কল্যানেশ্বরী মন্দিরঃ এক প্রাচীন সিদ্ধাসন
~*~*~*~*~*~*~*~*~*~*~*~*~*~*~*~*~*~*~*~*~*
রবিবারের ভোরের ব্লাক ডায়মন্ড ধরে বেড়িয়ে পড়লাম এক সহকর্মীর বধূবরণের নিমন্ত্রণের আহ্বানে, আসানসোল না নেমে ৩ টি স্টেশন বাদে এলো বরাকর স্টেশন। ছোটখাটো স্টেশনের বাইরে এসে পেয়ে গেলাম অটো। পথ চলা শুরু হল পাহাড়ি খনিজ অঞ্চলের মধ্যে দিয়ে। গাছপালা গুলির পাতা কেমন যেন কয়লার গুঁড়োয় কালচে বর্ণ ধারন করেছে। কখনো চড়াই কখনো গড়ান রাস্তায় চলতে চলতে এক সময় আসানসোল বাইপাস রাস্তা পার হয়ে সোজা এগিয়ে গেলাম। অপ্রসস্ত রাস্তার ধারেই চোখে পড়ল ছিমছাম লালচে গ্রানাইট পাথরে মোড়া কল্যানেশ্বরী মন্দিরের তোরণ। পাথুরে জমির উপর অবস্থিত ঘন বনানীর ঘেরাটোপে বয়ে চলা বরাকরের পাহাড়ি ঝর্নার কোলে নিরিবিলি পরিবেশে এই মন্দিরের প্রাচীনত্ব কল্পনা করতে অসুবিধা হয় না। আপাদমস্তক সম্পূর্ণ মন্দিরই পাথরের ব্লক দিয়ে তৈরি করা হয়েছিল, নক্সাবহুল নয় বরং সাধারন মানের কারুকার্য খচিত মন্দিরের গায়ে চুন রঙের প্রলেপ পড়ে নৈপুণ্য গেছে মিশে। নিচু খিলানের উপর মোটা দেওয়াল ঘেরা অপ্রশস্ত মন্দিরে দ্রষ্টব্য একটি অতি প্রাচীন শক্তপোক্ত হাড়িকাঠ বা বলি স্তম্ভ। শোনা যায় বঙ্গীয় তৃতীয় শতাব্দীতে হিন্দু রাজা হরিপদ গুপ্ত প্রথমে বরাকর নদী থেকে পাঁচ কিলোমিটার দূরে পাহাড়ের মধ্যে এই মন্দির প্রতিষ্ঠা করে দেবী কালিকার পূজো শুরু করেন। তিনি মারা যাবার পর মন্দিরে কোন পূজো না হওয়াতে মন্দির ভগ্ন হয়ে যায় পরবর্তী কালে। ৫০০ বছর আগে পুরুলিয়ার পঞ্চকোটের রাজা আবার সেই মন্দির নতুন ভাবে তৈরি করে মহাশক্তির পূজো শুরু করেন, মা কল্যানেশ্বরী পুরুলিয়া রাজ পরিবারের কুলদেবী। পাশ দিয়ে বয়ে চলা ছোট্ট পাহাড়ি ঝর্নার পরিবেশটি অপূর্ব। সুদীর্ঘ কাল ধরে জলের প্রবাহ উপল খণ্ড গুলিকে মসৃণ করে তুলেছে।
সব পীঠস্থানে কিছু না কিছু অলৌকিক ঘটনার স্বাক্ষী রয়ে গেছে। পশ্চিম বর্ধমান এবং ঝাড়খন্ডের লাগোয়া কল্যানেশ্বরী মন্দিরের ইতিহাসও লোকের মুখে মুখে ঘুরে নরবলি না হলে নাকি পূজো সম্পূর্ণ হতো না। সে প্রাচীন কালের কথা, কালক্রমে অত্যাচারী ডাকাত দেরও সময় গেছে তার সাথে সাথে নরবলির জায়গায় পাঁঠা বলি শুরু হয়।কল্যানেশ্বরী মন্দির নিয়ে অনেক লোক কথা প্রচলিত আছে,
এক লৌকিক কাহিনি প্রচলিত আছে কল্যানেশ্বরী মন্দিরে। এক গরীব ব্রাক্ষ্মন পূজো করতেন, তিনি ভিক্ষা করে পূজোর যোগাড় করতেন। একদিন মন্দিরে তার মেয়েকে বসিয়ে রেখে ভিক্ষা করতে গেছেন পূজার জন্য। মায়ের পূজোর দেরী হয়ে যাচ্ছিল দেখে মা ক্রুদ্ধ হয়ে তার মেয়ের বিনাশ সাধন করেন। ভিক্ষা করে ফিরে এসে ব্রাহ্মণ দেখে মেয়ে মারা গেছে। সে তখন মা এর কাছে কাঁদতে লাগলো অঝোরে। এতে মায়ের ক্রোধ প্রশমিত হয় এবং তাঁর আশীর্বাদে কয়েক বছর পর ব্রাক্ষ্মনের একটা পুত্র সন্তান হয়। দেবী কালিকে এখানে কল্যানেশ্বরী রুপে পূজো করা হয়। কার্তিক মাসের অমাবস্যাতে মা যখন ব্রাক্ষ্মণের সন্তানকে মেরে ফেলেন তারপর থেকে নাকি প্রত্যেক বছর সেখানে নরবলি দিয়ে পূজো হতো। পরবর্তী কালে স্বপ্নাদেশে মা নরবলি বন্ধ করার আদেশ দেন এবং জানান কেউ সন্তান কামনায় পূজো দিলে তিনি তাদের মনস্কামনা পূর্ণ করবেন। তারপর থেকে নরবলি বন্ধ হয়। পঞ্চকোটের রাজার মন্দির করার পেছনে লৌকিক কাহিনি প্রচলিত আছে। শোনা যায় একদিন এক চুড়ী বিক্রেতা জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে যাওয়ার সময় দেখেন জঙ্গলে পাথরের উপর বসে আছে এক বালিকা বধু, সে চুড়ীওয়ালার কাছে চুড়ী পরতে চাইলে চূড়ীওয়ালা তাকে চূড়ী পরিয়ে পয়সা চাইতে গেলে সে বলে রাজা পয়সা দেবে। পরদিন চূড়ীওয়ালা রাজার কাছে পয়সা চাইতে গেলে রাজা পয়সা দিয়ে দেন এবং জানান গতকাল মা তাকে স্বপ্নে দেখা দিয়ে জানিয়ে দিয়েছিলেন।কয়েকদিন পর বরাকর নদীতে চূড়ী পরা মা এর হাত রাজা এবং অনেকে প্রত্যক্ষ করেছিলেন। রাজা আবার মাকে দেখা দিতে বলাতে সেই মন্দিরের কাছে মা দেখা দিয়েছিলেন। বুদ্ধ ধর্ম লুপ্ত হওয়ার সময় শঙ্কর আচার্যের ঘরে জন্ম গ্রহন করেন দেবনাথ চ্যাটার্জি। পরবর্তীকালে দেবনাথ দেওঘরীয়া নামে পরিচিত হন তিনি। সাধনাতে সিদ্ধ লাভ করেন এবং তখনকার সময় বল্লাল সেন অর্থাৎ সেনবংশের কুলদেবী দুর্গাপুর গড়জঙ্গলে অবস্থিত মা শ্যামারুপা দেবনাথ দেওঘরীয়া কে স্বপ্ন দেন আমি আসছি আমি এলে এই আমার পদচিহ্ন থাকবে। সেই পদচিহ্ন আজো মন্দির পরিসরে দেখতে পাওয়া যায়।
বেশ কিছু দর্শনার্থীর সাথে লাইনে দাঁড়িয়ে গর্ভমন্দিরে প্রবেশ করে যা দেখলাম, মাতৃ মূর্তিটি কি রূপ সেকথা “শ্রী শ্রী কল্যানেশ্বরী মাতার মাহাত্ম্য কথা” বইতে পাওয়া যায়। বইটির প্রথম পাতায় মাতার মূর্তির বিবরণ দেওয়া আছে। সেটিই একটু পড়ে শোনাচ্ছি।
মাতার মূর্তি তো আছে আবৃত শিলায়,
উপরে মণ্ডিত হয় সিন্দুর জৌলাগায়।
পূজার দক্ষিণে আক আছে যে গহ্বর,
দক্ষিণা কালিকা মূর্তি হয় সে ভিতর।
কাঞ্চনে নির্মিত মূর্তি হয়েছে গঠন,
পার্শ্বে তার কালী তারা মহাবিদ্যাগণ।
সিন্দুরে তো মূর্তি খানা পড়িছে ঢাকিয়া,
পাণ্ডাগণ পূজে মাতার শ্রীচরণে গিয়া।
দেবীর আসল মূর্তি গহ্বর ভিতরে,
পাণ্ডাদের সাধ্য নাহিয়ে দেখাতে মারে রে।
পদ্যাংশটির গদ্যরূপ করলে এরূপ দাঁড়ায় –সাধারণ দর্শনার্থী শিলা মূর্তি দর্শন করেন। আসল মূর্তিটি দক্ষিণা কালী রূপী সোনা দিয়ে নির্মিত। সেই মূর্তিটি একটি গহ্বরে রাখা থাকে। পাণ্ডারা সেই মূর্তিটি দেখাতে পারে না। কল্যানেশ্বরী মন্দিরে পূজা দিয়ে কাছেই এক হোটেলে রাত্রি যাপন করেছিলাম। হোটেলের বারান্দায় থেকে দেখতে পাওয়া একটি ছোট টিলা – নাম ভাণ্ডার পর্বত। সেই পাহাড়ের চুড়ায় আছে একটি শিবমন্দির। ভোরের দিকে স্নান সেরে পৌঁছে গেলাম পাহাড়ের কাছে। নিচে দেখতে পেলাম কয়েকজন সাধুদের আস্তানা, তাদেরই পরামর্শে জুতো নিচে রেখে ক্রমশ উঠতে থাকলাম সিঁড়ি বেয়ে, অত্যন্ত পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন প্রায় সমান সিঁড়ি উঠে গেছে সবুজ ঘন জঙ্গল চিরে। ২৮৮ সিঁড়ি বেয়ে উপত্যকায় পৌঁছে অবাক হয়ে দেখলাম এতটাই নিস্তব্ধ পরিবেশ যে নিজের নিশ্বাস নিজেরই শ্রুতিগোচর হচ্ছে। উপত্যকায় আছে একটি ছোট শিবমন্দির। স্থানটি ধ্যান জপ করার পক্ষে আদর্শ,এই তপোবনচিত পরিবেশে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য অপূর্ব, সমগ্র কল্যানেশ্বরী টাউন সহ মাইথন দেখতে পাওয়া একটি উপরি পাওনা। মন্দিরটি সম্ভবত শ্রী শ্রী মা সারদা দেবীর নামাঙ্কিত মঠের কোন এক সাধু প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।প্রস্তর ফলকে সেই ঘটনার উল্লেখ দেখতে পেলাম।
আসানসোলে না নেমে ৩ টি ষ্টেশন পরে বরাকর স্টেশনে নেমে মন্দির মাত্র ৭ কিলোমিটার দুরত্ব। অটোতে চেপে, কল্যানেশ্বরী মন্দিরে পূজা দিয়ে সামান্য দূরে অবস্থিত ভাণ্ডার পর্বতে ২৮৮ সিঁড়ি বেয়ে উপত্যকায় পৌঁছে সমগ্র কল্যানেশ্বরী টাউন সহ মাইথন দেখা একটি উপরি পাওনা অত্যন্ত পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন প্রায় সমান সিঁড়ি উঠে গেছে সবুজ ঘন জঙ্গল চিরে, ভোরের দিকে এতটাই নিস্তব্ধ পরিবেশ যে পিন পড়লেও আওয়াজ হবে। উপত্যকায় আছে একটি ছোট শিবমন্দির। স্থানটি ধ্যান জপ করার পক্ষে আদর্শ যাদের meditation এর অভাস তারা খুব আনন্দ পাবেন এই তপোবনচিত পরিবেশে, কল্যানেশ্বরী মন্দিরের কাছে থাকার সুব্যবস্থা আছে, হোটেল যাত্রী নিবাস, হোটেল বর্ষা ইত্যাদি আছে। আবার, চলে আসতে পারেন নিকটবর্তী মাইথনে। চারপাশে সবুজের সমারোহে ছোট ছোট সংযোগকারি পাহাড়ে ঘেরা এই জলাধার। শহরের কোলাহল ছাড়িয়ে এক দুদিন নিরিবিলিতে কাটিয়ে দিতে পারেন অনায়াসে। শুধু নৌকো নয়, চাইলে আপনি বাঁধের চারপাশ ঘুরে আসতে পারেন স্পীড বোটে চেপেও মাথা পিছু ১০০ টাকা ভাড়া। মাইথনে থাকার জন্য রয়েছে ডি ভি সির মজুমদার ভবন, পঃবঃ বন উন্নয়ন নিগমের গেস্ট হাউস রাঙামাটি ,পঃবঃপর্যটন উন্নয়ন নিগমের মাইথন ট্যুরিষ্ট লজ, হোটেল শান্তি নিবাস, হোটেল মাইথন, ইত্যাদি।
#maithon #dam #jaychandi #pahar #kalyaneshwari temple
#মাইথন #ড্যাম #জয়চন্ডী #পাহাড় #বিহারিনাথ #কল্যানেশ্বরী #মন্দির
~*~*~*~*~*~*~*~*~*~*~*~*~*~*~*~*~*~*~*~*~*
রবিবারের ভোরের ব্লাক ডায়মন্ড ধরে বেড়িয়ে পড়লাম এক সহকর্মীর বধূবরণের নিমন্ত্রণের আহ্বানে, আসানসোল না নেমে ৩ টি স্টেশন বাদে এলো বরাকর স্টেশন। ছোটখাটো স্টেশনের বাইরে এসে পেয়ে গেলাম অটো। পথ চলা শুরু হল পাহাড়ি খনিজ অঞ্চলের মধ্যে দিয়ে। গাছপালা গুলির পাতা কেমন যেন কয়লার গুঁড়োয় কালচে বর্ণ ধারন করেছে। কখনো চড়াই কখনো গড়ান রাস্তায় চলতে চলতে এক সময় আসানসোল বাইপাস রাস্তা পার হয়ে সোজা এগিয়ে গেলাম। অপ্রসস্ত রাস্তার ধারেই চোখে পড়ল ছিমছাম লালচে গ্রানাইট পাথরে মোড়া কল্যানেশ্বরী মন্দিরের তোরণ। পাথুরে জমির উপর অবস্থিত ঘন বনানীর ঘেরাটোপে বয়ে চলা বরাকরের পাহাড়ি ঝর্নার কোলে নিরিবিলি পরিবেশে এই মন্দিরের প্রাচীনত্ব কল্পনা করতে অসুবিধা হয় না। আপাদমস্তক সম্পূর্ণ মন্দিরই পাথরের ব্লক দিয়ে তৈরি করা হয়েছিল, নক্সাবহুল নয় বরং সাধারন মানের কারুকার্য খচিত মন্দিরের গায়ে চুন রঙের প্রলেপ পড়ে নৈপুণ্য গেছে মিশে। নিচু খিলানের উপর মোটা দেওয়াল ঘেরা অপ্রশস্ত মন্দিরে দ্রষ্টব্য একটি অতি প্রাচীন শক্তপোক্ত হাড়িকাঠ বা বলি স্তম্ভ। শোনা যায় বঙ্গীয় তৃতীয় শতাব্দীতে হিন্দু রাজা হরিপদ গুপ্ত প্রথমে বরাকর নদী থেকে পাঁচ কিলোমিটার দূরে পাহাড়ের মধ্যে এই মন্দির প্রতিষ্ঠা করে দেবী কালিকার পূজো শুরু করেন। তিনি মারা যাবার পর মন্দিরে কোন পূজো না হওয়াতে মন্দির ভগ্ন হয়ে যায় পরবর্তী কালে। ৫০০ বছর আগে পুরুলিয়ার পঞ্চকোটের রাজা আবার সেই মন্দির নতুন ভাবে তৈরি করে মহাশক্তির পূজো শুরু করেন, মা কল্যানেশ্বরী পুরুলিয়া রাজ পরিবারের কুলদেবী। পাশ দিয়ে বয়ে চলা ছোট্ট পাহাড়ি ঝর্নার পরিবেশটি অপূর্ব। সুদীর্ঘ কাল ধরে জলের প্রবাহ উপল খণ্ড গুলিকে মসৃণ করে তুলেছে।
সব পীঠস্থানে কিছু না কিছু অলৌকিক ঘটনার স্বাক্ষী রয়ে গেছে। পশ্চিম বর্ধমান এবং ঝাড়খন্ডের লাগোয়া কল্যানেশ্বরী মন্দিরের ইতিহাসও লোকের মুখে মুখে ঘুরে নরবলি না হলে নাকি পূজো সম্পূর্ণ হতো না। সে প্রাচীন কালের কথা, কালক্রমে অত্যাচারী ডাকাত দেরও সময় গেছে তার সাথে সাথে নরবলির জায়গায় পাঁঠা বলি শুরু হয়।কল্যানেশ্বরী মন্দির নিয়ে অনেক লোক কথা প্রচলিত আছে,
এক লৌকিক কাহিনি প্রচলিত আছে কল্যানেশ্বরী মন্দিরে। এক গরীব ব্রাক্ষ্মন পূজো করতেন, তিনি ভিক্ষা করে পূজোর যোগাড় করতেন। একদিন মন্দিরে তার মেয়েকে বসিয়ে রেখে ভিক্ষা করতে গেছেন পূজার জন্য। মায়ের পূজোর দেরী হয়ে যাচ্ছিল দেখে মা ক্রুদ্ধ হয়ে তার মেয়ের বিনাশ সাধন করেন। ভিক্ষা করে ফিরে এসে ব্রাহ্মণ দেখে মেয়ে মারা গেছে। সে তখন মা এর কাছে কাঁদতে লাগলো অঝোরে। এতে মায়ের ক্রোধ প্রশমিত হয় এবং তাঁর আশীর্বাদে কয়েক বছর পর ব্রাক্ষ্মনের একটা পুত্র সন্তান হয়। দেবী কালিকে এখানে কল্যানেশ্বরী রুপে পূজো করা হয়। কার্তিক মাসের অমাবস্যাতে মা যখন ব্রাক্ষ্মণের সন্তানকে মেরে ফেলেন তারপর থেকে নাকি প্রত্যেক বছর সেখানে নরবলি দিয়ে পূজো হতো। পরবর্তী কালে স্বপ্নাদেশে মা নরবলি বন্ধ করার আদেশ দেন এবং জানান কেউ সন্তান কামনায় পূজো দিলে তিনি তাদের মনস্কামনা পূর্ণ করবেন। তারপর থেকে নরবলি বন্ধ হয়। পঞ্চকোটের রাজার মন্দির করার পেছনে লৌকিক কাহিনি প্রচলিত আছে। শোনা যায় একদিন এক চুড়ী বিক্রেতা জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে যাওয়ার সময় দেখেন জঙ্গলে পাথরের উপর বসে আছে এক বালিকা বধু, সে চুড়ীওয়ালার কাছে চুড়ী পরতে চাইলে চূড়ীওয়ালা তাকে চূড়ী পরিয়ে পয়সা চাইতে গেলে সে বলে রাজা পয়সা দেবে। পরদিন চূড়ীওয়ালা রাজার কাছে পয়সা চাইতে গেলে রাজা পয়সা দিয়ে দেন এবং জানান গতকাল মা তাকে স্বপ্নে দেখা দিয়ে জানিয়ে দিয়েছিলেন।কয়েকদিন পর বরাকর নদীতে চূড়ী পরা মা এর হাত রাজা এবং অনেকে প্রত্যক্ষ করেছিলেন। রাজা আবার মাকে দেখা দিতে বলাতে সেই মন্দিরের কাছে মা দেখা দিয়েছিলেন। বুদ্ধ ধর্ম লুপ্ত হওয়ার সময় শঙ্কর আচার্যের ঘরে জন্ম গ্রহন করেন দেবনাথ চ্যাটার্জি। পরবর্তীকালে দেবনাথ দেওঘরীয়া নামে পরিচিত হন তিনি। সাধনাতে সিদ্ধ লাভ করেন এবং তখনকার সময় বল্লাল সেন অর্থাৎ সেনবংশের কুলদেবী দুর্গাপুর গড়জঙ্গলে অবস্থিত মা শ্যামারুপা দেবনাথ দেওঘরীয়া কে স্বপ্ন দেন আমি আসছি আমি এলে এই আমার পদচিহ্ন থাকবে। সেই পদচিহ্ন আজো মন্দির পরিসরে দেখতে পাওয়া যায়।
বেশ কিছু দর্শনার্থীর সাথে লাইনে দাঁড়িয়ে গর্ভমন্দিরে প্রবেশ করে যা দেখলাম, মাতৃ মূর্তিটি কি রূপ সেকথা “শ্রী শ্রী কল্যানেশ্বরী মাতার মাহাত্ম্য কথা” বইতে পাওয়া যায়। বইটির প্রথম পাতায় মাতার মূর্তির বিবরণ দেওয়া আছে। সেটিই একটু পড়ে শোনাচ্ছি।
মাতার মূর্তি তো আছে আবৃত শিলায়,
উপরে মণ্ডিত হয় সিন্দুর জৌলাগায়।
পূজার দক্ষিণে আক আছে যে গহ্বর,
দক্ষিণা কালিকা মূর্তি হয় সে ভিতর।
কাঞ্চনে নির্মিত মূর্তি হয়েছে গঠন,
পার্শ্বে তার কালী তারা মহাবিদ্যাগণ।
সিন্দুরে তো মূর্তি খানা পড়িছে ঢাকিয়া,
পাণ্ডাগণ পূজে মাতার শ্রীচরণে গিয়া।
দেবীর আসল মূর্তি গহ্বর ভিতরে,
পাণ্ডাদের সাধ্য নাহিয়ে দেখাতে মারে রে।
পদ্যাংশটির গদ্যরূপ করলে এরূপ দাঁড়ায় –সাধারণ দর্শনার্থী শিলা মূর্তি দর্শন করেন। আসল মূর্তিটি দক্ষিণা কালী রূপী সোনা দিয়ে নির্মিত। সেই মূর্তিটি একটি গহ্বরে রাখা থাকে। পাণ্ডারা সেই মূর্তিটি দেখাতে পারে না। কল্যানেশ্বরী মন্দিরে পূজা দিয়ে কাছেই এক হোটেলে রাত্রি যাপন করেছিলাম। হোটেলের বারান্দায় থেকে দেখতে পাওয়া একটি ছোট টিলা – নাম ভাণ্ডার পর্বত। সেই পাহাড়ের চুড়ায় আছে একটি শিবমন্দির। ভোরের দিকে স্নান সেরে পৌঁছে গেলাম পাহাড়ের কাছে। নিচে দেখতে পেলাম কয়েকজন সাধুদের আস্তানা, তাদেরই পরামর্শে জুতো নিচে রেখে ক্রমশ উঠতে থাকলাম সিঁড়ি বেয়ে, অত্যন্ত পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন প্রায় সমান সিঁড়ি উঠে গেছে সবুজ ঘন জঙ্গল চিরে। ২৮৮ সিঁড়ি বেয়ে উপত্যকায় পৌঁছে অবাক হয়ে দেখলাম এতটাই নিস্তব্ধ পরিবেশ যে নিজের নিশ্বাস নিজেরই শ্রুতিগোচর হচ্ছে। উপত্যকায় আছে একটি ছোট শিবমন্দির। স্থানটি ধ্যান জপ করার পক্ষে আদর্শ,এই তপোবনচিত পরিবেশে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য অপূর্ব, সমগ্র কল্যানেশ্বরী টাউন সহ মাইথন দেখতে পাওয়া একটি উপরি পাওনা। মন্দিরটি সম্ভবত শ্রী শ্রী মা সারদা দেবীর নামাঙ্কিত মঠের কোন এক সাধু প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।প্রস্তর ফলকে সেই ঘটনার উল্লেখ দেখতে পেলাম।
আসানসোলে না নেমে ৩ টি ষ্টেশন পরে বরাকর স্টেশনে নেমে মন্দির মাত্র ৭ কিলোমিটার দুরত্ব। অটোতে চেপে, কল্যানেশ্বরী মন্দিরে পূজা দিয়ে সামান্য দূরে অবস্থিত ভাণ্ডার পর্বতে ২৮৮ সিঁড়ি বেয়ে উপত্যকায় পৌঁছে সমগ্র কল্যানেশ্বরী টাউন সহ মাইথন দেখা একটি উপরি পাওনা অত্যন্ত পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন প্রায় সমান সিঁড়ি উঠে গেছে সবুজ ঘন জঙ্গল চিরে, ভোরের দিকে এতটাই নিস্তব্ধ পরিবেশ যে পিন পড়লেও আওয়াজ হবে। উপত্যকায় আছে একটি ছোট শিবমন্দির। স্থানটি ধ্যান জপ করার পক্ষে আদর্শ যাদের meditation এর অভাস তারা খুব আনন্দ পাবেন এই তপোবনচিত পরিবেশে, কল্যানেশ্বরী মন্দিরের কাছে থাকার সুব্যবস্থা আছে, হোটেল যাত্রী নিবাস, হোটেল বর্ষা ইত্যাদি আছে। আবার, চলে আসতে পারেন নিকটবর্তী মাইথনে। চারপাশে সবুজের সমারোহে ছোট ছোট সংযোগকারি পাহাড়ে ঘেরা এই জলাধার। শহরের কোলাহল ছাড়িয়ে এক দুদিন নিরিবিলিতে কাটিয়ে দিতে পারেন অনায়াসে। শুধু নৌকো নয়, চাইলে আপনি বাঁধের চারপাশ ঘুরে আসতে পারেন স্পীড বোটে চেপেও মাথা পিছু ১০০ টাকা ভাড়া। মাইথনে থাকার জন্য রয়েছে ডি ভি সির মজুমদার ভবন, পঃবঃ বন উন্নয়ন নিগমের গেস্ট হাউস রাঙামাটি ,পঃবঃপর্যটন উন্নয়ন নিগমের মাইথন ট্যুরিষ্ট লজ, হোটেল শান্তি নিবাস, হোটেল মাইথন, ইত্যাদি।
#maithon #dam #jaychandi #pahar #kalyaneshwari temple
#মাইথন #ড্যাম #জয়চন্ডী #পাহাড় #বিহারিনাথ #কল্যানেশ্বরী #মন্দির