২৪-০২-২০ – আজ সকালেই ৯টার মধ্যে পুরোপুরি প্রস্তুত হয়ে আরাকুর “রাজধানী হোটেল” থেকে চেক আউট করলাম। বাইরে বেরিয়েই রাস্তার ধারে আমাদের পছন্দের একটি পকেট ফ্রেন্ডলি দক্ষিনী রেস্তারাঁ ছিল; সেখানে কালকের মত আজও দোসা, ইডলি, উত্তপম, কফি ইত্যাদি সহযোগে জম্পেশ করে প্রাতরাশ করে নেওয়া হল। একটু হেভী ব্রেকফাস্টই করা হল, কেননা আমরা শুনেছি যে আরাকু থেকে জগদলপুর পর্যন্ত ট্রেনে বিশেষ কিছু খাবার পাওয়া যাবে না। পথিমধ্যে স্টেশন গুলিও পড়বে ছোট ছোট, তাই স্টেশন স্টলের খাবারের আশা না করাই ভাল। আমরা সংগে কিছু শুকনো খাবার, যেমন, কেক, বিস্কুট, চানাচুর, মুড়ি, কিছু ফল ইত্যাদি নিয়ে নিলাম। আমাদের হোটেলের সামনে থেকে এমনিতে হেঁটেই আরাকু স্টেশনে চলে যাওয়া যায়, কিন্তু আমাদের সংগে কিছু লাগেজ থাকায় একটি অটো ডাকা হল, মাত্র ৫০.০০ টাকা ভাড়ায় ৫ মিনিটের মধ্যে পৌঁছে গেলাম আরাকু স্টেশনে একেবারে সামনেই। টিকিট কাটার কোনও প্রশ্ন নেই, কেননা আমরা আগেই অগ্রিম টিকিট বুক করে রেখেছি। এবার আমাদের বুকিং দ্বিতীয় শ্রেনীর স্লিপার ক্লাসে। আমাদের ট্রেন ছাড়বে বেলা ১১টার সময়। প্লাটফর্ম প্রায় খালিই, আমরা একটা ভাল জায়গা দেখে গুছিয়ে বসে চারিদিকের দৃশ্য দেখতে দেখতে আমাদের ট্রেনের অপেক্ষা করতে লাগলাম।
ট্রেন যথসময়েই এসে গেল। যে গুটিকয়েক যাত্রি ছিল, তারা প্রায় সবাই নেমে গেল আরাকু স্টেশনে। আমরা আমাদের নিজ নিজ বার্থের দখল নিয়ে বসে পড়লাম। ট্রেন প্রকৃতপক্ষে ফাঁকা গড়ের মাঠ। সংগে আমার ভাই রয়েছে, নাহলে হয়ত ভয়ই করত। ট্রেন ছাড়ল নির্ধারিত সময়েই, অর্থাৎ বেলা ১১.০০ টা নাগাত। এবার আমাদের টিকিট হচ্ছে দ্বিতীয় শ্রেনী স্লিপার ক্লাসে। পুরো যাত্রাটাই যেন প্রকৃতির এক ম্যাজিক। সেই পাহাড়, জংগল, ট্যানেল, ঝর্না, সবুজ ভ্যালী – সব মিলিয়ে সত্যিই এক মোহময় পরিবেশ, আমাদের চোখ ফেরাতে পারছিলাম না। যাঁরা ভাইজাগ – আরাকু রুটের সৌন্দর্যের কথায় পঞ্চমুখ, তাঁদের বলছি, আপনারা আরাকু থেকে জগদলপুরের দিকে একবার ট্রেনযাত্রা করে দেখুন। দেখুন, প্রকৃতি কিভাবে নিজেকে উজাড় করে দিয়েছে। মাঝে মাঝে ছোট্ট ছোট্ট নাম-না-জানা কিছু স্টেশন আসছে, ট্রেনও একবার করে থামছে। যেন থামতে হয়, তাই থামছে। কোন নড়াচড়া নেই, কেউ উঠছেও না, কেউ নামছেও না। সিংগল লাইন, আর তার উপরে আমরা যাচ্ছি প্যাসেঞ্জার ট্রেনে, তাই সবাইকে (এমনকি মাল গাড়ীকেও)পাশ করার পর নিজে চলতে শুরু করছে। আগেই জানতাম দুপুরের খাওয়া দাওয়া পাওয়া যাবে না, তাই সংগে যেসব শুকনো খাবার সংগে নিয়ে আসা হয়েছিল, তার সদব্যবহার করা হল। ইতিমধ্যে সুন্দর আবহাওয়া, মসৃন দৃশ্যপট, আরামদায়ক আসন, ভীড়হীন কামরা, খুব ভালই লাগছিল। কিন্তু এদিকে দেখছি এই ট্রেনের মতিগতি খুব একটা সুবিধার নয়; একের পর এক ট্রেনকে পাস দিতে দিতে নিজে যে প্রভূত লেট করে ফেলেছে, তার দিকে তো নজর নেই। আমাদের জগদলপুর পৌঁছানোর নির্ধারিত সময় হচ্ছে বিকাল সাড় চারটা, অর্থাৎ দিনের আলো থাকতে থাকতেই পৌঁছে যাবার কথা। কিন্তু এইভাবে লেট করলে তো বেশ রাত্রি হয়ে যাবে। নতুন জায়গা, যদিও জগদলপুর এক জেলা সদর, তবুও আমাদের মত বৃদ্ধ পার্টির জন্য দিনের আলোর মধ্যে পৌঁছতে পারলেই ভাল হত। কিন্তু কি আর করা যাবে, এই পরিস্থিতিতে আমাদের ইচ্ছা-অনিচ্ছার কোন দাম নেই। যাই হোক, শেষ পর্যন্ত কি এক মন্ত্রবলে প্রায় দু ঘন্টার লেট কে নামিয়ে আনল ১ ঘন্টায়। অর্থাৎ, আমরা পৌঁছে গেলাম জগদলপুর প্রায় সাড়ে পাচটা নাগাত, তখন আমাদের গন্তব্যস্থল গোধুলির ম্লান আলোয় আলোকিত। আমাদের মত গুটিকয়েক প্যাসেঞ্জার নামল, বাকি হাতে গোনা কয়েকজন রয়ে গেল ট্রেনে, ট্রেন তো যাবে আরও কিছু দূর, সেই আকরিক লোহার শহর কিরন্দুল পর্যন্ত। ভাইজাগের মত এখানেও দুএক জন ক্যাব অপারেটর তাদের কার্ড আমাদের হাতে ধরিয়ে দিল, তাদের মধ্যে দু একজন বাংগালীর নামও দেখতে পেলাম। কিন্তু তখন সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছে, আমরা তাড়াতাড়ি আমাদের হোটেলে পৌঁছনোর জন্য উন্মুখ, তাই এই ক্যাব অপারেটরদের সংগে কোনও কথা বলা গেল না। ঠিক করলাম, হোটেলে চেক ইন করে একটু বিশ্রাম নিয়ে আমাদের হোটেল এবং এই আমাদের হাতে-পাওয়া কার্ডধারীদের সংগে কথা বলে নেওয়া যাবে। আমরা শুনেছিলাম, আমাদের নির্ধারিত হোটেল (অতিথি হোটেল) স্টেশনের একদম লাগোয়া। এক অটোওয়ালা রাজী হয়ে গেল আমাদের সকলকে তার অটোতে নিয়ে যেতে। আরাকুর মত এখানেও অটোগুলি বেশ বড়ো, আমাদের পাঁচ জন লাগেজ সহ আরামসে ধরে গেল। ভাড়া চাইল মাত্র ৫০.০০ টাকা। এখানে একটা জিনিষ লক্ষ্য করলাম যে এরা খুব একটা বারগেনের দিকে যায় না। আমাদের অভিজ্ঞতা হল যখনই আমরা ক্যাব বা অটো ভাড়া করেছি, সঠিক ভাড়াই চেয়েছে এবং ফলতঃ আমাদের কোন বারগেনের দিকে যেতে হয় নি। আমাদের এই হোটেল সম্বন্ধে প্রথম পর্বেই বিস্তারিত রিভিউ লিখেছি, তাই আর এই ব্যাপারে আর কিছু বলার প্রয়োজন আছে বলে মনে করছি না। হোটেলটি সত্যিই স্টেশনের একেবারে লাগোয়া, বেশ বড় সাইজের প্রপার্টি। শুনলাম এটিই এখানকার প্রথম হোটেল। এখানে সব কিছুই ভাল লেগেছে, একটাই অসুবিধা ছিল, সেটা হচ্ছে এখানে কোনও লিফট নেই, আর আমাদের ঘরগুলি ছিল তৃতীয় তলে। এই ওঠা নামাতে আমাদের একটু অসুবিধা হচ্ছিল। যাইহোক, চেকইন করে নিয়ে আ্মাদের রুমে গিয়ে একটু ফ্রেশ হয়ে এক কাপ করে চা পান করে আমদের মুড ফিরে এল। আমরা এখানে দু দিন থাকব। এখানকার দ্রষ্টব্যস্থল গুলি বেশ দূরে দূরে তাই পরের দিন সকাল থেকেই শুরু করতে হবে আমাদের ঘোরঘুরি। এখন প্রথমেই দরকার একটা গাড়ী বুক করা। প্রথমেই হাতের স্টেশনে পাওয়া কার্ডগুলি থেকে কয়েকটি কার্ড বেছে নিয়ে শুরু করলাম ফোন করা। দুএকটি ফোন করার পর একজনের সংগে কথা বলে আমাদের ভালই লাগল, কথাবার্তা বেশ ভদ্র; আর রেটও যুক্তিসংগত বলে মনে হল। আর বিশেষ ভাবনা চিন্তা না করে (এমন কি আমাদের হোটেলের রিসেপশনের সংগে কোনও কথা না বলেই) এখানেই পাকা কথা দিয়ে দিলাম। ঠিক হল কাল ঠিক সকাল নটা নাগাত একটা ৭ সিটের SUV গাড়ী আমাদের হোটেলে রিপোর্ট করবে; এই একই গাড়ী আমাদের কাছে পর পর দুদিন থাকবে এবং এখানকার সমস্ত স্পটগুলি (দান্তেওয়াড়ার মূল মন্দির ছাড়া) ঘুরিয়ে দেখাবে, সময়ের কোনও limitation থাকবে না। ভাড়া পড়বে দিন প্রতি ২৫০০.০০ করে। ব্যস, আমাদের কাজ হয়ে গেল, মনটা তখন ফুরফুরে, একটু তাড়াতাড়িই ডিনার খেয়ে শুয়ে পড়লাম। কাল সকালে পূর্ন উদ্যমে আমাদের জগদলপুর explore করতে বেরোতে হবে। কিন্তু মানুষ ভাবে এক, হয় পুরোপুরি তার বিপরীত; আমাদের ক্ষেত্রেও ভাগ্যলক্ষী আমাদের অলক্ষ্যে একটু মুচকি হাসলেন। কেন? কাল সকালে দেখুন কি হয়!
২৫-০২-২০ – যদিও আমরা কাল সন্ধ্যা নাগাত এসে এখানে পৌঁছেছি, প্রকৃতপক্ষে আমাদের জগদলপুর ঘোরা শুরু হচ্ছে আজ সকাল থেকেই। তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে হোটেলেই ডাইনিং হলে আবার দক্ষিনী প্রাতরাশ খেয়ে আমরা হোটেলের সামনের রাস্তার ধারে অপেক্ষা করতে লাগলাম। ওমা, নটা বেজে গেল, আমাদের গাড়ীর পাত্তা নেই, ফোন করা হল নির্দিষ্ট টেলিফোন নং-এ। টেলিফোনের অপর প্রান্ত থেকে জনৈক মহিলা জানালেন তাঁর স্বামী এখন বাথরুমে, কিন্তু তিনি এই বলে আমাদের আস্বস্ত করলেন যে গাড়ী ইতিমধ্যে রওয়ানা হয়ে গিয়েছে, কিছুক্ষনের মধ্যেই আমাদের কাছে পৌঁছে যাবে; আবার কিছুক্ষন অপেক্ষা, ইতিমধ্যে সাড়ে নটা বেজে গেল, গাড়ীর পাত্তা নেই। আবার ফোন, কিন্তু তখনই আমাদের এই ট্রিপের সবচেয়ে বোম্বশেল টি পড়ল। ফোন অফ... আবার ফোন করা হল...একই ফল। তখন আমাদের বুঝতে বাকি রইল না যে আমরা সুন্দর ভাবে প্রতারিত হয়েছি। কি করা যাবে, এই সব ভাবছি, হঠাৎ দেবদূতের মত এক যুবক একটি বড় গাড়ী নিয়ে আমাদের হোটেলের সামনে নামল, আমরা প্রথমে ভেবেছিলাম যে এই বোধহয় আমাদের গাড়ী। কিন্তু পরে দেখা গেল সে যুবক গাড়ী থেকে নেমে কাউকে ফোন করে জানাল যে সে এসে গেছে। অর্থাৎ এটিও ভাড়ার গাড়ী, আমাদের হোটেলেরই কোনও ট্যুরিস্টকে নিতে এসেছে। আমাদের তখন সত্যিই বেসামাল অবস্থা, হয়তো আমাদের চেহারায় বা মুখ চোখের অভিব্যক্তিতে সেটা বোঝাও যাচ্ছে, তাই সেই যুবক নিজে থেকেই যেচে জানতে চাইল যে আমাদের কি হয়েছে। আমরা তখন ব্যকুল ভাবে তাকে আমাদের অসহয়তার কথা জানালাম। সে দু-এক মিনিট কিছু চিন্তা করে বলল, “কোই প্রব্লেম নেহি, আপকা এক SUV চাহিয়ে, এহি তো?” আমরা সমস্বরে, “হ্যাঁ” বলে সহমত জানালাম। যুবক –“কোই প্রব্লেম নেহি, হো জায়েগা”। সে তখন আমাদের ঘোরার প্লান, কত টাকার রফা হয়েছিল, ক’দিনের জন্য দরকার, ইত্যাদি জেনে নিয়ে, কাকে যেন ফোন করে দু চার মিনিট কথা বলে আমাদের জানাল, “হো গিয়া, আভি গাড়ী আ যায়েগী। সেম ভাড়া দে দিজিয়েগা; ঔর এক বাত, ড্রাইভার এক বাংগালীই হোগা।“ আমাদের তখন ডুবন্ত মানুষের খড়কুটো ধরে বাঁচার চেষ্টার মত অবস্থা। যা পাওয়া যায়, তাই সই। “ঠিক হ্যায়, ধন্যবাদ” ইত্যাদি বলে তাকে অভিবাদন জানালাম। এই যুবকের নাম জনৈক শ্রী তেওয়ারী(প্রথম নামটা ঠিক মনে পড়ছে না); ইনি জগদলপুরে Tiwari Tour & Travels নামে একটি ক্যাব সার্ভিস চালান, এর ফোন নং হল ৭৮৭৯৪৯৮৫৫৩, আমাদের এখানে বলে নেওয়া ভাল যে এই ব্যক্তির সংগে আর আমাদের দেখা হয় নি। পরে জেনেছিলাম, যখন আমাদের গাড়ীর দরকার পড়েছিল, ওনার নিজের গাড়ী তখন available ছিল না, কিন্তু নিঃস্বার্থ ভাবে আমাদের বিপদের কথা শুনে অন্য একজন ক্যাব অপারেটরকে ডেকে এই গাড়ীটি আমাদের পাইয়ে দিয়েছিলেন।
এই দম বন্ধ করা নাটকের পর আমরা যে গাড়ীটি পেলাম, সেটি ছিল ৮ সিটের জাইলো, গাড়ীর মালিক এবং ড্রাইভার ছিলেন এক স্থানীয় যুবক, এক বংগসন্তান, নাম শ্রী সুজন সরকার। এঁর পূর্ব পুরুষ তদানীন্তন পূর্ব বাংলা থেকে ছিন্নমূল হয়ে এসে স্থান পেয়েছিলেন দন্ডকারন্য ক্যাম্পে। তখন থেকেই এঁরা এখানেই থেকে গেছেন, পশ্চিম বাংলার সাথে এদের আর কোনও সংযোগ নেই। তবে ইনি ঝরঝরে বাংলা বলেন, স্ত্রীও বাংগালী, তাই বাংগালী সংস্কৃতি এখনও পুরো ভূলে যান নি। ইনিও এখানে একটি ক্যাব সার্ভিস চালান। এনার ফোন নং হল ৮৮৭৮৬৭৫১৩১ । অতীব ভদ্রলোক, স্থানীয় জায়গা সম্বন্ধে পুরোপুরি অবহিত, জলের মত ছত্তিশগড়ী ভাষা বলতে পারেন। এই যুবককে পেয়ে আমাদের খুব সুবিধা হয়ে গেছিল। ইনি এই এলাকা তার হাতের তালুর মত চেনেন, আমরা যখন যেখানে যেতে চেয়েছি, উনি আমাদের সেখানে বিনা বাক্যব্যায়ে নিয়ে গেছেন। একজন বন্ধু গাইডের মত সব জায়গার বিস্তারিত বিবরন আমাদের জানিয়ে রেখেছেন। এখানে বলে রাখি যে এই ব্যাপারে আমাদের কোনও ব্যবসায়িক স্বার্থ নেই, শুধু ভবিষ্যতের ট্রাভেলারদের সুবিধা হতে পারে বলে এই তথ্য গুলি শেয়ার করলাম। যাঁদের ভাল লাগবে না, তাঁরা দয়া করে এই অংশটি ignore করে যাবেন।
এখানে বলে নিই যে জগদলপুর সার্কিটে অন্যতম একটি স্পট হল দান্তশ্বরী মন্দির। প্রকৃতপক্ষে এই একই নামে দুজায়গায় দুটি পৃথক মন্দির আছে। একটি হচ্ছে দান্তেওয়াড়া নামে একটি জায়গায়। এই স্থানটি জগদলপুর থেকে প্রায় ৮০-৯০ কিমি মত দূরত্বে অবস্থিত। এটিই মূল মন্দির বলে শুনলাম। এই দান্তেশ্বরী দেবী হচ্ছে বস্তার রাজবংশের আরাধ্য দেবী। এই “দান্তেশ্বরী” নামটা এসেছে “দাঁত” থেকে; বলা হয়ে থাকে সে এইখানে সতীর দাঁত পড়েছিল, তাই এই দেবীর নাম হল দান্তেশ্বরী, এবং এটিকে একটি অন্যতম “সতীপীঠ” বলে গন্য করা হয়ে থাকে। এই মূল মন্দিরের একটি রেপ্লিকা মন্দির তৈরী করা হয়েছে জগদলপুরের প্যালেসের কম্পাউন্ডের ভিতরেই (সম্ভবতঃ) রাজ পরিবারের পূজো দেওয়ার সুবিধার জন্য। এখনও এখানে পুরোপুরি রীতি মেনে পূজো করা হয়ে থাকে। প্রথম থেকেই ঠিক করেছিলাম এই দান্তেওয়াড়ার মূল মন্দির দেখতে আমরা যাব না। তাই আমরা এখানে যে দান্তেশ্বরী মন্দিরে কথা উল্লেখ করব, সেটা হল জগদলপুর রাজ প্রাসাদ সংলগ্ন মন্দির।
আজকের আমাদের গন্তব্য ছিল এইরকম –
(১) বস্তার রাজপ্রসাদ, রাজপ্রসাদ সংলগ্ন দান্তেশ্বরী মন্দির – এই প্রাসাদ টিকে আমাদের দেশের অন্যান্য রাজ প্রাসাদের মত খুব বিলাসবহুল বা বিশালাকৃতি বলে মনে হল না। কিন্তু রুচিসম্পন্ন এই ছিমছাম প্রাসাদ টি মনে হল সাম্প্রতিক কালে সংস্কার ও রং করা হয়েছে। একেবারে ঝকঝকে চেহারার এই প্রাসাদটিকে আমাদের ভালই লাগল। পূর্বতন রাজপরিবারের বংশধরেরা এখনও এই প্রাসাদে বসবাস করেন বলে শুনলাম। তাই প্রাসাদের অত্যন্তরে সাধারনের জন্য প্রবেশাধিকার নেই, তবে প্রাসাদের একটি অংশ নিয়ে এক মিউজিয়মের রূপ দেওয়ার চেষ্টা হয়েছে। সেখানে অবশ্য সর্বসাধারনের প্রবেশাধিকার রয়েছে। এই অংশে রাজ পরিবারের বিভিন্ন সদস্যদের ছবি, ব্যবহৃত জিনিষপত্র রাখা আছে। ডিসপ্লে আইটেম গুলি বিশেষ পুরাতন নয়, বৃটিশ আমল ও তার পরের সময়ের জিনিষপত্র/ছবি ইত্যাদি রাখা হয়েছে। এই ছবিগুলির মধ্যে রয়েছে এই রাজবংশের শেষ নৃপতি স্বর্গীয় প্রবীর চন্দ্র সিংদেও-এর একটি পেন্টিং। শুনেছি এই রাজা স্থানীয় আদিবাসীদের মধ্যে অত্যন্ত জনপ্রিয় ছিলেন; এবং ৬০-এর দশকে আদিবাসীদের আন্দোলনের নেতৃত্ব দেওয়ার সময় এই প্রাসাদেরই সিঁড়ির উপর পুলিশের গুলিতে উনি মারা যান।
(২) বালাজী মন্দির – এই মন্দিরটি রাজ প্রাসাদের কাছেই, শহরের মধ্যে অবস্থিত। মন্দিরের গঠন হুবহু দক্ষিনাত্যের বিখ্যাত বালাজী মন্দিরের প্রতিরূপ। আমাদের জানান হল, প্রকৃতপক্ষে এই মন্দির টি এখানে স্থাপনা হয়েছে স্থানীয় অন্ধ্র আ্যসোশিয়েশনের দ্বারা; এবং স্বাভাবিক ভাবেই এর রূপ দেওয়া হয়েছে অন্ধ্র প্রদেশস্থিত মূল বালাজী মন্দিরের মতই। চমৎকার শৈলীতে নির্মিত এই মন্দির খুব পরিস্কার পরিচ্ছন্ন, মেনটেন্যান্সও বেশ উচ্চ মানের। সাধারন দর্শকদের যে ভাবে পূজারীরা স্বাগত জানালেন, সেটা আমাদের খুব ভাল লাগল।
(৩) আ্যন্থ্রপলজিকাল মিউজিয়াম – এটিকে এখানের সবাই ট্রাইবাল মিউজিয়য়াম বলে জানে। এই মিউজিয়াম টি স্থানীয় Anthopological Surevy of Inidia office-এর চত্বরেই স্থাপনা করা হয়েছে। এখানে শুধু বস্তারই নয়, সমগ্র মধ্য ভারতের জনজাতির জীবনশৈলীর এক সংক্ষিপ্ত বিবরন ধরে রাখা হয়েছ। আমার মনে হয়েছে যদি কেউ এই জনজাতি সম্পর্কে খুঁটিনাটি খোঁজখবর নিতে চান, অথচ তার হাতে সময় কম, তাহলে এই মিউজিয়ম তাকে খুবই সাহায্য করবে। আমি যে সব জিনিষপত্র এখানে দেখতে পেলাম তার মধ্যে রয়েছে বিভিন্ন ১) headgears, ২)footwear, ৩) ornaments, ৪) musical instruments, ৫) dresses, ৬) paintings, ৭) wood carvings, ৮) weapons, ৯) masks, ১০) art work, ১১) sculptures ইত্যাদি। এই ছোট্ট মিউজিয়াম টিকে আমাদের বেশ ভালই লাগল। কিন্তু একটা জিনিষ আমাদের খুব পীড়া দিল, সেটা হচ্ছে, আমরা নাকি গত এক সপ্তাহের মধ্যে প্রথম ট্যুরিষ্ট পার্টি, যারা এই মিউজিয়াম দেখতে এসেছে। Visitor Book-এর entry দেখেও তাই মনে হল।
(৪) মেন্দ্রী ঘুমর ফলস – এবার আমরা শহর ছেড়ে বস্তারের উন্মুক্ত প্রান্তরে বেরিয়ে পড়লাম। আমাদের প্রথম গন্তুব্য হল এই জলপ্রপাত। আমাদের ড্রাইভার-কাম-গাইড মহোদয় আমাদের জানালেন যে ছত্তিশগড়ের জলপ্রপাত দেখার প্রকৃত সময় হল বর্ষা কাল ও তার অব্যবহিত পরের সময়। এখন অনেকগুলি প্রপাতে নাকি একেবারেই জল নেই, যেগুলিতে আছে, তার পরিমান একেবারে সামান্য। প্রথমে এই কথার সত্যতা ঠিক বুঝতে পারি নি, কিন্তু এক এক করে যখন জলপ্রপাত গুলি আমরা দেখতে লাগলাম, তখন আমরা উপলব্ধি করলাম ওনার কথার সত্যতা। আমরা এখন যে ফলসটি দেখছি এই জলপ্রপাতটি আম ট্যুরিস্টের কাছে খুব একটা জনপ্রিয় জায়গা নয়; তাই বোধহয় এই ফলসের পরিবেশ এখনো পর্যন্ত অনাবিল, কৃত্রিমতার ছোঁওয়া এখনো এর গায়ে লাগে নি। আমাদের খুবই ভাল লাগল। এখন একটি ধারায় জল পড়ছে, কিন্তু ভৌগলিক গঠন দেখা পরিস্কার বোঝা গেল বর্ষার সময় কি বিপুল জলরাশি কত দিক থেকে ধেয়ে এসে আছড়ে পড়ে নীচে। এখানে বলে নিই যে প্রায় সব কটি জলপ্রপাত দুভাবে দেখা যায়; একটি হল উপর থেকে; আর অন্যটি হল নিচে নেমে গিয়ে। বলাই বাহুল্য, আমারা আমাদের বয়সের এবং শারিরীক সক্ষমতা নিরিখে প্রথম উপায়টিই আমরা অবলম্বন করেছিলাম। ট্রেক করে নীচে নেমে দেখার সাহস আর হয় নি।
(৫) চিত্রধারা ও তামর ঘুমর ফলস – কোন জল ছিল না। তবু আমাদের ড্রাইভার মহোদয় আমাদের চিত্রধারা ফলসের কাছে আমদের নিয়ে গেলেন; আমরা শুধু রুক্ষ, নেড়া পাহাড়ের রুপ দেখে সেখানে কিছুক্ষন সময় কাটিয়ে ফিরে চললাম। এখানে একটা কথা বলতে ইচ্ছে করছে। জলবিহীন এই জলপ্রপাতগুলিতে জল না থাকলেও জলপ্রপাতের গতিপথের নিরাভরন সৌন্দর্য্যও কিন্তু কম দ্রষ্টব্য নয়।
(৬) চিত্রকুট ফলস – এই হল সেই সুবিখ্যাত জলপ্রপাত, যাকে বলা হয়ে থাকে “Niagara Falls of India”। বহুদিনের ইচ্ছা ছিল এই ফলসটি দেখতে যাব। আজ সেই ইচ্ছা পূরন হল। এই বিপুল জলরাশির সামনে দাঁড়ালে সবার মনেই বিস্ময় জাগবে। জগদলপুরের পশ্চিম দিকে প্রায় ৪০ কিমি দূরে ইন্দ্রাবতী নদী উপরে এই জলপ্রপাতটি অবস্থিত। এই ফলসের উচ্চতা ৯৫ ফিট; কিন্তু বর্ষাকালে এটির ব্যাপ্তি এতই বেশী হয় যে লোকে এই ফলসকে “ভারতবর্ষের নায়াগ্রা” বলে ডেকে থাকে। এই ফলসের নিচে নেমে নৌকা বিহার করা যায়; আমি সে সাহস করি নি, কিন্তু আমার ভাই ও তার স্ত্রী অনায়াসেই নিচে নেমে নৌকা ভাড়া করে একেবারে ফলসের নিচে পর্যন্ত গিয়েছিল। আমি নিশ্চিত নই, তবে খুব সম্ভবতঃ আধ ঘন্টার এই সফরে ওদের মাথাপিছু ভাড়া পড়েছিল ৪০.০০ টাকা করে। আমাদের ড্রাইভার আমাদের জানালেন যে এই ফলসের একটি বিশেষত্ব হল সূর্যের আলো থাকলে এই ফলসের জলের ছটায় রামধনুর সৃষ্টি হয়। এই অসাধারন দৃশ্য বর্ষাকালে, যখন সূর্য মেঘের আড়ালে মুখ লুকায়, তখন কিন্তু দৃশ্যমান হয় না। আমাদের সৌভাগ্য যে আমরা এই দৃশ্য দেখতে পেয়েছি। আমাদের দূর্বল ক্যামেরায় এটা ক্যামেরাবন্দীও করেছি, কিন্তু সেটা কতটা বোঝা যাচ্ছে, তা ঠিক বলতে পারব না। এই ফলসের পাশে কিছু দোকান রয়েছে, তার মধ্যে কিছু খাবারের দোকানও ছিল। তখন দুপুর পেরিয়ে অপরাহ্ন, আমাদের লাঞ্চ করা হয়ে ওঠেনি। ওখানেই একটি দোকান বেছে নিয়ে বসে গেলাম; খেলাম দোসা, ইডলি – এতেই আমাদের লাঞ্চের কাজ চলে গেল। সস্তায় পুষ্টিকর খাদ্য, আর কি!
(৭) তিরথগড় ফলস – এ দিন আমাদের শেষ গন্তব্য ছিল এই তিরঘগড় জলপ্রপাত। এটি জগদলপুরের দক্ষিন-পশ্চিম দিকে প্রায় ৩৫ কিমি দূরে কাংগেরঘাটি ন্যাশনাল পার্কের মধ্যে অবস্থিত। এখানে বলে নিই এই কাংগেরঘাটি ন্যাশনাল পার্কে মধ্যেই রয়েছে “কুটুমসর গুহা”, যা কিনা বোরা গুহার মতই একটি প্রাকৃতিক লাইমস্টোন গুহা; এটি সৃষ্টি হয়েছে কাংগের নদীর (কোলাব নদীর একটি শাখা নদী) অববহিকায়। এই গুহাতে প্রাকৃতিক ভাবেই কিছু Sculptures তৈরী হয়েছে এবং স্থানীয়রা এগুলি মধ্যে কয়েকটিকে আমাদের দেবতা প্রতিরুপ বলে মান্যতা দিয়েছে। কিন্তু এই গুহা দেখা প্রচুর কষ্টসাধ্য, অনেক নিচে নামতে হয় ট্রেক করে, এমন কয়েকটি জায়গা আছে, সেখানে নাকি প্রায় হামাগুডি দিয়ে অগ্রসর হতে হয়। আমাদের পক্ষে এই কষ্টসাধ্য ট্রেক করা সম্ভব হত না। আমাদের ড্রাইভার মহোদয়ও তাই বললেন। এজন্য ওই ন্যাশনাল পার্কে প্রবেশ করা সত্ত্বেও (তীরথগড় ফলস দেখতে এই পার্কে তো ঢুকতেই হত) আমরা ঐ গুহাতে ঢোকার দুঃসাহস করি নি। এখানে এটা বলাও দরকার যে এই ন্যাশনাল পার্কে ঢোকার জন্য দর্শকদের কয়েকটা ফি দিতে হয়, যেমন দর্শকদের জন্য মাথাপিছু ২৫.০০ টাকা করে এবং গাড়ীর জন্য ৫০.০০ টাকা করে। গুহাতে গেলে আবার গাইড নিতে হত, তার ফি ৫০.০০ টাকা। মুভি ক্যামেরার জন্য ২০০.০০ টাকা আর স্টিল ক্যামেরার জন্য ২৫.০০ টাকা দিতে হয়। আমাদের কাছে ছিল মোবাইল ক্যামেরা, যার জন্য কোন চার্জ লাগে নি।
এবার আনাদের গন্তব্য হল "তিরথগড় জলপ্রপাত"। অন্যান্য ফলসের তুলনায় এই ফলসের একটু বেশীই নগরায়ন হয়েছে বলে আমাদের মনে হল। প্রচুর দোকানপাঠ, একটা মন্দিরও চোখে পড়ল, বেশ কিছু ঘরবাড়ীও দেখা গেল আশে পাশে। দর্শকের সংখ্যাও অন্যান্য স্পটগুলোর তুলনায় এখানে একটু বেশী বলে মনে হল। এখানে জলপ্রপাতের দেখা পেতে হলে বেশ কিছুটা নীচে নামতে হয়। অবশ্য যথেষ্ট চওড়া সিঁড়ি আছে, ফলে ধীরে ধীরে নামলে খুব একটা কষ্ট হয় না। সিঁড়ির প্রথমে ধাপ থেকেই জলের আওয়াজ পাওয়া যায়, কিন্তু প্রথম দেখা পাওয়া যায় অন্ততঃ ৬০-৭০ টি সিঁড়ি নাবার পর। তাও কিছু গাছের আড়াল থেকে। পুরো দৃশ্যমান ভিউ পেতে হলে আরও অন্ততঃ শ’খানেক সিঁড়ি নিচে নামতে হত, সেটা আমার সাধ্যে কুলায় নি, তাই ঐ প্রথম ভিউ পয়েন্ট পর্যন্তই যেতে পেরেছিলাম। এই ফলস টি প্রকৃতপক্ষে একাধিক জলধারার সমন্বয়ে গঠিত হয়েছে, আর এই সন্মিলিত জলধারা টি নিচে নেমে গেছে একাধিক ধাপে ধাপে। এ দিক থেকে দেখতে গেলে এই ফলসের সৌন্দর্য্য অনন্যই বলা চলে। এই ফলসের ভবিষ্যতের দর্শকদের প্রতি একটি সতর্ক বার্তা – এখানে শাখামৃগ দের উৎপাত খুব বেশী, এরা সংখ্যায় প্রচুর, খাবারের খোঁজে দর্শকদের ব্যাগ, জামা কাপড় ইত্যাদিতে এদের হাত ঢুকিয়ে দেওয়া খুবই সাধারন ব্যাপার। প্রতিরোধ করতে গেলে দলবদ্ধ ভাবে আক্রমন করার ঘটনাও আমার চোখের সামনেই ঘটল। স্থানীয় এক দোকানীর পরামর্শ দিলেন যে সংগে একটা লাঠি জাতীয় কিছু সংগে রাখলে এরা একটু ভয় পায়। যাইহোক, এই ফলস দেখা যখন আমরা শেষ করলাম, তখন আমাদের শরীর আর বইছে না; একটি দোকানে একটু বসে বিশ্রাম নেওয়া গেল, আর সংগে সেই দোকানীর ভাজা গরমা গরম আলুর চপ খেয়ে নিজেদের কিঞ্চিত চার্জ করে নিলাম। এই স্পটটিই ছিল আজকের আমাদের শেষ দেখার জায়গা, ঘড়ির কাটা তখন ছুঁয়েছে প্রায় বিকাল ৫টার কাটায়। এবার আমাদের ফিরতে হবে হোটেলের উদ্দেশ্য, দূরত্ব প্রায় ৪০ কিমি। ঘন্টা খানেক তো লাগবেই। তাই এবার ফিরে চললাম আমাদের ডেরার দিকে।
জগদলপুর পর্বের শেষে বলে নেওয়া ভাল যে এখানে আমরা মূলতঃ দুটি স্পট দেখি নি – (১) মূল দান্তেওয়াড়া মন্দির; এবং (২) কুটুমসর গুহা। দুটি স্থানই আমরা ইচ্ছাকৃত ভাবে বাদ দিয়েছি; কিন্তু ভবিষ্যতের যাত্রীরা, যাঁরা এখানে ঘুরতে আসবেন এবং যাঁরা অন্যান্য স্পটের সংগে এই দুটি জায়গাও দেখতে চাইবেন, তাঁরা এখানে দু’দিনের প্রোগ্রাম করলে ভাল করবেন। কেননা জগদলপুর থেকে দান্তেওয়াড়া প্রায় ৮০-৯০ কিমি, এখানে যাওয়া আসা নিয়ে প্রায় ৫/৬ ঘন্টা তো লাগবেই।
এর সংগে সাংগ হল আমাদের জগদলপুর ভ্রমন; এই “জলপ্রপাতের দেশে”র অবারিত প্রকৃতির অনাবিল সৌন্দর্য আমাদের সত্যিই আপ্লুত করেছে। মনে হচ্ছে জীবনের কিছু অপ্রাপ্তির বোঝা এতে কমল। এর পরে আমরা যাব আমাদের অন্তিম গন্তব্যে, অর্থাৎ কোরাপুটে। এর গল্প বলব আমার এই কাহিনীর শেষ পর্বে।

descriptionবিশাখাপত্তনম আরাকু জগদলপুর কোরাপুট EmptyRe: বিশাখাপত্তনম আরাকু জগদলপুর কোরাপুট

more_horiz

#বিশাখাপত্তনম –> আরাকু –> জগদলপুর -> কোরাপুট –(৭)
কোরাপুট পর্ব
২৭-০২-২০ – আজ আমরা জগদলপুর ছেড়ে যাব কোরাপুট, যা কিনা আমাদের এই ট্রিপের অন্তিম গন্তব্যস্থল। এই পুরো ট্রিপটার সবচেয়ে অনিশ্চিত, কিন্তু সম্ভাবনাপূর্ন একটি জায়গায় যাচ্ছি, যে এলাকা আমাদের কাছে প্রকৃতির এক অকৃত্রিম সৌন্দর্যের দ্বার খুলে দেবে বলে আশা রাখছি। আর “অনিশ্চিত” বলছি এই কারনে যে (১) এই যাত্রায় এই প্রথম আমাদের জগদলপুর থেকে কোরাপুট যাবার কোন অগ্রিম টিকিট বুকিং করা নেই। এমন কি আমরা কি ভাবে কোরাপুট যাব তাও আমাদের ঠিক করাও নেই; এবং (২) কোরাপুটে আমাদের কোনও হোটেল পর্যন্ত বুকিং করা নেই। এই তথাকথিত “হটকারী” সিন্ধান্ত নেওয়ার পেছনে কিছু যুক্তিও আছে, যেমন, প্রথমতঃ (ক) জগদলপুর থেকে কোরাপুটের দূরত্ব খুব বেশী নয়; দ্বিতীয়তঃ (খ) এই জার্নিটা হবে পুরো দিনের বেলায়; এবং সর্বপরি (গ) এই দুই জায়গার মধ্যে ট্রেন, বাস ও ট্যাক্সি – সমস্ত রকম যোগাযোগই আছে, ইত্যাদি। সুতরাং আমাদের অপশন অনেক। এছাড়া, আমরা যখন যাচ্ছি তখন সেটা কোনও ট্যুরিস্ট সিজন নয়, তাই হোটেলের অগ্রিম বুকিং করার কোনও প্রয়োজনও নেই। যাইহোক, আগের দিন রাত্রে ডিনার করার পর জগদলপুর হোটেলে বসে স্থির হল ট্রেনেই যাওয়া যাক। হোটেলের লোকেরাও বলল যে এই রুটে একেবারেই ভীড় হয় না, তাই সকালের দিকে একটা প্যাসেঞ্জার ট্রেন আছে, সকাল ১০.০০ নাগাত, এই ট্রেনে সাধারন সেকেন্ড ক্লাসের টিকিট কেটে নিলেই হবে। এই কথামত আমরা সকাল বেলায় রেডি হয়ে আমরা যাকে বলি, “সস্তায় পুষ্টকর খাদ্য” অর্থাৎ দোসা, ইডলি ইত্যাদি দিয়ে প্রাতরাশ সেরে একটি অটোরিক্সা নিয়ে চলে এলাম জগদলপুর স্টেশনে। এবং রেলওয়ে কাউন্টার থেকে পাঁচটি আনরিজার্ভড সেকেন্ড ক্লাসের টিকিট কেটে নিলাম। তার পরে কোন ট্রেন, কখন, কোন প্লাটফর্ম থেকে ছাড়বে ইত্যাদি খোঁজ করতে গিয়ে আবিস্কার করলাম যে এ সেই একই ট্রেন, যেটাতে করে আমরা আরাকু থেকে জগদলপুর এসেছিলাম। শুধু ট্রেনের এখন রিটার্ন জার্নি। অর্থাৎ এটা হল কিরন্দুল-ভাইজাগ প্যাসেঞ্জার, যেটা জগদলপুর ছাড়ার নির্ধারিত সময় হল বেলা ১০.০০টা; এবং কোরাপুট পৌঁছনোর সময় হল দুপুর ০১-১৫ মি। যাইহোক, শেষ পর্যন্ত ট্রেন এল ঝাড়া ১ ঘন্টা লেট করে (এটা নাকি এখানকার দস্তুর, এবং প্রায় রোজই হয়ে থাকে।)
পথিমধ্যে কিছু ছোটখাট নাটকীয় ঘটনা ঘটে গেল। আমরা ভাবলাম যখন সময় পাওয়াই গেছে তাহলে ফোন করে কোরাপুটের কিছু হোটেলের খোঁজ খবর নেওয়া যাক। প্রথমে ফোন করা হল “হোটেল আলিশান” বলে একটি হোটেলকে, যার রিভিউ বেশ ভাল ছিল। কিন্তু জায়গা নেই। তারপর ফোন করা হল “হোটেল রাজ রেসিডেন্সী” নামে অন্য আর একটি হোটেলকে। এটার রিভিউও বেশ ভাল। কিন্তু এখানেও জায়গা নেই; এখানকার রিসেপশন আমাদের জানালেন যে যদিও এই সময় ঠিক ট্যুরিস্ট সিজন নয়, কিন্তু এখন এখানে “বিয়ের সিজন” চলছে, তাই প্রায় সব হোটেলই বুকড হয়ে রয়েছে। যাঃ বাবা, এটা তো আমাদের হিসাবের বাইরে ছিল। যাইহোক, ভালই শিক্ষা হল, ভবিষ্যতে এই ধরনের পরিস্থিতিতে আমাদের বিয়ের সিজনকেও হিসাবের মধ্যে রাখতে হবে। যাইহোক, এর পর “অতিথি ভবন” নামক একটি হোটেলকে ফোন করা হল। এই হোটেল সম্পর্কে ইতিপূর্বে আমার পোস্ট-করা “প্লানিং” পর্বে বিস্তারিত লিখেছি, তাই আর পুনারক্তি করছি না। শুধু এইটুকুই জানাচ্ছি যে এই হোটেলটিও পুরো বুকড ছিল, কিন্তু এখানকার একজন কর্মচারীর সৌজন্যে আমরা শেষ পর্যন্ত এদেরই sister hotel (শান্তি নিবাস)-এ আমরা ঠাঁই পেয়েছিলাম। এবং আমাদের অভিজ্ঞতা এখানে খুবই ভাল ছিল। যাইহোক, এবার back to train journey! সিংগল লাইনের কল্যানে এবং অন্য ট্রেনগুলিকে ছেড়ে দিতে দিতে আমাদের ট্রেনের লেট প্রায় দু ঘন্টায় পৌঁছল। শেষকালে আমরা কোরাপুট পৌঁছালাম অপরাহ্ন সাড়ে তিনটা নাগাত। ইতিমধ্যে আমাদের থাকার জায়গা “শান্তি নিবাসে” টেলিফোনের মাধ্যমে confirmed হয়ে গেছে, তাই সোজা একটা অটোরিক্সা নিয়ে (একটা অটোতেই সকলকে ধরে গেল) সোজা গেলাম হোটেল “শান্তি নিবাস”, স্টেশন থেকে দূরত্ব প্রায় ৪/৫ কিমি, ভাড়া পড়ল ১০০.০০ টাকা। স্টেশন থেকে অটো করে আমাদের হোটেলে যাবার সময় দেখলাম কোরাপুট একটি পাহাড়ী জায়গা, উঁচু-নিচু রাস্তা ঘাট, আবহাওয়াও আদৌ গরম নয়। পরে নেটে দেখলাম সমুদ্রপৃষ্ট থেকে কোরাপুটের উচ্চতা হল ২,৮৫০ ফিট।
হোটেলে আমাদের চেক ইন ইত্যাদি অত্যন্ত সুশৃঙ্খলভাবেই হয়ে গেল, এখানকার স্টাফেরা যথেষ্ট হেল্পফুল ও বিনয়ী ছিল। কিন্তু আমাদের হোটেলে কিচেন নেই, খাবার জন্য পাশেই এদের সহযোগী “হোটেল অতিথি ভবন”-এ আছে কিচেন ও ডাইনিং হল এবং ওখানে সুলভ মূল্যে খাবার পাওয়া যায়। অতএব আমরা তাড়াতাড়ি ফ্রেশ হয়ে নিয়ে দ্রুত চললাম খাবারের উদ্দেশ্যে। যেহেতু এই সংস্থা একটি ধর্মীয় সংগঠনের দ্বারা পরিচালিত, এখানে শুধু নিরামিষ খাবারই পাওয়া যায়, এমনকি এখানে রান্নায় পিঁয়াজ, রসুন ইত্যাদিও ব্যবহার করা হয় না। যাইহোক, তখন আমাদের প্রচন্ড ক্ষিধে পেয়েছে, তাই এসব তুচ্ছ ব্যাপারকে আমরা তত গুরুত্ব দিলাম না। খাবারের মূল্য খুবই পকেট ফ্রেন্ডলি, যেমন, অর্ডিনারী থালির মূল্য হচ্ছে ৪০.০০ টাকা মাত্র।
কোরাপুটে ঘোরার একটা বিশেষ্যত্ব হল এখানকার দ্রষ্টব্য স্থানগুলি বেশ দূরে দূরে অবস্থিত, এবং কিছু স্পট বেশ উঁচু পাহাড়ের উপরে, সেখানকার রাস্তা খুব একটা ভাল নয়। তাই ঘোরার জন্য গাড়ী তো আবশ্যকই, এবং সে গাড়ী SUV শ্রেনীর হলেই ভাল। তাই আমাদের প্রথম লক্ষ্য ছিল একটা গাড়ীর বন্দোবস্ত করা। এ ব্যাপারেও আমাদের কোনও পূর্ব হোমওয়ার্ক করা ছিল না। সেজন্য প্রথমেই আমরা এখানকার রিসেপশনের সংগে বেড়ানোর জন্য গাড়ীর কি বন্দোবস্ত হতে পারে, তার খোঁজ খবর নিলাম। জানা গেল এই হোটেলের নিজস্ব কোনও ট্রাভেল বিভাগ নেই, তবে এঁদের সংগে দু’
একটি ক্যাব অপারেটরের সংগে যোগাযোগ আছে, আমরা চাইলে ওঁরা সেই অপারেটরদের সাথে আমাদের যোগযোগ করিয়ে দেবেন। আমরা তাতে রাজী হয়ে গেলাম। ঠিক হল সন্ধ্যা ৮টা নাগাত আমরা যখন ডিনার করতে আসব, তখন কোন একটি অপারেটরের সংগে আমাদের কথা বলিয়ে দেবেন। এর পরে আমরা হোটেল থেকে বেরিয়ে আমাদের হোটেলে না গিয়ে স্থানীয় বাজারের দিকে গেলাম, যা কিনা এখান থেকে পায়ে হাঁটা দূরত্বে। আমরা এখানে বাজারের মধ্যে ট্যাক্সি স্টান্ড খুঁজে বার করে একাধিক ড্রাইভারের সংগে কথা বললাম, আমরা কোথায় কোথায় ঘুরতে চাই, তা জানালাম, ক’দিন ধরে ঘুরব তাও বললাম এবং এর পরে তাদের কাছ থেকে তাদের চার্জ কি রকম পড়বে তাও জেনে নিলাম। ওদের বললাম আমরা নিজেদের মধ্যে কথাবার্তা বলে আজ রাত্রি নটার মধ্যেই ওদের ফোন করে আমাদের সিন্ধান্ত জানিয়ে দেব। উদ্দেশ্য হল আমাদের হোটেলের পাঠানো ড্রাইভারের সংগে কথা বলার পরই এই ইস্যুটা ফাইনাল করা।
আমাদের তথ্য অনুযায়ী কোরাপুটকে কেন্দ্র করে মোটামুটি এই স্পটগুলি ঘোরা হয়ে থাকে – (১) ডুমুরিপেট রাম মন্দির; (২) সুনাবেদা শ্রী হনুমান মন্দির; (৩) নালকো টাউনশিপের সিরডি সাঁইবাবা মন্দির; (৪) কাঁটা বাউনিসিয়ানি দেবী মন্দির; (৫) দেওমালী হিলটপ; (৬) কোরাপুট (৭) রানী দুদুমা ফলস; (৮) সুলারপেট ড্যাম; (৯) দুদুমা ফলস; (১০) গুপ্তেশ্বর গুহা-তথা-মন্দির; (১১) বত্রিশ সিংহাসন ইত্যাদি। এই স্পট গুলির মধ্যে দুএকটি স্থান আমরা প্লানিং পর্বেই বাদ দিয়েছিলাম, যেমন, গুপ্তেশ্বর গুহা; এখানে যেতে হলে যে ধরনের শারীরিক সক্ষমতার দরকার, তা আমাদের নেই। তাই বন্ধুদের পরামর্শ ও আমাদের নির্বাচিত ড্রাইভারের মতামত মেনে আমরা এই স্পটটি আমরা প্রথম থেকেই বাদ দিয়েছিলাম। আর শেষকালে বত্রিশ সিংহাসন এবং কোরাপুট ট্রাইবাল মিউজিয়ম(আমাদের হোটেলের খুব কাছে হওয়া সত্ত্বেও) বাদ পড়ে গেছে সময়ের অভাবে।
যাইহোক, ঠিক রাত আটটা নাগাত আমরা আবার “হোটেল অতিথি ভবন”-এর রিসেপশনে এসে হাজির হলাম। রিসেপশনের স্টাফেরা আমাদের সংগে ওদের মনোনীত ক্যাব অপারেটরের সংগে আমাদের আলাপ করিয়ে দিল। ক্যাব অপারেটর বয়সে তরুন, সদা হাস্যমুখ, বিনয়ী, তাই প্রথম দর্শনেই আমাদের ভাল লেগে গেল। যাইহোক, একটু দরাদরি পর, যে অফার আমরা পেলাম সেটা হল উনি আমাদের একটি ৭ সিটের SUV দু’দিনের জন্য দেবেন; আমাদের উল্লেখিত সব স্পট ঘুরিয়ে দেখাবেন (গুপ্তেশ্বর বাদে) এবং এর জন্য দিন প্রতি ২,৫০০.০০ করে দুদিনের জন্য ৫,০০০.০০ টাকা নেবেন। এর আগে আমরা বাজার থেকে যে রেট পেয়েছিলাম তা এর থেকে কিঞ্চিত বেশি। তার উপরে এই ক্যাব অপারেটর আমাদের হোটেলের দ্বারা মনোনীত, কিছু অসুবিধা বা বিতর্ক হলে আমাদের হোটেলের মধ্যস্থতা পাওয়া যাবে, এই সব কারনে আমরা এই ক্যাব অপারেটরের অফার গ্রহন করার সিন্ধান্ত নিলাম। সেই অনুযায়ী কথাবার্তা পাকা করে, আগামী কাল সকাল ৯টার সময় আমাদের হোটেলে গাড়ী এসে রিপোর্ট করবে এই কথা দিয়ে আমাদের নির্বাচিত ক্যাব অপারেটর বিদায় নিলেন। আমরা এই সংগে বাজারের অন্য যে সব ড্রাইভারদের সংগে কথা বলে এসেছিলাম, তাদের জানিয়ে দিলাম যে আমরা তাদের সার্ভিস নিতে পারছি না। আগের কথা এখনই বলে নিই। আমাদের এই ক্যাব অপারেটর নির্বাচনের সিদ্ধান্ত পরবর্তীকালে অত্যন্ত সঠিক বলে প্রমানিত হয়েছিল। এই অপারেটর ভদ্রলোকের নাম হল
শ্রী বাবুলা, ফোন নং – ৯৯৩৭৯২৬৪৯৯ এবং ৯৪৩৯২৮৪৭৪০
এই প্রসংগে বলে নেওয়া ভাল হবে যে এই ক্যাব অপারেটরের সংগে আমাদের কোনও ব্যবসায়িক সম্বন্ধ নেই; শুধু যে সব বন্ধুরা আগামী দিনে কোরাপুট বেড়াতে যাবেন, তাঁদের সুবিধার্থে এই রেফারেন্স দিয়ে দেওয়া হল। আর একটা কথা, আমাদের মনে হল এই অপারেটরের সংগে “অতিথি ভবন” ও “শান্তি নিবাস” কর্তৃপক্ষের সংগে ভাল যোগাযোগ রয়েছে। আমি একবার মজাচ্ছলে বাবুলাবাবু কে বলেছিলাম যে আপনার তো এদের সংগে ভাল সম্পর্ক আছে, তাহলে ভবিষ্যতে যদি এই হোটেল বুক করার প্রয়োজন হয়, তাহলে নিশ্চয়ই আপনার সাহায্য পাওয়া যাবে! এর জবাবে ঐ ভদ্রলোক কোনও সোজা উত্তর না দিয়ে বলেছিলেন যে সে তখন দেখা যাবে (“...তব দেখা যায়েগা”) । মানে, উনি সরাসরি স্বীকার করেন নি, আবার অস্বীকারও করেন নি। কিন্তু আমি অবশ্যই বলব যে ওনার সার্ভিস বেশ ভাল ছিল, যা যা কথা হয়েছিল, তা তো উনি পুরোপুরি রেখেছেনই, তা ছাড়া আমরা যখন একটু এক্সট্রা কিছু অনুরোধ করেছি, উনি সেটাও accommodate করার চেষ্টা করেছেন। আর একটা বড় কথা যে উনি আমাদের কাছে কোনও আগাম অর্থ দাবী করেন নি, এমন কি প্রথম দিনের শেষে যখন আমরা এক দিনের ভাড়া দেবার কথা বললাম, উনি দ্বিতীয় দিনের পর পুরো টাকাটা একসংগে নেবেন বলে আমাদের জানালেন। অর্থাৎ উনি আমাদের উপর পুরোপুরি বিশ্বাস করে সার্ভিস দিয়েছেন। এই ব্যাপারটাও আমাদের ভাল লেগেছে।
যাইহোক, এবার আমাদের বেড়ানোর গল্পে ফেরা যাক। আমাদের কোরাপুট ভ্রমনের প্রথম দিন সকালে আমরা যখন প্রস্তুত হয় হোটেলের সামনে রাস্তায় দাঁড়িয়ে গাড়ীর জন্য অপেক্ষা করছি, তখন দেখা গেল যে আমাদের হোটেলের মূল গেটের বিপরীত দিকে রাস্তার উপরে একটি ছোট্ট দোকানে দক্ষিনী প্রাতরাশ বিক্রি হচ্ছে এবং বেশ কিছু পথ চলতি লোক ওখানে দাঁড়িয়ে সেই প্রাতরাশ গ্রহন করছে। দেখে মনে হল বেশ জনপ্রিয় ধাবা। আমাদের তো তখনও প্রাতরাশ নেওয়া হয় নি, হাতে কিছু সময়ও ছিল, তাই আমরা ঠিক করলাম এখান থেকে কিছু খেয়ে নেওয়া যাক। দোসা, ইডলি, বড়া ইত্যাদি নেওয়া হল, সংগে গরমাগরম চা। স্বাদ যথেষ্ট ভাল ছিল, এবং বলা বাহুল্য, এটাও ছিল “সস্তায় পুষ্টকর খাদ্য”! এর পরে পরেই আমাদের নির্দিষ্ট গাড়ী এসে হাজির হল, এটাও একটা জাইলো, 7 সিটের SUV গাড়ী। ড্রাইভার বাবুলা বাবু নন, অন্য একজন; তার নাম ঠিক মনে পড়ছে না।
এইবার শুরু হল আমাদের কোরাপুট ভ্রমন। আমরা প্রথমে গেলাম কোরাপুটের কাছেই সুনাবেদা নামে এক জনপদের কাছে “ডুমুরিপুট” নামে এক গ্রামে, যা কিনা এন এইচ-২৬ এর পাশেই অবস্থিত। এখানে রয়েছে এক প্রাচীন শ্রীরাম মন্দির। এখানের এক বৈশিষ্ট হল মন্দিরে ঠিক সামনে শ্রীরাম ভক্ত হনুমানজীর হাঁঠু ভেংগে প্রনত হয়ে বসে থাকার এক বিশাল মূর্তি। বলা হয়ে থাকে এই মূর্তিটি নাকি highest kneeling Hanuman Statue in Odisha! মন্দিরটিও বেশ সুন্দর, কিন্তু মন্দিরের ভিতরের শ্রীরাম, সীতা ও লক্ষন-এর মূর্তিগুলি বাইরের হাঁটু-ভেংগে-বসা শ্রী হনুমানজীর মূর্তির তুলনায় নিতান্তই ছোট।
আমাদের এর পরের গন্তব্য হল দামনজোড়ি নামে এক ইন্ড্রাষ্টিয়াল টাউনশিপ, এটা ভারত সরকারে সংস্থা নালকোর কর্মচারীদের জন্য প্রতিষ্টিত এক সাজানো গোছানো ছিমছাম টাউনশিপ। এই উপনগরী শুরু হবার মুখেই আমাদের নিয়ে যাওয়া হল একটি বিচিত্র ধরনের মন্দিরে, যদিও একে মন্দির বলব, না অন্য কিছু, ঠিক বুঝে উঠতে পারছি না। এখানকার বৈশিষ্ট হল যে এখানে কোনও মূর্তি বা কোনও স্ট্রাকচারও নেই, দেখে যা মনে হল এটি একটি প্রাচীন বিশাল বাঁশ বাগানের অংশ; এবং এই বাঁশ গাছকেই দেবীজ্ঞানে স্থানীয়রা পুজো করেন। আমরা দেখতে পেলাম যে খোলা আকাশের নীচে এই বাঁশ বাগানের মধ্যে এখানকার স্থানীয় আদিবাসীরা তাঁদের ছেলে মেয়েদের বিয়ে দিতে এসেছেন, কেউ বা এনেছেন ছাগশিশু, সম্ভবতঃ বলি দেবার জন্য। প্রচুর ধুপকাটি জ্বালনো হয়েছে; এবং আশপাশের বাঁশ গাছের নিন্মভাগ লাল কাপড়ে মুড়ে দেওয়া হয়েছে। আর একটা জিনিষ আমাদের অবাক করল, সেটা হচ্ছে এখানে কোন পুরোহিত নজরে পড়ল না। এই ধরনের বিচিত্র মন্দিরের কথা এর আগে আমরা শুনি নি, দেখা তো দূরের কথা। ড্রাইভারের সাথে কথা বলে, এবং পরবর্তিকালে নেট সার্চ করে যা তথ্য পেলাম, তা হল এই দেবীস্থান হল “কাঁটা বাউন্সিয়ানী দেবী”র স্থান। স্থানীয় অধিবাসীরা এই দেবীকে দেবী দূর্গারই এক রূপ বলে মেনে থাকেন।
এর পরে আমরা মূল নালকো টাউনশিপের মধ্যে প্রবেশ করলাম। এই সাজানো গোছানো টাউনশিপ আমাদের পরিচিত যেকোনও ইন্ড্রাষ্টিয়াল টাউনশিপের মত করেই গড়ে তোলা হয়েছে। এই সংগে এখানকার কর্তৃপক্ষ এঁদের কর্মচারী ও তাঁদের পরিবারের জন্য গড়ে দিয়েছেন দুটি সুন্দর মন্দির – (ক) শিরডি সাই বাবা মন্দির; এবং (খ) হনুমানজী মন্দির। দুটি মন্দিরই পাশাপাশি অবস্থিত; এবং এই মন্দিরদ্বয়ের সংগে গড়ে তোলা হয়েছে একটি সুসজ্জিত উদ্যান। খুবই সুন্দর করে সাজানো এবং দেখে মনে হল নিয়মিত পুজা ও পার্কের দেখভাল করা হয়ে থাকে। এখানকার একটি বৈশিষ্টের কথা উল্লেখ করতেই হবে। এখানে শ্রী হনুমানজীর মূর্তিটি সত্যিই বিশালাকৃতি, মাটি থেকে ১০৮ ফিট উঁচু। এই মূর্তি নাকি এশিয়ার মধ্যে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ হনুমানজীর মুর্তি। কিন্তু একটা কথা এখানে বলা প্রয়োজন, শ্রী হনুমানজীর মূর্তির বিভিন্ন অংশে মৌমাছিরা চাক বেঁধেছে, যা নিচে থেকেই পরিস্কার বোঝা যাচ্ছে। অথচ এই ব্যাপারটাতে কর্তৃপক্ষ বা পূজারী কারও কোন ভ্রুক্ষেপ আছে বলে মনে হল না।
এর পরে আমরা গেলাম “দেওমালী হিল টপ”-এ। আমার কাছে এই স্থানটির বিশেষ এক আকর্ষন ছিল। বহুদিন আগে, আমার এক পরিচিত ব্যক্তি, বেশ কিছু পাহাড়ী রাস্তা ট্রেক করে (তখন পাকা রাস্তা ছিল না) এই জায়গায় এসে পৌঁচেছিলেন; এবং তাঁর কাছ থেকে এই স্বর্গীয় স্থানের বিবরন শুনে তখন থেকেই এই জায়গায় আসার ইচ্ছে মনের মধ্যে লালন করছিলাম। আজ তা পুরন হতে চলেছে। স্বাভাবিক ভাবেই আমি রোমাঞ্চিত ও কিঞ্চিত উত্তেজিতও বটে। এই দেওমালী হিল টপ কোরাপুট থেকে মোটামুটি ৭০ কিমি দূরে অবস্থিত পূর্বঘাট পর্বতমালার চন্দ্রগিরি-পট্টাংগি সাব-রেঞ্জের অংশ ; এটিকে ওডিশার সর্বোচ্চ শৃংগ বলে মানা হয়ে থাকে, এর উচ্চতা সমুদ্রপৃষ্ট থেকে ৫৪৮৬ ফিট। বর্তমানে এই স্পটে পৌঁছানোর জন্য একটি সুন্দর পাহাড়ী রাস্তা তৈরী করা হয়েছে, এর ফলে আমাদের SUV সহজেই হিলটপের উপরে পৌঁছে গেল।
যেখানে এসে আমাদের গাড়ী থেমে গেল; এবং ড্রাইভার আমাদের নামতে বলল, সেখানে সন্তর্পনে পা রাখতেই আমার সমস্ত দেহ রোমাঞ্চিত হয়ে উঠল।আমরা দাঁড়িয়ে আছি, আক্ষরিক অর্থে্‌ এক দিকশূন্যপুরে। একটা ন্যাড়া পাহাড়ের উপরে এক ফালি ফ্লাট জায়গা, আশ পাশে কোন গাছপালা, কোনও স্ট্রাকচার, কোন পাহাড়ের শৃংগ – কিছুই দৃশ্যমান নয়; শুধু দেখতে পাচ্ছি আমাদের উপরে আকাশের ঘেরাটোপ, যেন মশারীর মত আমাদের ঘিরে ধরেছে। শন শন করে হাওয়া বইছে বেশ বেগেই। আচ্ছা, আপনারা কেউ কি বাতাসের “শন, শন” শব্দের আওয়াজ শুনেছেন? বোধহয় না, কিন্তু আমি যেন এখানে এই আওয়াজ স্পষ্ট শুনতে পেলাম। চারিদিকে কিচ্ছু নেই, আশে পাশে চোখ মেলে কেবল দেখতে পাচ্ছি উপরে নীলাকাশ, আর নিচে, অনেক নিচে, অসংখ্য ছোট ছোট পর্বত শৃংগের বিন্যাস। যেন এক প্রার্থনারত রুক্ষ সন্যাসীর জটাজালে আটকে পড়ে গেছি। একটা সরু রাস্তা আরও অল্প কিছু উঁচুতে চলে গিয়েছে, এই পথ যেন আমাদের ডাকছে, কোথায়? জানি না। আর একটু এগিয়ে দেখি একটা নিঃসংগ দ্বিতল সমান উঁচু আধ-ভাংগা ওয়াচ টাওয়ার গোছের স্ট্রাকচার, সেখানে সিঁড়িও রয়েছে, কিছুটা উপরে ওঠাও যায়। এখান থেকে নিচে গিরিখাত হঠাৎ যেন ঝাঁপ মেরে পড়েছে, আশে পাশে অসংখ্য গিরি শৃংগ যেন দেওমালীর এই গিরিশৃংগকে অভিবাদন করছে। হিমালয়ের সামনে দাঁড়ালে আমার কেমন যেন নিজেকে অকিঞ্চিতকর বলে মনে হয়; আর এই দেওমালীতে পৌঁছে আমার সেই একই অনুভূতি হল, সংগে কিছু আশংকা, কিছু ভীতি। কেন? কিসের জন্য? আমার জানা নেই। হঠাৎ করে নিজেকে যেন একাকী, এক নিঃসংগ পথিক বলে মনে হতে থাকল। যাইহোক, এই প্রাথমিক বিহ্বলতা কাটিয়ে চারিদিকে আবার নজর দিতে লক্ষ্য করলাম, এই রুক্ষ পাহাড়ের পাথর ভেদ করে জেগে উঠেছে জীবন, ছোট ছোট নাম-না-জানা ফুল ফুটেছে আশপাশে। সব মিলিয়ে প্রকৃতি যেন কোন বিশেষ অতিথির জন্য শয্যা সাজিয়ে রেখেছে। এই অসামান্য স্পটটি কিন্তু কিছুটা অবহেলা, অযত্নে বিষন্ন হয়ে রয়েছে। তাই এবার কিছু ছোট খাট ”নেই” জগতের হিসাব খুঁজে দেখলাম। যেমন, নেই কোনও টয়লেটের ব্যবস্থা, ফলে বিনা বাধায় প্রকৃতি দূষন চলছে। আর সবচেয়ে বড় কথা, আশে পাশে কোথাও নেই কোন পানীয় জলের ব্যবস্থা। ওয়াচ টাওয়ারটার ভগ্নদশা সারানোর কোন উদ্যোগও আমাদের চোখে পড়ল না। এই ছোটখাট কয়েকটি জিনিষ যদি ওড়িশা ট্যুরিজিম নজর দেয়, তবে আমার মনে হয়, এই স্পটটি দর্শনার্থীদের কাছে এক জনপ্রিয় অবশ্য-দ্রষ্টব্য জায়গা হয়ে উঠবে। এখানে বলে রাখি, আমরা এই স্পটে প্রায় ঘন্টাখানেক কাটিয়েছিলাম; এবং এমন একটি অসামান্য জায়গায়, এই এক ঘন্টার মধ্যে, অন্য কোনও দ্বিতীয় প্রানীকে আসতে দেখি নি। এখান থেকে ফিরতে ফিরতে মনে হচ্ছিল যে এই জায়গা দেখতে আসা আমার ট্রাভেলার জীবনের এক পরম প্রাপ্তি। কেমন একটা ভালোলাগার পরিতৃপ্তি নিয়ে এখান থেকে ফিরে এলাম। এই ভাল লাগার রেশ এখনও আমার মনে লেগে রয়েছে। এই প্রসংগে একটা কথা বলে নেওয়া ভাল যে এখানে যে কথাগুলি লিখেছি, সেগুলি একান্তই আমার ব্যক্তিগত বোধ/চিন্তা থেকে লিখেছি। যাঁদের এগুলি অর্থহীন বকবকানী বলে মনে হবে, তাহলে আমার অনুরোধ, এই প্যারাগ্রাফটিকে যেন ignore করে এড়িয়েই যান।
আমাদের পরের গন্তব্য, যা কিনা আমাদের আজকের শেষ গন্তব্য স্থল, হল “রানী দুদুমা জলপ্রপাত”। অকৃত্রিম প্রাকৃতিক পরিবেশের মধ্যে লুকিয়ে থাকা এই জলপ্রপাত টি কোরাপুট থেকে প্রায় ৪০-৪৫ কিমি দূরত্বে আর সেমালিগুডা শহর থেকে প্রায় ২০ কিমি দূরে অবস্থিত। এই জলপ্রপাতটির নিকটস্থ গ্রামের নাম নন্দপুর। এখানে বলে নেওয়া উচিত হবে যে এই “রানী দুদুমা জলপ্রপাত” আর “দুদুমা জলপ্রপাত” কিন্তু এক নয়। দুটি জলপ্রপাত মধ্যে দূরত্ব যথেষ্ট, আকারে, প্রকারে, চেহারায় দুটির মধ্যে কোনও মিলই নেই, তবু দুটি নামের মধ্যে কেন এমন মিল তা আমি চেষ্টা করেও বার করতে পারি নি। স্থানীয় লোকেরাও এ ব্যাপারে আমাদের খুব একটা সাহায্য করতে পারে নি। যাই হোক, এই ফলস টি প্রকৃতপক্ষে ওডিশা ও অন্ধ্র প্রদেশে সীমান্তে অবস্থিত। শুনেছি এই জলপ্রপাতের মোট তিনটি ধারা আছে, আমরা অবশ্য দুটি ধারা ই দেখতে পেরেছিলাম, হয়ত বর্ষাকালে সব ক’টি ধারাই দৃশ্যমান হয়। এই তিনটি ধারার মধ্যে দুটি ধারা নাকি ওডিশার মধ্যে পড়েছে, আর অন্যটি পড়েছে অন্ধ্র প্রদেশে। এই জলপ্রপাতের কাছে যেতে হলে কিন্তু ১ কিমি-র মতো হাঁটতে হয়; এবং এই হাঁটা প্রায় ট্রেকিং-এর মতোই, আমাদের মত বৃদ্ধদের কাছে বেশ কষ্টসাধ্য। আগে সঠিক খবর থাকলে হয়ত আমি চেষ্টাই করতাম না, কিন্তু এক্ষেত্রে আমি বলব, এই প্রকৃত খবর না-থাকাটা একদিক থেকে আমার পক্ষে সাপে বর হয়েছে। আমাদের গাড়ী একটা নির্দিষ্ট পয়েন্ট পর্য্যন্ত গিয়ে পার্কিং লটে থেমে গেল। সেখানে আমাদের ৫০.০০ পার্কিং ফি দিতে হল আমাদের গাড় পার্ক করার জন্য। যে যুবকেরা এই পার্কিং ফি আদায় করছিল, তাদের যখন জিজ্ঞাসা করলাম কতদূর যেতে হবে এই ফলস দেখতে, তখন তার বলল এই তো খুব কাছেই, দশ মিনিটের মত লাগবে। আমার স্ত্রী ও কন্যা কিছুটা গিয়েই তাদের যাত্রার ক্ষান্তি দিল এবং পথিমধ্যে যাত্রীদের বসার যে বেঞ্চ করে দেওয়া আছে, সেখানে বসে পড়ল। আমার ভ্রাতা ও তার স্ত্রী তর তর করে এগিয়ে গেল উপরের দিকে। আমি আস্তে আস্তে, দম নিয়ে নিয়ে, ধীরে ধীরে এগুতে লাগলাম, পথের মাঝে দেখলাম এই যাত্রাপথের সংস্কার ও সৌন্দর্যায়ন হচ্ছে। অনেক মহিলা ও পুরুষ কারিগররা কাজ করে চলেছেন। সবাই মনে হল বাংগালী, কেননা তারা নিজেদের মধ্যে বাংলায় কথাবার্তা বলছে। অবশ্যই আলাপ করলাম, জানা গেল যে এই কাজের বরাত পেয়েছে এক কোলকাতার ঠিকেদার এবং স্বাভাবিকভাবি এখানে কর্মরত কারিগর ও তাদের সহকারীরা সবাই বাংগালী। আমি বিশেষ করে খুশী হলাম এই শুনে যে এই কর্মচারীরা সবাই আমার এলাকা বেহালা-ঠাকুরপুকুর অঞ্চলের বাসিন্দা। এরা সবাই তাদের পরিবার নিয়েই এখানে এসেছে, এবং স্বামী-স্ত্রী উভয়েই কাজ করছে। কাছেই নন্দপুর নামে এক গ্রামে বাড়ী ভাড়া করে বসবাস করছে। যাইহোক, কিছুক্ষন গল্প করে আবার এগোলাম। এখানেও, আমার দেশের লোক হওয়া সত্ত্বে্‌ও, এরা আমাকে জলপ্রপাতের দূরত্ব সম্পর্কে ভূল তথ্য দিল। ফেরার পথে এই সম্পর্কে অনুযোগ করলে ওরা হাসতে হাসতে বলল, “কাকু, ঠিক দূরত্ব বললে আপনি তো আর এগোতেনই না, আপনার জায়গাটা আর দেখা হত না। তাই আপনাকে উৎসাহ দেবার জন্য দূরত্ব কমিয়ে বলেছি। দেখুন, আপনি তো ঠিকঠাকই দেখে এখন ফিরে আসছেন”। ভেবে দেখলাম, একদিক থেকে ঠিকই তো। যাই হোক, এখানে বলে নিই, এই ১ কিমি মতো যাত্রা পথ আমাদের মত বৃদ্ধদের পক্ষে যথেষ্ট কষ্টসাধ্য জার্নি, কিন্তু একটু কষ্ট করে পৌঁছতে পারলে কথা দিতে পারি ঠকবেন না। অসম্ভব সুন্দর প্রাকৃতিক পরিবেশের মধ্যে লুক্কায়িত এই ঝর্নাটির চারিপাশে গভীর জংগল, একটু দূর থেকেই জলের আওয়াজ শুনতে পাওয়া যায়, তারপরে হঠাৎই প্রকাশিত হয় এর রূপ, আমরা এর দুটি ধারা, একটি বড়, অন্যটি ছোট ও শীর্ন, দেখতে পেয়েছি। আমরা ছাড়া আর অন্য কোন প্রানীকে এই ফলসের কাছে দেখতে পাই নি। এই প্রপাতের একটি বিশেষত্ব হল যে এখানে একদম জল প্রপাতের নিচে পৌঁছে যাওয়া যায়, স্নান করাও যায়। আমার ভাই ও ভ্রাতৃবধু তো আগেই এখানে পৌঁছে গিয়েছিল, তারপর আমি ওখানে গিয়ে ওদের সংগে যোগ দিই। ওখানে পৌঁছানোর পর প্রারম্ভিক মনোভাব হল এই যে, আমি পেরেছি! এখানে আধ ঘন্টার মত কাটিয়ে, খুব একটা পরিতৃপ্তির শান্তি নিয়ে ফিরে পথ ধরলাম। ফিরতি পথে আবার আমার দেশওয়ালী লোকদের সংগে দেখা হল, তাদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে ফিরে চললাম আমাদের আস্তানায় দিকে।
এ দিনের শেষ গন্তব্য হল কোরাপুট মূল শহরের মধ্যে অবস্থিত “শবর শ্রীক্ষেত্রের জগন্নাথ মন্দির”, যা কিনা, আমাদের হোটেলের ঠিক উপরে এক টিলার ঊপরে অবস্থিত। আমাদের গাড়ী, আমাদের বিশেষ অনুরোধে (এই স্পটটি আমাদের নির্দ্দিষ্ট ভ্রমনসূচির মধ্যে ছিল না্‌ এই মন্দির চত্তরেই নামিয়ে দিয়ে আমাদের থেকে আজকের মত বিদায় নিল। এই মন্দিরের নাম “শবর শ্রীক্ষেত্র জগন্নাথ মন্দির”। আমরা যা শুনলাম যে এই নামকরনের পিছনে একটি ইতিহাস আছে, বলা হয়ে থাকে যে দ্বাদশ শতাব্দীতে স্থানীয় জাতিগোষ্টীর (যাঁদের “শবর” বলে ডাকা হয়) শাষকেরা এই মন্দির তৈরী করেছিল। তাই এই মন্দিরটি “শবর শ্রীক্ষেত্র” বলে পরিচিতি লাভ করেছে। এই ধর্মস্থান বর্তমানে পুরীর মন্দিরের পরেই ওডিশার অন্যতম মূখ্য জগন্নাথ মন্দির বলে মানা হয়ে থাকে। কোরাপুটের সর্বোচ্চ টিলার উপর এই মন্দির প্রকৃতপক্ষে একাধিক মন্দিরের সমন্বয়ে গঠিত হয়েছে। পরিস্কার পরিচ্ছন্ন মন্দির, মন্দির প্রাংগন থেকে কোরাপুটের দৃশ্য আমাদের ভালই লাগল। এই মন্দিরটি প্রদক্ষিন করার পর আমরা পায়ে হেটে আমাদের হোটেলে নেমে এলাম।
২৮-০২-২০ – আজ আমাদের এই জগদলপুর-কোরাপুট অফবিট সার্কিট ভ্রমনের অন্তিম দিন। যথারীতি গত কালের মতই আমরা বেরিয়ে পড়লাম আমাদের আজকের গন্তব্যের উদ্দেশ্যে। আজ আমাদের জন্য বরাদ্দ দু’তিনটি স্পট, কিন্তু স্পটগুলি বেশ দূরে দূরে অবস্থিত। আজকের দ্রষ্টব্যের মধ্যে রয়েছে “ডুডুমা জলপ্রপাত”, যার নাম আমাদের ছোট বেলা থেকেই শুনে আসছি। ফলে এই নামটার সংগে একটা নস্টালজিক-তথা-রোমান্টিক আমাদের সব বাংগালী হৃদয়ের সঙ্গেই জড়িয়ে আছে, আমরাও এর ব্যতিক্রম নই। যাইহোক, এদিনের আমাদের প্রথম গন্তব্য ছিল জোলাপুট ড্যাম ও তার সংগে একটি পার্ক। এই ড্যাম সম্পর্কে বিশেষ কিছু বলার নেই, দেশের অন্যান্য ড্যামের মতই একটি সাধারন ড্যাম; শুধু এটা বলা যেতে পারে যে এই ড্যামের অবস্থান এক পাহড়ী রুক্ষ পরিবেশের মধ্যে, ফলে ড্যাম টির পরিবেশ বেশ দৃষ্টিনন্দন।
এর পরে আমরা গেলাম আজকের Star attraction ডুডুমা জলপ্রপাতের কাছে। এই জল প্রপাতটি সম্ভবতঃ ভারতবর্ষের সর্বোচ্চ জলপ্রপাত, এর উচ্চতা প্রায় ৫৭৫ ফিট, মাছকুন্ড নামে এক নদীর অববাহিকায় এর সৃষ্টি। এই এলাকাটি স্থানীয় “বোন্ডা” উপজাতি অধ্যুষিত, এবং নিকটস্থ গ্রামের নাম হল “বাডিগঢ়া”। কোরাপুট থেকে এর দূরত্ব প্রায় ৯০ কিমি মতো। যে বিশাল জলস্রোত এই জলপ্রপাত বহন করে সগর্জনে নিচে গিরিখাতে পড়ছে, তার (এই অফ সিজিনেও) পরিমান এত বেশী যে এর থেকে উদ্ভূত জলকনা দ্বারা সৃষ্ট ধোঁওয়া দর্শকদের দৃষ্টি আচ্ছন্ন করে দেয়। এই জলপ্রপাতের ভৌগলিক অবস্থান ওডিশায় হলেও এর জল যে গিরিখাত দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে, সেটি অন্ধ্রপ্রদেশ ও ওডিশার মধ্যে সীমানা নির্ধারন করে দিয়েছে। ডুডুমার মূল প্রবাহ একটিই, কিন্তু এর সহযোগী আরও দুটি প্রপাত আমাদের নজরে এল, দুটিই অপেক্ষাকৃত অনেক ছোট, তার একটি ওডিশার মধ্যে, অন্যটি অন্ধ্রপ্রদেশের দিকে। শোনা গেল এই প্রপাতে নীচে নামার জন্য সিঁড়ি করা আছে, যার সংখ্যা হল প্রায় আটশোর মত। বলা বাহুল্য, আমরা নীচে নামার দুঃশ্চেষ্টা করি নি। আমরা উপরের থেকে যা দেখলাম, তাতেই আমাদের মন ভরে গেল। এর নিছক বিশালত্বের কাছে কেমন যেন একটা অসহায় ভীতি, এক অনিশ্চিতের আশংকা আমাদের মনে এল। কথায় বলে না, “ভয়ংকর সুন্দর”, এই জলপ্রপাত হল সেই ভয়ংকর সুন্দরের এক প্রকৃষ্ট উদাহরন। এই প্রপাতের কাছে আমরা কাটালাম বেশ কিছুক্ষন, আমাদের এই ভ্রমনের শেষ প্রান্তে এসে মনে হল আমাদের এই অফবিট ভ্রমনের পূর্ন পরিনিতি পেল গতকালের “দেওমালী হিলটপ” আর আজকের “ডুডুমা জলপ্রপাত” – এই দুটি দ্রষ্টব্য অন্ততঃ আমার ট্রাভেলার জীবনের হাইলাইটস হয়ে থাকবে।
এর পরে আমরা আজকের ঘোরার শেষ স্পট, “জোলাপুট ড্যাম” ও “মাছকুন্ড হাইডেল পাওয়ার প্রজেক্ট” বাইরে থেকে ঘুরে দেখে নিলাম। প্রজেক্টের ভিতরেও ঢোকা যায়, তবে তার জন্য বিশেষ অনুমতির প্রয়োজন পড়ে। আমাদের তার জন্য সময় বা ইচ্ছা কোনটাই ছিল না। ফেরার পথে এক গ্রাম্য বাজারের মধ্যে একটি সাধারন খাবারের দোকানে কিছু খেয়ে ক্ষুন্নিবৃত্তি নিবারন করলাম। আমরা আমাদের সারা দিনের কষ্টসাধ্য, কিন্তু মন-ভালো-করে-দেওয়া এক পরিতৃপ্তি নিয়ে আমাদের আস্তানায় এসে আমাদের ভালোলাগা স্মৃতি গুলি নিয়ে কিছু নাড়াচাড়া করার পর হোটেলের পাওনা গন্ডা মিটিয়ে, খাওয়া দাওয়া সেরে তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়লাম, কেননা কাল সকালেই আমাদের ফেরার ট্রেন। আমাদের ফেরার ট্রেন হল সম্বলেশ্বরী এক্সপ্রেস, যা কিনা কোরাপুট থেকে ছাড়ে সকাল ০৭.১০ মি। আমাদের হোটেলের স্টাফেরা বলল যে আমাদের স্টেশনে যাবার জন্য কোনও গাড়ী অগ্রিম বুকিং-এর প্রয়োজন নেই, কেননা ভোর বেলা থেকেই হোটেলের সামনে থেকেই প্রচুর অটো পাওয়া যাবে; আমরা ওদের কথামত আর কোন গাড়ী বুকিং করি নি। আরও একটা জিনিষ জানা গেল যে আমাদের ট্রেনে সম্বলপুর পর্যন্ত কিন্তু কোনও পান্ট্রি কার থাকবে না, তাই রাস্তায় খাওয়া দাওয়ার বন্দোবস্ত আমাদেরই করে নিতে হবে, অন্ততঃ সম্বলপুর পর্যন্ত। তাই আমরা কিছু শুকনো খাবার, যেমন, মুড়ি, চানাচুর, কেক, ডিম সেদ্ধ, পাকা কলা, ইত্যাদি সংগ্রহ করে রাখলাম, যাতে অন্ততঃপক্ষে আমাদের লাঞ্চ পর্যন্ত কাজ চলে যায়।
২৯-০২-২০ – আজ ভোর বেলায় প্রস্তুত হয়ে ল্যাগেজ নিয়ে বাইরে আসতেই আমরা পেয়ে গেলাম এক অটো, ভাড়া সেই একই, ১০০.০০ টাকা – হোটেল থেকে স্টেশন। ১৫ মি মধ্যে পৌঁছে গেলাম কোরাপুট স্টেশনে। কিছুক্ষন বাদেই ট্রেন এল, আমাদের টিকিট ছিল এ সি থ্রি টায়ারে, একেবারে ফাঁকা কামরা, আমরা মাত্র কয়েকজন যাত্রি, এমন কি কোনও টিকিট কালেক্টরেরও দেখা মিলল না। এই রকম চলল সম্বলপুর পর্যন্ত। তারপরে কিছু ভীড় হল, কিন্তু তাও শুধু বৈধ যাত্রিদেরই, অন্য রুটের মত অবৈধ যাত্রীদের দৌরাত্ম্য আমাদের এই যাত্রায় ভোগ করতে হয় নি – এটাও এই রুটের এক বৈশিষ্ট্য বলে আমাদের মনে হল। আমাদের ফিরতি যাত্রা ছিল ঘটনাবিহীন, নিরুপদ্রব।
১-০৩-২০ – নতুন মাসের প্রথম দিনের সকালে ঘুম ভাংগল তখন আমরা পশ্চিমবংগে ঢুকে পড়েছি। ট্রেন মোটামুটি সঠিক সময়েই চলছে। ঠিক ০৬-১৫ মি আমাদের ট্রেন হাওড়া স্টেশনে পৌছালাম; বাইরে বেরিয়ে প্রিপেড ট্যাক্সি লাইনে বিশেষ ভীড় ছিল না, ১৫ মি মধ্যেই পেয়ে গেলাম আমাদের ট্যাক্সি; সকাল আটটার মধ্যেই পৌঁছে গেলাম আমাদের বেহালার বাড়ীতে। এই ভাবে শেষ হল আমাদের এক অবিস্মরনীয় অফবিট ভ্রমন।
বন্ধুদের যদি কোনও প্রশ্ন থাকে, আমি সানন্দে সাধ্যমত তার উত্তর দিতে তৈরি রইলাম। তবে একটা অনুরোধ, প্রশ্ন করার আগে একবার আমার পোস্ট করা সব ক’টি পর্ব একবার ভাল করে পড়ে নিয়ে তারপর আপনাদের প্রশ্ন করবেন। ধন্যবাদ ও নমস্কার।

descriptionবিশাখাপত্তনম আরাকু জগদলপুর কোরাপুট EmptyRe: বিশাখাপত্তনম আরাকু জগদলপুর কোরাপুট

more_horiz
privacy_tip Permissions in this forum:
You cannot reply to topics in this forum
power_settings_newLogin to reply