আমরা গয়া কাশী বৃন্দাবন করে বেড়াই, অথচ অনেক সময় ই ঘরের কাছের অনেক কিছু আমাদের দেখা হয়ে ওঠেনা, আজ বন্ধুদের তেমনই তিন অসাধারণ জায়গার গল্প বলব যার সাথে ইতিহাস আধ্যাত্মিকতা এবং অবশ্যই ছোট্ট করে ধারেকাছে বেড়ানোর শুলুকসন্ধান।

শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু অপ্রকট হাওয়ার আগে কোনো একসময় শ্রীনিত্যানন্দ প্রভু কে একদিন একলা গোপনে ডেকে বলেন
,
"অতিসত্বর এই লীলা করিব তিরোভাব
তোমার গৃহেতে হবে আমার অবতার
এই অবতারে যে দেখে নাই দেখিবে আরবার,

অর্থাৎ আমি খুব শীঘ্রই লীলা সম্বরণ করব, তোমার গৃহে আমার অবতার আবির্ভাব হবে এবং যারা আমাকে দর্শন করে নি তাঁদের আবার আমার দর্শন হবে...

১৪৫৭ শকাব্দের অগ্রহায়ণ মাসে শুক্লা চতুর্থীতে নিত্যানন্দ পত্নী বসুধা দেবীর অষ্টম গর্ভে জন্মগ্রহণ করেন প্রভু বীরচন্দ্র, খড়দহের কুঞ্জবাটিতে, যিনি পরবর্তীতে বীরভদ্র গোস্বামী বলে পরিচিত হন এবং মানুষজন যখন তন্ত্রমত আর বৌদ্ধধর্ম প্রচারের মাঝখানে পরে দিশেহারা হয়ে ওঠে তখন মানুষ জনকে সাহস যোগান এবং মহাপ্রভুর নিত্যানন্দ প্রভু কে দেওয়া গৌড়বঙ্গে কৃষ্ণনাম প্রচারের আদেশ পালন করেন, সাথে চলতে থাকে তাঁর সাধন ভজন, এভাবে একদিন স্বপ্নে তিনি জানতে পারেন গৌড়ের প্রাসাদে একটি কষ্টিপাথর আছে, এবং আদেশ পান সেই পাথর দ্বারা শ্যামসুন্দর নামে এক কৃষ্ণ বিগ্রহ প্রতিষ্ঠা করে তাঁর নিত্যসেবা পূজা করার, আরও জানতে পারেন যে এই কষ্টিপাথর টি মহারাজ পরীক্ষিত ওখানে রাখেন এবং তিনি প্রতিদিন সেই পাথর নাকি প্রণাম করতেন, আরও জানতে পারেন ধর্মরাজ যুধিষ্ঠির এর রাজসূয় যজ্ঞের সময় স্বয়ং ভগবান শ্রীকৃষ্ণ এই পাথর টির ওপর দাঁড়িয়ে যজ্ঞে আগত ব্রাহ্মণ দের পা ধুইয়ে দিয়েছিলেন,
অতঃপর প্রভু বীরভদ্র ব্যাকুল হন এই পাথর উদ্ধার করে শ্যামসুন্দর বিগ্রহ প্রতিষ্ঠা করতে,
সেইমতো বৈষ্ণব ভক্তদের একত্রিত করে কীর্তন করতে করতে প্রভু বীরভদ্র রওনা দেন তৎকালীন গৌড় অধুনা মালদার উদ্দেশ্যে, কীর্তনের দল মালদায় প্রবেশ করতে না করতে, গুপ্তচর মারফত খবর চলে যায় বাদশাহের কাছে, যে একদল কীর্তনরত হিন্দু লোক মালদায় প্রবেশ করছে,
বাদশাহ প্রহরী কে আদেশ করলেন, দলের পান্ডাকে বন্দী করে তাঁর সামনে পেশ করা হোক,
প্রভু বীরভদ্র কে বাদশাহর দরবারে নিয়ে আসা হোলো, গোমাংস দিয়ে বাদশাহ অভ্যর্থনা করলেন প্রভু বীরভদ্র কে কিছুটা ইচ্ছা করেই, প্রভু বীরভদ্রের সামনে সেই মাংস ভড়া পাত্রটির ঢাকনা খুলতেই দেখা গেল সেটি একপাত্র পদ্মফুল হয়ে গেছে, বাদশাহ এবার আরও একবার বাজিয়ে দেখার জন্য একটি রুপোর গ্লাসে একপাত্র সুরা এনে প্রভু বীরভদ্রের সামনে ধরলেন বললেন একটু গলা ভিজেয়ে নিন, পাত্রের ঢাকনা খুলতেই দেখা গেল সেটি এক গ্লাস দুধ হয়ে গেছে, বাদশাহের চিনতে অসুবিধা হয়নি লুটিয়ে পরেন, ঘটনাচক্রে বাদশাহর জামাতা তখন ভয়ংকর অসুস্থ, বীরভদ্র প্রভুকে বাদশা জানান আমার জামাতা গুরুতর অসুস্থ, হাকিম বৈদ্য কবিরাজ সবাই জবাব দিয়েছে, আপনি কিছু করুন, প্রভু বীরভদ্র বলেন আমি সুস্থ করে দিতে পারি তোমার জামাতা কে, কিন্তু আমাকে তার বিনিময়ে একটা জিনিস দিতে হবে, বাদশা আনন্দে আত্মহারা হয়ে বললেন সুস্থ করে দিতে পারলে আপনাকে অদেয় আর কিছু থাকবে না, প্রভু বীরভদ্র সেই দুধভড়া গ্লাস বাদশার হাতে দিয়ে বললেন যাও এই দুধটা তোমার জামাতাকে পান করিয়ে দিয়ে এসো সুস্থ হয়ে যাবে, বাদশা ছুটে গেলেন জামাতার ঘরে দেখলেন জামাতা উঠে বসে মাথার চুল বিন্যাস করছে, বাদশা কিছু বলার আগেই জামাতা জানান কিছু আগে এক সন্ন্যাসী এসে তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে তাকে সুস্থ করে দিয়ে গেছেন, এবং এই চিরুনি দিয়ে মাথা টা আচরে নিতে বিলেন, বাদশা নির্বাক হয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন, ফিরে আসেন প্রভু বীরভদ্রের কাছে, বিনিময়ে তাঁর কি চাই জানতে চান,
প্রভু জানান আমার ওই কষ্টিপাথর টি চাই, বাদশার নির্দেশে সে পাথার প্রভু বীরভদ্র কে দিয়ে দেওয়া হয়, খড়ে ঢেকে সে পাথর প্রভু ভেলায় চাপিয়ে গঙ্গা বক্ষে ভাসিয়ে বলেন শ্যামসুন্দর তুমি খড়দহের উদ্দেশ্যে যাত্রা করো, সে পাথর ভাসতে ভাসতে খড়দহের ঘাটে এসে ভেড়ে, এই ঘাটকে তাই আজও মানুষ শ্যামের ঘাট বলে, বীরভদ্র প্রভু ফিরে আসেন খড়দহে, সেই কষ্টিপাথর ঘাটে তোলেন এবং তাঁর স্বপ্নে দেখা শ্যামসুন্দর রুপ বর্ণনা করে নয়ন নামে এক বৈষ্ণব ভাস্কর কে দায়িত্ব দেন শ্যামসুন্দর বিগ্রহ বানানোর জন্য, ভাস্কর প্রথমে এক বিগ্রহ তৈরি করেন যা দেখে প্রভু বীরভদ্র বলেন এ বিগ্রহের রুপ তাঁর স্বপ্নে দেখা বিগ্রহের মতো নয়, আবার একটি মূর্তি তৈরি করেন সেটিও মেলেনা, শেষমেশ আরও এক বিগ্রহ তৈরি করেন ভাস্কর যেটি প্রভু বীরভদ্রের স্বপ্নে দেখা বিগ্রহের সঙ্গে হুবুহু মিল পান প্রভু বীরভদ্র এবং শ্যামসুন্দর নামে খড়দহে প্রতিষ্ঠা করেন, প্রথম যে বিগ্রহ টি তৈরি হয় তাঁর নাম দেওয়া হয় রাধাবল্লভ জীউ প্রতিষ্ঠিত হন শ্রীরামপুর এ রুদ্র পন্ডিত তাঁর সেবা পূজার দায়িত্ব পান,

দ্বিতীয় বিগ্রহটির নাম দেওয়া হয় নন্দদুলাল, প্রতিষ্ঠিত হন খড়দহের স্বামীবন বা সাঁইবন এ, তাঁর সেবা পূজার দায়িত্ব পান লক্ষ্মণ পন্ডিত,

মাঘী পূর্ণিমার দিন ঘটা করে একইসাথে একইদিন এ এই তিন বিগ্রহ প্রতিষ্ঠা করা হয়,

কথিত আছে মাঘীপূর্ণিমার দিন এক কষ্টিপাথর থেকে তৈরি একসাথে এই তিন বিগ্রহের অর্থাৎ শ্রীরামপুর এ শ্রীরাধাবল্লভ, খড়দহে শ্রী শ্যামসুন্দর এবং সাঁইবন এ শ্রী নন্দদুলাল এর দূর্লভ দর্শন ( যা বৈষ্ণব মহলে তিন ঠাকুর দর্শন নামে পরিচিত) করলে অক্ষয় পূণ্য লাভ হয়...

আজ সেই মাঘী পূর্ণিমা, দর্শন করে এলাম, তিন ঠাকুর...ফিরে এসেছি ক্ষাণিক আগেই, মন টা যেন কাণায় কাণায় পূর্ণ, মন কে জিজ্ঞাসা করলাম এ আনন্দ দর্শনানন্দ নাকি ভ্রমণানন্দ... মন উত্তর দিলো দুটোই, যাকে একসাথ পূর্ণানন্দ ও বলা যায়....

(তথ্যসূত্র একটি ছোট্ট চটিবই যা শ্যামসুন্দর মন্দির অঞ্চলের একটি দোকান থেকে কেনা,
লেখাটা খুব দীর্ঘ হয়ে গেল, তাই পথনির্দেশ কেউ জানতে চেয়ে কমেন্ট করলে বলে দেবো..)