তারাপীঠ একটি “সিদ্ধপীঠ”, অর্থাৎ এখানে সাধনা করলে সাধক জ্ঞান, আনন্দ ও সিদ্ধি বা অলৌকিক ক্ষমতা প্রাপ্ত হন। এখানে ভক্তিই শেষ কথা। ‘তারাপীঠং মহাপীঠং গন্তব্যং যত্নতঃ সদা।’

উত্তরমুখী আটচালা তারা মায়ের মন্দিরটি লাল ইটের নির্মিত এর ভিতের দেওয়াল বেশ মোটা। উপরিভাগে শিখর পর্যন্ত একাধিক ধনুকাকৃতি খিলান উঠেছে। চারচালার ওপরে চার কোণে চারটি ছোট ছোট চূড়া অবস্থিত। মন্দিরের চূড়ায় একটি তামার পতাকাসহ ত্রিশুল তিনটি পদ্ম ভেদ করে উঠেছে।

মন্দিরের প্রবেশপথের মধ্যে খিলানের ওপর দুর্গার প্রতিকৃতি রয়েছে। উত্তরদিকে বামপাশের খিলানের ওপর কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের ঘটনা, ভীষ্মের শরশয্যা, অশ্বত্থামা হত প্রভৃতি মহাভারতের কাহিনী উৎকীর্ণ রয়েছে। মন্দিরের উত্তর ভিতের পূর্বদিকে সীতাহরণ, অকালবোধন, রাম ও রাবণের যুদ্ধের দৃশ্য এবং পশ্চিমদিকে কৃষ্ণলীলার চিত্র খোদিত। ১২ ফুট × ৬ ফুট মাপের মন্দিরের গর্ভগৃহে দেবীমূর্তি সংস্থাপিত।

তারাপীঠের কথা বললেই চলে আসে জয়দত্ত সদাগরের কথা। আজও মুখে মুখে চলে আসছে তাঁর কাহিনী। আজ থেকে প্রায় আটশো বছর আগের ঘটনা। তিনি ছিলেন বীরভূমের রত্নাগড় নিবাসী। একবার তিনি বাণিজ্যে প্রভূত সম্পদ, অর্থ লাভ করে বাড়ি ফিরছিলেন। চলার পথে অসুস্থতায় মৃত্যু হল তাঁর প্রাণাধিক পুত্রের। বাড়ি ফিরেই ছেলের অন্ত্যেষ্টি করবেন স্থির করে তিনি মাঝিদের বললেন, পুত্রের দেহটাকে ভালো করে ঘি মাখিয়ে রাখতে। তাতে পচন ধরবে না। এদিকে সন্ধ্যা নেমেছে। রাত্রিটা তাই পথেই বিশ্রাম নিতে হবে। চলতে চলতে থামলেন এক বিশাল জঙ্গলের পাশে। স্থানটির নাম চণ্ডীপুর।

রাতে ঘুম নেই জয়দত্তের। মৃত ছেলের দেহ আঁকড়ে রাত জাগছেন তিনি। সেই সময় তারামা এক কুমারী মেয়ের রূপ ধরে নৌকার কাছে এসে দাঁড়ালেন। তাঁর কালো রূপে যেন আলো ছিটকে পড়ছে। রাত্রির আকাশজুড়ে অপূর্ব এক জ্যোতি। অপূর্ব সুন্দরী সেই মেয়েটি জয়দত্তকে জিজ্ঞাসা করলেন,‘ও বাছা, এত নৌকা ভরে কী নিয়ে চলেছো গো ?’ পুত্রশোকে জয়দত্তের মন ভারাক্রান্ত ছিল। তাই তিনি রাগত স্বরে মেয়েটিকে বললেন, ‘ছাই আছে’। সে কথা শুনে মেয়েটি ‘আচ্ছা’ বলে চলে গেলেন। কিছুক্ষণ পরে জয়দত্ত দেখলেন তাঁর নৌকার সব বাণিজ্যসামগ্রী, অর্থ ছাইতে পরিণত হয়েছে।

পরদিন সকালে মাঝিরা রান্নায় বসল। খেয়েদেয়ে নৌকা নিয়ে যাত্রা করতে হবে। কাটা শোল মাছ কাছেই এক কুণ্ডের জলে ধুতে গেল তারা। কী আশ্চর্য ! জলের স্পর্শ পেয়ে মাছটি জ্যান্ত হয়ে সাঁতরে চলে গেল। মাঝিরা দৌড়ে এসে জয়দত্তকে সব কথা জানাল। জয়দত্তের মনে পড়ল আগের রাতের কথা। সেই মেয়েটির কথা। তখন পুত্রশোকে কাতর হয়ে বারবার তিনি বলতে লাগলেন, ’মাগো দেখা দে। কে তুই মাগো আমাকে এমন পরীক্ষা করে গেলি। আমাকে ক্ষমা কর মা। আমার সন্তানকে বাঁচিয়ে দে।’

সেদিন রাতেই স্বপ্নের মধ্যে ফিরে এলেন সেই মেয়েটি। তাঁকে দেখে জয়দত্ত বললেন, ‘পুত্র মলো ধন ছাই কিসের লাগিয়া।’ কুমারী মেয়ে রূপী তারা মা তাঁকে বললেন, ‘ভবানী বলেন সাধু না হও কাতর /প্রাতে উঠি পাবে ধন নৌকার ভিতর।’ সেই সঙ্গে তারা মা তাঁকে বললেন, কুণ্ডের জল ছেলের গায়ে ছড়ালেই সে বেঁচে উঠবে।

সকালে জয়দত্ত তাঁর হারানো সম্পদ ফিরে পেলেন এবং বশিষ্ঠকুণ্ডের জল ছেলের গায়ে ছেটাতেই ছেলে ‘তারা তারা’ বলে বেঁচে উঠল। ছেলের মুখে তারা নাম শুনে বিস্মিত জয়দত্ত বুঝতে পারলেন দেবী তারার অলৌকিক কৃপার কথা। পুত্রকে ফিরে পাওয়ার আনন্দে তিনি সারাদিন বসে তারা মায়ের জপ করতে লাগলেন। রাতে আবার দেবী তাঁকে স্বপ্নে দর্শন দিলেন। তাঁকে আদেশ করে বললেন, ‘এই জঙ্গলের মধ্যে একটা শ্বেতশিমুল গাছের নীচে একটা শিলাবিগ্রহ রয়েছে।

সেই বিগ্রহ একটা মন্দিরে প্রতিষ্ঠা করে তার পুজোর ব্যবস্থা করবি। আমি হলাম উগ্রতারা। জঙ্গলের মধ্যে শ্মশানে আমার বাস।’ পরদিন সকালে লোকজন নিয়ে সেই বিশাল জঙ্গলে খুঁজে খুঁজে শ্বেতশিমুল গাছের নীচ থেকে শিলাবিগ্রহ আবিষ্কার করলেন জয়দত্ত। কাছেই পেলেন চন্দ্রচূড় শিবের মূর্তি।

বশিষ্ঠকুণ্ড বা জীবিতকুণ্ডের সামনে তাড়াতাড়ি মন্দির নির্মাণ করে সেই শিলামূর্তি ও চন্দ্রচূড় শিবের মূর্তি প্রতিষ্ঠা করলেন তিনি। শুধু তো মন্দির প্রতিষ্ঠা করলেই হবে না। তার নিত্যপূজাও দরকার। তাই জয়দত্ত কাছেই মহুলা গ্রামের এক ব্রাহ্মণকে নিত্যপূজার দায়িত্ব দিয়ে বিদায় নেন। এভাবেই তারাপীঠে প্রথম মন্দির নির্মাণ হয়। শুরু হয় মায়ের ভোগরাগ।

আগে থেকেই এই স্থান তারামায়ের বিরাজক্ষেত্র। পুরাণেও এই স্থানের বর্ণনা মেলে। এখানকার সিদ্ধ শ্মশানে বহু সাধুসন্ত সিদ্ধিলাভ করেছেন।

পুরাণের কাহিনী থেকে জানা যায়, সতীহারা শিব দেবীকে কামনা করে এখানে এসে সাধনা করেন। তিন লক্ষ জপ করেছিলেন। তাঁর সাধনায় তুষ্ট হয়ে তারা বলেছিলেন, তিনি আবার উমারূপে তাঁর কাছে স্ত্রী রূপে যাবেন।

আরও জানা যায়, মহামুনি বশিষ্ঠ বিষ্ণুর দ্বারা আদিষ্ট হয়ে এখানে এসে সাধনা করেছিলেন। সেই শ্বেতশিমুল, গাছের নীচে বসে তিনিও তিন লক্ষ তারা জপ করেছিলেন। তিনি সাধনলাভ করেছিলেন আশ্বিন মাসের কোজাগরী শুক্লা চতুর্দশীতে।

আরও আশ্চর্যের ঘটনা হল, জয়দত্ত মন্দির প্রতিষ্ঠা করে প্রথম যেদিন দেবীর পুজো করেছিলেন, সেদিনটাও ছিল কোজাগরী শুক্লা চতুর্দশী। আজও এই বিশেষ দিনে তারামায়ের পুজো ধুমধাম করে হয়।

জয়দত্তের তৈরি করা মন্দির একদিন ক্রমেই জীর্ণরূপ ধারণ করল। তখন সেই মন্দিরকে নতুনভাবে নির্মাণ করতে এগিয়ে এলেন বীরভূমের এড়োল গ্রামের রামজীবন রায়চৌধুরী। সেটি হল তারাপীঠের মন্দিরের দ্বিতীয় নির্মাণ। সেটা ছিল আনুমানিক ১৭৪৩ খ্রীষ্টাব্দ।

রামজীবন ছিলেন তারাপীঠের এলাকা ওই পুরো এলাকার পত্তনিদার। তারাপীঠের মন্দিরের ভগ্নদশা দেখে ভক্ত রামজীবনের মন খারাপ হয়ে যায়। কিন্তু মন্দির সংস্কারের মতো অর্থ তাঁর ছিল না। তাই প্রজাদের কাছ থেকে তোলা খাজনার টাকায় তিনি আবার নতুন করে মন্দির গড়ে দিলেন। এর ফলে তিনি খাজনার টাকা তৎকালীন বাংলার নবাব আলিবর্দি খাঁকে দিতে পারলেন না। এর বিচার করার জন্য তাঁকে পেয়াদারা মুর্শিদাবাদে ধরে নিয়ে যায়। তিনি বলেন, খাজনার টাকা দিয়ে তিনি তারামায়ের মন্দির নির্মাণ করেছেন। কোনওরকম তছরুপ তিনি করেননি। নবাব একথার সত্যতা বিচারের জন্য লোক পাঠালেন। তাঁরা ফিরে এসে নবাবকে জানালেন, রামজীবন সত্য কথাই বলেছেন। তাঁর সত্যবাদিতায় খুশি হয়ে নবাব সব খাজনা মকুব করে রামজীবনকে রেহাই দিলেন।

সময় পেরিয়ে যায়। দ্বারকা নদী দিয়ে গড়িয়ে যায় কত জল। কত সাধক এখানে আসেন আবার সিদ্ধিলাভ করে চলে যান। একদিন এলেন সাধক কমলাকান্ত। এসে দেখেন জীর্ণ তারামায়ের মন্দির। সেই ভাঙা মন্দিরের সামনে বসে তিনি মাকে শোনালেন একের পর এক গান। আর তাঁর দু’চোখ বেয়ে নেমে এল জলের ধারা।

মন্দিরের সেই ভগ্নদশা দেখে কেঁদে ফেলেছিলেন জগন্নাথ রায়ও। তিনি ছিলেন মল্লারপুরের জমিদার। মায়ের মন্দিরের সামনে দাঁড়িয়ে মানত করেছিলেন, ‘মাগো আমার মনোবাঞ্ছা পূর্ণ হলে তোমার নতুন মন্দির গড়ে দেব মা।’ তারামা তাঁর মনোবাঞ্ছা পূর্ণ করেছিলেন। তারপরই জগন্নাথ রায় তারামায়ের মন্দির সংস্কার করে দেন। সেটা ১৮১৮ খ্রীষ্টাব্দের ১৫ই এপ্রিল। মন্দির নির্মাণের পাশাপাশি নতুন করে তৈরি করলেন চন্দ্রচূড় শিবের মন্দির, মায়ের বিরামখানা, ভোগঘর, ভাণ্ডারঘর প্রভৃতি।

তারাপীঠের সর্বাধিক প্রসিদ্ধ সাধক হলেন বামাক্ষ‍্যাপা ( ১৮৪৩ - ১৯১১ ) মন্দিরের নিকটেই তাঁর আশ্রম ছিল। বামাক্ষ‍্যাপা ছিলেন তারাদেবীর একনিষ্ঠ ভক্ত। তিনি মন্দিরে পূজা করতেন এবং শ্মশানে সাধনা করতেন।

লোকবিশ্বাস অনুযায়ী তারা দেবীকে শ্মশানের অন্ধকারে দেখা যায়। তন্ত্রসাধকরা বিশ্বাস করেন নরকঙ্কাল ও শ্মশানক্ষেত্র তারা দেবীর বিশেষ প্রিয়। দেবীর যে সকল চিত্র আঁকা হয়ে থাকে, তাতে তাঁকে শ্মশানক্ষেত্রনিবাসিনী রূপেই দেখানো হয়। এই কারণে তন্ত্রসাধকেরা শ্মশানক্ষেত্রকেই তাঁদের সাধনস্থল হিসেবে বেছে নেন।

এখানকার দেবী নাম তারা কেন হল, তাই নিয়েও আছে পুরাণের এক কাহিনী। সমুদ্রমন্থনে ওঠা বিষ পান করে শিব হয়ে উঠলেন নীলকণ্ঠ। বিষে জর্জরিত তিনি। সেই যন্ত্রণা থেকে কীভাবে শিব মুক্তি পাবেন। সব দেবতা ‘দেবী তারার’ কাছে গিয়ে বললেন, শিবকে গরলমুক্ত করতে। ‘দেবী তারা’ তখন শিবকে আপন সন্তানের মতো কোলে নিয়ে আপন স্তন্য থেকে অমৃত পান করাতে লাগলেন। সেই অমৃত পান করে শিবের বিষজ্বালা দূর হল। সেই থেকে দেবীর নাম হল তারিণী। তিনি শিবকে তারণ করেছেন। এই বিশ্বকেও তিনি তারণ করেন। সেই তারিণী থেকেই তারা নামের সৃষ্টি।

.

জয় মা তারা

.

(সংগৃহীত)