যমুনোত্রীর পথে
যমুনোত্রী যাওয়ার দুটি পথ আছে । যারা হরিদ্বার থেকে আসেন তারা সবাই মুসৌরী থেকে বারকোট হয়ে হনুমান চটি পাড় হয়ে জানকীচটিতে এসে পৌঁছান । আবার অনেকে উত্তরকাশী থেকে ধারাসু হয়ে যমুনোত্রীতে আসেন । আমরা এই দ্বিতীয় পথ ধরেই এখানে এসেছিলাম । আমাদের গাড়ি উত্তরকাশী থেকে আরো পথ এগিয়ে চললো । এখন যতটা পথ এগিয়ে থাকবো পরের দিন কম পথ আমাদের যেতে হবে । রাত আটটার সময়ে ব্রহ্মখাল নামে একটা জায়গাতে আমাদের গাড়ি এসে দাঁড়ালো । এখানেই একটা হোটেলে আমাদের একটা রাত কাটানোর ব্যবস্তা হলো । রাত্রিতে খাওয়া দাওয়া তাড়াতাড়ি করে নিলাম । অনেকটা পথ চলার জন্য সবাই ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলো । তাছাড়া পরের দিন ভোরবেলা বেড়িয়ে পড়তে হবে কারন বেলা দশটার মধ্যে যদি জানকী চটিতে যদি পৌঁছানো যায় তবে ভালো হয় ।
চালকের কথা মতো সকালে চা পান করে সকাল সাতটা মধ্যে আমরা আবার বেড়িয়ে পড়লাম । এবার আমাদের প্রায় ৭৫ কিলোমিটারের মতো পথ পারি দিতে হবে । পথ চলতে চলতে পাহাড়ের অপরূপ সৌন্দয্য দেখতে দেখতে কখন যে হনুমান চটিতে পৌঁছে গেছি সেটা বুঝতেই পারিনি । আরো কিছুদূর এগিয়ে আমরা জানকী চটিতে বেলা সাড়ে দশটার সময়ে এসে পৌঁছালাম । এখান থেকেই হাঁটা পথো যমুনোত্রীর মন্দিরে পৌঁছানো যাবে ।আমাদের পথ চলা বেলা এগারোটার সময়ে শুরু হলো । এখান থেকে হাঁটা পথ ৫ কিলোমিটার হলেও এই পথটুকু অনেকটাই চড়াই আছে । যমুনা নদীকে ডানদিকে রেখে যমুনোত্রী যাওয়াষ পথ ক্রমশ উপরের দিকে উঠে গেছে । পথ চলতে চলতে অনেক বেপোরোয়া ঘোড়া ও ডান্ডিওয়ালাকে অতিক্রম করতে হলো । প্রাকৃতিক শোভা দেখতে দেখতে কখন যে এতটা চড়াই পথ অতিক্রম করে ফেলেছি সেটা খেয়ালই করিনি । পথ চলতে গিয়ে কত রকম মানুষের সাথে পরিচয় হলো । ভারতের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে মানুষতো আসেনই তার সাথে অনেক বিদেশী মানুষ জনও আসেন যমুনোত্রী দর্শনে । যাইহোক আমরা দুপুর আড়াইটের সময় মন্দিরের সামনে এসে উপস্থিত হলাম । সব যাত্রীর মুখে শুনতে পারছি যমুনা মাতা কি জয়, আমরাও সাথে সাথে তাই বলতে লাগলাম । এটা বলার সাথে সাথে এই পথ চলার পরিশ্রম অনেকটাই লাঘব হয়ে যায় ।
যমুনোত্রীতে যমুনা নদীর কিন্তু উৎসস্থান নয় । এখানে যমুনার উষ্ণ প্রস্রবনের উদ্গম । এখানে উষ্ণ প্রকাশ বলেই যমুনোত্রী হিমালয়ের চারধামের মধ্যে একধাম । যমুনার উৎসমুখ এই মন্দির থেকে আরো ১১ কিলোমিটার দূর্গম ও ভয়ংকর পথে অবস্থান করছে । এই পথ সাধারন যাত্রীদের জন্য নয় । উত্তর – পশ্চিম ভারতে প্রবাহিত এই নদী টিহরি গাড়োয়ালের হিমালয় শৈলের যমুনোত্রী শৃঙ্গের ৫ মাইল উত্তরে এবং বন্দরপুঞ্চ শৃঙ্গের ৮ মাইল উত্তর – পশ্চিমে উদ্ভুত হয়েছে । যমুনোত্রীর উচ্চতা প্রায় ৩,৩৩২ মিটার । এখানে একটি হ্রদও আছে । যমুনার উৎপত্তিস্থল সমুদ্রগর্ভ থেকে প্রায় ১০,৮৪৯ ফুট উচ্চতায় অবস্থান করছে । যমুনার উভয়দিক খুবই জমজমাট । মন্দিরে যেতে গেলে যমুনার সেতু পার করে আসতে হয় । আমরা সবাই সেতু পার হয়ে ওপারে গেলাম । এখানে দেখতে পেলাম উষ্ণকুন্ডে বহু লোক স্নান করছেন । মহিলাদে স্নান করতে যাতে কোনো অসুবিধা না হয় তারজন্য এখানে মহিলাদের জন্যও আলাদা ব্যবস্থা আছে । এই উষ্ণকুন্ডের জল আবার হিমশীতল যমুনার জলে গিয়ে মিশছে । এখানকার কুন্ডগুলির মধ্যে বিখ্যাত হলো সূর্যকুন্ডটি । এই কুন্ডের জলে চাল, ডাল সেদ্ধ করে সেটি প্রসাদ হিসাবে গ্রহন করা হচ্ছে । এই কুন্ডের পাশেই একটা বিশাল প্রস্তরশিলা আছে যা দিব্যশিলা নামে পরিচিত । এই দিব্যশিলাকে পূজা দিয়ে যমুনা মাকে দর্শন দিতে হয় । এই মন্দিরে যম ও যমুনা উভয়রই মূর্তি আছে । অনেক আগে এখানে কোনো মন্দির ছিলো না । তখন এই শিলাই পূজিত হতো । পরবর্তীকালে ১৮৯২ সালে জয়পুরের মহারানী গুলারিয়া এই মন্দিরের প্রতিষ্ঠা করেন । ১৯২৩ সালে হিমবাহের প্রবাহে এই মন্দিরের অনেক ক্ষতি হয়েছিলো, তখন কেবল যম ও যমুনার মূর্তি দুটি অটুট ছিলো । এই মন্দির আবার পুননির্মান করা হয় কিন্তু আবার ১৯৮২ সালে হিমবাহের জন্য এটি ক্ষতিগ্রস্ত হয় । বর্তমানে আবার এই মন্দিরকে নির্মান করা হয়েছে । এখানে ভক্তগন মাকে দর্শনের জন্য বহু দূর দূরান্ত থেকে পাড়ি জমান । পথ চলতে চলতে আমার সাথে এরকম ৭০ বছরের বেশী বয়সের লোকের সাথে দেখা হয়েছিলো যাদের কারও ঘর রাজস্থান আবার কারো মহারাষ্টে । তাদের পথ চলাতে কোনো ক্লান্তি অনুভব করতে দেখিনি । তাদের দেখে আমরাও পথ চলাতে উৎসাহ পেয়েছিলাম । পূজো দিয়ে কিছু খেয়ে নিয়ে মন্দিরকে পিছনে ফেলা আবার জানকীচটির দিকে পা বাড়ালাম । বেলা ৩টেই রওনা দিয়ে বিকেল সাড়ে চারটের সময়ে জানকীচটিতে ফিরে আসলাম । আমাদের জন্য আমাদের গাড়ির চালক মদন সিং অনেকক্ষন অপেক্ষা করছেন । এবার আমাদের ফেরার পালা । এখান থেকে বারকোট বলে এক জায়গায় রাত কাটিয়ে পরের দিন হরিদ্বারে ফিরে যাবো ।
কিভাবে যাবেন : হাওড়া থেকে হরিদ্বার যাওয়ার যেকোনো ট্রেনে উঠে হরিদ্বারে নেমে গাড়ি ঠিক করে উত্তরকাশী বা মুসৌরী হয়ে জানকীচটি আসতে হবে । উত্তরকাশী থেকে ধারাসু হয়ে অথবা মুসৌরির পথে বারকোট হয়ে যেকোনো একটি পথে জানকীচটিতে আসা যেতে পারে । তারপর এখান থেকে পাঁচ কিলোমিটার হাঁটা পথে যমুনোত্রী আসতে হবে ।
কোথায় থাকবেন : এখানে হনুমানচটি বা জানকী চটিতে থাকা যেতে পারে । সুবিধামতো হোটেল খুঁজে নিতে হবে ।
কখন যাবেন : অক্ষয় তৃতীয়ার পর এই মন্দিরের দরজা খোলা হয় এবং দীপাবলীর পর আবার মন্দিরের দরজা বন্ধ হয়ে যায় । তবে বর্ষাকালে এখানে না যাওয়াই ভালো ।