কন্যাকুমারী ভ্রমণ Kanyakumari Tour
কন্যাকুমারী দেবীর নামেই তীর্থের নাম । সব প্রাচীন তীর্থ ক্ষেত্রের সঙ্গে পুরাণ কাহিনী জড়িত আছে এখানেও তার ব্যতিক্রম নয়, পুরান মতে কশ্যপ ঋষির পুত্র বানাসুর অমরত্ব লাভের আশায় দীর্ঘ কঠিন তপস্যায় সিদ্ধিলাভ করলে দৈববাণী হয় যে অমরত্ব ছাড়া দীর্ঘায়ু হওয়ার জন্য অন্য বর প্রার্থনা করলে তা পূরণ হবে। কৌশলী বানাসুর বিবাহিতা নারী বা পুরুষ দেব দৈত্য-দানব মানব এদের কারুর হাতে না নিহত হবার পর প্রার্থনা করলে তা মঞ্জুর হয়। স্বভাবতই আসুরিক অত্যাচারে ত্রিলোক বাসি অতিষ্ঠ হয়ে ব্রহ্মা বিষ্ণুর শরণাপন্ন হলে তারা দেবতা ও ঋষিদের সমুদ্রতীরে একটি যজ্ঞ করতে বললেন এবং ওই যজ্ঞ থেকে উত্থিতা পরমা সুন্দরী কন্যার হাতে বানাসুর বিনষ্ট হবার কথা জানালেন। সমস্ত ঋষি ও দেবতাদের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় ভারতের দক্ষিণতম প্রান্তে ভারত মহাসাগর, আরব সাগর ও বঙ্গোপসাগরের মিলন স্থলের কাছে অনুষ্ঠিত যজ্ঞাগ্নী থেকে আবির্ভূত হলেন এক পরমাসুন্দরী কুমারী কন্যা। সেই কন্যা দেবাদিদেব মহাদেব কে পতি রূপে পাবার জন্য ভারত মহাসাগরের বুকে ভাসমান শিলা খণ্ডে এক পদে দণ্ডায়মান থেকে কঠোর তপস্যা শুরু করলে মহাদেব বিবাহে সম্মতি দিলেন। দেবতারা প্রমাদ গুনে সুচতুর নারদের শরণাপন্ন হলে তিনি দেবীকে স্তুতি বাক্যে ভুলিয়ে মহাদেবের শক্তি পরীক্ষার জন্য তিনটি অসম্ভব বস্তু কে(১, চক্ষুহীন নারিকেল, ২, গ্রন্থিহীন ইক্ষু, ৩, শিরাহীন পান পত্র) বিয়ের রাতে হাজির করার জন্য দেবীকে পরামর্শ দিলেন। শিবশক্তি বলে কথা, তিনি যথারীতি এই সমস্ত দ্রব্য সংগ্রহ করে বরের সাজে সদলবলে কন্যাকুমারীর উদ্দেশ্যে রওনা হলেন।দেবতারা আবার নারদের শরণাপন্ন হলে তিনি কন্যাকুমারী থেকে 13 কিলোমিটার দূরে মহাদেবের যাত্রাপথে অবস্থান করে মাঝ রাত্রিতে মোরগের ডাক ডেকে উঠলেন, মহাদেব রাত্রি শেষ হয়েছে ভেবে সেইখানে স্থানুবৎ দাঁড়িয়ে রইলেন, নাম হল স্থাণুপুরম আবার এই জায়গায় দেবরাজ ইন্দ্রের অহল্যা গঠিত পাপ থেকে শিবের পূজা করে মুক্তি পেয়ে শুচি হয়েছিলেন বলে আরেক নাম শুচিন্দ্রম। সুচিন্দ্রম এর আরেকটি কাহিনী হল, এখানেই অত্রী ঋষি পত্নী অনসূয়ার সতীত্ব পরীক্ষার জন্যে ব্রহ্মা বিষ্ণু ও মহেশ্বর উপস্থিত হলে, স্বামীর পাদোদক ছিটিয়ে অনুসূয়া তাদের দুগ্ধপোষ্য শিশুতে পরিণত করে স্তন্যপান করান। পরে সাবিত্রী লক্ষ্মী ও পার্বতীর ক্ষমা চাওয়ায় ও অনুরোধে অনুসূয়া তাদের স্বামীদের পূর্বরূপ ফিরিয়ে দেন। এই অপকর্মের চিহ্নস্বরূপ ওই তিন দেবতার অংশ থেকে নেওয়া তিনটি শিবলিঙ্গ এখানে রাখা আছে।এদিকে অভিমানী কন্যা শিবের অনুপস্থিতির জন্য সমস্ত বিবাহের সাজসজ্জা ছিড়ে ফেলে আবার তপস্যারতা হলেন। কন্যাকুমারী সাগর জলের রং ও বালির রং মাঝে মাঝে হালকা গোলাপি, হালকা নীল, পান্নাসবুজ, আবার কালো রূপে দেখা দিতে থাকে। দেবীর পায়ের চাপে ও তাপে পাথরের বূকে খোদিত চরণ চিহ্ন আজও পুজিত হচ্ছে সেই ত্রেতা যুগ থেকে। দশ অবতারের অন্যতম পরশুরাম প্রথম মন্দির নির্মাণ করে কুমারী দেবীর পূজা শুরু করেন। আদি মন্দির কালের গর্ভে বিলীন হলে প্রায় কাছাকাছি সেই স্থানেই বর্তমান মন্দির নির্মিত হয়। এবার বানাসুর বধের কাহিনী, বানাসুরের দুই সেনাপতি মুখ আর দুর্মুখের মুখে কুমারী দেবীর রূপের কথা শুনে তাকে পাবার জন্য এলে দেবী তাকে যুদ্ধে পরাস্ত করতে পারলে সম্মত হবেন কথা দিলেন। দীর্ঘ 18 দিন ঘোরতর যুদ্ধ হলো, কিন্তু দৈবের বিধান ও অহংকারী বাণাসুরের পাপে পরিপূর্ণ কালের শেষ হল,বাণাসুরের প্রার্থনা মত সে স্হান বাণতীর্থ নামে খ্যাত হলো। আষাঢ়ী অমাবস্যায় অনেকেই এখানে পিতৃতর্পণ করেন। দেবী আবার তপস্যায় ব্রতী হলেন। মন্দিরের গোপুরমের গাত্রে দেবদেবীর মূর্তি খোদাইয়ের অপূর্ব কারুকাজ দেখে মুগ্ধ হতে হয়, বিশাল মন্দির চত্বর পাথরে বাঁধানো, পরে নাট মণ্ডপ, পেতলের ধ্বজা, দীপ স্তম্ভ, বেদীতে দেবীর বাহন সিংহ, প্রায়ান্ধকার প্রদীপের আলোয় (পুরুষদের উর্ধাংশ অনাবৃত করে )গর্ভ মন্দিরের ঘোরপ্যাঁচ ঘুরে প্রায় ঘন্টা খানেক লাইনে দাঁড়াবার পরে আমরা চারজন কাল কষ্টি পাথরের প্রায় তিন ফুট কুমারী মায়ের বিগ্রহ দর্শন করলাম যেন এক হাস্যময়ী দণ্ডায়মানা দ্বিভূজা কিশোরী তপস্যারতা। প্রণাম জানিয়ে ধন্য হলাম। উত্তর ও পূর্ব দিকে দুটি প্রবেশপথ থাকলেও পূর্বদ্বারটি বছরে তিনবার খোলা হয় (১ বিজয়া দশমীতে দেবীর বানাসুর বধ উৎসব সমারোহের দিন,২ বৈশাখ মাসে ধ্বজারোহন উৎসবের দশম দিন,৩ আর কার্তিক মাসে দীপাবলীর দিন)! শোনা যায় ওই পূর্ব দ্বার দিয়ে সমুদ্রের প্রতিফলিত রশ্মি মায়ের মুকুটের একটি বড় হীরকখণ্ডের উপর পতিত হওয়ার ফলে তার দ্যুতিতে জলদস্যু বা অন্যান্য সমুদ্রচারী জলযান বাতিস্তম্ভের আলোভেবে এগিয়ে এসে শিলাখণ্ডে, ধাক্কা খেয়ে ভেঙে যেত, তারপর থেকেই পূর্ব দ্বার বন্ধ রাখা হয়। এবার স্বামীজির কথা না বললে কন্যাকুমারী দর্শন অসম্পূর্ণ থেকে যাবে।সারা ভারত পরিক্রমা শেষে স্বামী বিবেকানন্দ 1892 সালের 24 ডিসেম্বর কন্যাকুমারী মন্দির দর্শনের পরে কুমারী মায়ের চরণ চিহ্ণিত শীলায় নির্জনে ধ্যানে বসার মনস্থ করলেন । কিন্তু কপর্দকশূন্য পরিব্রাজক সন্ন্যাসী পারাপারের চার পয়সা ( বর্তমানে যা 50 টাকা+২০টাকা) দিতে না পারায় নৌকার মাঝিরা তাকে নিতে অসম্মত হয়, তখন স্বামীজী ঠাকুর কে স্মরণ করে সেই ভয়ঙ্কর সামুদ্রিক জীবে পরিপূর্ণ উত্তাল তরঙ্গ সাঁতরে পার হয়ে ঐ শীলায় উঠে কুমারী মাকে প্রণাম জানিয়ে তিনি দিন একাসনে ধ্যানস্হ থাকার পর জন্ম ভূমি ভারত মাতাকেই দেবী রূপে উপলব্ধি করলেন। এর পরেই তার বিশ্বধর্ম মহাসভায় যোগদান। 1893 সালেরশতবর্ষ পূর্তি কে স্মরণীয় করে রাখতে রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনের সভাপতি শ্রদ্ধেয় স্বামী বীরেশ্বরানন্দ জি মহারাজ ১৯৯৩ সালে ঐ শীলায় স্বামী বিবেকানন্দের দন্ডায়মান ব্রোঞ্জ মূর্তি নির্মাণ করান। যা আজ বিবেকানন্দ শিলা হিসাবে বাঙালি পর্যটকদের কাছে অত্যন্ত আকর্ষণীয়। বিবেকানন্দ শীলার অনতিদূরে আরেকটি টিলায় তামিল কবি থিরুভাল্লুভার এর মূর্তি ও একটি দর্শনীয়। কাছাকাছি অন্যান্য দ্রষ্টব্য। রানসম চার্চ, গান্ধী মন্ডপ, ভদ্রকালী মন্দির, পাপবিনাশনম কুণ্ড, ত্রিবেণী সঙ্গম ঘাট, বিবেকানন্দ মিউজিয়াম, ভাট্টাকোট্টাই দুর্গ (৬কিমি), ইন্দ্র কান্ত বিধায়ক মন্দির, নাগেরকোয়েল এ নাগ রাজার মন্দির (১৯কিমি), সুচিন্দ্রম মন্দির (১৯কিমি) ইত্যাদি। আর অবশ্যই ওয়াচ টাওয়ার থেকে সূর্যোদয় ও সূর্যাস্ত দেখা এক অসাধারণ অভিজ্ঞতা, যদিও সব সময় দেখা যায় না। যাওয়ার ভালো সময় সেপ্টেম্বর থেকে নভেম্বর। সরাসরি যাওয়ার ভালো ট্রেন হাওড়া কন্যাকুমারী এক্সপ্রেস12655up(mon) ছাড়ে1610, কন্যাকুমারী এসটিডি04652, থাকার ভালো জায়গা তামিলনাড়ুর সরকারের অতিথি নিবাস(246257,nacdab800 _1200,acdab1200_3500). এখানকার প্রাতরাশ(দই বড়া, ইডলি, মশালা দোসা,উত্তাপাম ইত্যাদি দক্ষিণ ভারতের অন্যান্য জায়গার তুলনায় স্বাদে-গন্ধে অপূর্ব), বিচ রোড ধরে পূর্ব দিকে মন্দির ছাড়িয়ে এগিয়ে গেলে একটি বাঙালি হোটেলে ভালো মানের আমিষ ও নিরামিষ খাবার পাওয়া যায়। প্রসঙ্গত এই বীচ রোডে ভালো মানের এলাচ লবঙ্গ দারুচিনি ও গোলমরীচ এবং দুষ্প্রাপ্য দক্ষিণাবর্ত শঙ্খ সংগ্রহ করা যেতে পারে।