ভ্রমণে শিষ্টাচার – কতটা জরুরী? (পর্ব – হোটেল)
~ হোটেল-এ থাকা কালীন কি প্রত্যাশা আমাদের ~

আগেই ডিসক্লেমার, এই লেখাটা আমি কোন জ্ঞান বিতরণের জন্য লিখছি না – কারণ দেখবেন বেশীর ভাগই কমন সেন্স। তবে কিনা এই বিখ্যাত ব্যক্তি বলে গেছেন “কমন সেন্স ইজ নট সো কমন”। নিজের অভিজ্ঞতা কিছুটা ভাগ করে নিচ্ছি আর কি। আপনারাও যোগ করতে পারেন আপনাদের অভিজ্ঞতা।

বেড়াতে গিয়ে হোটেলে থাকার একটা খুব বেসিক নিয়ম হচ্ছে যে ‘খোলা’ মনে সেই হোটেলে থাকা। এখানে ধরে নিচ্ছি যে হোটেল কর্তৃপক্ষ আপনাকে আগে থেকেই চিটিং করে নি। তো দেখা গেছে যে আপনি যত খোলা মনে থাকতে পারবেন, হোটেলের কর্মচারী থেকে শুরু করে বাকি সার্ভিসও আপনি তত ভালো ভাবে এনজয় করছেন।

১) প্রত্যাশার মাপকাঠিঃ
আগে থেকে নিজের মতন করে একটা প্রত্যাশা সেট করে নিন হোটেল বুক করার সময়। অর্থাৎ আপনি যে অনুপাতে খরচ করতে রাজী আছেন সেই অনুপাতে রিটার্ণ পেতে পারেন কিনা। এই খরচ এবং সার্ভিসের একটা সঠিক ব্যালেন্সড ধারণা থাকলে আপনাকে হোটেলে চেক ইন করে হতাশ হতে হবে না। ধরুণ আমি দিতে রাজী আছি একটা টু-স্টার হোটেলের রুম রেন্ট, কিন্তু তখন ফাইভ-স্টার সার্ভিস আশা করলে হবে না! মনে রাখবেন এই হোটেল ইন্ডাষ্ট্রিতে আপনি যত গুড় দেবেন তত মিষ্টী হবে – আমি কর্মচারীদের বযবহারের কথা বলছি না। বলছি হোটেলের ফেসিলিটির কথা। আগে থেকে ওয়েবসাইটে দেখে নিতে পারেন কি কি ওদের ফেসিলিটি আছে এবং হোটেলের থেকে ভিউ কেমন হতে পারে। আগে থেকে যত বেশী জেনে যাবেন, তত কম হতাশ হবার সম্ভাবনা।

২) হোটেলের রুম থেকে কি কি জিনিস আপনি নিতে পারেন –
এই প্রশ্নটা খুব বেশী জটিল না, যদি না আমরা নিজেরা জটিল করে ফেলি। আমি শুধু থাকতে গেছি রুমে – তাই আমার কিছুই সেই রুম থেকে নিয়ে আসা উচিত নয়। কিন্তু হোটেলওলারা কিছু মনে করে না বা চার্জ করে না আপনি যদি শ্যাম্পু বা লোশনের ছোট বটল গুলো বা সাবান – বা পেন এবং মাথার গোড়ায় থাকা ছোট নোটপ্যাড এগুলো নেন। লক্ষ্য করে দেখবেন যে যখন রুম সার্ভিস করতে আসে তখন এরা পেন, প্যাড এসব এক্সর্টা সাথে করে নিয়ে কারণ এরা ধরেই নেয় যে এগুলো অনেকেই নিয়ে যায়। কিন্তু আর একটু বড় আইটেম যেমন – লন্ড্রি ব্যাগ, জুতো পালিশ করে রাখার ব্যাগ এগুলো ওরা এক্সপেক্ট করে না যে আপনি সাথে করে নিয়ে যাবেন – যদিও আপনি নিয়ে গেলে হোটেল চার্জ করে না কিছু। হোটেলে সমীক্ষা চালিয়ে দেখা গেছে যে অনেকে আবার টিভির রিমোট থেকে ব্যাটারী পর্যন্ত খুলে নিয়ে যায়! কিন্তু আপনি যদি বালিশ, কভার, তোয়ালে বা বাথরোব এই সব কিছু নিয়ে আসেন তাহলে খুব সম্ভবত হোটেল আপনাকে চার্জ করবে।

৩) হোটেলে ঘোরাঘুরির সময় একটু ভদ্র-সভ্য আচরণ/ব্যবহারঃ
হোটেলে অনেক ধরণের অতিথি আসে – পৃথিবীর নানা প্রান্ত থেকে। তাই যখন হোটেলের অন্য কোন রুমের পাশ দিয়ে যাবেন তখন একটু আসতে কথা বলা ভালো, কারণ হয়ত সেই ঘরের লোকটা এই মাত্র সারা রাতের জার্নি করে এল! সঙ্গে বাচ্ছা থাকলে একটু বেশী সতর্ক থাকা উচিত। কারণ বাচ্ছারা বোঝে না – এবং ওই বয়সে ওরা ছোটাছুটি করবেই। তাই হোটেলের মধ্যে তাদের নিয়ন্ত্রণে রাখা বাবা-মা বা অভিভাবকদেরই কাজ। খুব ছোট্ট ছোট্ট জিনিস যেমন ‘প্লীজ’ এবং ‘থ্যাঙ্ক ইউ’ এর অচেনা পরিবেশে অনেক সময় ম্যাজিকের মতন কাজ করে।

৪) হোটেলের মধ্যে যেই জায়গায় থাকবেন সেখানকার মতন আচরণ করুনঃ
ধরুণ আপনি হোটেলের মধ্যে বাচ্ছাদের খেলার জায়গায় গেছেন, সেখানে দল বেঁধে বড়রা গিয়ে গল্প না জুড়লেই ভালো। বা ধরুন ম্যাসাজ বা স্পা নিতে গেছেন – সেখানে একটু শান্ত পরিবেশ এক্সপেক্ট করে সবাই, তাই সেটা নজরে রেখে আস্তে কথা বার্তা পালন করুন। যদি রেষ্টুরান্ট থাকেন যেখানে নিয়ম মেনে খাবার চেষ্টা করুন। যেমন সকালের ব্রেকফাষ্ট – অনেক জায়গায় ব্যুফে থাকে, ব্যুফে মানে সেখানে বসে খেয়ে আসা – ব্যাগে ভরে দুপুরের জন্য খাবার নিয়ে যাওয়া নয়! দুঃখের বিষয় এটা খুব খুব কমন ব্যাপার একটা। অনেকে আশেপাশে একটু দেখে নিয়ে ভাবেন কেউ দেখছে না – তাঁরা ভুলে যান যে বেশীর ভাগ জায়গায় সি সি টি ভি ক্যামেরা লাগানো থাকে। ভাবুন একবার – আমি দিনে ৫-১০-১৫-২০ হাজার টাকা রুম ভাড়া দিয়ে হোটেলে থাকছি, কিন্তু ব্যাগে ২০ টাকা দামের আপেল, লেবু ভরছি! হ্যাঁ, খাবার শেষে আপনি হাতে একটা কলা, বা আপেল বা লেবু নিয়ে উঠে গেলেন সেটা খুব কমন। কিন্তু এর বেশী নয়। যদি হোটেলের লাউঞ্জে বসে থাকেন তাহলে সেখান থেকে জোরে জোরে মোবাইল ফোনে কথা না বলাই ভালো। বেশীক্ষণ কথা বলতে গেলে একটু উঠে পাশে যাওয়াই বেটার। অনেক সময় বাচ্চাদের মুড খারাপ থাকে, জোরে কান্না কাটি করে – অবস্থা অনুযায়ী ব্যবস্থা নিন। শাসন করতে হলে রুমে বা খালি জায়গায় গিয়ে করুন।

৫) অন্য সহভ্রমনকারীদের সম্মান করুণঃ
মনে রাখবেন যে হোটেলের দেওয়াল সাধারনত খুব পাতলা হয়। ভাবুন একবার যে আপনি অনেক রাতে ক্লান্ত হয়ে এসে ঘুমাবার চেষ্টা করছে আর পাশের ঘরে থেকে খুব চিৎকার এবং টিভি বা খুব জোরে মিউজিক ভেসে আসছে। কেমন মনে হবে আপনার? সেই মত ভেবে আচরণ করুন। হ্যাঁ, আমরা সবাই আনন্দ করার জন্যই বেড়াতে গেছি, কিন্তু তা যেন অন্যের অসুবিধা সৃষ্টি না করে হয়। সেই খানেই আমাদের মনুষ্যত্বের পরিচয় থাকবে।

৬) হোটেল কর্মচারীদের সাথে ব্যবহারঃ
যতটা পারবেন কর্মচারীদের সাথে ভালো ব্যবহার করার চেষ্টা করুন। বেশীর ভাগ সময়েই ভালো ব্যবহার বেশী কার্যকারী হয় চিৎকার চেঁচামাচীর থেকে। মনে রাখবেন এরা অনেকেরই বেতন খুব কম আর বেশীর ভাগ দেশে এদের জব-গ্যারান্টি বলে কিছু নেই। ওরা জানে যে আপনি নালিশ করলে ওর চাকুরী পর্যন্ত চলে যেতে পারে। তাই সাধারণত এরা ইচ্ছে করে আপনার অসুবিধার সৃষ্টি করবে না। যদি দেখেন আপনার যা সার্ভিস পাওয়া উচিত তা পাচ্ছেন না, তাহলে সেই স্টাফকে একটা সুযোগ দিন তার ব্যবহার ঠিক করার। তার পরে নালিশ করা তো পরে রইলই!

৭) সুইমিং পুলের ব্যবহারঃ
সুইমিং পুল ব্যবহার করার সময় সঠিক পোষাক ব্যবহার করুন। এই ড্রেস কোড কোন আঁতলামর জন্য বানানো হয় নি – বরং জলের পিওরিটি বজায় রাখতে এটা খুব জরুরী। না হলে নানা লোকের ব্যবহার করা জল থেকে চর্মরোগ এবং ইনফেকশন হতে বেশী সময় লাগবে না। আর সুইমিং পুলে নামার আগে পাশের শাওয়ার থেকে গায়ে জল ঢেলে নিন – কারণ একই, জলকে সুস্থ রাখার চেষ্টা। বাচ্ছাদের জলে নামাবার আগে জলের গভীরতা দেখে নেবেন। যদি সাঁতার না জানেন তাহলে জলে নামার আগে দেখে নেবেন যে পুল-গার্ড হাজির আছে কিনা।

Cool ফিটনেস সেন্টারের ব্যবহারঃ
হোটেলের জিম ব্যবহার করলে খেয়াল রাখুন যে কোন একটা মেশিন যেন ব্যালেন্সেড ভাবে ব্যবহৃত হয়। মানে ধরুণ একটাই মাত্র ট্রেডমিল আছে – সেক্ষেত্রে অনেকে হয়ত আপনার পর সেটা ব্যবহার করবে বলে অপেক্ষা করছে। এটা একটু খেয়াল রাখবেন। আর মেশিন পত্র ব্যবহারের শেষে নিজের ঘাম ইত্যাদি ট্যিসু দিয়ে মুছে দেবেন, পাশেই দেখবেন টিস্যু রাখা থাকে। অপরের ঘাম লেগে থাকা জিনিস কে আর ব্যবহার করতে চায়!

৯) বখশিসঃ
এটা সম্পূর্ণ নিজের ব্যাপার, তবে অনেক দেশে এটা কিন্তু একটা প্রায় নিয়মের মত। যেমন আমেরিকায় ১০-১৫% বখশিস (টোটাল বিলের) খুব কম যদি রেষ্টুরান্টে খেতে যান। হোটেলের পোর্টার বা রুম সার্ভিস বা ক্লিনিং লেডিকে বখশিস দেওয়াটাও রেওয়াজ। কিন্তু ইউরোপের বেশির ভাগ জায়গায় টিপ্সের তেমন চল নেই। আপনি না দিলেও কেউ ভ্রু কুঁচকে তাকাবে না। আজকাল ভারতে এই ১৮% জি এস টি এসে বখশিসের ব্যাপারটা অনেকটা উঠে গেছে।

১০) হোটেল রুমের ব্যবহারঃ
পারলে রুমটা একটু গোছানো ভাবে ব্যবহার করুণ। জিনিস পত্র নানা দিকে ছড়িয়ে থাকলে রুম পরিষ্কারের বিশাল অসুবিধা। এটা একটু ভেবে দেখবেন। দরজায় ঠিক মতন সাইন-এর ব্যবহার করুন – ডোন্ট ডিস্টার্ব বা মেক মাই রুম যেমনটা প্রোজয্য। নিজের দামী জিনিসগুলো বাইরে বেরুবার সময় রুমের লকারে রেখে দিন। আর সেই লকাদের যা পাসওয়ার্ড সেট করবেন সেটা আপনি ছাড়াও আপনার সাথীকে বলে রাখুন – ইনকেস যদি ভুলে যান। পাসপোর্ট হাতছাড়া করবেন না। আমি তো বলব পাসপোর্ট লকারে রেখে যাবেন না। বাইরে গেলে সাথে নিয়ে ঘুরুন।

এই মোটামুটি দাঁড়ালো – আবারো বলছি এই সব বেশীর ভাগটাই কমন সেন্স। একটা ভালো ইম্প্রেশন রেখে আসার কথা ভাবুন, দেখবেন নিজেরই ভালো লাগছে আর সেই স্মৃতি বহুবছর পরেও আপনার সাথে থেকে যাবে।

#সবুজসখ্যেরঅঙ্গীকারে