Churn : Universal Friendship
Welcome to the CHURN!

To take full advantage of everything offered by our forum,
Please log in if you are already a member,
or
Join our community if you've not yet.


Churn : Universal Friendship
Welcome to the CHURN!

To take full advantage of everything offered by our forum,
Please log in if you are already a member,
or
Join our community if you've not yet.

Churn : Universal Friendship
Would you like to react to this message? Create an account in a few clicks or log in to continue.

Churn : Universal Friendship Log in

PEACE , LOVE and UNITY


descriptionমালদা ভ্রমন Malda Tour Emptyমালদা ভ্রমন Malda Tour

more_horiz
মালদা - আমাদের এই বাংলার উত্তরদিক ঘেঁষে, একটি ইতিহাসময় জেলা, বলা যায় দক্ষিণ বাংলা আর উত্তর বাংলার মাঝখানের যোগসূত্র। মালদা জেলার দক্ষিণে জেলা মুর্শিদাবাদ, উত্তর ও উত্তরপূর্বে উত্তর ও দক্ষিণ দিনাজপুর। ইতিহাসময় জেলা, কারণ অতীতে একসময় এই অঞ্চল দেখেছে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন রাজত্বের রমরমা। দেখেছে মৌর্য এবং পরে গুপ্ত যুগের শেষে সপ্তম শতাব্দীতে পরাক্রমশালী রাজা শশাঙ্কের শাসনকাল থেকে পরবর্তী পর্যায়ে অষ্টম থেকে দ্বাদশ শতাব্দীতে প্রথমে পাল বংশ ও পরে সেন বংশের রাজত্ব, যখন এর নাম ছিল গৌড়। সেন বংশের রাজা লক্ষণসেনের রাজত্বকালে এই জায়গার নাম হয় লক্ষণাবতী। কিন্তু তারপর একসময় পরিবর্তন ঘটে ইতিহাসের, গৌড় চলে যায় মুসলিম শাসকদের হাতে। মাঝখানে একবার কিছু সময়ের জন্য রাজধানী আবার সরে যায় আরো উত্তরদিকে পাণ্ডুয়ায়। আজকে মালদা জেলার মূল শহর যে মালদা, তা একদিকে এই গৌড় আর অন্যদিকে পাণ্ডুয়ার মাঝখানে। গৌড় আর পাণ্ডুয়ায় আজও ছড়িয়ে আছে সেসময়কার অজস্র নিদর্শন। সেইসব দেখতে গেলে এই মালদা শহরেই আসতে হবে। আমিও যাবো সেই পুরোনো ইতিহাসের পথ ধরে, ঘুরে ঘুরে দেখবো সেই সব নিদর্শন কয়েকটি পর্বে। তবে, মালদা শহর দিয়েই যখন যেতে হচ্ছে, তখন গৌড় বা পাণ্ডুয়ার আগে জেনে নিই বা দেখে নিই মালদা শহরেরই কয়েকটি জায়গা।

মালদা ট্যুরিস্ট লজ - মালদা শহর একটি উন্নত ও আধুনিক শহর, ট্রেন ও বাসে দেশের অন্যান্য অঞ্চলের সঙ্গে যুক্ত। কলকাতা থেকে যাওয়ার অনেক ট্রেন আছে, যদিও সবচাইতে সুবিধেজনক হল - শতাব্দী এক্সপ্রেস যা দুপুর দুটো পনেরোয় হাওড়া থেকে ছেড়ে মালদা পৌঁছয় সন্ধ্যে সাতটা দশে বা গৌড় এক্সপ্রেস, যেটি রাত দশটা পনেরোয় শিয়ালদা থেকে ছেড়ে মালদা পৌঁছয় পরদিন সকাল ছটায় । মালদায় থাকার জন্যে প্রচুর হোটেল আছে বিভিন্ন মানের - রাজ্য সরকারের ট্যুরিস্ট লজটি যার অন্যতম। স্টেশন থেকে বেশী দূরে নয়, রথবাড়ী মোড়ের কাছে এর অবস্থান কিন্তু অত্যন্ত সুবিধেজনক জায়গায়। যে কোন জায়গায় যাওয়ার গাড়ী, অটো, টোটো, সব এখান থেকেই পাওয়া যায়। খাওয়ার ব্যবস্থাও এদেরই ডাইনিং হলে, তবে কাছে পিঠে আরো খাবার দোকান ও রেস্তোরাঁও আছে হাতের নাগালের মধ্যে। তবে এই মুহূর্তে সংস্কারের কাজ চলার জন্য পশ্চিমবঙ্গের সব কটি ট্যুরিস্ট লজই সাময়িক ভাবে বন্ধ, খুলতে পারে পুজোর ঠিক আগেই।

রামকৃষ্ণ মিশন - মালদা শহরের অন্যতম দর্শনীয় স্থান। চারপাশে বাগান আর গাছ গাছালীর মধ্যে কিছুটা বেলুড় মঠের আদলে তৈরী এই অপূর্ব মন্দির দেখলেই মন ভরে যায়। বিশেষ করে সন্ধ্যা আরতির সময় এখানকার পরিবেশ হয়ে ওঠে সত্যিই অসাধারণ।

বাঁধের কালী মন্দির - রামকৃষ্ণ মিশনের ঠিক বাইরেই চার রাস্তার মোড়ে এই ছোট অথচ সুন্দর কালী মন্দির, সুন্দর এখানকার নীল রঙের প্রতিমা। আলাদা করে দেখার হয়তো কিছু নেই, তবে রামকৃষ্ণ মিশনে এলে তার গায়েই এই কালী মন্দিরটি দেখা যেতেই পারে।

মালদা মিউজিয়াম - রামকৃষ্ণ মিশনের কাছেই এই মিউজিয়াম। এটি দেখতে গেলে অবশ্যই সন্ধ্যেবেলায় এলে হবেনা, আসতে হবে দিনের বেলাতে - বৃহস্পতিবার বাদ দিয়ে। এখানে আছে মালদা জেলার বিভিন্ন স্থান থেকে পাওয়া বহু হিন্দু জৈন আর বৌদ্ধ মূর্তি। ছোট মিউজিয়াম, একটি হল ঘরের মধ্যেই সব দর্শনীয় মূর্তি সীমাবদ্ধ। কিন্ত এর গুরুত্ব অন্য জায়গায়। যে সব স্থান থেকে এই সব মূর্তি পাওয়া গেছে, সেই সব জায়গায় পুরোনো মন্দিরগুলির অস্তিত্ব আজ আর নেই , কিন্তু এই সব অনুপম শিল্পকাজগুলো দেখলেই সহজেই অনুমান করা যায় - কেমন ছিল সেই সব লুপ্ত হয়ে যাওয়া মন্দিরগুলি। বিশেষ করে গৌড় বা পাণ্ডুয়া অঞ্চলে, যেখানে আজ ঐতিহাসিক নিদর্শনের ছড়াছড়ি, সেখানেও কিন্তু প্রাচীন কোনো মন্দিরের কোন চিন্হই আজ আর চোখে পড়ে না। সব কিছুই আজ পুরোপুরি ধ্বংসপ্রাপ্ত । এমনভাবেই অন্যান্য জায়গার অনেক মন্দিরই আজ সম্পূর্ণ বিলুপ্ত, শুধু তাদের কিছু চিন্হ পাওয়া যায় এই মিউজিয়ামে। আছে বিভিন্ন মহিষাসুরমর্দিনী মূর্তি, বিষ্ণু মূর্তি, বুট পরা ( এবং না পরাও ) সূর্য মূর্তি, বারাহী মূর্তি, নৃসিংহ মূর্তি, ভগবান বুদ্ধের বিভিন্ন মূর্তি এবং আরো অনেক অসাধারণ সব মূর্তি - বেশীর ভাগই কালো পাথরের। প্রতিটি মুর্তির সামনেই অপলক দৃষ্টিতে দাঁড়িয়ে দেখতে হয় তাদের শিল্প সুষমা। এছাড়া আছে অনেক মুদ্রা, অস্ত্রশস্ত্র, শিলালিপি, তাম্রলিপি এবং অন্যান্য সামগ্রী, যদিও সেসব আছে ভিতরে, দর্শনার্থীদের চোখের বাইরে। তবে এখানে ছবি তোলা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ --তাই যেসব অনুপম মূর্তি এখানে রাখা আছে, তার কোনো নমুনাই এই পোষ্টে দেখাতে পারা গেল না। গৌড় আর পান্ডুয়ায় আজ যা দেখা যায়, তা প্রায় সবই মুসলিম যুগের স্মারক - কিন্তু তারও আগে হিন্দু ও বৌদ্ধ যুগে, এখানকার শিল্পসুষমা যে কি উচ্চতায় পৌঁছেছিল - তা বুঝতে গেলে আসতেই হবে এই মালদা মিউজিয়ামে।

মনোকামনা বা মনস্কামনা মন্দির - মালদা শহরের মধ্যেই আর একটি ছোট কিন্তু অত্যন্ত জনপ্রিয় মন্দির। ছিমছাম পরিবেশ, চারিদিকে সাদা বারান্দার মধ্যে লাল রঙের মন্দির, কিন্তু চুড়োটি সাদা। মন্দিরের মধ্যে চণ্ডী দেবীর অবস্থান। পাশেই আছে শিবমন্দিরও। বিশ্বাস - এখানে প্রার্থনা করলে মনোবাঞ্ছা পূর্ণ হয়, তাই এর নাম মনোকামনা মন্দির। সেই বিশ্বাসের সূত্রেই দেখা যায় মন্দিরের দেওয়ালে কালি দিয়ে লেখা অনেক ভক্তের প্রার্থনা, যদিও আমার মতে - যে কোনো সৌধের গায়েই এই ধরণের লেখা সৌধের সৌন্দর্যকে ভীষণভাবেই আঘাত করে।

গুরুদ্বারা - মালদায় একাধিক গুরুদ্বারা আছে যার মধ্যে একটি পুরাতন মালদায়। আমি সেখানে গিয়েছিলাম ব্যক্তিগত অনুষ্ঠানে। গাম্ভীর্যময় শান্ত পরিবেশ, চত্বরে ঢোকার পরে উঁচু বেদীর ওপর মূল গুরুদ্বারা - তার প্রবেশদ্বারগুলি রুপোর। ভেতরে অত্যন্ত ভক্তির সঙ্গে চলে গুরু গ্রন্থসাহেব থেকে পাঠ। শিখেরা বীরের জাতি - তাই মূল বেদীর ধাপের ওপর রাখা আছে কৃপাণ আর কামানের ছোট প্রতিমূর্তি। পাশে একটি ঘরে গুরু তেগবাহাদুরের ছবিকে ঘিরে রাখা আরো কৃপাণ। মালদার কেন্দ্রস্থল থেকে গুরুদ্বারাটি অনেক দূরে, ব্যক্তিগত অনুষ্ঠানে গিয়েছিলাম বলেই আমার দেখার সুযোগ ঘটেছিল, নইলে হয়তো জানতে পারতাম না এই গুরুদ্বারাটির কথা।

অনেক বড় হয়ে গেছে লেখাটি, তাই আজকের পর্ব এই পর্যন্তই। এরপরের পর্বে গৌড়ে যাওয়ার আগে দেখে নেব - আরো দুটি বিখ্যাত জায়গা - জহুরা মায়ের মন্দির ও রামকেলী ।

descriptionমালদা ভ্রমন Malda Tour EmptyRe: মালদা ভ্রমন Malda Tour

more_horiz
মালদা ভ্রমণে আগের পর্বে লিখেছি মালদা শহরের মধ্যেকার কিছু দর্শনীয় স্থান। এবার কিন্তু সেই শহরের বাইরে বেরিয়ে পড়া। যেতে হবে গৌড়ের দিকে, কিন্তু তার আগে দেখে নেব শহরের বাইরের তিনটি বিশেষ স্থান।

জহুরা চন্ডী মন্দির - মালদা শহর থেকে পাঁচ ছয় কিলোমিটার দূরে বিস্তৃত আমবাগানের মধ্যে এই মন্দির । সুন্দর পরিবেশে বেশ আধুনিক মন্দির। লোকমুখে এটিকে জহুরা কালী মন্দির বলা হলেও আসলে এটি চন্ডী মন্দির। বলা হয়, সেন বংশের রাজা বল্লাল সেন এই অঞ্চলে যে চারটি চন্ডী মন্দির স্থাপন করেছিলেন - এটি তার অন্যতম। তবে, মন্দিরের গায়ে যে পাথরের ফলক আছে, তাতে দেখা যায় যে প্রায় তিনশো বছর আগে সাধক ছল্প তেওয়ারী এখানে গড়ের ওপর জহুরা চন্ডী মাতার বেদী প্রতিষ্ঠা করে পূজা শুরু করেন । তার প্রায় একশো বছর পরে ১২১৩ সালে আর এক সাধক হীরারাম তেওয়ারী এখানে সাধনায় সিদ্ধিলাভ করে দৈব দর্শন করেন, এবং সেই দৈব দর্শন অনুযায়ীই মায়ের মূর্তির রূপরেখা তৈরি করেন এক বৈশাখ মাসে। ঘন লাল রঙে রাঙানো এক বিশাল ঢিবি আর তার ওপরে মায়ের মুখের কল্পনায় এক মুখোশ - এই হচ্ছে এখানকার দেবী মূর্তি। মূল মুর্তির দুপাশে এমন আরো কিছু মুখোশ দেখা যায়, সেই সঙ্গে গর্ভগৃহে আছে শিব এবং গণেশের মূর্তিও। ওই তেওয়ারী সাধকদের পরবর্তী প্রজন্মই এখানে বংশানুক্রমে পুজো করে আসছেন এখনো । এখানকার বৈশিষ্ট্য হলো, রাত্তিরে কোনো পূজা হয় না, যা পূজা হয় সব দিনের বেলায় এবং শুধু শনি ও মঙ্গলবার। ওই দুদিন বেশ ভীড় হয়, পুজোর জন্যে বড় লাইন পড়ে। পুজো দিতে আসেন বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মানুষ । এছাড়া মায়ের প্রতিষ্ঠা মাস উপলক্ষে বড় মেলা বসে বৈশাখ মাসে। মূল মন্দির লালচে গেরুয়া রঙের পঞ্চরত্ন ধাঁচের, যদিও সেই পঞ্চরত্নের ধরণ আমাদের প্রচলিত ধরণ থেকে একটু আলাদা। চারপাশের গাছ গাছালির মধ্যে সাদা আর লাল রঙের চারপাশে প্রশস্ত বারান্দা ঘেরা এই মন্দিরের পরিবেশ কিন্তু ভারী সুন্দর।

হাতিবাঁধা থাম - এবার আমার যাত্রা বাংলার প্রাচীন রাজধানী গৌড়ের দিকে। গৌড়ের অবস্থান মালদা শহর থেকে প্রায় বারো কিলোমিটার দূরে। যাওয়ার পথে মুলরাস্তার ওপরেই বাঁদিকে পড়ে দুটি বিরাট পাথরের স্তম্ভ। হঠাৎ মাঝপথে এরকম দুটি স্তম্ভ এখানে কেন আর কিভাবে এলো তা ঠিক জানা যায় না। তবে আকার আর স্থাপত্যের বিচারে স্তম্ভ দুটি প্রত্নতাত্বিক দিক দিয়ে গুরুত্বপূর্ণ, তাই এগুলি বর্তমানে ভারতীয় পুরাতত্ত্ব বিভাগ বা Archaeological Survey of Indiaর অধীন। তাদের বোর্ড থেকে জানা যায়, যে এগুলির সঙ্গে গৌড়ের বড় সোনা মসজিদের অন্তর্গত কিছু থাম বা স্তম্ভের মিল আছে, তাই সম্ভবত সেই মসজিদ থেকেই এগুলি কোন সময় এখানে আনা হয়েছিল। যদিও কেন আনা হয়েছিল তার কারণ কিন্তু অজানা। পরে কোনো এক সময় স্থানীয় কোনো জমিদার এখানে তাঁর হাতি বেঁধে রাখতেন - এই রকম এক জনশ্রুতিকে কেন্দ্র করেই এর নাম হয়েছে হাতিবাঁধা থাম।

রামকেলি - হাতিবাঁধা থাম থেকে গৌড়ের দিকে এগিয়ে যাওয়ার পথে কিছুটা দূর এগিয়েই পড়ে একটি গ্রাম - রামকেলি। রাস্তার ওপরেই ডানদিকে শ্রীচৈতন্যের একটি মূর্তি। আসলে চৈতন্যদেবের স্মৃতিসমন্বিত এই গ্রামে তাঁর পদধূলি পড়েছিল ১৫১৫ সালে জ্যৈষ্ঠ মাসের শেষ দিনে। বৃন্দাবন যাত্রার পথে এখানেই দুটি কেলিকদম্ব আর তমাল গাছের ছায়ায় তিনি বিশ্রাম নিয়েছিলেন, দেখা হয়েছিল তাঁর সঙ্গে সেই সময়ের সুলতান হুসেন শাহের দরবারের দুই উচ্চপদস্থ কর্মচারী রূপ গোস্বামী আর সনাতন গোস্বামীর সঙ্গে। চৈতন্যদেব এখানে ছিলেন কয়েকদিন, তাঁর প্রভাবে রূপ সনাতন দুজনেই হয়ে উঠলেন তাঁর একনিষ্ঠ ভক্ত এবং কালক্রমে বৈষ্ণব সমাজের দুই স্তম্ভ। সেই কদম্ব আর তমাল গাছ এখনো আছে, আর তাদের তলাতেই পরে স্থাপিত হয় একটি ছোট মন্দির, যার ভেতরে একটি পাথরে দুটি পায়ের ছাপ রক্ষিত আছে, যেগুলি শ্রী চৈতন্যেরই পায়ের ছাপ বলে কথিত। মহাপ্রভুর মূর্তিটিও এই চরণ মন্দিরের পাশে সেই গাছগুলিরই তলায়। আবার, এই চরণ মন্দিরের পাশ দিয়ে একটু ভেতরে গেলেই পড়বে সনাতন গোস্বামী প্রতিষ্ঠিত মদনমোহন জীউ মন্দির। ভেতরে তাঁরই প্রতিষ্ঠা করা রাধাকৃষ্ণ মূর্তি - কৃষ্ণ মূর্তি কষ্টি পাথরের, আর রাধা মূর্তি অষ্টধাতুর। আছে কালক্রমে স্থাপিত হওয়া আরো বেশ কিছু বিগ্রহ আর মহাপ্রভু, অদ্বৈত স্বামী আর নিত্যানন্দ স্বামীর মূর্তি। সনাতন গোস্বামী এখানে মন্দির স্থাপনা করেন পাঁচশো বছর আগে, কালক্রমে সেই মন্দির জীর্ণ হয়ে গেলে তার জায়গায় এই নতুন মন্দির নির্মাণ করা হয় বাংলা ১৩৪৫ সালে। সুন্দর ছিমছাম আধুনিক মন্দির, সামনে আলাদা নাটমন্দির, কিন্তু ভেতরের বিগ্রহ সেই পাঁচশো বছরের প্রাচীন। অত্যন্ত নিষ্ঠার সঙ্গে নিত্য পূজা হয় এখানে, পুরোহিতের পরিবারের বাড়ী এই মন্দির প্রাঙ্গণেই। মন্দিরের কাছাকাছি আছে পাঁচশো বছর আগে রূপ-সনাতনের খনন করানো আটটি বিশাল কুন্ড বা দীঘি - শ্যাম কুন্ড, রাধা কুন্ড, ললিতা কুন্ড, বিশাখা কুন্ড, ইন্দুরেখা কুন্ড, সুরভি কুন্ড, রঞ্জা কুন্ড, ও রূপসাগর। চৈতন্যদেবের এখানে আগমনকে স্মরণ করে এখনো এখানে সপ্তাহব্যাপী বিশাল মেলা বসে জ্যৈষ্ঠ মাসের শেষ সপ্তাহে।

রামকেলির পরেই এবার আমি ঢুকে পড়বো প্রাচীন গৌড় শহরে - তার কথা আসবে পরের পর্বে।

descriptionমালদা ভ্রমন Malda Tour EmptyRe: মালদা ভ্রমন Malda Tour

more_horiz
রামকেলি থেকে কিছুদূর গিয়েই এসে পড়া গেল একসময়ের বাংলার রাজধানী গৌড়ে। গৌড় শব্দটির দুটি ভাগ আছে - একটি গৌড় অঞ্চল অন্যটি গৌড় শহর। গৌড় অঞ্চল ছিল অনেক প্রাচীন, ভারতের পূর্বাংশে আর বর্তমান বাংলার উত্তরাংশ জুড়ে ছিল তার ব্যাপ্তি। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন রাজত্বে এই অঞ্চলের রাজধানী হিসেবে পুন্ড্রবর্ধন বা কর্ণসুবর্ণর নাম পাওয়া যায়। সপ্তম শতাব্দীতে গৌড়রাজ শশাঙ্কের রাজধানী ছিল কর্ণসুবর্ণ। তাঁর মৃত্যুর পর সূচনা হয় পাল বংশের, আবার তারও প্রায় চারশো বছর পরে আরম্ভ হয় সেনবংশের রাজত্ব। এই সেন বংশেরই রাজা লক্ষণ সেন গৌড় শহরে তাঁর নতুন রাজধানী শুরু করেন, নাম দেন লক্ষণাবতী। কিন্ত কিছুদিন পরেই ১২০০ খ্রিস্টাব্দের প্রথমদিকে বখতিয়ার খিলজির আক্রমণে এই লক্ষণাবতীর পতন ঘটে, বৌদ্ধ পালবংশ এবং হিন্দু সেনবংশের রাজত্বের পরে শুরু হয় মুসলিম শাসন। কিন্তু তা সত্বেও গৌড়ের পরের ইতিহাস বেশ অস্থির। বখতিয়ার খিলজির পরেও বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন মুসলিম বংশ এখানে শাসন করেছেন, মাঝখানে গৌড় থেকে কিছুদিনের জন্য রাজধানী স্থানান্তরিত হয়েছে পাণ্ডুয়ায়, আবার একসময় তা ফিরে এসেছে সেই গৌড় বা লখনৌতিতে। এর মাঝে শের শাহের আক্রমণ ঘটেছে গৌড়ে, নগরী হয়েছে বিধস্ত। আবার হুমায়ূনের হাতে গৌড় পুনরুদ্ধার হয়েছে, নতুন ভাবে সেজে উঠে নতুন নাম পেয়েছে “জন্নতাবাদ”। কিন্তু তারপরেও নানা ঘাত প্রতিঘাত, সংঘর্ষ, শাসক বদল চলতেই থাকে, শেষে একসময় মহামারীর প্রাদুর্ভাব ঘটে, বহু সৈন্য সামন্তর মৃত্যু ঘটে , গৌড় নগরী পরিত্যক্ত হয়। এখন আমরা যে গৌড় দেখি, তা একসময়ের এই দ্বন্দ্বসংকুল নগরীরই ধ্বংসাবশেষ। এখানে একটা কথা বলে রাখা ভালো যে, একসময় এখানে বৌদ্ধ এবং হিন্দু রাজত্ব থাকলেও, বর্তমানে কিন্তু সেই সময়ের কোনো মন্দির, বিহার, স্তুপ, মঠ, সৌধ - কিছুই দেখা যায় না, সেই সময়ের সমস্ত ঐতিহাসিক নিদর্শন আজ সম্পূর্ণ ধ্বংসপ্রাপ্ত ও বিলুপ্ত । তাই আজ আমরা দেখি শুধু মুসলিম শাসনাধীন গৌড় নগরীর বিভিন্ন স্থান বা সৌধের ধ্বংসাবশেষ।

প্রাথমিক এই ভূমিকাটুকু মাথায় রেখেই আমাদের গৌড় দর্শন। রামকেলি থেকে কিছু দূর গেলেই এই গৌড় নগরী আর তার প্রথম আর সবচাইতে বিখ্যাত স্থান এই বড় সোনা মসজিদ বা বারদুয়ারী মসজিদ। আজ শুধু এই মসজিদটিই আমরা দেখবো একটু খুঁটিয়ে । ১৫২৬ সালে এটি নির্মিত হয় সুলতান নাসিরুদ্দিন নসরত শাহের আমলে। মূল রাস্তার পাশেই একটি উঁচু টিলার ওপর এটি অবস্থিত, বিশাল বাগানের মাঝখানে মসজিদের অবস্থান। তিনদিকে তিনটি প্রবেশ তোরণ, তার মধ্যে পূর্বদিকের তোরণটিই এখনো অক্ষুণ্ন, দক্ষিণেরটির শুধু মাত্র দুদিকের দুটি স্তম্ভ দাঁড়িয়ে আছে, আর উত্তর তোরণটি কিছুটা জীর্ণ হলেও ব্যবহারযোগ্য। গাড়ী থেকে নেমে বাগানে প্রবেশ করতে হয় এই উত্তরদিকের তোরণ দিয়েই। আর প্রবেশের পরই ভালো করে বোঝা যায় এই মসজিদের বিশালতা আর সৌন্দর্য। পূর্বদিকে মোট এগারোটি খিলান দেওয়া প্রবেশপথ - প্রতিটি খিলানের ওপর একটি করে মোট এগারোটি অর্ধগোলাকৃতি গম্বুজ। ভেতরে ঢুকলে বোঝা যায় পূর্বদিকের এই এগারোটি খিলান দেওয়া টানা বারান্দার সৌন্দর্য। সেই বারান্দা পার হয়ে পশ্চিমদিকে গেলেই পৌঁছনো যায় মসজিদের মূল অংশে, যা আজ অনেকটাই ধ্বংসপ্রাপ্ত। বোঝা যায় এই মূল অংশটি বিন্যস্ত ছিল তিনটি ভাগে, আর সেই তিনটি ভাগের স্তম্ভের পাদপিঠ গুলি আজও দেখা যায় সারিবদ্ধভাবে। এই অংশের ছাদের কোনো চিন্হ এখন আর নেই, যেমন নেই সেই ছাদের ওপরে মোট তেত্রিশটি গম্বুজেরও কোনো চিন্হ। এই গম্বুজগুলি উজ্জ্বল সোনালী রঙের ছিল বলেই হয়তো এটিকে বড় সোনা মসজিদ বলা হয়। এই অংশে ইতস্তত পড়ে আছে কিছু ভাঙা পাথরের চিন্হ, আর তার থেকে তাদের কারুকাজের কিছু আভাসও পাওয়া যায়। তবে সবচাইতে লক্ষণীয় হলো এই মূল অংশের উত্তরদিকে একটি উঁচু অংশ, যেটিকে মহিলাদের বসার স্থান বা ladies gallery বলে অনুমান করা হয়। এই গ্যালারিটিই এই অংশের সৌন্দর্য অনেকখানি বাড়িয়ে তুলেছে। আরও লক্ষণীয় - ১৬৮ ফিট লম্বা আর ৭৬ ফিট চওড়া এই মসজিদ এখন সম্পূর্ণ ভাবে Archaeological Survey of Indiaর নিয়ন্ত্রণে, তাদের যত্ন করে তৈরি করা বাগানের মধ্যে দাঁড়িয়ে আছে পাঁচশো বছরের এই ঐতিহাসিক স্থাপত্য।

পরের পর্বে - দাখিল দরওয়াজা , ফিরোজ মিনার।

descriptionমালদা ভ্রমন Malda Tour EmptyRe: মালদা ভ্রমন Malda Tour

more_horiz
দাখিল দরওয়াজা বা সেলামী দরওয়াজা - গৌড়ের বড় সোনা মসজিদ থেকে প্রায় আধ কিলোমিটার দূরে দাঁড়িয়ে আছে একাকী একটি তোরণ - দাখিল দরওয়াজা। বলা হয়, একসময় এটি ছিল গৌড় নগরীতে প্রবেশের মূল তোরণ। সুলতান যখন বাইরের কাজ সেরে ফিরতেন গৌড়ে, তখন এখানে প্রবেশের মুহূর্তে তাঁকে সম্মান বা গার্ড অফ অনার দেওয়া হত বলে এটিকে সেলামী দরওয়াজাও বলা হয়। তোরণটি আনুমানিক পঞ্চদশ শতকের প্রথমার্ধে নির্মিত হয়, যদিও এ ব্যাপারে তোরণের মুখে আর্কিওলজিকাল সার্ভের বোর্ডের লেখাটি একটু বিভ্রান্তিকর। সেখানে লেখা আছে এটি আনুমানিক ১৪২৫ সালে নির্মাণ করান বারবক শা, আবার তার পরেই লেখা আছে - বারবক শা’র রাজত্বকাল ছিল ১৪৫৯ থেকে ১৪৭৪ অবধি। অর্থাৎ তথ্যের তারিখ ঠিক মিলছে না। যাই হোক, ছোট ছোট ইঁটের তৈরি এই তোরণের চার কোণে চারটি বারো কোণ সম্পন্ন বুরুজ ছিল, এখনো তাদের কিছুটা দেখতে পাওয়া যায়। দেখা যায়, অল্প কিছু টেরাকোটার কাজও। বাংলায় টেরাকোটা মন্দিরের কাজ বিখ্যাত, কিন্তু তারও আগে অল্প যে কয়েকটি মুসলিম স্থাপত্যে টেরাকোটার কাজ দেখা যায়, এটি তার মধ্যে একটি। তোরণের রাস্তা বা প্যাসেজের মধ্যে তিনটি খিলান, আর তার দুপাশে দুটি করে ছোট আলো আঁধারী অলিন্দ - যা এখন ছোট বাদুড়ের আস্তানা। তোরণের দুপাশের জমি ঢালু হয়ে ওপরের দিকে উঠে গেছে, সম্ভবত ওই দুদিকে ছিল সেইসময়ের দুর্গের প্রাকার।

ফিরোজ মিনার - দাখিল দরওয়াজা থেকে কিছুটা দূরে আবার প্রায় সাড়ে পাঁচশো বছরের একটি পুরোনো স্থাপত্য, এবার এটি একটি মিনার - ফিরোজ মিনার। সৈফুদ্দিন ফিরোজ শা তাঁর আগের সুলতান বরবক শা কে হত্যা করে সুলতান হয়েছিলেন ১৪৮৬ থেকে ১৪৮৯ এর মধ্যে, সম্ভবত তাঁরই সেই বিজয়ের সূচক হিসেবে সেই সময়েই এটি নির্মিত হয়েছিল। যদিও অনেকে বলেন এটি একসময় ফিরোজা রঙের বর্ণময় মীনা করা ইঁট দিয়ে শোভিত ছিল বলে এর নাম ফিরোজ মিনার - তবে এই তত্বের প্রমাণ হিসেবে সেরকম কোনো ইঁটের চিন্হ কিন্তু এখানে পাওয়া যায় না। আবার আর এক মত অনুযায়ী এটির নাম এসেছে পীরু শা থেকে, কারণ একসময় নাকি এখানে ওই নামে এক ফকির থাকতেন। নামের সূত্র যাই হোক না কেন, এটি গৌড়ের আর একটি দর্শনীয় স্থাপত্য। ৮৪ ফিট উঁচু আর ৬২ ফিট ব্যাসের এই মিনার এখন মোট পাঁচ তলার। নীচ থেকে প্রথম তিনটি তলা অষ্টকোণী, তার পর একটি কার্ণিশ, তার পরের দুটি তলা - আবার গোল বা বৃত্তাকার। ওপরের দিকটি আস্তে আস্তে সরু বা tapered হয়ে গেছে। ওপরে ওঠার জন্য ভেতরে ৭৩টি সিঁড়ি আছে, যদিও স্বাভাবিকভাবেই সেখানে কাউকে প্রবেশ করতে দেওয়া হয় না। মিনারটি নাকি আগে আরো অনেক উঁচু ছিল, কিন্তু পরে একসময় এটি বিপজ্জনক হয়ে দাঁড়ালে সম্পূর্ণ ভেঙে পড়া থেকে বাঁচাতে এর ওপরের কিছু তলা ভেঙে এটির আয়তন ছোট করে ফেলা হয়। মিনারের গায়ে ইঁটের গায়ে ঝুলন্ত মোটিফ, আর প্রবেশের দরজার পাশে পাথরের ফ্রেম। এখানেও আবার দুরকম রঙের পাথর দেখা যায় - ধূসর ও কালো। ধূসর রঙের পাথর আছে ওই গেটের পাশ থেকে পুরো মিনারটিকে বেষ্টন করে। আবার কালো পাথরের ওপর যেরকম কাজ আছে, তাতে মনে হতেই পারে যে ওই পাথর আগের অন্য কোনো স্থাপত্য থেকে হয়তো সংগ্রহ করে আনা হয়েছে।

ফিরোজ মিনার এখন আর্কিওলজিকাল সার্ভের নিয়ন্ত্রণে। তাঁদের তৈরি করা ছোট কিন্তু সুন্দর বাগান আর চারপাশের গাছগাছালির মধ্যে মিনারটির অবস্থান কিন্তু সত্যিই দৃষ্টিনন্দন।

পরের পর্বে - কদম রসুল মসজিদ ও ফতে খাঁর সমাধি।

descriptionমালদা ভ্রমন Malda Tour EmptyRe: মালদা ভ্রমন Malda Tour

more_horiz
ফিরোজ মিনার থেকে গাড়ীতে পাঁচ মিনিটের মধ্যে পৌঁছে যাওয়া গেল - কদম রসুল মসজিদ এবং ফতে খাঁর সমাধি প্রাঙ্গণে। বেশ বড় একটি প্রাচীর ঘেরা জায়গায় একই সঙ্গে গৌড়ের দুটি দ্রষ্টব্য। ঘোরানো লোহার দরজা দিয়ে ঢুকে আর্কিওলজিকাল সার্ভের তৈরি করা সুন্দর বাগানের মধ্যে একটি ছোট তোরণ, তার মধ্যে দিয়ে গেলে সামনেই পড়বে ফতে খাঁর সমাধি আর বাঁ দিকে মূল কদম রসুল মসজিদ। প্রথমে দেখে নেব এই সমাধিটি।

ফতে খাঁর সমাধি - এটি আওরঙ্গজেবের সেনাপতি দিলওয়ার খাঁয়ের পুত্র ফতে খাঁর সমাধি। বলা হয়, সেই সময়ে বাংলার দায়িত্বপ্রাপ্ত শাহ সুজাকে বিদ্রোহ করার পরামর্শ দিয়েছিলেন পীর শাহ নিয়ামতুল্লা, তাই তাঁকে শায়েস্তা করতে আওরঙ্গজেব পাঠিয়েছিলেন ওই দিলওয়ার খাঁকে। কিন্তু গৌড়ে পৌঁছলেই রক্তবমিতে মারা যান দিলওয়ারের পুত্র ফতে খাঁ। তাঁর সমাধির ওপর পরে রচিত হয় এই স্থাপত্যটি। এটির কোনো প্রতিষ্ঠালিপি নেই, কিন্তু ফতে খাঁ মারা যান ১৬৫৭ থেকে ১৬৬০ এর মধ্যে, আর তাঁর সমাধির ওপর এই ঘরটি তৈরি হয় সেই সময় থেকে ১৭০৭ সালের মধ্যে। বাংলার দোচালা রীতিতে তৈরি ভবনটির ছাদে দুটি চালার মিলিত প্রান্তরেখায় খুব ছোট ছোট পাঁচটি চূড়া বা পঞ্চবন্ধনী। বাইরে দুটি শূন্য কুলুঙ্গি, ভেতরেও আধা অন্ধকার কক্ষে দেওয়ালে বেশ কিছু কুলুঙ্গি, আর মাটিতে ফতে খাঁর সমাধি - কাজ করা রঙিন চাদর দিয়ে ঢাকা।

পুরোনো বিশ্রামাগার বা স্নানাগার - ফতে খাঁর সমাধির ঠিক পাশেই , কদম রসুল মসজিদের বিপরীতে একটি ভেঙে পড়া বড় ঘরের অবস্থান। সামনের দিকে পাঁচটি খিলান দেওয়া প্রবেশ পথ আর দেওয়াল অক্ষুণ্ন থাকলেও ঘরের ভেতরটি বিধ্বস্ত, আর মাথার ওপরে ছাদও সম্পূর্ণই অবলুপ্ত। কিছু জায়গায় এটিকে স্নানঘর বা পা ধোয়ার স্থান বলে বলা হলেও আর্কিওলজিকাল সার্ভের বোর্ডে কিন্তু এটিকে বিরামশালা বা Rest House বলা হয়েছে।

কদম রসুল মসজিদ - ফতে খাঁর সমাধি আর ওই বিরামশালার ঠিক বিপরীতেই দাঁড়িয়ে আছে এখানকার মূল দ্রষ্টব্য - কদম রসুল মসজিদ। ১৫৩১ সালে সুলতান নসরত শাহের তৈরি এই মসজিদ - প্রবেশ পথের ওপরে আছে কালো পাথরে সম্ভবত ফারসীতে লেখা এটির প্রতিষ্ঠালিপি। প্রবেশ পথ তিন খিলানের আর সেই খিলানগুলি পাথরের ছোট ছোট অষ্টকোণী স্তম্ভের ওপর বিন্যস্ত। পুরো মসজিদ ইঁটের হলেও সামনের এই ছোট স্তম্ভ আর ছাদের ওপর চার কোণে চারটি ছোট সরু চূড়া পাথরের। মাথার ওপর মাঝখানে একটি মাত্র অর্ধবৃত্তাকার চূড়া বা Dome. সামনে প্রবেশপথের ওপরে ও পাশের প্যানেলে বেশ কিছু টেরাকোটার কাজ। প্রবেশ পথ দিয়ে ঢুকে একটি ছোট বারান্দা - আর তারপরেই মূল গর্ভগৃহ। সেই গর্ভগৃহে একটি উঁচু বেদীর ওপর রাখা পাথরের মাঝখানে একটি পদ চিন্হ, কাপড় দিয়ে ঢাকা। মসজিদে একজনই মাত্র ব্যক্তি ছিলেন - তিনি দর্শনার্থীদের ঘুরিয়ে দেখান, কাপড়টি সরিয়ে পদচিহ্নটিও দেখান। বলা হয় পদচিহ্নটি হজরত মহম্মদের, কিন্তু আর্কিওলজিকাল সার্ভের বোর্ডের তথ্য অনুযায়ী মূল পদচিহ্ন বর্তমানে অন্যত্র রক্ষিত। তাহলে এখানে যে পদচিহ্ন দেখা যায়, সেটির সঠিক পরিচয় কি - তা নিয়ে একটু ধন্ধ থেকেই যায়। যদিও ওই ব্যক্তির দাবী - ওটিই মূল পদচিহ্ন, আবার এখানে নিয়ে আসা হয়েছে। এছাড়া এখানে আরো একটি ব্যাপার লক্ষণীয় - এই মসজিদের সামনের খিলান আর তার স্তম্ভ, খিলানের প্যানেলে টেরাকোটার কাজ, ভিতরের বারান্দা, ফতে খাঁর সমাধির দোচালা স্থাপত্য - এই সব কিছুর সঙ্গেই কিন্তু হিন্দু মন্দির স্থাপত্যের প্রচুর মিল আছে।

সমাধিক্ষেত্র - কদম রসুল মসজিদের ঠিক পেছনেই অর্থাৎ মূল রাস্তা দিয়ে ঢুকেই বাঁদিকে একটি বড় ঘেরা জায়গা দেখা যায় - যার মধ্যে নামহীন কিছু সমাধি আছে। ছোট খিলান যুক্ত নটি প্রবেশদ্বার দিয়ে এখানে ঢোকা যায়। মনে করা হয়, হয়তো কোন সময় এটি রাজপরিবার বা বিশিষ্ট ব্যক্তিদের সমাধিস্থল হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে থাকতে পারে। এর মধ্যে একটি সমাধিকে ঘিরে হয়তো আলাদা করে কোনো স্থাপত্য ছিলো - যার একেবারে নীচের দিকে কিছু অংশ এখনও পড়ে থাকতে দেখা যায়। এগুলি ছাড়াও এই ঘেরা জায়গার বাইরে কিন্তু কদম রসুল মসজিদের চৌহদ্দির ভিতরেই আরো দুএকটি সমাধি আছে,যদিও কোনোটিরই পরিচয় এখন আর জানা যায়না।

কদম রসুল মসজিদ থেকে বেরিয়ে পরের পর্বে আমাদের গন্তব্য - চিকা মসজিদ ও গুমটি দরওয়াজা।

descriptionমালদা ভ্রমন Malda Tour EmptyRe: মালদা ভ্রমন Malda Tour

more_horiz
কদম রসুল মসজিদ থেকে কয়েকমিনিটের মধ্যেই এসে পড়া গেল আর একটি বেষ্টনীর মধ্যে, যার মধ্যেও আছে একই সঙ্গে দুটি দর্শনীয় - চিকা মসজিদ এবং গুমটি দরওয়াজা। কিন্তু এই দুটি দর্শনীয় ছাড়াও এই জায়গাটির একটি আলাদা বৈশিষ্ট্য আছে, সেই কথাতেও আসবো এই প্রসঙ্গে।

চিকা মসজিদ - আর্কিওলজিকাল সার্ভের অধীনের এই জায়গাটিতে গেট দিয়ে ঢুকতেই সামনে পড়ে একটি মসজিদের মত স্থাপত্য - যেটির ছাদের ওপর একটি মাত্র অর্ধবৃত্তাকার গম্বুজ বা Dome । আনুমানিক ১৪৫০ সাল নাগাদ এটি নির্মাণ করান সুলতান নাসিরউদ্দিন মামুদ শাহ । যদিও এটিকে মসজিদ বলা হয়, তবু অনেকেই এটিকে মসজিদ বলে মানতে চান না, কারণ বাইরে থেকে চতুষ্কোণ হলেও ভেতরে গোলাকৃতি এই ভবনের অভ্যন্তরে কোনো “মিহরাব” বা অন্য কোনো বৈশিষ্ট্য নেই। আবার অনেকে এটিকে পরবর্তী পর্যায়ে সুলতান হুসেন শাহের কারাগার বলেও উল্লেখ করেন । কিন্তু সেখানেও প্রশ্ন থেকে যায় কারণ কারাগারের ক্ষেত্রে একটি প্রবেশপথই যথেষ্ট, কিন্তু এটির চারদিকে চারটি প্রবেশপথ। এছাড়া কোনো এক সময়ের ব্যবহৃত একটি মসজিদ কয়েকবছরের মধ্যেই ধর্মাচরণের স্থান থেকে কারাগারে রূপান্তরিত হবে, এটিও একটি ভাববার বিষয়। এটির নামকরণের মধ্যেও কিছু দ্বিমত আছে। বেশীর ভাগ মতে এটির ভিতর বহু বাদুড় বা চামচিকার বাস থাকাতে এটির নাম “চিকা” মসজিদ। আবার অনেকের মতে, এটির গায়ে একসময়ে মিনা করা চকচকে ইঁটের কারুকাজ ছিল - তার থেকেই এটির নাম চিকা বা চামকান মসজিদ, যদিও সেরকম কোন কাজ এখানে এখন দেখা যায় না, যা দেখা যায় পার্শ্ববর্তী গুমটি দরওয়াজায়।

গুমটি দরওয়াজা - চিকা মসজিদ থেকে একটু দূরেই আর একটি এক গম্বুজ বিশিষ্ট স্থাপত্য দেখা যায়, যেটি আনুমানিক ১৫১২ খ্রিস্টাব্দে তৈরি করান সুলতান হুসেন শাহ। বলা হয়, এটি হয়ে থাকতে পারে প্রহরীদের ঘর ( গুমটি শব্দটির সূত্রপাত ফারসি “গুমবদ” শব্দ থেকে যার অর্থ প্রহরীর কুটির )। এছাড়া এটিকে বলা হয় গৌড়ে প্রবেশের একটি ছোট তোরণ। এটির মূল প্রবেশপথের দুদিকে দুটি লম্বালম্বি খাঁজকাটা স্তম্ভ। এছাড়াও দুই কোণে আরো বড় কোনো স্তম্ভ বা বুরুজ ছিল, তার নীচের গোলাকৃতি Basementই শুধু এখন অবশিষ্ট আছে। কিন্তু এই স্থাপত্যটির সবচাইতে বড় বৈশিষ্ট্য - এর মীনা করা ইঁটের কাজ। এটি একসময় ওই ধরণের এনামেল করা ইঁট দিয়ে অলঙ্কৃত করা ছিল, যার কিছুটা এখনো দেখা যায় প্রবেশ দরজার উপর দিকে, আর পাশের স্তম্ভের কিছু অংশে। সেই সব ইঁটের বেশীর ভাগই এখন আর নেই, কিন্তু যেটুকু এখনো আছে, আজ এতবছর পরেও তাদের ঔজ্জ্বল্য আমাদের চোখ ধাঁধিয়ে দেয়।

পড়ে থাকা হিন্দু মন্দিরের স্তম্ভ - সব শেষে আসি এখানকার একটি ভিন্নতর বৈশিষ্ট্যের কথায়। চিকা মসজিদের পাশে, পিছনে আর গুমটি দরওয়াজা আর চিকা মসজিদের মাঝামাঝির বিস্তীর্ণ জায়গা জুড়ে আরো অনেক বড় কোনো প্রাচীন স্থাপত্যের ধ্বংসাবশেষ দেখা যায়। দেখা যায় বহু স্তম্ভ, পরপর সাজানো আয়তাকার বহু বেসমেন্ট এবং আরো বেশ কিছু চিহ্ন যা একসময়ের বিশাল কোনো ভবনের বা স্থাপত্যের ইঙ্গিত দেয়। কি ছিল এখানে ? উত্তর পাইনি। কিন্তু চমকে উঠেছি গুমটি দরওয়াজার কাছেই আলাদা করে শুইয়ে রাখা একটি অত্যন্ত সুন্দর পাথরের স্তম্ভ দেখে। তার গায়ে অত্যন্ত সুন্দর অলংকরণ যেগুলি হিন্দু মন্দিরেরই সাধারণতঃ দেখা যায়। তার চাইতেও বড় কথা, এই স্তম্ভে অত্যন্ত স্পষ্ট ভাবে খোদিত আছে অনেকটা উড়িষ্যার মন্দির রীতির অনুকরণে কোন মন্দিরের ছবি। কিসের ইঙ্গিত দিচ্ছে এখানকার এই স্তম্ভ বা অন্য ধ্বংসাবশেষগুলি ? আগে কি কোনো বিশাল মন্দির ছিল এই এলাকায় ? তা কি হতে পারে ইসলামী শাসনের আগের আরো প্রাচীন যুগের - সেন রাজত্ব বা তারও আগের কোনো বিশাল বৈভবময় মন্দির বা অন্য কোনো স্থাপত্যের স্মৃতি ? প্রশ্ন এল মনের মধ্যে, কিন্তু উত্তর পেলাম না।

পরবর্তীতে - বাইশ গজী প্রাচীর আর বল্লাল বাটী।

descriptionমালদা ভ্রমন Malda Tour EmptyRe: মালদা ভ্রমন Malda Tour

more_horiz
চিকা মসজিদ থেকে বেরিয়ে কিছুটা দূরে এবার একটু অন্য ধরণের কয়েকটা জায়গায়।

বাইশগজী প্রাচীর - গাড়ীর রাস্তার একপাশে হঠাৎ করে একটি লম্বা আর উঁচু প্রাচীর। অনেকদূর অবধি চলে যাওয়া সেই প্রাচীর - কিন্তু একটানা নয়, মাঝে মাঝেই ভেঙে পড়েছে। এই প্রাচীরের উচ্চতা ৬৬টি ফুট বা বাইশ গজ, তার থেকেই এর নাম বাইশ গজী প্রাচীর। বই থেকে পাচ্ছি এটি নীচের দিকে প্রায় আঠারো ফিট চওড়া, ওপরের দিকে ক্রমশ সরু হয়ে গেছে। সম্ভবত এটি তৈরি হয় সুলতান বরবক শাহের আমলে ১৪৫৯ থেকে ১৪৭৪ সালের মধ্যে। প্রাচীরের মাঝখানে ছিল সেই সময়ের রাজপ্রাসাদ - হাভেলি খাস। কিন্তু কোনো প্রাসাদের চিহ্ন আমার অন্তত চোখে পড়েনি। কিন্তু চিহ্ন না থাকলেও সেই প্রাসাদকে ঘিরে যে বিশাল প্রাচীর গড়ে তোলা হয়েছিল - তা কিন্তু টিঁকে আছে এতদিন পরেও। অনেক জায়গায় প্রাচীরের সংস্কার হয়েছে, আবার কিছু জায়গায় তার ভঙ্গ আদিম রূপ। তবে মাঝে মাঝে ভেঙে গিয়ে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়লেও এই প্রাচীরের ব্যাপ্তি আর বিশালত্ব কিন্তু বেশ বিস্ময় জাগায় এখনো।

বল্লালবাটী - বাইশগজী প্রাচীরের পাশ দিয়ে ঢুকে এক জায়গায় পাওয়া যায় কিছুদিন আগে খনন করে পাওয়া এক প্রাচীন প্রাসাদের ভগ্নাবশেষ। আগে এই জায়গায় একটি ঢিপি ছিল, নাম ছিল বল্লাল বাটী। বিশ্বাস ছিল, যে সেই জায়গাতেই লুকিয়ে আছে রাজা বল্লাল সেনের প্রাসাদ। শেষ পর্যন্ত মাত্র কয়েকবছর আগে, ২০০৩ সালে খনন করা হয় সেই ঢিবি, বেরিয়ে আসে এক প্রাসাদ বা কোনো প্রাচীন স্থাপত্যের অংশবিশেষ। সবচাইতে লক্ষণীয় এখানে প্রচুর গোলাকৃতি থামের আভাস, যার প্রতিটির মধ্যিখানে একটি করে গর্ত। কি হতে পারে এই স্থাপত্যের বৈশিষ্ট্য ? এতগুলি গর্ত করা থাম একেবারে গায়ে গায়ে লাগানো - কেমন ছিল সেই মূল স্থাপত্যটি ? কেউ কেউ মনে করছেন রাজপ্রাসাদ নয়, এটি হতে পারে কোনো বৌদ্ধ বিহারের ধ্বংসাবশেষ। সঠিক উত্তর জানা নেই, কারণ সদ্য আবিষ্কৃত এই জায়গাটির সম্পর্কে এখনো বিশেষ কিছু তথ্য পাওয়া যায় নি।

জাহাজঘাটা - বল্লালবাটীর মতোই আর একটি সম্প্রতি আবিষ্কৃত জায়গা - জাহাজঘাটা, বল্লালবাটী থেকে আর একটু ভেতর দিকে। জায়গাটি নির্জন, হয়তো খুব নিরাপদও নয়, তাই অনেকেই যেতে চান না। বলা হয়, এটি ছিল একটি স্থানীয় বন্দর, যেখানে গঙ্গা বইতো খুব কাছ দিয়েই, আর এখানে এসে দাঁড়াতো বড় নৌকো বা ছোট জাহাজ। কালক্রমে গঙ্গা সরে গেছে অনেক দূরে, (যদিও কাছাকাছি জলের চিহ্ন আছে এখনো), সেই সঙ্গে লুপ্ত হয়ে গেছে এই জাহাজঘাটার ইতিহাস। সাম্প্রতিক খনন কাজে নতুন করে কিছুটা জেগে উঠেছে এই জায়গা, তবু তার প্রকৃত ইতিহাস জানতে এখনো অনেক বাকী।

পরবর্তীতে - লুকোচুরি দরওয়াজা।

descriptionমালদা ভ্রমন Malda Tour EmptyRe: মালদা ভ্রমন Malda Tour

more_horiz
জাহাজঘাটা থেকে আবার ফেরা সুলতানী আমলের বিশাল সব স্থাপত্যে। এবারে আবার একটি দরওয়াজা আর একটি মসজিদ।

লুকোচুরি দরওয়াজা - কদম রসুল মসজিদ আমরা আগেই দেখেছি, সেই মসজিদের পাশেই মূল রাস্তার ওপরেই এই বিশাল তোরণ, গাড়ী চলাচল করে তার ভেতর দিয়েই। আনুমানিক ১৬৫৫ সালে শাহ সুজার আমলে এটি নির্মিত, যদিও আরেকটি মতে, এটির নির্মাণ আরো আগে ১৫২২ সালে হুসেন শাহের আমলে, পরে শাহ সুজার আমলে সম্ভবত এটির ব্যাপক পরিবর্তন ও পরিবর্ধন হয়। এটির আদি নাম ছিল শাহী দরওয়াজা, কিন্তু পরে জনগণের মুখে মুখে এটির নাম পরিবর্তিত হয়ে দাঁড়ায় “ লুকোচুরি গেট “ বা “ লুকোচুরি দরওয়াজা “। কেউ কেউ বলেন এখানে সম্রাট লুকোচুরি খেলতেন তাঁর সঙ্গীদের সঙ্গে, কিন্তু কেমন যেন মনে হয় এই ভাবনাটাই হাস্যকর। বরং “ মালদা জেলার পুরাকীর্তি “ বইতে যে বলা আছে দীর্ঘদিন পরিত্যক্ত থাকায় স্থানীয় ছোট ছোট শিশুদের লুকোচুরি খেলার মনোরম স্থান হওয়ায় এটির নাম কালক্রমে লুকোচুরি গেট হয়ে দাঁড়ায়, মনে হয় সেই ব্যাখ্যাটিই কিছুটা যথাযথ। এছাড়া বলা হয়, এটির নাম এসে থাকতে পারে “ লক্ষ ছিপি দরওয়াজা “ থেকেও - কারণ লক্ষ বা অসংখ্য বহুবর্ণ মীনা করা টাইলস দিয়ে একসময় এটি সাজানো ছিল। এটির উচ্চতা ৬৫ ফিট, ভেতরে ২৫ ফিট চওড়া রাস্তা। শাহ সুজা হাতি নিয়ে এই দরওয়াজা দিয়ে যাতায়াত করতেন বলে মনে করা হয়। প্রবেশপথের একদিকে দুপাশে দুটি বর্ধিত অংশে দুটি ঘর - যেগুলির সামনের দিকে তিনটি করে আর পাশে একটি করে খিলান দেওয়া প্রবেশপথ। ঘর দুটি সম্ভবত রক্ষীদের দ্বারা ব্যবহার হত - এখন এক পাশের একটি ঘরে যাওয়া গেলেও অন্য পাশের ঘরটি লোহার জালের দরজা দিয়ে বন্ধ। মূল দরওয়াজার মধ্যেই দুপাশে ওঠার সিঁড়ি - যেখান দিয়ে দোতলার নহবতখানা বা তিনতলার ছাদে পৌঁছনো যেত। এখন অবশ্য রক্ষীদের ঘর বা নহবতখানা দুটির অবস্থাই জীর্ণ, ওপরে কাউকে উঠতেও দেওয়া হয়না। তবুও আধুনিক পীচের রাস্তার ওপরে দাঁড়িয়ে আধুনিক যানবাহনের চলাচলের সাক্ষী এই গেট - যে ভাবে গত প্রায় ছশো বছর ধরে সে সাক্ষী থেকে এসেছে বিভিন্ন রাজত্বের বিভিন্ন ধরণের বাহনের চলমান ইতিহাসের।

তাঁতিপাড়া মসজিদ - লুকোচুরি গেট থেকে গাড়ীতে মাত্র পাঁচ মিনিটের মধ্যে পৌঁছে যাওয়া যায় গৌড়ের অন্যতম বিশিষ্ট দর্শনীয় তাঁতিপাড়া মসজিদে। সুলতান ইউসুফ খানের সময়ে ১৪৭৪ থেকে ১৪৮০ সালের মধ্যে নির্মিত সুন্দর এই ইঁটের মসজিদটি গৌড়ের টেরাকোটা মসজিদগুলির মধ্যে অন্যতম শ্রেষ্ঠ নিদর্শন। মূল মসজিদের মাপ ছিলো বাইরে থেকে ৯১’ x ৪৪’ । কিন্তু এটির দেওয়ালগুলি সাড়ে ছ ফিট গভীর হওয়াতে এটির ভেতরের মাপ দাঁড়িয়েছে ৭৮’ x ৩১’ । সামনের দিকে ছিল পাঁচ খিলানের প্রবেশ পথ, কিন্তু দুটি খিলান ভেঙে যাওয়ায় এখন সামনে তিনটি মাত্র খিলানই দেখা যায়। মূল মসজিদে একটিই কক্ষ, তার মাঝখান বরাবর চারটি কালো পাথরের স্তম্ভ দিয়ে দুই ভাগে ভাগ করা। এইভাবে দুটি সারিতে সামনের পাঁচটি খিলানের বরাবর মোট দশটি Dome ছিল ছাদের ওপর, কিন্তু পুরো ছাদ শুদ্ধ সব কটি domeই ভেঙে পড়ে ১৮৮৫ সালের এক বিধ্বংসী ভূমিকম্পে। এই ভাবেই ভেঙে পড়েছে বাইরের দিকে দুটি খিলান দেওয়া প্রবেশপথ। কিন্তু এখনো যা আছে, তাতেই বোঝা যায় এর সুন্দর টেরাকোটার কাজ। বাইরে প্রবেশপথের পাশের প্যানেলে এবং ভেতরে মেহরাবের ওপরে সেই সব কাজ এখনো দেখা যায়। সুন্দর ফুল, লতাপাতা আর বিভিন্ন ডিজাইন, সেইসঙ্গে ওপরে পদ্ম ফুলের আকৃতির কারুকাজ। আর্কিওলজিকাল সার্ভের অধীনে এই মসজিদ, তাদেরই তত্ত্বাবধানে বিভিন্ন সময়ে এটির সংস্কার হয়েছে। সামনে অনেকখানি জায়গা জুড়ে সুন্দর বাগান করা, তার মধ্যেই দুটি বেশ বড় সমাধি, গেট দিয়ে ঢোকার সময়ে সহজেই চোখে পড়ে। বলা হয় এই দুটি এই মসজিদের নির্মাতা মিরশাদ খান আর তাঁর কন্যা জুল ফয়রনের সমাধি। অন্য মতে এই দুটি এখানকার কাজী - ওমর কাজী আর তাঁর ভাইয়ের সমাধি। যে সময় এই মসজিদ তৈরি হয়, সেই সময় এই এলাকায় তাঁতি সম্প্রদায়ের বাস ছিল বলেই হয়তো এর নাম তাঁতিপাড়া মসজিদ।

পরবর্তীতে - লোটন মসজিদ।

descriptionমালদা ভ্রমন Malda Tour EmptyRe: মালদা ভ্রমন Malda Tour

more_horiz
এরপর আরো দুটি মসজিদ - যেগুলির সঙ্গে কোনো মানুষ বা সম্প্রদায়ের নাম জড়িত। প্রথমে লোটন ও পরে চামকাটি মসজিদ।

লোটন মসজিদ - তাঁতিপাড়া মসজিদ থেকে একটু দূরে গিয়েই আর একটি খুব সুন্দর মসজিদ - লোটন মসজিদ। সুলতান ইউসুফ শাহের সময় ১৪৭৫-৭৬ সালে তৈরি এই মসজিদটির সম্পর্কে বলা হয় যে এটি “ নটু “ বা “নাথু” বা “লুটন” নামের কোনো নর্তকীর নামে তৈরি। তবে, নামের উৎপত্তি যাই হোক না কেন, মসজিদটি ছোট হলেও এর সৌন্দর্য কিন্তু ছিল অন্যত্র। সমস্ত মসজিদটি ছিল সাদা, সবুজ, নীল, হলুদ রঙের মীনা করা ইঁট দিয়ে সাজানো - যার কিছু কিছু চিহ্ন আজ এত বছর পরেও অল্প দেখা যায়। মসজিদে ঢোকার পথে পাশাপাশি তিনটি খিলান, ভেতরে অনেকটা ভেঙে গেলেও পুরোনো সৌন্দর্যের কিছুটা আন্দাজ পাওয়া যায়। তিনটি মেহরাবের অংশ এখনো ভাঙা, কিন্তু ভেতরের ছাদ আর্কিওলজিকাল সার্ভের হাতে সংস্কার করা। মেহরাবের সামনেই আবার তিনটি খিলান, সেই খিলানের ওপর দিকে আর ছাদের ভেতরদিকে বিভিন্ন রকমের খাঁজকাটা ডিজাইন। ছাদের ওপর মাঝখানে একটি বড় গম্বুজ, অন্যদিকে একটি ছোট বারান্দার ওপরে আরো তিনটি ছোট গম্বুজ। মসজিদের মেঝেতে এখনো সুন্দর মীনে করা কাজ দেখা যায়, এতদিন পরেও। এক কথায়, ছোট মসজিদ হলেও এটি এই অঞ্চলের একটি অন্যতম সুন্দর স্থাপত্য।

চামকাটি মসজিদ - আর একটি বিশেষ মসজিদ এই গৌড়ে, যেটির সঙ্গে কিছুটা হলেও একটি সম্প্রদায়ের নাম জড়িত। বলা হয়, চর্ম ব্যবসায়ী এক সম্প্রদায়ের জন্য নির্মিত এই চামকাটি মসজিদ। আর্কিওলজিকাল সার্ভের বোর্ডেও সেই ইঙ্গিত আছে। যদিও এর বিপরীত মতও অবশ্যই আছে। সেই মতে বলা হয় সরু (চাম) রাস্তার (কাটি) ধারে এর অবস্থান বলেই এর নাম চামকাটি। এটিও তৈরি হয় লোটন মসজিদের প্রায় কাছাকাছি সময়েই, আনুমানিক ১৪৭৫ সাল নাগাদ, সুলতান ইউসুফ শাহের আমলে। মসজিদের প্রবেশ পথ তিন খিলানের, তার পরেই একটি অলিন্দ, সেটি পেরিয়ে মূল মসজিদ। অলিন্দের ওপরের ছাদের অনেকটাই এখন ভেঙে পড়েছে, যদিও ভেতরে মূল মসজিদের ছাদ অক্ষুণ্ন। তবে আর্কিওলজিকাল সার্ভের করা সংস্কার কাজ চোখে পড়ে। মসজিদকে ঘিরে বিভিন্ন কোণে খাঁজকাটা গোলাকার থামের অবশেষ, ছাদের ওপরের গম্বুজটির পাঁচটি সূক্ষ ধাপ, সামনের দিকে অর্ধেক ভেঙে পড়া বারান্দা, দেওয়ালে মাঝে মাঝে রংবেরঙের মীনের কাজ করা ইঁট, সব মিলিয়ে মসজিদটির গঠনশৈলী একটু আলাদা এখানকার অন্যান্য মসজিদের চাইতে। চামকাটি নামটির জন্যে, অনেকেই এটিকে আমার আগে বর্ণনা করা চিকা মসজিদ বা চামকান মসজিদের সঙ্গে একটু গুলিয়ে ফেলেন - যদিও দুটি সম্পূর্ণ আলাদা স্থাপত্য।

পরের পর্বে - গুণমন্ত মসজিদ।

descriptionমালদা ভ্রমন Malda Tour EmptyRe: মালদা ভ্রমন Malda Tour

more_horiz
privacy_tip Permissions in this forum:
You cannot reply to topics in this forum
power_settings_newLogin to reply