আকালীপুর এবং গুহ্যকালীর টানে

ঘূর্ণিঝড় ‘পেতাই’ এর দাপটে সকাল থেকেই(তারিখ-১৬ই ডিসেম্বর, ২০১৮) আকাশে কালো মেঘ আর ঘ্যানঘ্যানে বৃষ্টি। তারাপীঠে এসেছি দিন তিনেক হলো। গতকালই ঘুরে এসেছি মাসাঞ্জর, বক্রেশ্বর আর মামা ভাগ্নে পাহাড়, কোন অসুবিধা হয়নি। কিন্তু আজ সকাল থেকেই বৃষ্টি, ঘুম থেকে উঠে তাই মনটা খারাপ হয়ে গেলো। আগের দিনের ড্রাইভার সকাল ৮ টার সময় হাজির, অগত্যা সবাই মিলে বেড়িয়ে পড়লাম বীরচন্দ্রপুরের দিকে। একে একে দেখে নিলাম বীরচন্দ্রপুর ইস্কন মন্দির,নিত্যানন্দ এর জন্মস্থান, বীরচন্দ্রপুর গর্ভাবাস, বীরচন্দ্রপুর জগন্নাথ মন্দির আর বীরচন্দ্রপুর বাঁকারায় মন্দির। কিন্তু আমার আবার অজানা বা অল্পখ্যাত জায়গা খুঁজে দেখার একটা সুপ্ত বাসনা আছে তাই মারুতি ভ্যান ছুটে চলল আকালীপুরের দিকে।

বীরভূমের পূর্বপ্রান্তের এক ঐতিহাসিক গ্রাম ভদ্রপুর। এখানেই একসময় ছিল মহারাজ নন্দকুমারের বিশাল সাম্রাজ্য ও রাজপ্রাসাদ। এই গ্রামের পশ্চিমেই আকালীপুর। যেখানে রয়েছে মহারাজ নন্দকুমার প্রতিষ্ঠিত গুহ্যকালীর মন্দির । কথিত আছে মগধরাজ জরাসন্ধ এই গুহ্যকালী বিগ্রহ গোপনে মন্দির স্থাপন করে পাতালে পূজার্চনা করতেন। কালের নিয়মে সে মন্দির বিলীন হয়। তাঁর মৃত্যুর পর,আজ থেকে আনুমানিক ২৩৫ বছর আগে রানী অহল্যবাঈ স্বপ্নে দেখা শিবলিঙ্গ অন্বেষণের সময় খননকার্য্য করতে গিয়ে মায়ের সেই মূর্তি পান এবং কাশীরাজ চৈত সিং কে সেটি দান করেন। কাশীরাজ মায়ের সেই মূর্তিকে পূজার্চনা করতে থাকেন। এখন সেই সময় ওয়ারেন হেস্টিংস তখন কাশীতেই অবস্থান করছিলেন। মায়ের অপরূপ কারুকার্যসম্পন্ন মূর্তিটির উপর তাঁর লোভ হয়। তিনি এটিকে ইংল্যান্ডের মিউজিয়ামে নিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা করেন। চৈত সিং এই পরিকল্পনার কথা জানতে পেরে মায়ের মূর্তিটি গঙ্গা বক্ষে লুকিয়ে রাখলেন। এদিকে মহারাজ নন্দকুমার মা কে প্রতিষ্ঠা করার স্বপ্নাদেশ পেয়ে কাশী যাত্রা করলেন এবং চৈত সিংকে সব বললেন। মূর্তি রক্ষা করার এত সুন্দর উপায় পেয়ে কাশীরাজ নৌকা করে মূর্তিটি নন্দকুমারের সাথে পাঠিয়ে দিলেন। দীর্ঘ গঙ্গাপথ অতিক্রম করে, দ্বারকা- ব্রাহ্মনী নদী বেয়ে মায়ের বিগ্রহ এসে পৌচ্ছলো এই আকালীপুরে। নন্দকুমার তন্ত্রমতে বেদীমূলে মাকে স্থাপন করে মন্দির নির্মান শুরু করেন। অপর দিকে এই খবর পেয়ে ও নন্দকুমারের প্রজাদরদী কার্যকালাপে ঈর্শ্বান্বিত হয়ে তাকে শাস্তি দেওয়ার গোপন ষড়যন্ত্র করতে থাকেন হেস্টিংস। ফলস্বরূপ একদা তাঁকে দোষী সাব্বস্ত করে মহারাজের ফাঁসির আদেশ হয়।

গুহ্যকালীর এই রকম মূর্তি ভারতের অন্যত্র খুঁজে পাওয়া যাবে না। চিন, নেপালে এই রকম কালী মূর্তির গঠন দেখতে পাওয়া যায়। দামি একখণ্ড কষ্টি পাথর থেকে এই অপূর্ব মূর্তিটি তৈরি করা হয়েছে। জানিনা, কোন ধ্যানমগ্ন শিল্পী মনের মাধুরী মিশিয়ে এই শিল্পকর্ম করেছেন। আয়তাকার কালো পাথরে বেদির অপর গুহ্যকালী বসে আছেন। বেদিটির চার কোনায় চারটি সাপের ফনা। গুহ্যকালী দুটি কুণ্ডলীকৃত সাপের উপর অর্ধ পদ্মাসনে বসে আছেন। ডান পা একটি সাপের মাথা স্পর্শ করেছে। দেবীর মস্তকে যে “সহস্রধার” চক্রের কথা বলা হয়েছে সাপের মুকুট তারই প্রতীক। দেবীর গলায় পঞ্চাশটি নরমুণ্ড দিয়ে তৈরি মালা। কর্ণ কুহর থেকে বুক অবধি নেমে এসেছে দুটি মৃত শব শিশু। নাভী কুণ্ডের উপর দিয়ে সাপের কোমর বেষ্টন। দুহাতে সাপের বলয়। মা এখানে ত্রিনয়না, বিস্ফারিত চক্ষু। উন্মুক্ত বিশাল জিহ্বা। মায়ের দুই হাতে বর এবং অভয় মুদ্রা। এই বরাভয় মুদ্রায় দেবী রক্ষা করছেন তার সৃষ্টিকে।

আমরা যখন আকালীপুর পোঁছালাম তখন দেখলাম সবে পূজো শুরু হয়ে গেছে তাই প্রায় ২০-২৫ মিনিট ধরে গুহ্যকালীর পূজো দেখার সৌভাগ্য হোল। আরও কিছু দর্শনার্থী ছিল, যারা আগেই মন্দিরে বসে পূজো দেখছিলেন। আমাদের আবার নলাটেশ্বরী ও মলুটি যাবার প্ল্যান ছিল, অগত্যা ফিরে আসতেই হোল আকালীপুর থেকে।

ছবিগুলো সবকটাই মোবাইলে তোলা, প্রচণ্ড বৃষ্টির জন্য ক্যামেরা বার করার সাহস হয়নি।

জরুরী তথ্যঃ
১) মা এর পূজো প্রতিদিন বেলা ১১-১০:৩০ নাগাদ একবারই হয়। দুপুরে এখানে নিত্য ভোগ প্রসাদের ব্যবস্থা আছে। জনপ্রতি ৭০টাকা। আগে ফোন করে কতজন খাবেন জানিয়ে দেবেন। মায়ের মন্দির একদম নদী ও শ্মশানের পাশে নির্জনে। এখানে দর্শনার্থীদের জন্য তেমন কোন ব্যবস্থা নেই। মন্দিরের পাশে দু তিনটি ডালাঘর আছে। পানীয় জল বা টয়লেটের ব্যবস্থা ভালো নয়। একটি টয়লেট আছে কিন্তু খুব সাধারন মানের। রাত্রিবাস ও এখানে করা যায় না। মন্দিরে পূজা, ভোগ প্রসাদ এর জন্য যোগাযোগ করতে পারেন পূজারীর সঙ্গে। শ্রী দেবাশীষ বন্দ্যোপাধ্যায় - 9474831916/ 8670355422। ইনি সকল দর্শনার্থীদের আন্তরিক ভাবে আপ্যায়ন করেন,পীঠ প্রসঙ্গে বলেন। খুব ভালো একজন মানুষ।
২) দুর্গাপূজার পর চতুর্দশী তিথিতে গুহ্যকালীর বিশেষ পূজার ব্যবস্থা আছে। এই সময় এখানে মেলা বসে এবং প্রচুর জন সমাগন হয়। এছাড়া পৌষ মাসের শেষে মকর সংক্রাতিতে হাজার হাজার মানুষ বনভোজন এবং মকর স্নান করেন। তখনও একদিনের জন্য মেলা বসে

কিভাবে যাবেনঃ
১) আমরা তারাপীঠে থেকে মারুতি ভ্যান ভাড়া করে সকালে বীরচন্দ্রপুরের মন্দিরগুলো দেখে তারপরে আকালীপুরে গুহ্যকালী দেখা, তারপরে নলহাটিতে নলাটেশ্বরী দর্শন করে সোজা মলুটিতে মৌলিক্ষা মায়ের মন্দির দেখে তারাপীঠে ফিরে আসা। ড্রাইভারকে দিয়েছিলাম ২০০০ টাকা। চরন দাস ড্রাইভার ফোন নম্বর- ৭৫৮৪০৩৪৭৫৬
২) আকালীপুরে যাওয়ার সবচেয়ে সহজ উপায় হল ট্রেনে নলহাটি আসা। এখান থেকে বহরমপুরের দিকে বাসে করে ১০-১২ কিমি দুরে নগড়া মোড়। এখান থেকে টোটো বা ভ্যানে ডানদিকের গ্রাম ও মোঠো পথ দিয়ে গুহ্যকালীর মন্দির চার কিমি। যাওয়ার সময় যে টোটোয় যাবেন তাকেই ফেরার জন্য বলে রাখবেন, কারন না হলে ফেরার গাড়ি পাওয়া যায়না। বা নলহাটি থেকে সরাসরি গাড়ি বুক করা যায়। আবার রামপুরহাট থেকেও বাস আসছে নগড়া মোড়ে। ওখান থেকে টোটো বা ভ্যানে আকালীপুর আসুন। দর্শন সেরে নলহাটি বা তারাপীঠে থাকুন।

তথ্য সূত্র এবং কৃতজ্ঞতা স্বীকারঃ
মুর্শিদাবাদ কাহিনী – নিখিল নাথ রায়
শারদীয়া উদ্বোধন - ১৪১০
শারদীয়া বর্তমান - ১৪১০
ডঃ অনিমেষ চট্রোপাধ্যায়
কমলেন্দু বিকাশ রায়।

কলমে - অতনু চক্রবর্তী