বৈকুণ্ঠধামের পথে
[You must be registered and logged in to see this link.]
হরিদ্বার থেকে বদ্রীনাথ যাওয়ার রাস্তায় বহু বাঙালী গেছেন,যাচ্ছেন বা ভবিষ্যতেও যাবেন। রাস্তার দৈর্ঘ্য ৩১৫ কিলোমিটার।এখন প্রশ্ন হল এই দীর্ঘ পথ যেতে সময় লাগবে কতটা? পথের অসুবিধা কি কি আছে? যে সমস্ত বাঙালী বহুবার এ পথে গেছেন তাঁদের ব্যাপার আলাদা। কিন্তু যাঁরা এখনও এ পথে যাত্রা করেন নি তাঁদের কাছে এ পথ দীর্ঘ ও ক্লান্তিকর।কিন্তু পথের ক্লান্তি ভুলিয়ে দেওয়ার মত সব রকম উপাদান এ পথে ছড়ান আছে। ঋষিকেশ থেকে ভোর পাঁচটায় বদ্রিনাথের উদ্দেশ্যে বাস ছাড়ে বটে,তবে বাস তো ছুটবে নির্দিষ্ট রাস্তা দিয়ে তার নির্দিষ্ট সময় মেনে।নইলে যে পৌঁছতে অনেক দেরী হয়ে যাবে।তার চেয়ে গাড়িতে যাওয়াই ভাল।যেমন খুশি দাঁড় করিয়ে একটু বাইরে এসে হিমালয় ও কয়েকশ ফুট নিচে বয়ে চলা অলকানন্দার রূপ উপভোগ করা যায়।পথের বেশ কিছু জায়গা ধ্বসপ্রবণ।সেখানে মোতায়েন আছেন কয়েকজন অতন্দ্র প্রহরী। কান পেতে আছেন হিমালয়ে,ওই বুঝি ওপরে কোন পাথর পড়ার শব্দ !! Stop!!! সমস্ত যান চলাচল বন্ধ!! বর্ষার সময় গেলে এমন অভিজ্ঞতা হওয়া এ পথে অমূলক নয়। তবে শরৎকাল এই স্থান ভ্রমণের জন্য তুলনামূলকভাবে নিরাপদ।তবে ব্যক্তিটির আপদ ঠিক কিসে কিসে তা না জেনে নিরাপদ কথাটি বলা ঠিক নিরাপদ নয়।পাহাড়ী পথের তীব্র বাঁক এবং গাড়ীতে চড়া সম্পর্কিত অনেক অসুস্থতাই মানুষের থাকতে পারে।তাঁদের ক্ষেত্রে এ যাত্রা মোটেই সুখকর নয়। ঋষিকেশ থেকেই পাহাড়ী পথের শুরু।কিছু দূর এগোতেই দেখা গেল রাস্তা ভীষন খারাপ।ভবিষ্যতে আরও ভাল রাস্তা হবে,কমে যাবে রাস্তার তীব্র বাঁক।সড়কপথে জুড়বে চারধাম,মসৃণ হবে যাত্রা।তাই এই সুবিশাল কান্ডকারখানা।পাহাড়ে পাহাড়ে সভ্য দানব খাবল বসাচ্ছে।মাটি পাথর ধুলোয় মাখামাখি।গাড়ির ছাদে রাখা মালপত্রে পুরু ধুলোর আস্তরণ। এবড়ো খেবড়ো রাস্তায় গাড়ি চলে হেলে দুলে। পিছনের সিটে যাঁরা বসেন তাঁদের সর্বাঙ্গ তোলপাড় করে ওঠে।ঋষিকেশ থেকে দেবপ্রয়াগ ৭২ কিলোমিটার। তার মধ্যে প্রায় ৪০-৫০ কিলোমিটার রাস্তা এইরকম।কয়েকটি জায়গায় তো গাড়ির কাচ তুলে দিয়ে এ সি চালাতে হল ধুলো থেকে বাঁচতে।হরিদ্বার থেকে সকাল ৮ টায় ছেড়ে এটুকু আসতে আমাদের সময় লাগল প্রায় চার ঘন্টা।মধ্যাহ্নভোজনের পর আমরা আবার এগিয়ে চললাম। এখান থেকে রুদ্রপ্রয়াগ ৭০ কিলোমিটার।দুপুর আড়াটে নাগাদ পৌঁছলাম সেখানে।এখান থেকেই কেদারনাথের পথ আলাদা হয়ে গেছে।উত্তরাখণ্ডের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল নদীকে অনুসরণ করে রাস্তা নির্মাণ। রুদ্রপ্রয়াগ থেকে মন্দাকিনী নদী অনুসরণ করে রাস্তা চলে গেছে কেদারনাথের দিকে।আমরা যদিও চলেছি অলকানন্দাকে অনুসরণ করে।কখনও নদী কয়েক ফুট নীচে তো কখনও সে চলে যায় কয়েক শ ফুট নীচে। শ্রীনগরে অলকানন্দার ওপরে একটি বাঁধ রয়েছে। নদীকে দেখে মনেই হয় না যে আমরা এতটা পথ পেরিয়ে বেশ ওপরে উঠেছি।আসলে নদীও যে নেমে আসছে ওপর থেকেই।তাই নদীকে দেখে স্থানের উচ্চতা বোঝা যায় না।রুদ্রপ্রয়াগ থেকে কর্ণপ্রয়াগ ৩৩ কিলোমিটার।আমরা যখন কর্ণপ্রয়াগে পৌঁছলাম তখন বাজে বিকেল সাড়ে চারটে।এখানে অলকানন্দায় মিশেছে পিন্ডারী বা কর্ণগঙ্গা।সেই পিন্ডারী বরাবর যে রাস্তা চলে গেছে ডান দিকে,সে দিকে একশ কিলোমিটার মত গেলেই পৌঁছান যাবে গোয়ালদাম। গাড়োয়াল ও কুমায়ুনের সীমানা। কর্ণপ্রয়াগ থেকে বরফাবৃত ত্রিশূল খুব দূরে নয়।কিন্তু আমাদের রাস্তার বাম দিকে বয়ে চলেছে অলকানন্দা, আর ডান দিকে সুউচ্চ পাহাড় আমাদের আড়াল করে রেখেছে শ্বেতশুভ্র হিমালয়ের থেকে। মন চায়,যদি কোনপ্রকারে এই পাহাড়ের মাথায় ওঠা যায় তবে অবশ্যই ত্রিশূলকে কাছ থেকে দেখতে পাব।কিন্তু গোয়ালদামের দিকে যাওয়া ছাড়া এমন কোন পথ আমার জানা নেই।অগত্যা এগিয়ে চলি।পথে বার বার নেমে প্রতিটি প্রয়াগে সঙ্গমঘাটে নেমে অলকানন্দা কে স্পর্শ করছিলাম।তাই দেরী হচ্ছিল বিস্তর।তা হোক। এই তো চলার আনন্দ। চলার পথে দর্শনীয় স্থানগুলোর সম্বন্ধে জ্ঞান,তাদের মধ্যে দূরত্ব ইত্যাদি বিষয় জানা থাকলে পথের ক্লান্তি কমে। এ বিষয়ে অজ্ঞ মানুষ গাড়িতে উঠে হা পিত্যেশ করে বসে থাকবেন আর ভাববেন, "উফ,আর কতক্ষণে যোশীমঠ আসবে রে বাবা!" কিন্তু যিনি সব জেনে বুঝে বেড়াতে যান ,তার কাছে পথের মজা অন্যরকম। এই তো শঙ্কু মহারাজের হিমালয়ের পথ.....এই তো উমাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের পথ....আর কিছুটা গেলেই নন্দপ্রয়াগ,তারপর পিপলকোঠি,তারপর বিষ্ণুপ্রয়াগ....তারপর....এভাবে মনের কল্পনায় থাকা যায়গা গুলো সত্যিই চোখের সামনে ভেসে ওঠে। এভাবেই এগিয়ে চলি। কর্ণপ্রয়াগ থেকে ২১ কিলোমিটার গিয়ে পৌঁছলাম নন্দপ্রয়াগ। অলকানন্দায় মিলেছে নন্দাকিনী।ড্রাইভার জিৎ সিং রানা একটি সুন্দর জায়গা দেখে গাড়ি দাঁড় করিয়ে দিল।ওপর থেকে দেখলাম নন্দাকিনী ও অলকানন্দার সঙ্গম। সে চিত্র মন এবং মোবাইলবন্দী করেই আবার এগিয়ে চলা।পাহাড়ে সন্ধে নাম ঝুপ করে। জীবনানন্দের মত শিশিরের শব্দ পাই না বটে,তবে ঝিঁ ঝিঁ পোকার ডাক এবং পাহাড়ের অন্ধকারে জনপদের ঝিকিমিকি আলো বুঝিয়ে দেয় সন্ধে হয়ে গিয়েছে। সাড়ে ছ টা বাজে।আর চলা ঠিক হবে না। আমরা পৌঁছলাম পিপলকোঠি।সেখানে হোটেল বদ্রীনাথে হল আমাদের রাত্রিবাসের ব্যবস্থা।
পিপলকোঠি থেকে যোশীমঠ ৩৬ কিলোমিটার।যোশীমঠ থেকে বদ্রীনাথ ৪৬ কিলোমিটার।পরদিন গাড়ি ছাড়ল সকাল সাড়ে সাতটায়। গন্তব্য বদ্রীনাথ। বৈকুণ্ঠ ধামে সেই দিনটা থেকে পরদিন বসুধারা ফলস দেখতে যাওয়ার ইচ্ছে ছিল।কিন্তু বাধ সাধল ঠান্ডা। খবর পেলাম বদ্রীনাথে রাতের দিকে তাপমাত্রা হিমাঙ্কের নীচে চলে যাচ্ছে। দু দিন আগেই হয়েছে তুষারপাত। আমি মনে মনে খুশি হলেও সহযাত্রীরা বদ্রীনাথে থাকার প্রস্তাবে রাজি হলেন না।এখানে বলে রাখি,দীর্ঘ পাহাড়ি পথের ধকল ও তীব্র ঠান্ডা যাঁরা সহ্য করতে পারেন না, তাঁদের এ পথে না আসাই ভাল,বিশেষত এই অক্টোবর মাসের শেষ দিকে।কিন্তু এই সময়ে যে রকম গাঢ় নীল পরিষ্কার আকাশ পাওয়া যায় তা কিন্তু অন্য সময়ে পাওয়া যায় না।মে মাসে পাহাড়ে জঙ্গলে আগুন লাগে।ধোঁয়াশায় ভরে থাকে পাহাড় ও উপত্যকা। ফলে দৃষ্টিসীমা যায় কমে।বৃষ্টি না হলে বরফের চূড়াগুলো দেখাই যায় না। অন্য অসুবিধাও আছে।সে হল পুণ্যার্থীদের ব্যাপক ভিড়। যে ঘর এখন আপনি ৮০০-৯০০ টাকায় পাবেন,মে জুন মাসে সেই ঘরেরই ভাড়া হবে ১৫০০ টাকা।এমনকি অনেক খুঁজে ঘর না ও পেতে পারেন। শ্রীনগর,পিপলকোঠি এই জায়গাগুলোতে হোটেল যথেষ্ট সংখ্যায় আছে।মোটামুটি ৮০০-১০০০ টাকায় ভালো ঘর পাওয়া যায়। যাত্রীরা সন্ধের সময় হোটেলে ওঠেন আর সকাল হতেই বেরিয়ে যান, এটাই এ পথের নিয়ম।তাই হোটেলের বন্দোবস্ত যে খুব উচ্চমানের হবে তা আশা না করাই ভাল। যাই হোক আমাদের গাড়ি কিন্তু এর মধ্যে থামে নি। সকালের লালচে আলোয় রাঙা বরফচূড়া রাস্তা থেকে মাঝে মাঝে উঁকি মারছে। ফটো তোলার শেষ নেই।মনে হয় এই বুঝি হিমালয়ের শ্রেষ্ঠ রূপ।পরক্ষণেই মনে হয় এই তো আরও কাছাকাছি দেখছি শৈলশ্রেণীগুলোকে। সাড়ে নটার মধ্যেই পৌঁছলাম যোশীমঠ। আদি গুরু শংকরাচার্য প্রতিষ্ঠিত চার মঠের এক মঠ এখানেই অবস্থিত। রাস্তার বাঁ দিকেই দেখতে পেলাম বিখ্যাত হাতি পাহাড়। ড্রাইভার বলল,"উপর দেখিয়ে স্লিপিং লেডি"। হ্যাঁ, ঠিক ই তো।যেন এক নারীমূর্তি শুয়ে আছে হাতি পাহাড়ের ওপরে। ধন্য প্রকৃতি!! ধন্য আমাদের চক্ষু। এরপর যে যায়গাটায় আমরা থামলাম সেটার নাম বিষ্ণুপ্রয়াগ। অলকানন্দায় এসে মিশেছে ধৌলী গঙ্গা। জলের গর্জন খুব বেশী। নদীর ওপর ঝুলন্ত সেতু থেকে প্রত্যক্ষ করছিলাম অলকানন্দার নৃত্য।যোশীমঠের উচ্চতা ৬১৫০ ফুট।আর বদ্রীনাথের উচ্চতা ১০৮০০ ফুট।আবার যোশীমঠ থেকে বিষ্ণুপ্রয়াগ,এই ১৪ কিলোমিটার পথ নীচের দিকে নেমে গেছে।আগেই বলেছি যোশীমঠ থেকে বদ্রীনাথ ৪৬ কিলোমিটার।অর্থাৎ বদ্রীনাথের পথে বিষ্ণুপ্রয়াগের পর মাত্র ৩২ কিলোমিটারের মধ্যে রাস্তা উঠে গেছে চার হাজার ফুটেরও বেশী উচ্চতায়। তাই রাস্তা যে ঠিক কিরকম হতে পারে তার একটা আন্দাজ নিশ্চয় পাওয়া যায়। অলকানন্দা কে বাঁ দিকে রেখে পাহাড়ের রাস্তায় ঘুরে ঘুরে আমাদের গাড়ি ওপরে উঠছে।এর মধ্যে গোবিন্দঘাট এবং পাণ্ডুকেশ্বরে রাস্তা খুব খারাপ। বৈকুণ্ঠধামের পথে এই দুটি ল্যান্ডস্লাইড ও রকফল জোন।রাস্তা বলতে প্রায় কিছুই নেই।রাস্তার ওপরেই নেমে এসেছে পাহাড়ী ঝর্ণা।সেই জল পাথর ডিঙিয়েই চলেছে আমাদের গাড়ি।অবশেষে বদ্রীনাথ যখন পৌঁছলাম তখন বেলা এগারোটা। পার্কিং এ গাড়ি রেখে সোজা চলে গেলাম মন্দির দর্শনে। সাম্প্রতিক তুষারপাতে সুউচ্চ পাহাড়ের মাথায় বরফ জমেছে। তার ফাঁক দিয়েই দেখা যাচ্ছে চির তুষারাবৃত নীলকন্ঠ পর্বত। অলকানন্দার পুল পেরিয়ে পৌঁছে গেলাম মন্দিরের কাছে।যে সহযাত্রীরা এত দীর্ঘ পথ অতিক্রম করে মাঝে মাঝেই অস্ফুট স্বরে তাঁদের ক্লেশ ব্যক্ত করছিলেন তাঁরা সবাই হঠাৎ যেন উৎসাহিত হয়ে উঠলেন। ওই তো বদ্রীবিশাল.....অলকানন্দার তীরেই উষ্ণ প্রসবন তপ্ত কুন্ড। মন্দির চত্তরে পাতলা ভিড়। পুলের কাছে আসতেই তীব্র ঠান্ডা হওয়া হাড় অবধি কাঁপিয়ে দিল। নির্ঝঞ্ঝাটে অল্প সময়ের মধ্যেই বদ্রীবিশালের দর্শন পেলাম।মন্দিরের সামনের অংশের সাথে অনেকটা মিল পাওয়া যায় বৌদ্ধ গুম্ফার।অনেকে বলেন শঙ্করাচার্যের চেষ্টায় বৌদ্ধ গুম্ফাই নাকি মন্দিরে রূপান্তরিত হয়েছে।মন্দিরের ইতিহাস যাই হোক না কেন বদরিকাশ্রমের নাম কিন্তু মহাভারতেও পাওয়া যায়। পাণ্ডবরা তীর্থ দর্শন করতে যাওয়ার সময় বদরিকাশ্রমে উপস্থিত হন। দ্রৌপদীর জন্য ভীমের ব্রহ্মকমল আনতে যাওয়ার কাহিনী,হনুমানের পথ আটকাবার কাহিনী... ইত্যাদি অজস্র কাহিনীর কেন্দ্রবিন্দু এই স্থান।মানা গ্রামের পথে উত্তরদিকে মুখ করে দাঁড়ালে বদ্রীনাথের দান দিকে রয়েছে নরপর্বত এবং বাম দিকে রয়েছে নারায়ণ পর্বত। এই দুই এর মধ্যেকার উপত্যকা অলকানন্দা দ্বারা সৃষ্ট। এই উপত্যকাই আসলে বদরিকাশ্রম।নারায়ণ পর্বতের দক্ষিণে রয়েছে বরফাবৃত নীলকন্ঠ পর্বত। উত্তরে মানা গ্রাম ভারত-তিব্বত সীমান্তের আগে শেষ ভারতীয় গ্রাম। বদ্রী থেকে দূরত্ব মাত্র চার কিলোমিটার। গাড়িকে পার্কিং এ রেখে এগিয়ে চললাম মানা গ্রাম দেখতে। এর পরে গাড়ি নিয়ে এগোনো 'মানা'। মানা পাসের দিকে যেতে গেলে বিশেষ অনুমতি লাগে। যাই হোক গ্রামের সরল মানুষজন,তাঁদের গ্রাম জীবন,হাতে বোনা উলের জিনিসপত্র ইত্যাদি দেখতে বেশ লাগে। একঘর মানাবাসী কে দেখলাম গাড়িতে তাদের গবাদি পশু তুলে তার ওপর নিজেরা চেপে বসছেন। বুঝলাম শীত আসছে। এবার ওদের নীচে ফিরে যাবার সময় হয়েছে। কেউ চলেছেন চামোলি,কেউ গোপেশ্বর কেউবা যোশীমঠ। খবর পেলাম বদ্রীনাথের কপাট বন্ধ হবে ২০ শে নভেম্বর। অবাক হয়ে ভাবলাম এখনই এত শীত,এর পরে ২০ শে নভেম্বর মানে তো ঠান্ডা আরো বাড়বে !! যাই হোক এগিয়ে চললাম ভীমপুলের দিকে। সরস্বতী নদীর উৎপত্তিস্থল এই ভীমপুল। সাদা ফেনার মত জল নির্গত হচ্ছে পাহাড়ের ফাটল দিয়ে। উদ্দাম জলধারা বাতাসে ছড়িয়ে দিচ্ছে অজস্র বারিকণা, তাতে সূর্যালোক পড়ে সৃষ্টি হচ্ছে রামধনু। মহাভারতের পঞ্চনায়ক ও তাঁদের সঙ্গিনী মহাপ্রস্থানের পথে এসেছিলেন এই পথে। বলা হয় শতপন্থ তালের নিকট দিয়েই হয়েছিল যুধিষ্ঠিরের স্বর্গারোহন। এখান থেকে সেই স্বর্গারোহিনী শৃঙ্গ দেখতে পেলাম পাহাড়ের ফাঁকে। মহাভারতের এই স্বর্গারোহনের পথ নিয়ে মতভেদ আছে। কেউ বলেন গোমুখ থেকে ওপরে উঠে গঙ্গোত্রী হিমবাহ পেরিয়ে তারা এসেছিলে স্বর্গারোহিনী শৃঙ্গের কাছে। আবার কেউ বলেন বদ্রীনাথ পেরিয়ে মানা হয়ে বসুধারা পেরিয়ে তাঁরা গিয়েছিলেন স্বর্গারোহিনী দিকে। পথ যাই হোক ল,পথের শেষ কিন্তু সেই এক। ম্যাপে দেখতে পাওয়া যায় গঙ্গোত্রী হিমবাহ থেকে শতপন্থের সরলরৈখিক দূরত্ব কিন্তু বেশি নয়। হিমালয়ের সু উচ্চ বরফাবৃত শৃঙ্গগুলিই বাধাস্বরূপ মাঝে দাঁড়িয়ে আছে। সে যাই হোক,যদি আমরা এই মানা গ্রামের পথ কেই স্বর্গারোহনের পথ ভাবি তাহলে এই স্থানে সরস্বতী নদী পেরোতে তাঁদের বেগ পেতে হয়েছিল। তখন ভীম একটা বিশাল পাথরকে ফেলে নদীর ওপর পুল তৈরী করেছিলেন। সেটিই ভীমপুল। সরস্বতী নদী এখান থেকে বেরিয়ে কাছেই মিশেছে অলকানন্দায়। জায়গাটার নাম কেশবপ্রয়াগ। আরও এগিয়ে বাঁ দিকে বেঁকে যাওয়া অলকানন্দাকে সঙ্গী করে এগিয়ে গেলাম কিছুটা। আর পাঁচ কিলোমিটার গেলেই বসুধারা। কিন্তু মানা গ্রামেরই মানুষজন আমাদের বারণ করলেন। যেহেতু বদ্রীতে থাকার প্ল্যান নেই তাই বসুধরা যাওয়ার বাসনা মনের মধ্যেই আবদ্ধ থাকল। ফেরার পথে দেখলাম ব্যাস গুহা। লোকজন বললেন ব্যাসদেবের লেখা বিশাল মহাভারত নাকি প্রস্তরিভূত হয়ে আছে। দেখলাম বই এর পাতার মত স্তরে স্তরে সজ্জিত হয়ে আছে পাথর। ভূগোল বই এ পড়া আবহবিকার নয়ত? তা হবে হয়ত। এবার ফেরার পালা। পার্কিং এর কাছে আসতেই ড্রাইভার বলল," ও দেখিয়ে বসুধরা".....বলে কি? বাইনোকুলারে চোখ লাগিয়ে দেখলাম। সত্যিই তো। ঐ তো পাহাড়ের গা বেয়ে ঝরে পড়ছে বসুধারা। কৌশানীর ovservatory থেকে কেনা যন্ত্রটাকে ধন্যবাদ দিলাম। যেতে না পারি,দেখতে তো পেলাম দূর থেকে। মনে হয় এই তো এত কাছে,এক ছুটে চলে যাই। কিন্তু এটাই পাহাড়ি পথের ধাঁধা। আমরা যেখান থেকে বসুধারা দেখছি সেখান থেকে তার দূরত্ব প্রায় সাত কিলোমিটার। এবার ফেরার পালা। রাতে আমরা যোশীমঠেই থাকলাম।রাতে অনুভব করলাম তীব্র শীতের কামড়। বদ্রীতে তাহলে এখন কত ডিগ্রী? Accuweather App জনাল -৬ ডিগ্রী!!!
পরদিন হাতি পাহাড়ে সূর্যোদয় হল। আরও ওপরে তুষারশুভ্র হিমালয় উঁকি মারছে। আজ আমরা যাব আউলি।উত্তরাখণ্ডের meadow গুলোকে গাড়োয়ালি ভাষায় বলে বুগয়াল। সেই আউলি বুগয়ালের উচ্চতা ১০০০০ ফুট।সেখান থেকে ঢালু হয়ে ৮০০০ ফুট অবধি নেমে এসেছে। যোশীমঠ থেকে দূরত্ব মাত্র ১৫ কিলোমিটার। তবে যোশীমঠ থেকে রোপওয়ে তে পৌঁছনো যায় আউলি তে। যাওয়া আসা মিলিয়ে টিকিটের দাম জনপ্রতি ৭৫০ টাকা। আমরা গেলাম গাড়ীতে। আউলি যাওয়ার পথে পাহাড়ে ওঠার সময় প্রচুর সবুজ দেখলাম। যোশীমঠ আসতেই কিরকম যেন ন্যাড়া পাহাড়ের রুক্ষতা শুরু হয়ে গেছিল। কিন্তু এই পথ মায়াবী। সবুজের ফাঁকে উকি মারছে তুষারশুভ্র হিমালয়। কুমায়ুন কে মনে পড়ছিল বার বার। আউলি পৌঁছে সিঁড়ি দিয়ে উঠে গেলাম ওপরে। chairlift এর ব্যবস্থা রয়েছে। চারটি চেয়ার উঠে যাচ্ছে আউলি lake এর দিকে। ভাড়া জনপ্রতি ৩০০ টাকা। chairlift এ চড়ে বসতেই চারপাশে বরফাবৃত হিমালয়। একদিকে ত্রিশূল,নন্দাদেবী,নন্দাঘুন্টি,অন্যদিকে নীলকন্ঠ.....সবমিলিয়ে ৩৬০ ডিগ্রী না হলেও ২৭০ ডিগ্রী অবশ্যই হিমালয়। আর বাকিটা সবুজ ঘাসের ঢালু জমি ও তার ওপরে ঘন সবুজ জঙ্গল। আউলির সৌন্দর্য মন ভাল করে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট। এখানে কিছু রিসর্ট আছে। আরও কিছু হোটেল ও রিসর্ট তৈরী হচ্ছে দেখলাম। artificial lake টি আউলির সৌন্দর্য কে আরও বাড়িয়ে দিয়েছে।
ঘন্টার পর ঘন্টা কাটানো যায় এই আউলিতে। কিন্তু আর সময় নেই। আজই নীচে নামতে হবে। শ্রীনগরে রাত্রিবাস করার পরিকল্পনা আছে। পরদিন নেমে যাব ঋষিকেশে।তাই এবার ফেরার পালা।কিন্তু বসুধারার জন্য মন কেমন করতে লাগল। আবার আসব.... আসতেই হবে....বসুধারার জন্য।
#বদ্রীনাথ #বদরিনাথ #বদ্রিনাথ #হরিদ্বার #ঋষিকেশ #অলকানন্দা #গঙ্গা #দেবপ্রয়াগ #রুদ্রপ্রয়াগ #পিপিলকোঠি #উত্তরাখণ্ড #চারধাম #দেবভূমি
#Badrinath #Haridwar #Rishikesh #Alakananda #Ganga #debprayag #Rudraprayag #pipalkothi #Uttarakhand #chardham #devbhumi
[You must be registered and logged in to see this link.]
হরিদ্বার থেকে বদ্রীনাথ যাওয়ার রাস্তায় বহু বাঙালী গেছেন,যাচ্ছেন বা ভবিষ্যতেও যাবেন। রাস্তার দৈর্ঘ্য ৩১৫ কিলোমিটার।এখন প্রশ্ন হল এই দীর্ঘ পথ যেতে সময় লাগবে কতটা? পথের অসুবিধা কি কি আছে? যে সমস্ত বাঙালী বহুবার এ পথে গেছেন তাঁদের ব্যাপার আলাদা। কিন্তু যাঁরা এখনও এ পথে যাত্রা করেন নি তাঁদের কাছে এ পথ দীর্ঘ ও ক্লান্তিকর।কিন্তু পথের ক্লান্তি ভুলিয়ে দেওয়ার মত সব রকম উপাদান এ পথে ছড়ান আছে। ঋষিকেশ থেকে ভোর পাঁচটায় বদ্রিনাথের উদ্দেশ্যে বাস ছাড়ে বটে,তবে বাস তো ছুটবে নির্দিষ্ট রাস্তা দিয়ে তার নির্দিষ্ট সময় মেনে।নইলে যে পৌঁছতে অনেক দেরী হয়ে যাবে।তার চেয়ে গাড়িতে যাওয়াই ভাল।যেমন খুশি দাঁড় করিয়ে একটু বাইরে এসে হিমালয় ও কয়েকশ ফুট নিচে বয়ে চলা অলকানন্দার রূপ উপভোগ করা যায়।পথের বেশ কিছু জায়গা ধ্বসপ্রবণ।সেখানে মোতায়েন আছেন কয়েকজন অতন্দ্র প্রহরী। কান পেতে আছেন হিমালয়ে,ওই বুঝি ওপরে কোন পাথর পড়ার শব্দ !! Stop!!! সমস্ত যান চলাচল বন্ধ!! বর্ষার সময় গেলে এমন অভিজ্ঞতা হওয়া এ পথে অমূলক নয়। তবে শরৎকাল এই স্থান ভ্রমণের জন্য তুলনামূলকভাবে নিরাপদ।তবে ব্যক্তিটির আপদ ঠিক কিসে কিসে তা না জেনে নিরাপদ কথাটি বলা ঠিক নিরাপদ নয়।পাহাড়ী পথের তীব্র বাঁক এবং গাড়ীতে চড়া সম্পর্কিত অনেক অসুস্থতাই মানুষের থাকতে পারে।তাঁদের ক্ষেত্রে এ যাত্রা মোটেই সুখকর নয়। ঋষিকেশ থেকেই পাহাড়ী পথের শুরু।কিছু দূর এগোতেই দেখা গেল রাস্তা ভীষন খারাপ।ভবিষ্যতে আরও ভাল রাস্তা হবে,কমে যাবে রাস্তার তীব্র বাঁক।সড়কপথে জুড়বে চারধাম,মসৃণ হবে যাত্রা।তাই এই সুবিশাল কান্ডকারখানা।পাহাড়ে পাহাড়ে সভ্য দানব খাবল বসাচ্ছে।মাটি পাথর ধুলোয় মাখামাখি।গাড়ির ছাদে রাখা মালপত্রে পুরু ধুলোর আস্তরণ। এবড়ো খেবড়ো রাস্তায় গাড়ি চলে হেলে দুলে। পিছনের সিটে যাঁরা বসেন তাঁদের সর্বাঙ্গ তোলপাড় করে ওঠে।ঋষিকেশ থেকে দেবপ্রয়াগ ৭২ কিলোমিটার। তার মধ্যে প্রায় ৪০-৫০ কিলোমিটার রাস্তা এইরকম।কয়েকটি জায়গায় তো গাড়ির কাচ তুলে দিয়ে এ সি চালাতে হল ধুলো থেকে বাঁচতে।হরিদ্বার থেকে সকাল ৮ টায় ছেড়ে এটুকু আসতে আমাদের সময় লাগল প্রায় চার ঘন্টা।মধ্যাহ্নভোজনের পর আমরা আবার এগিয়ে চললাম। এখান থেকে রুদ্রপ্রয়াগ ৭০ কিলোমিটার।দুপুর আড়াটে নাগাদ পৌঁছলাম সেখানে।এখান থেকেই কেদারনাথের পথ আলাদা হয়ে গেছে।উত্তরাখণ্ডের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল নদীকে অনুসরণ করে রাস্তা নির্মাণ। রুদ্রপ্রয়াগ থেকে মন্দাকিনী নদী অনুসরণ করে রাস্তা চলে গেছে কেদারনাথের দিকে।আমরা যদিও চলেছি অলকানন্দাকে অনুসরণ করে।কখনও নদী কয়েক ফুট নীচে তো কখনও সে চলে যায় কয়েক শ ফুট নীচে। শ্রীনগরে অলকানন্দার ওপরে একটি বাঁধ রয়েছে। নদীকে দেখে মনেই হয় না যে আমরা এতটা পথ পেরিয়ে বেশ ওপরে উঠেছি।আসলে নদীও যে নেমে আসছে ওপর থেকেই।তাই নদীকে দেখে স্থানের উচ্চতা বোঝা যায় না।রুদ্রপ্রয়াগ থেকে কর্ণপ্রয়াগ ৩৩ কিলোমিটার।আমরা যখন কর্ণপ্রয়াগে পৌঁছলাম তখন বাজে বিকেল সাড়ে চারটে।এখানে অলকানন্দায় মিশেছে পিন্ডারী বা কর্ণগঙ্গা।সেই পিন্ডারী বরাবর যে রাস্তা চলে গেছে ডান দিকে,সে দিকে একশ কিলোমিটার মত গেলেই পৌঁছান যাবে গোয়ালদাম। গাড়োয়াল ও কুমায়ুনের সীমানা। কর্ণপ্রয়াগ থেকে বরফাবৃত ত্রিশূল খুব দূরে নয়।কিন্তু আমাদের রাস্তার বাম দিকে বয়ে চলেছে অলকানন্দা, আর ডান দিকে সুউচ্চ পাহাড় আমাদের আড়াল করে রেখেছে শ্বেতশুভ্র হিমালয়ের থেকে। মন চায়,যদি কোনপ্রকারে এই পাহাড়ের মাথায় ওঠা যায় তবে অবশ্যই ত্রিশূলকে কাছ থেকে দেখতে পাব।কিন্তু গোয়ালদামের দিকে যাওয়া ছাড়া এমন কোন পথ আমার জানা নেই।অগত্যা এগিয়ে চলি।পথে বার বার নেমে প্রতিটি প্রয়াগে সঙ্গমঘাটে নেমে অলকানন্দা কে স্পর্শ করছিলাম।তাই দেরী হচ্ছিল বিস্তর।তা হোক। এই তো চলার আনন্দ। চলার পথে দর্শনীয় স্থানগুলোর সম্বন্ধে জ্ঞান,তাদের মধ্যে দূরত্ব ইত্যাদি বিষয় জানা থাকলে পথের ক্লান্তি কমে। এ বিষয়ে অজ্ঞ মানুষ গাড়িতে উঠে হা পিত্যেশ করে বসে থাকবেন আর ভাববেন, "উফ,আর কতক্ষণে যোশীমঠ আসবে রে বাবা!" কিন্তু যিনি সব জেনে বুঝে বেড়াতে যান ,তার কাছে পথের মজা অন্যরকম। এই তো শঙ্কু মহারাজের হিমালয়ের পথ.....এই তো উমাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের পথ....আর কিছুটা গেলেই নন্দপ্রয়াগ,তারপর পিপলকোঠি,তারপর বিষ্ণুপ্রয়াগ....তারপর....এভাবে মনের কল্পনায় থাকা যায়গা গুলো সত্যিই চোখের সামনে ভেসে ওঠে। এভাবেই এগিয়ে চলি। কর্ণপ্রয়াগ থেকে ২১ কিলোমিটার গিয়ে পৌঁছলাম নন্দপ্রয়াগ। অলকানন্দায় মিলেছে নন্দাকিনী।ড্রাইভার জিৎ সিং রানা একটি সুন্দর জায়গা দেখে গাড়ি দাঁড় করিয়ে দিল।ওপর থেকে দেখলাম নন্দাকিনী ও অলকানন্দার সঙ্গম। সে চিত্র মন এবং মোবাইলবন্দী করেই আবার এগিয়ে চলা।পাহাড়ে সন্ধে নাম ঝুপ করে। জীবনানন্দের মত শিশিরের শব্দ পাই না বটে,তবে ঝিঁ ঝিঁ পোকার ডাক এবং পাহাড়ের অন্ধকারে জনপদের ঝিকিমিকি আলো বুঝিয়ে দেয় সন্ধে হয়ে গিয়েছে। সাড়ে ছ টা বাজে।আর চলা ঠিক হবে না। আমরা পৌঁছলাম পিপলকোঠি।সেখানে হোটেল বদ্রীনাথে হল আমাদের রাত্রিবাসের ব্যবস্থা।
পিপলকোঠি থেকে যোশীমঠ ৩৬ কিলোমিটার।যোশীমঠ থেকে বদ্রীনাথ ৪৬ কিলোমিটার।পরদিন গাড়ি ছাড়ল সকাল সাড়ে সাতটায়। গন্তব্য বদ্রীনাথ। বৈকুণ্ঠ ধামে সেই দিনটা থেকে পরদিন বসুধারা ফলস দেখতে যাওয়ার ইচ্ছে ছিল।কিন্তু বাধ সাধল ঠান্ডা। খবর পেলাম বদ্রীনাথে রাতের দিকে তাপমাত্রা হিমাঙ্কের নীচে চলে যাচ্ছে। দু দিন আগেই হয়েছে তুষারপাত। আমি মনে মনে খুশি হলেও সহযাত্রীরা বদ্রীনাথে থাকার প্রস্তাবে রাজি হলেন না।এখানে বলে রাখি,দীর্ঘ পাহাড়ি পথের ধকল ও তীব্র ঠান্ডা যাঁরা সহ্য করতে পারেন না, তাঁদের এ পথে না আসাই ভাল,বিশেষত এই অক্টোবর মাসের শেষ দিকে।কিন্তু এই সময়ে যে রকম গাঢ় নীল পরিষ্কার আকাশ পাওয়া যায় তা কিন্তু অন্য সময়ে পাওয়া যায় না।মে মাসে পাহাড়ে জঙ্গলে আগুন লাগে।ধোঁয়াশায় ভরে থাকে পাহাড় ও উপত্যকা। ফলে দৃষ্টিসীমা যায় কমে।বৃষ্টি না হলে বরফের চূড়াগুলো দেখাই যায় না। অন্য অসুবিধাও আছে।সে হল পুণ্যার্থীদের ব্যাপক ভিড়। যে ঘর এখন আপনি ৮০০-৯০০ টাকায় পাবেন,মে জুন মাসে সেই ঘরেরই ভাড়া হবে ১৫০০ টাকা।এমনকি অনেক খুঁজে ঘর না ও পেতে পারেন। শ্রীনগর,পিপলকোঠি এই জায়গাগুলোতে হোটেল যথেষ্ট সংখ্যায় আছে।মোটামুটি ৮০০-১০০০ টাকায় ভালো ঘর পাওয়া যায়। যাত্রীরা সন্ধের সময় হোটেলে ওঠেন আর সকাল হতেই বেরিয়ে যান, এটাই এ পথের নিয়ম।তাই হোটেলের বন্দোবস্ত যে খুব উচ্চমানের হবে তা আশা না করাই ভাল। যাই হোক আমাদের গাড়ি কিন্তু এর মধ্যে থামে নি। সকালের লালচে আলোয় রাঙা বরফচূড়া রাস্তা থেকে মাঝে মাঝে উঁকি মারছে। ফটো তোলার শেষ নেই।মনে হয় এই বুঝি হিমালয়ের শ্রেষ্ঠ রূপ।পরক্ষণেই মনে হয় এই তো আরও কাছাকাছি দেখছি শৈলশ্রেণীগুলোকে। সাড়ে নটার মধ্যেই পৌঁছলাম যোশীমঠ। আদি গুরু শংকরাচার্য প্রতিষ্ঠিত চার মঠের এক মঠ এখানেই অবস্থিত। রাস্তার বাঁ দিকেই দেখতে পেলাম বিখ্যাত হাতি পাহাড়। ড্রাইভার বলল,"উপর দেখিয়ে স্লিপিং লেডি"। হ্যাঁ, ঠিক ই তো।যেন এক নারীমূর্তি শুয়ে আছে হাতি পাহাড়ের ওপরে। ধন্য প্রকৃতি!! ধন্য আমাদের চক্ষু। এরপর যে যায়গাটায় আমরা থামলাম সেটার নাম বিষ্ণুপ্রয়াগ। অলকানন্দায় এসে মিশেছে ধৌলী গঙ্গা। জলের গর্জন খুব বেশী। নদীর ওপর ঝুলন্ত সেতু থেকে প্রত্যক্ষ করছিলাম অলকানন্দার নৃত্য।যোশীমঠের উচ্চতা ৬১৫০ ফুট।আর বদ্রীনাথের উচ্চতা ১০৮০০ ফুট।আবার যোশীমঠ থেকে বিষ্ণুপ্রয়াগ,এই ১৪ কিলোমিটার পথ নীচের দিকে নেমে গেছে।আগেই বলেছি যোশীমঠ থেকে বদ্রীনাথ ৪৬ কিলোমিটার।অর্থাৎ বদ্রীনাথের পথে বিষ্ণুপ্রয়াগের পর মাত্র ৩২ কিলোমিটারের মধ্যে রাস্তা উঠে গেছে চার হাজার ফুটেরও বেশী উচ্চতায়। তাই রাস্তা যে ঠিক কিরকম হতে পারে তার একটা আন্দাজ নিশ্চয় পাওয়া যায়। অলকানন্দা কে বাঁ দিকে রেখে পাহাড়ের রাস্তায় ঘুরে ঘুরে আমাদের গাড়ি ওপরে উঠছে।এর মধ্যে গোবিন্দঘাট এবং পাণ্ডুকেশ্বরে রাস্তা খুব খারাপ। বৈকুণ্ঠধামের পথে এই দুটি ল্যান্ডস্লাইড ও রকফল জোন।রাস্তা বলতে প্রায় কিছুই নেই।রাস্তার ওপরেই নেমে এসেছে পাহাড়ী ঝর্ণা।সেই জল পাথর ডিঙিয়েই চলেছে আমাদের গাড়ি।অবশেষে বদ্রীনাথ যখন পৌঁছলাম তখন বেলা এগারোটা। পার্কিং এ গাড়ি রেখে সোজা চলে গেলাম মন্দির দর্শনে। সাম্প্রতিক তুষারপাতে সুউচ্চ পাহাড়ের মাথায় বরফ জমেছে। তার ফাঁক দিয়েই দেখা যাচ্ছে চির তুষারাবৃত নীলকন্ঠ পর্বত। অলকানন্দার পুল পেরিয়ে পৌঁছে গেলাম মন্দিরের কাছে।যে সহযাত্রীরা এত দীর্ঘ পথ অতিক্রম করে মাঝে মাঝেই অস্ফুট স্বরে তাঁদের ক্লেশ ব্যক্ত করছিলেন তাঁরা সবাই হঠাৎ যেন উৎসাহিত হয়ে উঠলেন। ওই তো বদ্রীবিশাল.....অলকানন্দার তীরেই উষ্ণ প্রসবন তপ্ত কুন্ড। মন্দির চত্তরে পাতলা ভিড়। পুলের কাছে আসতেই তীব্র ঠান্ডা হওয়া হাড় অবধি কাঁপিয়ে দিল। নির্ঝঞ্ঝাটে অল্প সময়ের মধ্যেই বদ্রীবিশালের দর্শন পেলাম।মন্দিরের সামনের অংশের সাথে অনেকটা মিল পাওয়া যায় বৌদ্ধ গুম্ফার।অনেকে বলেন শঙ্করাচার্যের চেষ্টায় বৌদ্ধ গুম্ফাই নাকি মন্দিরে রূপান্তরিত হয়েছে।মন্দিরের ইতিহাস যাই হোক না কেন বদরিকাশ্রমের নাম কিন্তু মহাভারতেও পাওয়া যায়। পাণ্ডবরা তীর্থ দর্শন করতে যাওয়ার সময় বদরিকাশ্রমে উপস্থিত হন। দ্রৌপদীর জন্য ভীমের ব্রহ্মকমল আনতে যাওয়ার কাহিনী,হনুমানের পথ আটকাবার কাহিনী... ইত্যাদি অজস্র কাহিনীর কেন্দ্রবিন্দু এই স্থান।মানা গ্রামের পথে উত্তরদিকে মুখ করে দাঁড়ালে বদ্রীনাথের দান দিকে রয়েছে নরপর্বত এবং বাম দিকে রয়েছে নারায়ণ পর্বত। এই দুই এর মধ্যেকার উপত্যকা অলকানন্দা দ্বারা সৃষ্ট। এই উপত্যকাই আসলে বদরিকাশ্রম।নারায়ণ পর্বতের দক্ষিণে রয়েছে বরফাবৃত নীলকন্ঠ পর্বত। উত্তরে মানা গ্রাম ভারত-তিব্বত সীমান্তের আগে শেষ ভারতীয় গ্রাম। বদ্রী থেকে দূরত্ব মাত্র চার কিলোমিটার। গাড়িকে পার্কিং এ রেখে এগিয়ে চললাম মানা গ্রাম দেখতে। এর পরে গাড়ি নিয়ে এগোনো 'মানা'। মানা পাসের দিকে যেতে গেলে বিশেষ অনুমতি লাগে। যাই হোক গ্রামের সরল মানুষজন,তাঁদের গ্রাম জীবন,হাতে বোনা উলের জিনিসপত্র ইত্যাদি দেখতে বেশ লাগে। একঘর মানাবাসী কে দেখলাম গাড়িতে তাদের গবাদি পশু তুলে তার ওপর নিজেরা চেপে বসছেন। বুঝলাম শীত আসছে। এবার ওদের নীচে ফিরে যাবার সময় হয়েছে। কেউ চলেছেন চামোলি,কেউ গোপেশ্বর কেউবা যোশীমঠ। খবর পেলাম বদ্রীনাথের কপাট বন্ধ হবে ২০ শে নভেম্বর। অবাক হয়ে ভাবলাম এখনই এত শীত,এর পরে ২০ শে নভেম্বর মানে তো ঠান্ডা আরো বাড়বে !! যাই হোক এগিয়ে চললাম ভীমপুলের দিকে। সরস্বতী নদীর উৎপত্তিস্থল এই ভীমপুল। সাদা ফেনার মত জল নির্গত হচ্ছে পাহাড়ের ফাটল দিয়ে। উদ্দাম জলধারা বাতাসে ছড়িয়ে দিচ্ছে অজস্র বারিকণা, তাতে সূর্যালোক পড়ে সৃষ্টি হচ্ছে রামধনু। মহাভারতের পঞ্চনায়ক ও তাঁদের সঙ্গিনী মহাপ্রস্থানের পথে এসেছিলেন এই পথে। বলা হয় শতপন্থ তালের নিকট দিয়েই হয়েছিল যুধিষ্ঠিরের স্বর্গারোহন। এখান থেকে সেই স্বর্গারোহিনী শৃঙ্গ দেখতে পেলাম পাহাড়ের ফাঁকে। মহাভারতের এই স্বর্গারোহনের পথ নিয়ে মতভেদ আছে। কেউ বলেন গোমুখ থেকে ওপরে উঠে গঙ্গোত্রী হিমবাহ পেরিয়ে তারা এসেছিলে স্বর্গারোহিনী শৃঙ্গের কাছে। আবার কেউ বলেন বদ্রীনাথ পেরিয়ে মানা হয়ে বসুধারা পেরিয়ে তাঁরা গিয়েছিলেন স্বর্গারোহিনী দিকে। পথ যাই হোক ল,পথের শেষ কিন্তু সেই এক। ম্যাপে দেখতে পাওয়া যায় গঙ্গোত্রী হিমবাহ থেকে শতপন্থের সরলরৈখিক দূরত্ব কিন্তু বেশি নয়। হিমালয়ের সু উচ্চ বরফাবৃত শৃঙ্গগুলিই বাধাস্বরূপ মাঝে দাঁড়িয়ে আছে। সে যাই হোক,যদি আমরা এই মানা গ্রামের পথ কেই স্বর্গারোহনের পথ ভাবি তাহলে এই স্থানে সরস্বতী নদী পেরোতে তাঁদের বেগ পেতে হয়েছিল। তখন ভীম একটা বিশাল পাথরকে ফেলে নদীর ওপর পুল তৈরী করেছিলেন। সেটিই ভীমপুল। সরস্বতী নদী এখান থেকে বেরিয়ে কাছেই মিশেছে অলকানন্দায়। জায়গাটার নাম কেশবপ্রয়াগ। আরও এগিয়ে বাঁ দিকে বেঁকে যাওয়া অলকানন্দাকে সঙ্গী করে এগিয়ে গেলাম কিছুটা। আর পাঁচ কিলোমিটার গেলেই বসুধারা। কিন্তু মানা গ্রামেরই মানুষজন আমাদের বারণ করলেন। যেহেতু বদ্রীতে থাকার প্ল্যান নেই তাই বসুধরা যাওয়ার বাসনা মনের মধ্যেই আবদ্ধ থাকল। ফেরার পথে দেখলাম ব্যাস গুহা। লোকজন বললেন ব্যাসদেবের লেখা বিশাল মহাভারত নাকি প্রস্তরিভূত হয়ে আছে। দেখলাম বই এর পাতার মত স্তরে স্তরে সজ্জিত হয়ে আছে পাথর। ভূগোল বই এ পড়া আবহবিকার নয়ত? তা হবে হয়ত। এবার ফেরার পালা। পার্কিং এর কাছে আসতেই ড্রাইভার বলল," ও দেখিয়ে বসুধরা".....বলে কি? বাইনোকুলারে চোখ লাগিয়ে দেখলাম। সত্যিই তো। ঐ তো পাহাড়ের গা বেয়ে ঝরে পড়ছে বসুধারা। কৌশানীর ovservatory থেকে কেনা যন্ত্রটাকে ধন্যবাদ দিলাম। যেতে না পারি,দেখতে তো পেলাম দূর থেকে। মনে হয় এই তো এত কাছে,এক ছুটে চলে যাই। কিন্তু এটাই পাহাড়ি পথের ধাঁধা। আমরা যেখান থেকে বসুধারা দেখছি সেখান থেকে তার দূরত্ব প্রায় সাত কিলোমিটার। এবার ফেরার পালা। রাতে আমরা যোশীমঠেই থাকলাম।রাতে অনুভব করলাম তীব্র শীতের কামড়। বদ্রীতে তাহলে এখন কত ডিগ্রী? Accuweather App জনাল -৬ ডিগ্রী!!!
পরদিন হাতি পাহাড়ে সূর্যোদয় হল। আরও ওপরে তুষারশুভ্র হিমালয় উঁকি মারছে। আজ আমরা যাব আউলি।উত্তরাখণ্ডের meadow গুলোকে গাড়োয়ালি ভাষায় বলে বুগয়াল। সেই আউলি বুগয়ালের উচ্চতা ১০০০০ ফুট।সেখান থেকে ঢালু হয়ে ৮০০০ ফুট অবধি নেমে এসেছে। যোশীমঠ থেকে দূরত্ব মাত্র ১৫ কিলোমিটার। তবে যোশীমঠ থেকে রোপওয়ে তে পৌঁছনো যায় আউলি তে। যাওয়া আসা মিলিয়ে টিকিটের দাম জনপ্রতি ৭৫০ টাকা। আমরা গেলাম গাড়ীতে। আউলি যাওয়ার পথে পাহাড়ে ওঠার সময় প্রচুর সবুজ দেখলাম। যোশীমঠ আসতেই কিরকম যেন ন্যাড়া পাহাড়ের রুক্ষতা শুরু হয়ে গেছিল। কিন্তু এই পথ মায়াবী। সবুজের ফাঁকে উকি মারছে তুষারশুভ্র হিমালয়। কুমায়ুন কে মনে পড়ছিল বার বার। আউলি পৌঁছে সিঁড়ি দিয়ে উঠে গেলাম ওপরে। chairlift এর ব্যবস্থা রয়েছে। চারটি চেয়ার উঠে যাচ্ছে আউলি lake এর দিকে। ভাড়া জনপ্রতি ৩০০ টাকা। chairlift এ চড়ে বসতেই চারপাশে বরফাবৃত হিমালয়। একদিকে ত্রিশূল,নন্দাদেবী,নন্দাঘুন্টি,অন্যদিকে নীলকন্ঠ.....সবমিলিয়ে ৩৬০ ডিগ্রী না হলেও ২৭০ ডিগ্রী অবশ্যই হিমালয়। আর বাকিটা সবুজ ঘাসের ঢালু জমি ও তার ওপরে ঘন সবুজ জঙ্গল। আউলির সৌন্দর্য মন ভাল করে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট। এখানে কিছু রিসর্ট আছে। আরও কিছু হোটেল ও রিসর্ট তৈরী হচ্ছে দেখলাম। artificial lake টি আউলির সৌন্দর্য কে আরও বাড়িয়ে দিয়েছে।
ঘন্টার পর ঘন্টা কাটানো যায় এই আউলিতে। কিন্তু আর সময় নেই। আজই নীচে নামতে হবে। শ্রীনগরে রাত্রিবাস করার পরিকল্পনা আছে। পরদিন নেমে যাব ঋষিকেশে।তাই এবার ফেরার পালা।কিন্তু বসুধারার জন্য মন কেমন করতে লাগল। আবার আসব.... আসতেই হবে....বসুধারার জন্য।
#বদ্রীনাথ #বদরিনাথ #বদ্রিনাথ #হরিদ্বার #ঋষিকেশ #অলকানন্দা #গঙ্গা #দেবপ্রয়াগ #রুদ্রপ্রয়াগ #পিপিলকোঠি #উত্তরাখণ্ড #চারধাম #দেবভূমি
#Badrinath #Haridwar #Rishikesh #Alakananda #Ganga #debprayag #Rudraprayag #pipalkothi #Uttarakhand #chardham #devbhumi